FUNবিজ্ঞান-ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক -উপেক্ষিত বিজ্ঞানী রবার্ট মেয়ার -অরূপ ব্যানার্জি-বর্ষা ২০২২

ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে 

bigganrobertmayer

বিজ্ঞানের দুনিয়ায় হঠাৎ কোনও আবিষ্কার আচমকা হয় না। মানুষের গভীর চিন্তার ফসল হল যে-কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। আবার দেখা গেছে, সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গায় সঙ্গোপনে বিজ্ঞান সাধনায় রত এক বা একাধিক বিজ্ঞানী একই আবিষ্কার করেছেন। কেউ সেই আবিষ্কারের স্বীকৃতি পেয়েছেন, কেউ-বা পাননি। আর যিনি সেই স্বীকৃতির হক পাননি, তাঁকে গ্রাস করেছে অবসাদ। আবার হয়তো কেউ মনোবল জুটিয়ে লেগে গেছেন বিজ্ঞানচর্চায়। রেখে গিয়েছেন অনবদ্য অবদান।

এমনই এক মানুষ ছিলেন রাশিয়ান পদার্থ বিজ্ঞানী রবার্ট মেয়ার, যিনি সারাজীবন ধরেই বিজ্ঞান সাধক হয়েও প্রায় উপেক্ষিত থেকে গিয়েছেন। পদার্থবিদ্যার জগতে স্মরণীয় হয়ে থাকলেও তাঁর পেশাটা কিন্তু ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, এমনকি প্রথাগত পদার্থবিদ্যার তালিমও তিনি নেননি। তাঁর অবিস্মরণীয় আবিষ্কারের স্বীকৃতি পাননি সময়মত। জড়িয়ে পড়েছেন নানা বিবাদে, আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের বৈজ্ঞানিক ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে গেছেন।

জার্মানির হেইলব্রন শহরে ১৮১৪ সালে জন্ম হয় রবার্ট মেয়ারের। বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ থাকায় ছোটবেলাতেই রবার্ট ঠিক করেন যে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনো করবেন। তুবিঞ্জেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়তে যান মেয়ার। কিন্তু ডাক্তারি পড়ার চাইতে বিলিয়ার্ড আর তাস খেলতেই তাঁর বেশি মন লাগত। অনেকটা খামখেয়ালি ছিলেন রবার্ট। পড়াশুনোয় ফাঁকি দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে সাবধান করে দেয়। কিন্তু রবার্টের শরীরে তরুণ রক্ত একটু বেশিই গরম ছিল। তিনি কর্তৃপক্ষকে জানান, এমন কিছু অন্যায় তিনি করেননি যে তাঁকে দায়ী করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ছিল বেশ কড়া ধরনের। তারা রবার্টকে এক বছরের জন্য সাসপেন্ড করে। রবার্ট দমবার পাত্র নন। তিনি শুরু করলেন অনশন। সেই অনশন চলল ছয়দিন ধরে। তারপর কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই সাসপেনশন তুলে নেয়। পড়াশুনোয় খুব ভালো ফল না হলেও ডাক্তারি পড়া ছাড়েননি রবার্ট। এরপর তিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান চিকিৎসাশাস্ত্রের উচ্চতম ডিগ্রি নেবার জন্য।

ডাক্তারি পাশ করে রবার্ট হাসপাতালে না গিয়ে কাজ নিলেন এক জাহাজ কোম্পানিতে। সেই সময় পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ইউরোপিয়ানরা ব্যাবসা-বাণিজ্যের জন্য পাড়ি জমাত। রবার্টের জাহাজ চলল জাভা দ্বীপ। জাহাজিদের চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলেন। তাদের শিরার রক্ত অনেক বেশি লাল। প্রথমে তিনি মনে করেছিলেন অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে ভুলবশত বুঝি-বা কোনও ধমনী কেটে ফেলেছেন। কিন্তু বেশ কয়েকবার একই ঘটনা ঘটতে দেখে তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। শিরায় যে রক্ত বাহিত হয়, তাতে শরীরের বিপাক হওয়ার পর কোষে কোষে অক্সিজেনের সাহায্যে খাদ্য পুড়িয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বাহিত হয়। অতিরিক্ত অক্সিজেনও সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে ফিরে আসে। অক্সিজেন কম থাকায় শিরার রক্ত ধমনীর রক্তের চাইতে কম লাল হয়। কিন্তু ইউরোপে রোগীদের শরীরে শিরায় বাহিত রক্ত এতটা লাল হয় না, যতটা এশিয়াতে মানুষের শরীরে দেখা গেল।

প্রখ্যাত পদার্থবিদ অ্যান্টনি ল্যাভসিয়ারের লেখা একটি প্রবন্ধে রবার্ট পড়েছিলেন যে জীবের শরীরে উত্তাপের উৎস হল অত্যন্ত ধীর গতিতে অক্সিজেনের সাহায্যে খাবার পোড়া। নাবিকদের অস্বাভিবিক লাল রক্ত দেখে তাঁর মাথায় এল, এর পিছনে নিশ্চয়ই আসল রহস্য হল শরীরে খাদ্য পুড়ে যাবার হারের তারতম্য। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে পূর্ব এশিয়ার উষ্ণ আবহাওয়ায় মানুষের শরীরে উত্তাপের জোগান কম প্রয়োজন হয়, তাই অক্সিজেন পোড়ার হার কম এবং শিরায় ফিরে আসা রক্তে অক্সিজেন বেশি থাকায় তার রঙ লাল।

রবার্টের মাথায় যে ধারণাটা জন্ম নিল তা তাপগতিবিদ্যার একেবারে গোড়ার কথা, যা তখনও কারও জানা ছিল না। তার মনে হল, তাপ ও কাজ পরস্পর বিনিময়যোগ্য। অর্থাৎ তাপ থেকে কাজ পাওয়া যায়, আবার কাজ করলে তাপ সৃষ্টি হয়। তবে তাপ ও কাজের মোট যোগফল অপরিবর্তিত থাকে।

নিজের ধারণা জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য রবার্ট একটা গবেষণাপত্র লিখে ফেলে জমা দিলে Annalen der Physic পত্রিকায়। কিন্তু পদার্থবিদ্যায় প্রথাগত শিক্ষা না থাকায় রবার্টের লেখা প্রবন্ধটি খাপছাড়াভাবে লেখা হয় এবং তাতে পদার্থবিদ্যার প্রচুর অসঙ্গতি থেকে যায়। কাজেই সেই প্রবন্ধ ছাপা হওয়া তো দূরের কথা, সম্পাদকমশাই প্রবন্ধ প্রাপ্তির সংবাদ পর্যন্ত দিলেন না।

আসলে রবার্ট মেয়ার বলতে চেয়েছিলেন, শরীরে বিপাকীয় জারণ একটি রাসায়নিক পরিবর্তন, যে পরিবর্তনের ফলে তাপের উদ্ভব হয়। সেই তাপের ফলেই জীবদেহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজ করতে পারে। রবার্ট মেয়ার শক্তি বা এনার্জির নাম দিলেন ‘ফোর্স’। তাঁর ব্যবহৃত শব্দ আরও জটিলতার সৃষ্টি করল। তিনি লিখলেন, সব পদার্থই এই জগতে পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তন কোনও কারণ ছাড়া হতে পারে না। এর মূলে আছে বল (force), যার প্রভাবে সব প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে। এই বল, জড় বস্তুর মোট পরিমাণের মতোই অপরিবর্তনশীল।

মেয়ারের ব্যবহৃত ‘বল’ শব্দটির বদলে যদি আমরা ‘শক্তি’ শব্দটি বসিয়ে দিই, তবে সব প্রাঞ্জল হয়ে যায়। কিন্তু সেই সময়ে জটিলতার কারণে এবং অন্যান্য পরীক্ষিত ও গাণিতিক প্রমাণ না থাকায় তাঁর গবেষণাপত্র ধোপে টিকল না। শক্তি থেকে যে কাজের উৎপত্তি, সেই ধারণা হয়তো প্রথম তাঁর মাথাতেই এসেছিল, অন্তত বিজ্ঞানের তথ্যভাণ্ডার তাই বলে। মেয়ারের কাজ একেবারে অবহেলিত হয়ে গেল।

পরের বছর ১৮৪২ সালে রবার্ট মেয়ার তাঁর এক গণিত অধ্যাপক বন্ধুর সাহায্যে শক্তি ও কাজের মধ্যে সম্বন্ধ নিয়ে সেই একই গবেষণাপত্র ঘষামাজা করে লিখে জমা দিলেন আরেকটি পত্রিকায়। সেখানে সেই প্রবন্ধ ছাপা হল। তবে সেই গবেষণাপত্র খুব বেশি মানুষের গোচরে এল না। কিন্তু মেয়ার যা আবিষ্কার করলেন, তা আজকের বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ‘তাপ যান্ত্রিক সমতা’ (Mechanical Equivalence of Heat) সূত্র হিসাবে অতি পরিচিত এবং স্কুলের পাঠ্যবইতে শেখানো হয়ে থাকে।

সেই একই বছর ইংল্যান্ডে পদার্থবিদ জেমস জুলের গবেষণাপত্র প্রকাশ পেল, যাতে শক্তির কাজে পরিবর্তনের কথা উঠে এল। যে-কোনো কাজের পরিমাণ শক্তির সঙ্গে সমানুপাতিক। জুলের প্রস্তাবিত সমীকরণ হল W=JH, যেখানে J ধ্রুবকটি ‘জুল ধ্রুবক’ নামে খ্যাত হল। জেমস জুলও কিন্তু রবার্ট মেয়ারের মতো প্রশিক্ষিত পদার্থবিদ ছিলেন না। কিন্তু তাঁর প্রস্তাবিত সমীকরণ বিজ্ঞানের দুনিয়ায় গৃহীত হল।

[জেমস জুল ছিলেন ইংল্যান্ডের এক ধনী মদের কারখানার মালিকের ছেলে তিনি পদার্থবিদ্যার নানা বিষয়ে ছেলেবেলা থেকে উৎসাহী হলেও সেই বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নেননি। কিন্তু বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মেলামেশার ফলে ও তাঁর নিজের আন্তরিক উৎসাহে তিনি বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেন। তবে তাঁর বিজ্ঞানচর্চা ছিল শখের। তাপগতিবিদ্যার অনেক চমৎকার বিষয় তাঁর মাথায় জন্মায়। পদার্থবিদ উইলিয়াম থমসনের সঙ্গে তিনি কাজ করেছিলেন, যার ফল হয়েছিল চমৎকার সব আবিষ্কার।]

রবার্ট মেয়ার বললেন, ওই একই কথা তো আমিও বলেছি। কিন্তু কে তাঁর কথা শোনে! জুল তাঁর ধ্রুবকের মান বার করেছিলেন ৪২৬ কিলোগ্রাম-মিটার বা কিলো-ক্যালরি। অর্থাৎ এক কিলোগ্রাম ওজনের কোনও বস্তুর ওপর এক কিলো-ক্যালরি শক্তি খরচ করলে সেই বস্তুকে ৪২৬ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত তোলা যাবে। ওই একই ধ্রুবক রবার্ট মেয়ার জানিয়েছিলেন ৩৬৬ কিলোগ্রাম-মিটার বা কিলো-ক্যালরি। মেয়ারের হিসাবে যেমন ভুল ছিল, জুলের হিসাবও ঠিক ছিল না। বর্তমানে স্কুলপড়ুয়া মাত্রই জানে এই ধ্রুবকের মান ৪১৮ কিলোগ্রাম-মিটার বা কিলো-ক্যালরি।

হিসেব যাই হোক না কেন, শক্তির কাজে বদলানোর প্রাকৃতিক নিয়মের আবিষ্কর্তা প্রায় একই সঙ্গে করেন জুল ও মেয়ার। স্বীকৃতি পেলেন জুল। তাই বিবাদ বাড়তে লাগল।

ডাক্তারি করা ছেড়ে রবার্ট মেয়ার এবার পরীক্ষাগারে তাপ যান্ত্রিক সমতার পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে লাগলেন। তিনি দেখেন একটি গ্যাসকে নির্দিষ্ট চাপে একটি বিশেষ তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করতে যত তাপ লাগে, তা নির্দিষ্ট আয়তনে ওই একই তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করার চাইতে বেশি। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাটি স্বীকার করে নেন, কিন্তু মেয়ার তাঁর সমস্ত কাজ নিয়ে যখন গবেষণাপত্র জমা করেন আরেকটি জার্নালে, তখন সেই প্রবন্ধ নাকচ করে দেওয়া হয়। যুক্তির ত্রুটিবিচ্যুতির কারণেই মেয়ারের লেখা গৃহীত হয় না, যদিও তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তই ছিল সঠিক।

