FUNবিজ্ঞান-মহাবিশ্বে মহাকাশে-চাঁদ: পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ-কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়-শীত ২০২২

মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে

bigganmohabiswe01

পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের মহাজাগতিক বস্তু চাঁদ। জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের অপরূপ সৌন্দর্য আমাদের সকলের মন কেড়ে নেয়। চাঁদের এই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কোনও কবি কবিতা লেখেননি এমন কবি পৃথিবীতে আছেন কি না সন্দেহ। তাঁদের কল্পনায় চাঁদের সৌন্দর্য যতই মনোরম হোক না কেন, বিজ্ঞান কিন্তু অন্য কথা বলে—চাঁদ আদৌ সুন্দর নয়, মহাশূন্যে ভেসে বেড়ানো এবড়োখেবড়ো নিষ্প্রভ একটি বস্তুপিণ্ড। পূর্ণিমার রাতে পৃথিবীতে লুটোপুটি খাওয়া জ্যোৎস্না আসলে সূর্যের আলো চাঁদে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে আসে।

প্রাচীনকালে চাঁদকে দেবতা জ্ঞানে বন্দনা:

bigganmohabiswe02

প্রাচীনকাল থেকেই চাঁদ মানুষের কাছে অতি প্রিয়। ফলে চাঁদকে নিয়ে দেশে-বিদেশে সৃষ্টি হয়েছে নানা কাহিনি। এইসব কাহিনিগুলির অধিকাংশেই চাঁদকে দেবতার আসনে বসানো হয়েছে। ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলের সূক্তগুলির অধিকাংশই রচিত হয়েছে সোম অর্থাৎ চাঁদকে দেবতা জ্ঞানে বন্দনা করে। এছাড়াও কৃষিতে উৎপাদন এবং উর্বরতার সঙ্গে চাঁদের সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হত। এর প্রমাণ পাওয়া যায় গ্রিস, রোম, মিশর ইত্যাদি দেশের পুরাণগুলিতে। আমাদের দেশেও এমন ভাবনার নিদর্শন পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে। চিন ও জাপানে চন্দ্র-দেবতার নাম যথাক্রমে ‘সিং-মু’ ও ‘সুসা-না-ও’। চিনদেশের মানুষের কাছে ‘সিং-মু’ হল আকাশের রানি।

চাঁদ দেবতা থেকে কবে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করল তা জানা নেই। তবে পিথাগোরাসের সময়ে চাঁদকে একটি গ্রহ হিসেবে বিবেচনা করা হত। অ্যারিস্টটল মনে করতেন, চাঁদ একটি মসৃণ গোলক। তাঁর এই তত্ত্ব মেনে সে-সময় পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষও সেটাই বিশ্বাস করত। এই বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রথম মত প্রকাশ করেন গ্যালিলিও। ১৬০৯ সালে দূরবীক্ষণের সাহায্যে চাঁদ পর্যবেক্ষণ করে তিনি বললেন, চাঁদ মোটেই মসৃণ গোলক নয়। এর উপরিতল এবড়োখেবড়ো। এখানেও রয়েছে পৃথিবীর মতো পর্বত, উপত্যকা, গভীর খাদ ইত্যাদি।

চাঁদের সৃষ্টিতত্ত্ব:

bigganmohabiswe03

চাঁদ কীভাবে তৈরি হল তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও মতবাদ নেই। বিজ্ঞানী মহলে চাঁদের সৃষ্টি নিয়ে চারটি মতবাদ রয়েছে। মতবাদগুলির সপক্ষে যে যুক্তিগুলি দেখানো হয়েছে সেগুলির কোনোটাই খণ্ডন করা যাচ্ছে না, আবার পুরোপুরি গ্রহণও করা যাচ্ছে না। তবে যে তত্ত্বটি বর্তমানে বহুল সেটি হল ‘বিগ স্প্লাশ থিওরি’ (Big Splash Theory)। এই তত্ত্বটির কথায় পরে আসছি। তার আগে চারটি মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।

