ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে
সারা পৃথিবী জুড়ে ওমর খৈয়ামের নাম তাঁর লেখা রুবাইয়ের সঙ্গে জুড়ে আছে। একবিংশ শতাব্দীর এই কবির অসাধারণ রুবাই সংকলন করে বই প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম ‘রুবাইয়াত–ই-ওমর খৈয়াম’ (রুবাঈ অর্থ চতুর্দশপদী কবিতা)। পৃথিবীর নানা ভাষায় এই বই অনুবাদ করা হয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, ওমর খৈয়াম কবিতা লিখতেন শখে। জানলে অবাক হতে হয়, এই মানুষটির আসল কাজ ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা। কবিতা লেখা ছিল তাঁর মনোরঞ্জনের উপায়।
ঘিয়াত অলদিন ফতেহ্ ওমর ইবন ইব্রাহিম অল খৈয়াম-এর জন্ম হয় খোরাসান প্রদেশের রাজধানী নিশাবুরে। ফার্সি ভাষায় ‘খৈয়াম’ শব্দের অর্থ তাঁবু বানাবার কারিগর। ওমরের পিতৃপুরুষ তাঁবু বানাবার কাজ করতেন। আজকের দিনে তাঁবু বানাবার কাজ খুব সাধারণ মাপের বলে মনে হলেও, হাজার বছর আগে তাঁবু বানাবার কাজে যারা পারদর্শী ছিল, তাদের সমাজে খুব সুনাম ছিল এবং কাজটিও ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়ে ওই অঞ্চলে বেশিরভাগ মানুষ ছিল যাযাবর, যাদের পশুপালন করে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন হত এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় স্থানান্তরণ। বসবাসের জন্য তারা তাঁবুর ভিতরে বসবাস করত। সুলতান ও আমিররাও তাঁবু বানিয়ে থাকতেন। তাঁদের জন্য তাঁবুতে সবরকমের বিলাসের ব্যবস্থা করা হত। তাই খৈয়ামদের বেশ প্রতিপত্তি ছিল নিশাবুরে।
ওমর খৈয়ামের ছেলেবেলা সম্বন্ধে বেশি কিছু জানা যায় না, তবে তিনি বংশগত রাজকাজে যোগ দিতে চাননি, সে বিষয়ে জানা গিয়েছে। লেখাপড়ায় বেশি মনোযোগী হবার ফলে জ্ঞানার্জনের পথই বেছে নিয়েছিলেন ওমর। এই জ্ঞানের পিপাসা তাঁকে নিশাবুর ছেড়ে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল সমরখন্দ, বুখারা আর ইস্পাহানে। এইসব জায়গাগুলো ছিল মধ্য এশিয়ার দর্শন ও বিজ্ঞান শিক্ষার পীঠস্থান। এইসব জায়গাতে ওমর বিজ্ঞানের গবেষকদের সংস্পর্শে আসেন। বীজগণিত বা অ্যালজেব্রা হয়ে ওঠে তাঁর প্রিয় অঙ্ক চর্চার বিষয়। তিনি বীজগণিতের বিভিন্ন ঘাতের সমীকরণ সমাধান করতে চেষ্টা করতে থাকেন এবং বেশকিছু সমীকরণের সমাধান সূত্রও আবিষ্কার করে ফেলেন।
তৃতীয় ঘাতের বীজগণিতের সমীকরণের উপায় হিসাবে ওমর ব্যবহার করেন জ্যামিতিক কায়দা। তখনও এই ধরনের সমীকরণের ঘাত বার করার অন্য কোনও উপায় আবিষ্কৃত হয়নি। এই বিষয়ে ওমর খৈয়াম একটি অসাধারণ বই লেখেন, যার নামটা বেশ খটোমটো—‘মাকালাত ফি অল-জেবর অয়া অল মুকাবিলা’, অর্থাৎ অ্যালজেব্রার সমীকরণ সমাধানের উপায়ের একটি সংকলন। ওমরের পূর্বসূরিদের কাজের বিবৃতির সঙ্গে তিনি এই বইটিতে তেরোটি নতুন সমীকরণকে সনাক্ত করেন। জ্যামিতিক কোণের অংশ ব্যবহার করে ওমর সমাধান করার চেষ্টা করেন বিভিন্ন সমীকরণের। এই বইটিতে বাইনমিয়াল সম্প্রসারণের রাস্তা বাতলে দেন ওমর। তবে সেই বাইনমিয়ালে ঘাতটি ধনাত্মক হলে তবেই ওমরের পদ্ধতি কাজে লাগবে। তিনিই বিশ্বে প্রথম ব্যক্তি যিনি বাইনমিয়াল থিওরমের আবিষ্কর্তা এবং বাইনমিয়াল কো-এফিসিয়েন্টের সনাক্তকারী অঙ্কবিদ। ইউক্লিডের জ্যামিতির বিশ্লেষণ করে সরল ব্যাখ্যা দেন ওমর তাঁর লেখা বইটিতে। একই সঙ্গে সমান্তরাল রেখার তত্ত্ব নিয়েও আলোচনা করেন।
একাদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেলজুক তুর্কি উপজাতির যোদ্ধারা মেসোপটেমিয়া, প্যালেস্টাইন এবং ইরান দখল করে নেয়। সেলজুক শাসক তঘ্রিল বেগ নিশাবুরে এসে নিজেকে এই অঞ্চলের সুলতান বলে দাবি করে বসেন। সেলজুকরা গোঁড়া ধার্মিক মুসলমান ছিল। এমন সামাজিক পরিবেশ বিজ্ঞানচর্চার পক্ষে একেবারেই উপযুক্ত ছিল না। সম্ভবত এই কারণেই ওমর নিশাবুর থেকে সমরখন্দে চলে যেতে বাধ্য হন।
তঘ্রিল বেগের নাতি সুলতান মালিক শাহ্ ক্ষমতায় এলে তিনি ওমর খৈয়ামকে ইস্পাহানে একটি নতুন মানমন্দির গড়ে তোলার কাজ দেন। এই মানমন্দির গড়ে তোলার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে ইসলামিক ক্যালেন্ডারের ত্রুটি সংশোধন। মালিক শাহ্ আরও অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে এই কাজের জন্য ডেকে পাঠান ইস্পাহানে। ক্যালেন্ডারের ত্রুটির কারণে দিনক্ষণ দেখে বছরের সঠিক সময়ে ফসল তোলার উপর কর বসাতেন সুলতানেরা। আগে থেকে পরিকল্পনা না করলে খাজনা আদায় হত না। রাজ কোষাগারে অর্থ উপার্জন হত কম। কাজেই এই সঠিক ক্যালেন্ডার বানানোয় সুলতানের আগ্রহ সহজেই অনুমান করা যায়।
কাজ হাতে পেয়েই ওমর বানিয়ে ফেললেন ক্যালেন্ডার, নাম দিলেন—অল তারিখ অল জালালি। এই ক্যালেন্ডারে এতটাই কম ত্রুটি ছিল যে তা ইউরোপীয়দের জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের চাইতেও উন্নত হয়েছিল। ওমরের ক্যালেন্ডারে ৩৭৭০ সালে একদিনের হেরফের হত, জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারে ৩৩৩০ দিনে একদিন ভুল হত।
জ্যোতির্বিজ্ঞান ছাড়া পদার্থবিদ্যাতেও তিনি যথেষ্ট পণ্ডিত ছিলেন। কোনও বস্তুর আপেক্ষিক গুরুত্ব মাপার সঠিক পদ্ধতি আবিষ্কার হয় তাঁর হাতে। ওমরের হিসাবে একটি বছরে ৩৬৫.২৪২১৯৮ দিন থাকে। আজকের দিনে এই মান ৩৬৫.২৪২১৯০। হাজার বছরের বেশি আগে ওমরের প্রায় নিখুঁত হিসেব দেখে বিস্মিত হতে হয় বইকি। ওমর খৈয়ামের দীর্ঘ আঠারো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হল এই ক্যালেন্ডার।
সুলতান মালিক শাহ্ উদার মনের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তিনি হঠাৎ মারা গেলে ইস্পাহানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব ঘোরালো হয়ে পড়ে। গোঁড়া ধর্মাবলম্বীদের দাপট চলতে থাকে সুলতানি শাসনে। উন্মুক্ত চিন্তার মানুষ ওমরের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় রাজদরবার। বন্ধ করে দেওয়া হয় মানমন্দির। তবুও ওমর চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন বিজ্ঞানের উন্নত গবেষণায়। কিছুদিন পর তিনি তুর্কির মার্ভে চলে যান নিজের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে। মালিক শাহ্র তৃতীয় পুত্র ক্ষমতায় এলে আবার বিজ্ঞান ও দর্শনের গবেষণা শুরু হয়। মার্ভ একটি উৎকৃষ্ট জ্ঞানার্জনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ওমর খৈয়াম।
পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও অঙ্ক ছাড়া চিকিৎসাতেও তিনি বেশ নাম করে ফেলেন। কর্মযোগী এই মানুষটি অবসর সময় কখন পেতেন তা আজ আর জানা সম্ভব না হলেও ভেবে বিস্মিত হতে হয়, তিনি এত কাজের মাঝেও অসাধারণ সব রুবাঈ কী করে লিখে গিয়েছেন। তাঁর লেখা রুবাঈয়ের পাণ্ডুলিপি ইউরোপ ও বহির্বিশ্বে জানাজানি হয় যখন ১৮৩৯ সালে এডওয়ার্ড ফিডজেরাল্ড ফার্সি ভাষা থেকে ইংরেজিতে রুবাঈগুলি অনুবাদ করে একটি বই প্রকাশ করেন, যা পরবর্তীকালে ‘রুবাঈয়াত-ই-ওমর খৈয়াম’ নামে বিশ্বজোড়া খ্যাতি পায়। ওমরের এই রুবাঈগুলি বিশ্বসাহিত্যে এক উজ্জ্বল স্থান দখল করে আছে আজও। প্রায় আট শতক পর এই কবি বিশ্বের দরবারে আত্মপ্রকাশ করার পর তাঁকে নিয়ে চলতে থাকে অনুসন্ধান। জানা যায় তাঁর বিজ্ঞানের জগতে অসাধারণ সব অবদানের কথা।
ওমর খৈয়ামের লেখা মোট দশটি বই আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়েছে—যার মধ্যে চারটি অঙ্কের, তিনটি পদার্থবিদ্যার, তিনটি আধ্যাত্মবাদের ও একটি জ্যামিতির বই। তাঁর আবিষ্কার সমসাময়িক দুনিয়ায় অনেক আগে এগিয়ে ছিল। এর অনেক পরে রেনে দেকারতস ওমরের কায়দায় জ্যামিতিক পদ্ধতিতে তিন ঘাতের বীজগাণিতিক সমাধান আবিষ্কার করেন, তবে তিনি ওমরের বিষয়ে অবগত ছিলেন না বলেই মনে করা হয়।
ওমর খৈয়ামের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান যেন তাঁর অজস্র চতুর্দশপদী কবিতার আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু তাঁর জীবনদর্শন ও জীবনবোধের হদিস পাওয়া যায় তাঁর লেখা রুবাঈগুলিতে। কাজি নজরুল ইসলাম ওমরের হাজার হাজার কবিতার মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে দুশো কবিতা অনুবাদ করেন বাংলায়। একটি কবিতা এখানে তুলে ধরে দুই কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম।
‘ঘেরা টোপের পর্দা ঘেরা দৃষ্টি সীমা মোদের ভাই
বাইরে ইহার দেখতে গেলে শূন্য শুধু দেখতে পাই
এই পৃথিবীর আঁধার বুকে মোদের সবার শেষ আবাস
বলতে গেলে ফুরোয় না আর বিষাদ করুণ সেই কথাই’
তথ্যসূত্র
- Islamic Science, Volume 2, Compiled and edited by Dr. Abraham, Kindle Unlimited Edition
- https://mathshistory.st-andrews.ac.uk/Biographies/Khayyam/
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর
Lekhati pore Omar Khaium sammandhe eto tatthya jante pere khushite mon bhore uthlo.
University te parar samay shudhu unar kabita aabriti korechhi. Taar Padathobidya, Jotirbidya aar Bijganiter asadharan Gyan dekhe satti abak hoye gelam.
LikeLike