গবেষণাপত্র নাকচ হয়ে গেলে রবার্ট মেয়ার নিজের খরচে সব ছাপতে থাকেন। যদি তিনি তা না করতেন, তবে তাঁর কাজ চিরকালই থেকে যেত অন্ধকারে। এরপর মেয়ারের লেখা আরও গবেষণাপত্র ছাপা হয়, কিন্তু সবই তাঁর নিজস্ব খরচে।

যখন নিজের কাজের স্বীকৃতি বিজ্ঞানবোদ্ধাদের কাছে পাচ্ছেন না মেয়ার, তখন তাঁর নিজের পারিবারিক জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। তাঁর তিনটি পুত্রই একে একে নানা অসুখে ভুগে মারা যায়। মেয়ার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং একদিন তিনতলার ছাদ থেকে নীচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে যান। তাঁর আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না। বেঁচে গিয়েও মানসিক রোগের কারণে নিজেই গিয়ে এক মানসিক রোগের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান।

চিকিৎসা তাঁর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার সামান্য উন্নতিও করতে পারেনি। মানসিক হাসপাতাল থেকে মেয়ারকে ছেড়ে দেওয়া হয় তিন বছর পর। হেলব্রন শহরে ফিরে এসে নিজের ডাক্তারি পেশা আবার শুরু করেন মেয়ার, কিন্তু বিজ্ঞানের চর্চা থেকে নিজেকে একেবারে দূরে সরিয়ে রাখেন।

ইতিমধ্যে যে বছর দশেক সময় অতিবাহিত হয়, তার মধ্যে তাপগতি বিজ্ঞানের জগতে অনেক কাজ এগিয়ে গেছে। শক্তির নিত্যতা সূত্র তখন সত্য বলে সবাই মেনে নিয়েছে; ক্লসিয়াস, জেমস জুল এবং উইলিয়াম থমসনের মতো বিজ্ঞানীরা অনেক পরীক্ষা করে ফেলেছেন, অনেক সূত্র জানিয়েছেন। মেয়ারের কথা প্রায় সবাই ভুলেই গিয়েছিল, কিন্তু শেষ যে জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র নাকচ হয়ে যায়, সেই জার্নালের সম্পাদক হঠাৎ রটিয়ে দেন যে, মানসিক হাসপাতালে অসুখে ভুগে রবার্ট মেয়ারের মৃত্যু হয়েছে।

এবার মানসিকভাবে আহত রবার্ট মেয়ারকে তাঁর বেঁচে থাকার প্রমাণ দিতে হল। তিনি প্রতিবাদ করলেন। তা সত্ত্বেও মেয়ারের মৃত্যুর শোকসংবাদ ছাপা হল আরেকটি পত্রিকায়। মেয়ার বিজ্ঞান মহলে মৃতই থেকে গেলেন।

অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটল এরপর, যা রবার্ট মেয়ারকে সবার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। পদার্থবিদ জন টিন্ডালকে ১৮৬০ সালে লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউশন আমন্ত্রণ জানায় কতগুলি বক্তৃতা দেবার জন্য, যার বিষয় ছিল তাপ। তিনি এই বিষয়ে আগে ছাপা হওয়া কিছু গবেষণাপত্র পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন হেলমোলাজ ও ক্লসিয়াসের কাছে। ক্লসিয়াস তাঁকে যে গবেষণাপত্রগুলো পাঠান, তার সঙ্গে একটা চিঠিতে উল্লেখ ছিল রবার্ট মেয়ারের কাজের কথা। কিন্তু তিনি মন্তব্য করেন যে, এই কাজ এমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয়, তাই সেই গবেষণাপত্র না পাঠালেও চলবে। টিন্ডালের মনে সন্দেহ দেখা দিলে তিনি দাবি করেন মেয়ারের লেখা গবেষণাপত্রগুলো পাঠানোর জন্য। এবার ক্লসিয়াস রবার্ট মেয়ারের নিজের খরচে ছাপানো প্রবন্ধগুলো আবার পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিঠি লিখে নিজের আগের মন্তব্য ফিরিয়ে নিয়ে জানান, ‘গবেষণাপত্রগুলো সম্পর্কে আগে যা বলেছি, সব ভুল। এই মানুষটি সব সঠিক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত অনেক আগেই জানিয়েছে। অসাধারণ তাঁর বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। এক অতি উৎকৃষ্ট মানসিকতা না থাকলে এমন সব সূত্র লেখা যায় না।’

ক্লসিয়াস মেনে নিলেন যে, রবার্ট মেয়ারই সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি শক্তির সঠিক রূপ বুঝতে পেরেছিলেন এবং নিত্যতা সূত্রের প্রথম প্রবক্তাও তিনিই। বিজ্ঞানী হাইন রিখ হেলমোলজও একই মতামত দেন। প্রফেসর টিন্ডাল অবিচারের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই বেশ খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তিনি রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে দেওয়া সব বক্তৃতায় রবার্ট মেয়ারের অবদান উল্লেখ করে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি জানান, রবার্ট মেয়ারকেই তাপগতি বিজ্ঞানের প্রথম পুরুষ হিসাবে মেনে নেওয়া উচিত। এমনকি জুলের কাজের এক বছর আগে যে রবার্ট তাঁর মতামত ছাপাতে চেয়েছিলেন এবং তা ছাপতে দেওয়া হয়নি, সে-কথাও জোরের সঙ্গে প্রচার করতে থাকেন।

টিন্ডালের বক্তৃতার পর রবার্ট মেয়ারের খোঁজখবর শুরু হল। দেখা গেল তিনি সুস্থ শরীরে দিব্যি জীবিত আছেন। কিন্তু মেয়ার-জুল নিয়ে তর্কবিতর্কের ঝড় উঠল। জেমস জুল আর উইলিয়াম থমসনও ছেড়ে দেবার পাত্র নন। কে এই মেয়ার? যেন তাঁকে কেউ চেনেই না। এডিনবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক জুলের সমর্থনে সোচ্চার হলেন। জুল এবার ফিলসফিকাল ম্যাগাজিনে এক খোলা চিঠি জমা করে মেয়ারের কাজকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আরে এ তো কোনও পরীক্ষা-টরীক্ষা না করেই ঝটপট সব সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে। আর আমার কাজটার ভিত্তিতে আছে পরীক্ষাগারে নিরলস পরিশ্রম।’

সেই একই ম্যাগাজিনে এবার প্রফেসর টিন্ডাল লিখলেন এক চিঠি, ‘আপনার অবদানের কথা অস্বীকার করেছে কে? আমি তো শুধু ডক্টর মেয়ার যে শক্তির আসল রূপটা ধরতে পেরেছিলেন, সে-কথাটা স্বীকার করে নিতে বলেছি। এতে অসুবিধার কী আছে?’

টিন্ডালের চেষ্টায় ফিলসফিকাল ম্যাগাজিনে ইংরেজিতে তর্জমা হল তাঁর ১৮৪৫ সালে লেখা প্রবন্ধ। জুল তাঁর বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মেয়ারের কাজকে নগণ্য প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা চালাতে লাগলেন, আর টিন্ডাল মেয়ারকে সমর্থন করতে গিয়ে ব্যাপারটা দাঁড়াল ব্রিটিশ আর নন-ব্রিটিশ আবিষ্কার নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া, যার মীমাংসা কোনোদিন হয়নি।

বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিক তর্কের মীমাংসা হয় না। মেয়ার-জুল বিতর্কও থেকে গেল অমীমাংসিত। হয়তো তাই বাঞ্ছনীয়, কারণ কোনও এক আবিষ্কারের সূত্রপাত কার হাতে হয়েছে, নির্ধারণ করা খুব কষ্টকর। বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার বিবর্তন হয় অনেক মানুষের ধারাবাহিক কাজের মধ্যে দিয়ে।

রয়্যাল সোসাইটি অফ লন্ডন ১৮৭০ সালে প্রথমে জুলের কাজের জন্য তাঁকে সম্মানিত করে এবং তাঁর পরের বছর ওই একই সম্মান পদক দেয় রবার্ট মেয়ারকে। প্যারিস অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স সেই বছরেই রবার্টকে পুরস্কার দেয়।

১৮৭৮ সালে যক্ষ্মা রোগে ভুগে মারা যাবার সময় তাঁর যোগ্যতার সময়োপযোগী সম্মান না পাওয়ার দুঃখ হয়তো এই দুটি পুরস্কার কিছুটা অন্তত প্রশমিত করেছিল। পরবর্তীকালে রবার্ট মেয়ারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে হেলব্রন বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠে তাঁর একটি মূর্তি।

Exif_JPEG_PICTURE
Exif_JPEG_PICTURE

 জয়ঢাকের  বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s