প্রথম মতবাদ: এই মতবাদটির প্রবক্তা জর্জ ডারউইন (১৮৪৫-১৯১২)। ইনি বিবর্তনবাদের প্রবক্তা চার্লস ডারউইনের পুত্র। তাঁর মতে চাঁদ পৃথিবীরই অংশ। কঠিন অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ার আগে যে-কোনো কারণেই হোক (সম্ভবত সূর্যের আকর্ষণে) গলিত তরল পৃথিবীর দেহ থেকে একটি অংশ ছিঁড়ে বেরিয়ে যায় এবং পৃথিবীর আকর্ষণে বাঁধা পড়ে তার চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা কমতে থাকে এবং দুটি বস্তুপিণ্ডই কঠিন অবস্থায় আসে।

দ্বিতীয় মতবাদ: এই মতবাদে প্রথম মতবাদকে পুরোপুরি সমর্থন না করলেও একেবারে অস্বীকার করা হয়নি। বরং বলা যায় একটু অন্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সৃষ্টির প্রাক্কালে পৃথিবীর আবর্তনকাল ছিল ২.৬ ঘণ্টা। সেই সঙ্গে তার দেহে সঞ্চিত লোহা ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় এলাকায় জড়ো হতে থাকে। এর ফলে পৃথিবীর আবর্তনের বেগ যেমন বেড়ে যায়, তেমন চেহারাও যায় পালটে। দেখতে হয় পেয়ারার মতো। এইভাবে চলতে চলতে একসময় মাথার দিকের অংশটা ছিড়ে বেরিয়ে যায় এবং উপগ্রহ (চাঁদ) হয়ে পৃথিবীকে আবর্তন করতে থাকে। দ্বিতীয় মতবাদের সমর্থনে এই তত্ত্বের প্রবক্তা যে-যুক্তি খাড়া করেছেন সেটা হল, চাঁদের ঘনত্ব আর পৃথিবীর বহিঃস্তরের ঘনত্ব প্রায় সমান। এছাড়াও চাঁদে লোহার পরিমাণ যৎসামান্য এবং কেন্দ্রীয় অঞ্চলে কোনও ধাতুর সন্ধান পাওয়া যায়নি।

তৃতীয় মতবাদ: চাঁদ পৃথিবীর অংশ নয়। এটি স্বতন্ত্রভাবেই তৈরি হয়েছে। অনেকে মনে করেন, পৃথিবীর কক্ষপথে ও তার কাছাকাছি ছড়িয়ে থাকা বস্তুকণা একসঙ্গে জড়ো হয়ে চাঁদের সৃষ্টি। ধীরে ধীরে সেটি ছোটো থেকে বড়ো হতে হতে বর্তমান রূপ পায়। পৃথিবীর মতো চাঁদেরও সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার কথা। কিন্তু কোনও কারণে সেটি পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসে এবং পৃথিবীর অভিকর্ষের আওতায় বাঁধা পড়ে উপগ্রহে পরিণত হয়।

চতুর্থ মতবাদ: এই মতবাদ অনুযায়ী সৌরজগতের উপগ্রহগুলির কোনোটাই কোনও গ্রহের দেহাংশ নয়। জার্মান দার্শনিক ভাইজেকারের মতে, সূর্যের জন্ম যে নীহারিকা থেকে, সেই নীহারিকারই এক প্রকাণ্ড গোলাকার গ্যাসীয় মেঘ সূর্যের আকর্ষণে বাঁধা পড়ে সূর্যের সঙ্গে চলতে শুরু করে যার কেন্দ্রে ছিল সূর্য। সেই সময় সূর্য থেকে বিকিরিত হওয়া সৌরকণিকা স্রোতের ধাক্কায় ওই গ্যাসীয় মেঘ আলোড়িত হতে থাকে এবং বিভিন্ন দূরত্বে বিভিন্ন ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়। এর ফলে বিভিন্ন স্তরের গ্যাসীয় মেঘের বস্তুপুঞ্জগুলি তার কেন্দ্রে জড়ো হয়ে গ্রহ ও উপগ্রহগুলি সৃষ্টি করে। চাঁদেরও সৃষ্টি এইভাবেই।

আধুনিক যুগে অধিকাংশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী উপরের মতবাদগুলি মানতে রাজি নন। তাঁরা মনে করেন, অতীতে মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো মঙ্গলগ্রহের মতো বিশাল আকৃতির একটি বস্তুপিণ্ড পৃথিবীকে ধাক্কা মারে এবং পৃথিবীর সঙ্গে মিশে যায়। সেই ধাক্কায় পৃথিবীর উপরের স্তর থেকে মহাকাশে ছিটকে যাওয়া বিপুল পরিমাণ ধুলো ও পাথরের টুকরো কালক্রমে দানা বেঁধে চাঁদ নামক উপগ্রহটি সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীদের এমন ধারণা হওয়ার কারণ চাঁদ থেকে আনা পাথরের টুকরোগুলি এবং পৃথিবীর পাথরগুলো প্রায় সমবয়সি। এই তত্ত্বটি ‘বিগ স্প্লাশ থিওরি’ (Big Splash Theory) নামে পরিচিত।

চাঁদ কি সত্যিই পৃথিবীর উপগ্রহ?

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকদিন ধরেই একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—চাঁদ পৃথিবীর উপগ্রহ, না চাঁদ ও পৃথিবী দ্বৈত গ্রহ?  বিজ্ঞানীদের মনে এই ধরনের প্রশ্ন হঠাৎ করে আসেনি। সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদের ভর ও দূরত্ব তুলনা করলে বোঝা যায় যে পৃথিবী চাঁদকে যত জোরে আকর্ষণ করে, সূর্য তার দ্বিগুণ জোরে করে। নিউটনের গতিসূত্র অনুযায়ী এতদিনে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চাঁদের সূর্যের দিকে ছুটে যাওয়ার কথা। কিন্তু যাচ্ছে না তো! পৃথিবীকেই প্রদক্ষিণ করে চলেছে। এই ঘটনাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছে।

আসলে পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যে একটা সাধারণ মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র আছে যেটা পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে তার ব্যাসার্ধের  ভাগ দূরে অবস্থিত। এটি বেরিকেন্দ্র নামে পরিচিত। পৃথিবী ও চাঁদ এই সাধারণ মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের চারপাশে ঘোরে। এই আবর্তনের সময় প্রায় এক মাস। সূর্য পৃথিবী ও চাঁদকে পৃথকভাবে আকর্ষণ না করে এই সাধারণ মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। ফলে চাঁদকে যত জোরে আকর্ষণ করার কথা তত জোরে করতে পারে না। এছাড়াও সূর্যের মাধ্যাকর্ষণের বেশিরভাগ কাজে লেগে যায় সাধারণ মাধ্যাকর্ষণ বিন্দুকে উপবৃত্তাকার পথে ঘোরাতে। এই নির্দিষ্ট বিন্দুকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ও চাঁদ এমনভাবে একে অপরকে প্রদক্ষিণ করছে মনে হয় যেন পৃথিবী স্থির, চাঁদ তার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই ধরনের ঘটনা অন্য কোনও গ্রহ-উপগ্রহদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ:

পৃথিবীর একমাত্র স্বাভাবিক উপগ্রহ চাঁদ বা চন্দ্রের অপর নাম সোম। সূর্যের পরে অন্যান্য গ্রহদের তুলনায় চাঁদের প্রভাব পৃথিবীর উপর সবচেয়ে বেশি। তাই সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনটির নাম রাখা হয়েছে চাঁদ অর্থাৎ সোমের নামে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই কাজের দিন শুরু হয় সোমবার থেকে। ইংরেজিতে এই দিনটিকে বলা হয় ‘Monday’। ল্যাটিন শব্দ ‘Lunse Dies’ বা ‘Day of the Moon’ থেকে এই শব্দটির উৎপত্তি। এই দিনটিকে ফরাসিতে ‘Lundi’, ইতালিতে ‘Lunedi’, স্পেনীয় ভাষায় ‘Lunes’ এবং জার্মানিতে ‘Montag’ বলা হয়।

পৃথিবী থেকে চাঁদ কত দূরে আছে:

চাঁদ এক উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। তাই পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কখনও কমে আবার কখনও বাড়ে। চাঁদ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে থাকে তখন তাকে বলে চাঁদের ‘অনুভূ’ (Perigee) অবস্থান। এই সময় পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যে দূরত্ব থাকে ৩ লক্ষ ৬৩ হাজার ২৯৫ কিলোমিটার। আর যখন সবচেয়ে দূরে থাকে, সেই অবস্থানকে বলা হয় চাঁদের ‘অপভূ’ (Apogee) অবস্থান। এই সময় চাঁদ পৃথিবী থেকে ৪ লক্ষ ৫ হাজার ৫০৩ কিলোমিটার দূরে থাকে। তাই বলা যায়, পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার।

পৃথিবীর তুলনায় চাঁদ কত ছোটো:

খুব সহজভাবে যদি বলি তাহলে বলতে হয় ৫০টা চাঁদ গায়ে গায়ে ঠেকিয়ে একটা গোলক তৈরি করলে সেটা পৃথিবীর সমান হবে। অর্থাৎ, চাঁদের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ৫০ ভাগের ১ ভাগ। এবারে একটু গণিতের হিসেবে আসি। পৃথিবীর ব্যাস  ১২,৭৫৬ কিলোমিটার আর চাঁদের ব্যাস ৩৪৭৬ কিলোমিটার। অর্থাৎ, চাঁদের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ৪ ভাগের ১ ভাগ। ভরের ক্ষেত্রেও চাঁদের ভর পৃথিবীর ভরের ৮ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। আর চাঁদের অভিকর্ষজ বল পৃথিবীর ৬ ভাগের ১ ভাগ। এই হিসেবে পৃথিবীতে কোনও বস্তুর ওজন ৬ কেজি হলে বস্তুটিকে চাঁদে নিয়ে গেলে সেটার ওজন দাঁড়াবে ১ কেজি। চাঁদ সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য নীচে দেওয়া হল:

  • ভর ৭৩.৪৯ × ১০২১ কিলোগ্রাম
  • আয়তন ২১.৯৯ × ১০১৮ ঘনমিটার
  • ঘনত্ব ৩.৩৪ গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার
  • গতিবেগ ২.৩৮ কিমি/সেকেন্ড
  • অক্ষবেগ ৩,৮৬০ কিমি/ঘণ্টা
  • সাইনোডিক আবর্তন সময় (Synodic Revolution Period): ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট
  • নাক্ষত্র-আবর্তন সময় (Sidereal Revolution Period): ২৭ দিন ৭ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট
  • চান্দ্র-বিষুবে দিনের তাপমাত্রা ১২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস
  • চান্দ্র-বিষুবে রাতের তাপমাত্রা (-)১৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস
  • মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা (-)১৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস

চাঁদ পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করতে যে সময় নেয়, সেই একই সময়ের মধ্যে নিজের অক্ষের চারদিকে একবার ঘুরে আসে, যার ফলে পৃথিবী থেকে চাঁদের একটা দিকই আমরা সবসময় দেখতে পাই। যেহেতু চাঁদের অভিকর্ষজ বল অত্যন্ত কম, তাই সাধারণ গ্যাসের অণুগুলিকে উপগ্রহটি ধরে রাখতে পারেনি। এই কারণে চাঁদে কোনও বায়ুমণ্ডল নেই।

চাঁদের কলা:

bigganmohabiswe04

চাঁদের নিজস্ব কোনও আলো নেই। সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়। সেই আলো চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে যখন প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে এসে পড়ে তখন আমরা চাঁদকে দেখতে পাই। চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার সময় যখন পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে চলে আসে তখন চাঁদের যে-দিকটা পৃথিবীর দিকে থাকে সেই দিকে সূর্যের আলো পড়ে না, ফলে সে-দিকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। আমরা তখন চাঁদকে দেখতে পাই না। এই দিনটাকে বলা হয় অমাবস্যা। ঠিক উলটোটা যখন ঘটে অর্থাৎ, পৃথিবী যখন চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে অবস্থান করে তখন চাঁদের যে-দিকটা পৃথিবীর দিকে থাকে সে-দিকটায় সূর্যের আলো পড়ে আলোকিত হয়ে ওঠে, এই দিনটা হল পূর্ণিমা। পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা বা উলটোটা হতে চাঁদের সময় লাগে ১৫ দিন। পূর্ণিমার পর ১৫ দিন ধরে একটু একটু করে চাঁদের ঔজ্জ্বল্য একটু একটু করে কমতে থাকে। এই সময়টাকে বলা হয় কৃষ্ণপক্ষ। এর পরে আবার ১৫ দিন ধরে চাঁদের ঔজ্জ্বল্য বাড়তে থাকে। এই সময়টা হল শুক্লপক্ষ। প্রতিদিন চাঁদের যে-পরিমাণ ঔজ্জ্বল্য কমে বা বাড়ে তাকে বলা হয় চাঁদের কলা বা দশা (Phase)। পূর্ণিমার দিন চাঁদ ঠিক পূর্ব দিগন্তে ওঠে আর অস্ত যায় ঠিক পশ্চিম আকাশে। এরপর প্রতিদিন চাঁদের আকাশে ওঠার সময় প্রায় ৫১ মিনিট করে পিছোতে থাকে। সেই সঙ্গে প্রতিদিন চাঁদের এক ফালি করে কলার হ্রাস ঘটতে থাকে। চাঁদের কলার এই হ্রাসকে ইংরেজিতে বলে ওয়ানিং (Waning)। অমাবস্যার পরের দিন থেকে ঘটনাটা উলটে যায়। অর্থাৎ তখন প্রতিদিন কলা একটু একটু করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই কলা বৃদ্ধিকে ইংরেজিতে বলে ওয়াক্সিং (Waxing)। পুরাণমতে চাঁদের কলাকে ১৬টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তা থেকেই ‘ষোড়শকলা’ বা ‘ষোলকলা’ শব্দের উৎপত্তি। শুক্লপক্ষে চাঁদ প্রতিদিন এক কলা করে বৃদ্ধি পেয়ে তার ষোড়শকলা পূর্ণ করে। চাঁদের এই ষোড়শবিধ কলা হল— অমৃতা, মানদা, পূষা, তুষ্টি, পুষ্টি, রতি, ধৃতি, শশিনী, চন্দ্রিকা, কান্তি, জ্যোৎস্না, শ্রী, প্রীতি, অক্ষদা, পূর্ণা এবং পূর্ণামৃতা।

জোয়ার-ভাটা:

bigganmohabiswe05

সূর্য বা অন্যান্য গ্রহের চেয়ে চাঁদের অবস্থান পৃথিবীর অনেক কাছে। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর উপর চাঁদের আকর্ষণ অনেক বেশি হলেও সূর্যের আকর্ষণকেও উপেক্ষা করা যায় না। সূর্য ও চাঁদের এই মিলিত আকর্ষণের ফলেই পৃথিবীর সমুদ্রে জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি হয়। এছাড়াও বেরিকেন্দ্রে সাধারণ অক্ষের সাপেক্ষে পৃথিবী ও চাঁদের ঘূর্ণনে উদ্ভূত মহাকর্ষীয় আকর্ষণও পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী। ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য যত সহজে বললাম, ততটা সহজ নয়, বরং এটা বেশ জটিল প্রাকৃতিক ঘটনাটা। এই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সমুদ্রে জোয়ার দিনে দু-বার আসে। এক্ষেত্রে দিন বলতে ২৪ ঘণ্টা ৫১ মিনিট বোঝায়। পৃথিবী নিজের অক্ষের চারপাশে যেমন পাক খায়, চাঁদও পৃথিবীর চারপাশে পাক খায়। চাঁদের দিকে মুখ করা কোনও বিন্দু তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে ২৪ ঘণ্টা সময় নেয় ঠিকই, কিন্তু চাঁদ ততক্ষণে প্রায় ৫১ মিনিট পথ সরে গেছে। তাই ওই বিন্দুটি চাঁদ বরাবর আসতে আরও ৫১ মিনিট বেশি সময় নেয়। এই কারণে জোয়ার-ভাটার ক্ষেত্রে দিন ধরা হয় ২৪ ঘণ্টা ৫১ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে সমুদ্রে দু-বার জোয়ার আসে। পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ মোটামুটি একই রেখা বরাবর থাকে বলে ওই দু-দিনে জোয়ার বেশ জোরালো হয়। একে বলা হয় ভরা (তেজ) কোটাল বা স্প্রিং টাইডস (Spring tides)। আর সপ্তমী তিথিতে চাঁদ থাকে সূর্য ও পৃথিবীর রেখার লম্ব অর্থাৎ, সমকোণ বরাবর। তাই এই সময় জোয়ার হয় দুর্বল। একে বলা হয় মরা কোটাল বা নিপ টাইডস (Neap tides)।

জোয়ারকে সমুদ্রের দুটি প্রকাণ্ড ঢেউয়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এর একটি চূড়া থাকে চাঁদের দিকে অর্থাৎ সুবিন্দুতে (Zenith), আর অপর চূড়াটি থাকে ঠিক তার বিপরীত দিকে অর্থাৎ কুবিন্দুতে (Nadir)। পৃথিবীর নিজ অক্ষের চারপাশে পাক খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জোয়ারের চূড়া দুটি পৃথিবীকে ঘিরে পাক খেতে থাকে। পৃথিবী পাক খায় পশ্চিম থেকে পূর্বে আর জোয়ারের চূড়া দুটি বা স্রোত পাক খায় পূর্ব থেকে পশ্চিমে। যেহেতু পৃথিবীর স্থলভাগ বা সমুদ্রের তলদেশ মসৃণ নয়, তাই জোয়ারের স্রোত তার চলার পথে বাধা ঘন ঘন বাধা পায়। এর ফলে পৃথিবীর নিজ অক্ষের চারপাশে পাক খাওয়ার সময় কিঞ্চিৎ কমে যায়। কিন্তু চাঁদের তেমন হয় না। বলবিদ্যার নিয়মানুসারে চাঁদ তখন সামান্য হলেও দূরে সরে যায়। এইভাবেই চাঁদ একটু একটু করে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

চাঁদের কলঙ্ক:

চাঁদে কোনও বায়ুমণ্ডল নেই বললেই চলে। ফলে মহাশূন্য থেকে ছুটে আসা উল্কাপিণ্ড চাঁদের পৃষ্ঠদেশে আঘাত হানায় ছোটোবড়ো নানা আকারের গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে পাহাড়ের কোলে বড়ো বড়ো খাত। আগেই বলেছি, চাঁদের নিজস্ব কোনও আলো নেই। সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়। এই গহ্বরগুলির তলদেশ পর্যন্ত সূর্যের আলো পৌঁছতে পারে না। ফলে সেখান থেকে কোনও আলোর প্রতিফলন হয় না। এই অঞ্চলগুলিই পৃথিবী থেকে কালো কালো ছোপের মতো দেখায়। এই কালো দাগগুলিই হল চাঁদের কলঙ্ক। ‘চরকাকাটা বুড়ি’র যে গল্প আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি তা কাল্পনিক গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।

হারিয়ে যাবে চাঁদ:

চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। লক্ষ-কোটি বছর ধরে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। অমাবস্যার দিন বাদে প্রতিদিনই রাতে আমরা একে আকাশে দেখতে পাই। ছোটো বয়সে ঠাকুরমা-দিদিমার কোলে বসে আমরা কতই না গল্প শুনেছি। কিন্তু ভবিষ্যতে চাঁদের বুড়িকেও আর দেখা যাবে না, গল্পও আর শোনা হবে না। কারণ আকাশে চাঁদই থাকবে না। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, চাঁদ পৃথিবী থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও ভবিষ্যতে এমনটাই হবে। তখন চাঁদ আর পৃথিবীর চারদিকে ঘুরবে না। নিজস্ব নতুন কক্ষপথে সরাসরি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে।

তথ্যসূত্র:

  • The Universe; Ian Nicolson, 1996 Horus Editions.
  • Space Encyclopedia; Heather Couper and Nigel Henbest, 1999 Dorling Kindersley.
  • মহাবিশ্বের বিস্ময় (প্রথম খণ্ড); অরুণাভ চক্রবর্তী, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
  • মহাবিশ্ব; রমাতোষ সরকার, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা।
  • মহাবিশ্বে আমরা কি নিঃসঙ্গ; শঙ্কর চক্রবর্তী, বেস্টবুকস, কলকাতা।

বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সব লেখা একত্রে

1 thought on “FUNবিজ্ঞান-মহাবিশ্বে মহাকাশে-চাঁদ: পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ-কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়-শীত ২০২২

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s