দেশ ও মানুষ সব পর্ব একত্রে
কোটি কোটি মানুষ পাগলের মতো হাসপাতালে ভিড় জমাচ্ছেন একটি ছুঁচের খোঁচা খাবার জন্য। ছুঁচের ডগার কয়েক ফোঁটা তরলের মধ্যে আছে বেঁচে থাকার রসদ। লিখেছেন – অরিন্দম দেবনাথ।
১৯৬৯ সালে তামিলনাড়ু-অন্ধ্র সীমান্তের ছোট্ট মন্দির শহর তিরুঠানির এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্ম হয়েছিল কৃষ্ণমূর্তি এল্লার। তিরুঠানি, ঈশ্বর মুরুগার ছয় বাসস্থানের অন্যতম। সে সময় কেউ ভাবতেও পারেননি ঈশ্বর মুরুগার, মানবসভ্যতাকে বাঁচানোর আশীর্বাদী হাত নেমে আসবে তিরুঠানির কৃষ্ণমূর্তির হাত ধরে।
কৃষক পরিবারের ছেলে কৃষ্ণমূর্তি খানিক বড় হয়ে কৃষি নিয়ে পড়াশুনা করতে চাইলে, বাবা খানিক রেগেমেগেই বলেছিলেন “ওরে কৃষি নিয়ে পড়াশুনা করে কেউ কৃষক হয় না।কৃষক হতে হলে হাল ধরতে শিখতে হয়।” একগুঁয়ে কৃষ্ণমূর্তি স্নাতক স্তরে ব্যাঙ্গালোরের ‘ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচার সায়েন্স’ এ ভর্তি হলেন। প্রবল উৎসাহ আর কঠোর পরিশ্রমের ফল মিলল। ‘স্বর্ণপদক’ অর্জন করলেন। তবে আর পাঁচটা মেধাবী ‘স্বর্ণপদক’ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী ছাত্রের মতো মোটা অর্থের চাকরির দিকে ঝুঁকলেন না। তিনি বাইয়ার ফার্মার কৃষি বিভাগে যোগ দিলেও উচ্চশিক্ষাকে পাখির চোখ করেছিলেন। তিনি রোটারি স্কলারশিপ পেয়ে পি এইচ ডি করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন। শুরু হল অসাধারণ মেধার অধিকারী কৃষ্ণমূর্তির নানা উদ্যমের পেছনে ছুটে চলা।
কৃষ্ণমূর্তির গবেষণার বিষয় ছিল আণবিক জীববিজ্ঞান।
মার্কিন মুলুকে থাকাকালীন পরিচয় হয় অর্থনীতির স্নাতক সুচিত্রার। বিবাহ করেন তাঁকে।
মার্কিন প্রবাসী অধিকাংশ ভারতীয়রই স্বপ্ন একটা গ্রিন কার্ড। আমেরিকায় বসবাসের চাবি। কিন্তু সুচিত্রা চাইলেন, দেশে ফিরে এসে মানুষের সেবা করুন তিনি। দেশ থেকে মা বলে পাঠালেন, ফিরে এস। আমি যতদিন দু মুঠো খেতে পাব তোমারও অভাব হবে না। ডঃ কৃষ্ণও স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু একটু অন্যরকম। রোগ মুক্তির স্বপ্ন। লক্ষ লক্ষ মানুষকে অবহেলিত রোগ থেকে রক্ষা করার স্বপ্ন। যার একটিই পথ স্বল্প খরচে প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন তৈরি করা। আর এই স্বপ্নের ধাত্রীভূমি বানাতে চেয়েছিলেন নিজের মাতৃভূমি ভারতবর্ষে।
হায়াদ্রাবাদের নবগঠিত শিল্পকেন্দ্র জেনোম ভ্যালিতে স্থাপন করলেন নতুন গবেষণা কেন্দ্র তথা কারখানা ভারত বায়োটেক। এই গবেষণা কেন্দ্র তথা কারখানার প্রথম পণ্যটি ছিল সিজিয়াম-মুক্ত হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন। সেই ছিল বিশ্বের প্রথম সিজিয়ামমুক্ত হেপাটাইটিস ভ্যাকসিন। কৃষ্ণমূর্তির এই সাফল্য নজরে পড়ে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের। এই ফাউন্ডশনের আর্থিক সাহায্যে ভারত বায়োটেকের গবেষণাগারে তৈরি হয় রোটাভাইরাস এবং টাইফয়েড ভ্যাকসিন এবং বিশ্বের প্রথমবার।
১৬ বছর লেগেছিল রোটাভাইরাস ভ্যাকসিনকে সাধারণ মানুষকে দেবার উপযোগী করে তুলতে। পশ্চিমের দেশগুলোতে এই ভ্যাকসিনের দাম ছিল ৮৫ ডলার মানে প্রায় ৬৪০০টাকা। আর ভারত বায়োটেকের তৈরি রোটাভাইরাসের ভ্যাকসিনের দাম দাঁড়াল মাত্র এক ডলার। ৭৫ টাকা। বর্তমানে ৭০টা দেশে ভারত বায়োটেকের তৈরি ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। ডঃ কৃষ্ণমূর্তি আর তাঁর দলবলের নামে বর্তমানে ১৪০টা পেটেন্ট আছে।
এরপর এলো কোভিড কাল। পৃথিবীজুড়ে নেমে এলো মৃত্যুর আতঙ্ক। সম্পুর্ণ অজানা ভাইরাসের আক্রমণে হতবুদ্ধি হয়ে গেল চিকিৎসককুল। না জানা আছে চিকিৎসা পদ্ধতি, না জানা যাচ্ছে রোগের চরিত্র। কিছুদিন পরপর ভেক বদল করছে ভাইরাসটি। শুধু এইটুকু বোঝা গেল এই রোগীর সংস্পর্শে এলে রোগ ছড়াবে।
মানুষের প্রাণ বাঁচাতে আর রোগ উপশমের পন্থা খুঁজে বের করতে বিশ্বজুড়ে শুরু হল ২০২০ সালের মার্চ নাগাদ ‘লকডাউন।’ সব বন্ধ হয়ে গেল। পুলিশ রাস্তায় নেমে এসে মানুষকে ঘরে বসে থাকতে বলল। ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, সাফাইকর্মী… নিজেদের উজাড় করে দিতে লাগল মানুষের প্রাণ বাঁচাতে।
বিশ্বজুড়ে শুরু হোল এই মারণ ভাইরাস থেকে বাঁচার প্রতিষেধক বের করার দৌড়। ভাইরাসটি নতুন। কেউই জানত না তার নিখুঁত স্বরূপ। কী দিয়ে ভাইরাসটিকে প্রতিরোধ করা যাবে তাই নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন পৃথিবীর তামাম ভাইরাসবিদরা।
বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারি সংস্থা সিরাম ইন্সটিউট অফ ইন্ডিয়ার সিইও আদার পুনাওয়ালা অ্যাডেনোভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরির জন্য অক্সফোর্ড এবং অ্যাস্ট্রার সাথে আলোচনা করেছিলেন। ভারত থেকে আধ ডজনেরও বেশি সংস্থা চেষ্টা করেছিল করোনার হাত থেকে বাঁচার উপায় বের করার। কিন্তু বাস্তবে আমাদের ভাগ্য এই দু’জনের উপর নির্ভর করে ছিল।
একটি ভ্যাকসিন তৈরির বিশ্বব্যাপী দৌড়ে অনেক পদ্ধতির কথা উঠে আসছিল। কিন্তু কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে এগোন উচিৎ সেটা ঠিক করাই ছিল দুরহ। ডঃ কৃষ্ণমুর্তি বুঝতে পেরেছিলেন যে ভ্যাকসিনগুলি কেবল নিরাপদ এবং কার্যকর হলেই হবে না, হতে হবে ব্যবহারিক। এমনভাবে বানাতে হবে যাতে তা মজুত করতে কোন সমস্যা না হয়। গ্রামগঞ্জে, প্রত্যন্ত প্রান্তে অনায়াসে নিয়ে যাওয়া যায় ভ্যাকসিনের অ্যাম্পুল। তাছাড়া ভ্যাকসিন থাকতে হবে সাধারণ লোকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে।
অ্যাডেনোভাইরাস ভ্যাকসিন ল্যাবোরেটারিতে তৈরি হলেও তার সক্ষমতা নিয়ে সংশয় ছিল। এই ভ্যাকসিনটি একধরণের প্রোটিন যা শরীরে গিয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে নতুন ভাইরাসের সাথে লড়াইয়ে শরীরকে সক্ষম করে তোলে।কিন্তু শিম্পাঞ্জির উপর প্রয়োগ করে দেখা গেল এই প্রোটিন পুরোপুরি লড়াইয়ে কার্যকর হচ্ছে না। ডঃ কৃষ্ণমুর্তি জলাতঙ্কের ওষুধে খানিক রদবদল করে পশুর ওপর প্রয়োগ করে দেখলেন করোনার প্রতিষেধক হিসেবে তা পুরোপুরি ব্যর্থ। উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং টমাস জেফারসন ইনস্টিটিউটের সাথে এই বিষয়ে তাঁর প্রকল্পগুলিও একের পর এক অকৃতকার্য হল।
প্রায় সমস্ত বিশ্বের বৈজ্ঞানিকরা করোনার ভ্যাকসিন খুঁজে বের করতে মূলত মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA) কে ভিত্তি করে ছুটছিল, তখন ডঃ কৃষ্ণমুর্তি এল্লা অন্য পথে ভাবতে শুরু করলেন। ভাইরাসকে খতম করতে খানিক পুরনো পন্থা নিলেন। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চএর সহযোগিতায় প্রাচীনপন্থী চিন্তায় ফল মিলল।
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ার একটা প্রোটিন ল্যাবে সৃষ্টি হল ঠিকই, কিন্তু যতক্ষণ না পরীক্ষা করা হচ্ছে বলা যাচ্ছে না এতে কোন কাজ দেবে কিনা। পরীক্ষা পদ্ধতিটাও তো লম্বা। প্রথমে ইঁদুর ও গিনিপিগের ওপর প্রয়োগ। তাতে খানিক সাফল্যের আভাস পেলে তা মানব শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেখতে হবে তাঁর প্রতিক্রিয়া। এদিকে সময় দৌড়চ্ছে দ্রুত। হাজারে হাজারে মানুষ মারা যাচ্ছে পৃথিবীর কোনায় কোনায়। এর আগে হেপাটাইটিস-এর ভ্যাকসিন বের করতে দীর্ঘ ১৬ বছর গবেষণা করতে হয়েছিল। একের পর প্রয়োগ-পরীক্ষা চালাতে হয়েছিল। এই মারণ ভাইরাস প্রতিহত করার উপায় বের করতে কত বছর লাগবে, এই নিয়ে সারা বিশ্ব উৎকণ্ঠার দোলাচালে। যদি কোন ভ্যাকসিন বেরোয় তা কি কাজ করবে? নিরাপদ হবে কি এই ভ্যাকসিন নেওয়া।
ভারতের অগুনিত ভাইরোলজিস্টদের আন্তরিক উদ্যোগ ও সহায়তায় এই পরীক্ষাপর্বটি দ্রুত এগোতে থাকে। সবাই চাইছিলেন মারণযজ্ঞ থেকে পরিত্রাণের উপায়। কিছু মানব স্বেচ্ছাসেবীকে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর, ঠিক আঠাশদিনের মাথায় শুরু হয় এই স্বেচ্ছাসেবীদের রক্তের নমুনা পরীক্ষার কাজ। একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বায়োসেফটি পরীক্ষাগারে এই মারণ ভাইরাসের যাবতীয় পরীক্ষা চালানো হয়। দেখা হতে থাকে ভ্যাকসিনটি কাজ করেছে কিনা। যদি ভ্যাকসিন কাজ করে থাকে তবে রক্তের নমুনায় থাকা অ্যান্টিবডিগুলি ভাইরাসটিকে নিষ্ক্রিয় করে তুলবে এবং এর কোনও বৃদ্ধি হবে না।
ডঃ কৃষ্ণমুর্তি ও তাঁর দলের ঐকান্তিক প্রয়াসে সৃষ্টি ভ্যাকসিনটি পরীক্ষায় উৎরে যায়। ভারতের মাটিতে, ভারতীয় গবেষকদের দ্বারাই তৈরি হয় মৃত্যুর স্রোত বইয়ে দেওয়া করোনা ভাইরাসের প্রতিহত করার প্রতিষেধক। শুধু ভারতের জনগণের জন্যই নয় বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকদের কাছে এ’ছিল এক স্বস্তির দিন।
জন্ম নিল কোভ্যাকসিন।
ডঃ কৃষ্ণামুর্তি এল্লা কিন্তু পুরো গবেষণাটাই চালিয়েছিলেন নিজ উদ্যোগে। কোন সরকারি আর্থিক সাহায্য ছাড়াই। সামনে একটা বিশাল লড়াই অপেক্ষা করছিল। তা হোল মানবশরীরে আরও ভ্যাকসিনের প্রয়োগ আর একে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা। বিভিন্ন ভার্চুয়াল ও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে এই সাফল্য প্রশংসিত হলেও প্রায় সবাই এই ভারতীয় ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেন।
“এতো তাড়াতাড়ি ভ্যাকসিন বানিয়ে ফেললো।”
“কোন চাল না তো?”
তবে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ দারুণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। দ্রুত ছাড়পত্র দিয়ে ভ্যাকসিনটি মানুষের শরীরে প্রয়োগের ব্যবস্থা করে।
তৃতীয় বিশ্বে একমাত্র ভারতবর্ষই করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয় ভ্যাকসিন মৈত্রী উদ্যোগে সামিল হয়ে বিশ্বের অনেক দেশকে ভ্যাকসিন সরবরাহ শুরু করে। বিশ্বে গবেষক দেশ হিসেবে ভারতের মাথা উঁচু হয়ে ওঠে।
কিন্তু প্রথম দিকে বিনামুল্যে বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় এই ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হলেও খুব কম লোকই ভ্যাকসিন নিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। অবিশ্বাস আর নিজের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রতি আত্মবিশ্বাস এর অন্যতম কারন হতে পারে। যখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ে অজস্র মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে শুরু করেছে তখন জনগন হত্যে দিয়ে পড়েছেন ভ্যাকসিন নেবার জন্য।
ভ্যাকসিন নিলেও করোনা আক্রান্ত হতে পারেন, কিন্তু সে রোগ মারণঘাতি হয়ে ওঠার সম্ভবনা প্রায় শূন্য।
ভারতে তৈরি এই ভ্যাকসিনকে অবিশ্বাস না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।