জয়ঢাক ঘাটশিলা সাহিত্য ট্রেক ২০২০-র তৃতীয় সেরা গল্প
(১)
স্কুল থেকে ফিরেই টুকাই এমন চিৎকার করে ‘মা, দেখো কী নিয়ে এসেছি-ই-ই’ বলল যে সবার চোখ গিয়ে পড়ল ওর হাতে রাখা ছোট্ট জুতোর বাক্সটাতে। দালানে বসে টেনেটুনে তুলির চুল বেঁধে দিচ্ছিল মা। তুলির বিস্ময়ের অন্ত নেই। কী এনেছে দাভাই স্কুল থেকে? নিশ্চয়ই দুষ্প্রাপ্য কিছু। প্রাচীন শিলালিপি? নাকি প্রাগৈতিহাসিক কোনো জীব? মা অবশ্য ভুরুজোড়া কুঁচকেই তাকাল সেদিকে। মা টুকাইয়ের খামখেয়ালিপনার ধরনগুলো জানে। কখন যে কী নিয়ে এসে উপস্থিত হয়, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। সেবার কোথা থেকে একটা ব্যাঙ ধরে নিয়ে এসে উপস্থিত। মা চিৎকার করে সেটাকে সেদিনই বিদায় না জানালে বাড়িটা একদিন আস্ত চিড়িয়াখানা হয়ে যেত। সেরকমই আজব কোনো জীব ধরে নিয়ে এসেছে বুঝি। টুকাই বাক্সের মুখটা সযত্নে খুলতেই কালোমতো একটা মাথা বেরিয়ে এল আর তুলি ‘মাগো ইঁদুর!’ বলে এক লাফে দালান থেকে মাটিতে পড়ল। মা ভুরুজোড়া আরো কাছাকাছি এনে জিনিসটা ঠিক কী সেটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। টুকাই নির্বিকারভাবে বাক্স থেকে বের করে প্রাণীটাকে হাতে নিয়ে তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তুলির আরো কাছে গিয়ে বলল, “ভালো করে দ্যাখ পাগলি!”
তুলির মুখটা দেখে মনে হচ্ছে দাভাই স্কুল থেকে যেন কোনো বাঘ কিংবা সিংহছানা ধরে এনেছে। ছোট্ট জীবটা মাথাটা একবার এদিক আর একবার ওদিক করতে বোঝা গেল যে সে ইঁদুর নয়। একটি পাখি।
কালোমতো পাখিটা কী মা বুঝতে না পেরে বলল, “ময়না?”
“না না, শালিক। নিতাইদা এনে দিয়েছে।”
আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মা পরিষ্কার জানিয়ে দিল, “এখনই বিদেয় কর একে। আমি দেখতে পারব না।”
পাখি জেনে তুলির প্রাথমিক ভয়টা কেটেছে। টুকাই দুষ্টুমি করার জন্যই হোক কিংবা তুলিকে ভয় দেখানোর জন্যই হোক, পাখিটাকে হাতের মুঠো থেকে ছেড়ে দিল। পাখিটা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গিয়ে টুকাইয়ের কাঁধে গিয়ে বসল। সেই ডানা ঝাপটানো দেখে তুলির আবার একপ্রস্থ ‘মাগো!’ বলে চিৎকার করে মায়ের আঁচলে মুখ লুকোনো।
পাখিটার পা ভেঙে গেছে কি? ঠিকভাবে বসতে পারছে না টুকাইয়ের কাঁধে। সেদিকে তাকিয়ে মায়ের ধমক, “এসব কী অনাচার! ঘরের মধ্যে পশুপাখি নিয়ে এসে তাদের কষ্ট দেওয়া… গেরস্ত বাড়ির অকল্যাণ হয় এতে। বিদায় কর একে।”
কল্যাণ-অকল্যাণ অতশত বোঝে না টুকাই। অনেক কষ্ট করে টিফিনের পয়সা থেকে টাকা জমিয়ে স্কুলের মালি নিতাইদার হাতে নগদ কুড়ি টাকা গুঁজে এই পাখিটা পেয়েছে। বিদায় জানানোর কোনো শখই নেই ওর। তার ওপর সকাল থেকে পাখিটা ওর সঙ্গেই ছিল। পায়ে দড়ি বেঁধে লাস্ট বেঞ্চের সঙ্গে আটকে রেখেছিল পাখিটাকে। বন্ধুরা টিফিন থেকে খাবার নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরেছে—চাউমিন, লুচি, জ্যাম দেওয়া পাউরুটি। সেসব অবশ্য কিছুই মুখে তোলেনি। নিতাইদার কথামতো টিফিনে মার দেওয়া বাটার বাইট বিস্কুটটা জলে ভিজিয়ে ঠোঁটটা ফাঁক করে মুখে দিতেই কুচুম কুচুম করে খেয়েছে পাখিটা।
ঢ্যাঙা লিকলিকে কানাই-স্যারকে সবথেকে ভয় টুকাইয়ের। সেই পিরিয়ডটায় বুক ঢিপঢিপ করছিল। এই বুঝি দেখে ফেলল! দেখলে আর রক্ষে নেই। ‘ক্লাসের মধ্যে এইসব হচ্ছে?’ বলে কান ধরে সোজা ক্লাসের বাইরে নিলডাউন। ওই পিরিয়ডেই পাখিটা দু-বার চেঁচিয়ে উঠেছিল। বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠেছিল টুকাইয়ের। কানাই-স্যারের গোল গোল চোখদুটো ক্লাসের চারপাশে একবার চক্কর খেলেও বেঞ্চের নীচে পাখি থাকতে পারে সেটা স্যারের কল্পনাতেও আসেনি। সেই টুকাই ছুটির পর নিতাইদার থেকে একটা ছোটো জুতোর বাক্স জোগাড় করে তার চারপাশে ছোটো ছোটো গর্ত করে পাখিটাকে ঢুকিয়েছে যাতে নিঃশ্বাস নিতে কোনো কষ্ট না হয়। তারপর অনেক কাণ্ড করে বাড়ি নিয়ে আসতে মায়ের এই কথা। মা বলে কিনা বিদায় কর!
একরকম চেঁচিয়েই উঠল টুকাই, “বিদায় করার জন্য কি আমি ওকে এনেছি?”
মা স্পষ্টাস্পষ্টি জানাল, “আমি ওকে দেখতে পারব না। এবার তুমি যা খুশি করো।”
“তোমাকে কিচ্ছু দেখতে হবে না। আমি একটা খাঁচা কিনে আনব, সেখানেই থাকবে।”
“শুধু খাঁচায় রেখে দিলেই হবে? তাকে স্নান করাতে হবে না? খাওয়াতে হবে না?”
“আমি সকালে স্নান করিয়ে, খাইয়ে দিয়ে যাব। তুমি শুধু দুপুরটা খাইয়ো। স্কুল থেকে ফিরে আবার আমি খাওয়াব।”
“শুধু শুধু একটা অবলা প্রাণীকে খাঁচার মধ্যে আটকে রেখে কষ্ট দেওয়া।”
মার সঙ্গে সমান তালে যুক্তি পালটা যুক্তি চলতে থাকে টুকাইয়ের। বলল, “আরে, খাঁচাটায় তো মাত্র কয়েকদিন থাকবে। তারপর পোষ মেনে গেলে ও ছাড়াই থাকবে। তখন বাইরে বাইরে ঘুরবে। ঘরে এসে খাবার খেয়ে যাবে। পোষ মেনে গেলে দেখবে কাঁধে কাঁধে ঘুরছে।”
“কে বলেছে তোকে এসব?”
“নিতাইদাই বলেছে।”
“ওই নিতাইদাটাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। দাঁড়াও, কাল স্কুলে গিয়ে ওই নিতাইদার নামে হেডস্যারের কাছে কমপ্লেন ঠুকে আসছি।”
“ওমা! এইটুকু ছোট্ট ছানাকে এখন রাতবিরেতে কোথায় ছাড়ব? তাছাড়া এখনো নিজে খেতেও শেখেনি। ছেড়ে দিলে ও তো না খেতে পেয়েই মরে যাবে।”
টুকাই জানে, এই একটিমাত্র অস্ত্রেই মাতৃদেবীকে ঘায়েল করা যেতে পারে। ওদিকে পাখিটা পোষ মেনে গেলে কাঁধে উঠে বসবে, খোলা আকাশে উড়বে আবার ঘরে খেতেও আসবে, এটা শুনে বেশ মজার উপকরণ পেয়ে গেছে তুলিও। সেও মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “রাখো না মাম্মা। ক’দিন বাদেই তো পোষ মেনে যাবে।”
মাম্মা আর কী করে? অগত্যা।
ঠিক হল, পরদিন বাবা কাঠের খাঁচা কিনে আনবে। জুতোর বাক্সে তো আর পাখি রাখা যায় না। লোহার খাঁচাতেও শালিক থাকে না।
স্কুল থেকে ফেরার সময় পঞ্চাদার মুদির দোকান থেকে এক প্যাকেট ছাতু কিনে এনেছিল টুকাই। জলে গুলে সেটাই মুখের কাছে ধরল। মা-তুলি দুজনেই পাখির খাওয়া দেখছে। কিন্তু পাখিটা কিছুই খেল না।
মা বলল, “তোর যেমন বুদ্ধি! ওইটুকু পাখি কখনো নিজে খেতে পারে? যা, ঘর থেকে একটা ড্রপার নিয়ে আয়।”
তুলি একছুট্টে ড্রপার আনতেই টুকাই পাখিটার ঠোঁটটা ফাঁক করল আর মা ড্রপারে করে খাইয়ে দিল। বেশ খিদে পেয়েছিল বোঝা গেল। কুপ কুপ করে অনেকটা ছাতু খেল। আর জল খাওয়াতে গেলেই মুখটা ঘুরিয়ে নিল দুষ্টুমি করে। কিছুতেই খাবে না দুষ্টুটা।
এদিকে মুখেভাত তো হল, একটা নামকরণও সেরে ফেলতে হয়। তুলির মাথা থেকেই বের হল ‘তুয়া’ নামটা। টুকাইয়েরও এককথায় পছন্দ হয়ে গেল।
এবার ঘুম পাড়ানোর পালা। জুতোর বাক্সটাতেই আরো কিছু ফুটো করে তার মধ্যেই রাখা হল তুয়াকে। পায়ে দড়িটা বাঁধাই রইল। যদি বাক্স থেকে বেরিয়ে পড়ে তাহলে যাতে উড়ে পালাতে না পারে তার জন্য এই ব্যবস্থা। তারপর তুয়ার গলা-মাথায় ভালো করে হাত বুলিয়ে আদর করে গুড নাইট জানিয়ে বাক্স বন্ধ করে দিল টুকাই।
(২)
পরদিন সক্কাল বেলাতেই এক কাণ্ড। ঘুম থেকে উঠে টুকাই ছুটেছে তুয়াকে দেখতে। সারারাত বাক্সর মধ্যে ছিল, কেমন আছে কে জানে। অনেক বেলা হয়ে গেছে এখন। নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে ওর। ও তো আর টুকাইয়ের মতো কুম্ভকর্ণ নয়, অনেক ভোরে ওঠা অভ্যাস। জুতোর বাক্সটা খুলতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। তুয়া নেই! খোঁজ, খোঁজ।
“তু-লি-ই-ই!”
“কী হল দাভাই?”
“শিগগির আয়। তুয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
তন্নতন্ন করে খোঁজা হল ঘর, দালান, উঠোন, ছাদ সর্বত্র। কোত্থাও নেই। পায়ে দড়ি বাঁধা ছিল। তাছাড়া ও তো এখন খুব ছোটো। খুব ভালো করে উড়তেও শেখেনি। খুব উঁচুতে কোথাও উড়ে পালাতে পারবে বলে তো মনে হয় না। তাহলে? ঘরের মধ্যে কোনো বেড়াল আসেনি তো? অজানা আশঙ্কায় বুকটা ধক করে উঠল। সব জায়গায় খুঁজেও যখন কোথাও পাওয়া গেল না তখন… বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে উঠল টুকাইয়ের।
সব আশা যখন শেষ তখন বাথরুমে ঢুকতেই মহারাজের দেখা মিলল। চুপটি করে বাথরুমের এককোণে বসে আছে। কখন বাক্স থেকে বেরিয়ে বাথরুমে গেছে কে জানে।
খুব জোরে একটা ধমক লাগাল টুকাই। তারপর কোলে নিয়ে অনেক আদর করল। সকালে ব্রেকফাস্টে শুধু জলে গোলা ছাতু, মা তার সঙ্গে একটু কাঁচা লঙ্কা মিশিয়ে দিয়েছে। কাঁচা লঙ্কা খেলে নাকি পাখির বোল ফোটে তাড়াতাড়ি।
এদিন রবিবার। বাড়ি থেকে একটু দূরেই হাট বসে। বাবার সঙ্গে গিয়ে একটা সুন্দর খাঁচা কিনে আনল টুকাই। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি একটা ঘরের মতো দেখতে। বসার জন্য দুটো দাঁড়ও আছে। নতুন ঘর হল তুয়ার। ঘর পেয়ে বেজায় খুশি তুয়া। খোঁড়া পা নিয়েই পিড়িং পিড়িং করে একটু নেচে নিল ঘরের মধ্যে।
(৩)
নিতাইদার থেকে শালিকের অনেক গল্প শুনেছে টুকাই। শালিক একবার পোষ মেনে গেলে আর কোত্থাও যায় না বলেছে নিতাইদা।
“ওর কাছে যত থাকবি তত তাড়াতাড়ি ও পোষ মানবে। যা কথা বলবি সেটা শুনে শুনে ওর মুখে বোল ফুটবে।”
“সত্যি বলছ নিতাইদা?” টুকাইয়ের বিশ্বাস হয় না।
“সত্যি নয়তো কী? আমাদের পাশের বাড়ির একটা লোকের শালিক ছিল। সে লোকটা ছেলেকে কথায় কথায় হতচ্ছাড়া বলত, পাখিটা খুব সহজেই সেটা শিখে নিয়েছিল। ঘরে কোনো লোক এলেই বলত, ‘অ্যাই হতচ্ছাড়া!”
সেই শুনে টুকাইয়ের সে কী হিহি হাসি!
আরো অনেক গল্প বলেছে নিতাইদা। সেই পাখি সবসময় সে লোকের কাঁধে কাঁধে ঘুরে বেড়ায়। কোথাও গেলে কাছছাড়া করে না। সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
টুকাইও অনেক কিছু ভেবে নেয় মনে মনে। তুয়া আর কিছুদিন পর টুকাইয়ের কাঁধে চেপে স্কুলে যাবে। টিফিন টাইমে এসে টিফিন খেয়ে যাবে। তারপর সারাদিন গাছে গাছে ঘুরে বেড়াবে। স্কুল ছুটির পর আবার ওর কাঁধে চেপে বাড়ি ফিরবে। কখনো-বা ঘরে ফেরার ইচ্ছে হলে নিজেই উড়ে উড়ে বাড়ি গিয়ে মায়ের আদর, তুলির আদর খেয়ে আসবে। তুলির তো সেই মর্নিং স্কুল। সারাদিন বাড়িতেই থাকে। ওর সঙ্গে বকবক করেও বেশ সময় কাটবে তুলির। টুকাইয়ের কল্পনার পক্ষীরাজ ