সুমনা সাহার আগের ছড়া- পিঁপড়ের গান
নদী পার হতে এল দলবেঁধে দশজন ছোটো খোকা,
হাবেভাবে খুব পণ্ডিত তারা, আসলেতে খাঁটি বোকা।
খরতর বেগ, দুস্তর নদী, ভয় পেয়ে গেল তারা
পার হতে গিয়ে স্রোতে ভেসে শেষে প্রাণে যদি যায় মারা!
একজন ভারি বুদ্ধি খাটিয়ে বলে, ‘চলো সবে যাই,
ওপারেতে গিয়ে গুনে নেব মাথা কুছ পরোয়া নাই।’
ওপারে পৌঁছে সবাইকে ডেকে বলে, ‘সারি দিয়ে দাঁড়া,
মাথা গোনা হবে, আছে কি সকলে, নাকি গেছে কেউ মারা!’
গোনে বার বার, ‘এক’ থেকে ‘নয়’, আপনাকে দিয়ে বাদ
একজন খোকা খোয়া গেল, ‘হায়’, করে সে আর্তনাদ।
*
ওই পথ দিয়ে যেতে যেতে এক পথিক অবাক চায়;
কাছে এসে বলে, ‘কী হয়েছে বলো, করো কেন হায় হায়?’
হাউমাউ কাঁদে দশ বোকা খোকা, ‘ঠাকুরমশাই শোনো,
‘দশ’ থেকে মোরা ‘নয়’ যে হয়েছি সন্দেহ নেই কোনো।
নদী পার হতে স্রোতে ভেসে গেল আমাদের একজন
ছিলাম দশটি, এখন আমরা হয়েছি যে নয়জন!’
পথিক তাকিয়ে চকিতে বুঝেছে ভুলটি আদ্যোপান্ত
বলল, ‘ঠিক আছে, আমিই গুনছি, এইবারে হও শান্ত।’
*
দশ বোকা খোকা সারি বেঁধে রয়
পথিক গুনছে ‘এক’ থেকে ‘নয়’—
ঠাস করে চড় বসায় কষিয়ে দশম খোকার গালে
‘তুমি তো দশম, গোনার সময় সে-কথাই গেলে ভুলে?’
আপন স্বরূপ ভুলেছি মোরাও বাইরে খুঁজতে ব্যস্ত,
অন্তরে আছে নিত্য সত্য জেনে হও তুমি তৃপ্ত!
অন্তরে সেই পরম-আত্মা শাশ্বত সনাতন,
কিছুই আমরা হারিয়ে ফেলিনি সত্য চিরন্তন।
‘তত্ত্বমসি’, ‘তুমিই অমৃত’, এই তো মোদের বিত্ত
বেদান্ত কয়, সন্ধান করো আপন স্বরূপ নিত্য।
[স্বামী বিবেকানন্দ সনাতন হিন্দুধর্মের বাণী প্রচার করতে বিদেশে গিয়েছিলেন। তিনি তাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, আমরা সবরকমের আনন্দ বাইরে খুঁজে বেড়াই, আসলে বাইরে কিছুই নেই, আমাদের অন্তরেই আছে নিত্য আনন্দের উৎস। কেমন জানো? একটা লোক গামছা খুঁজে পাচ্ছে না। চারদিকে খোঁজাখুঁজি করছে, বাড়ির সবাইকে বকাবকি করছে, “তোমরা আমার গামছাটা কোথায় রেখেছ? আমি খুঁজে পাচ্ছি না!”
তখন একজন বলল, “তোমার গামছা তো তোমার কাঁধেই রয়েছে!”
ঠিক সেরকমই, আমরা আমাদের দুঃখকষ্টের জন্য অন্যকে দোষারোপ করি, মনে করি আমার এই দুরবস্থার জন্য অমুক লোকটা দায়ী। আমার এই হারিয়ে গেছে, আমার সেইটা নেই, ইত্যাদি। আসলে আমাদের হারায়নি কিছুই। ওই লোকটার গামছা খোঁজার মতোই আমরাও আমাদের সুখ, আনন্দ সব বাইরে সন্ধান করে বেড়াচ্ছি। ওই লোকটার গামছা কি সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিল? ও নতুন করে পেল? তা তো নয়, সেটা ওর কাছেই ছিল, কিন্তু ও ভুলে গিয়েছিল। তাই ওর কিছুই হারায়নি, আর নতুন করে কিছু প্রাপ্তিও হয়নি। বেদান্তও আমাদের এভাবে মনে করিয়ে দেয় যে, তোমার মধ্যেই সব আনন্দ, সব সুখের ঠিকানা, কেবল তুমি নিজের অন্তরে দৃষ্টি দাও। এটাই বোঝাতে স্বামীজী দশজন লোকের নদী পার হতে আসার গল্প বলেছিলেন। সেই গল্পটাকেই এখানে ছন্দে গাঁথা হয়েছে।]
অলঙ্করণ-লেখক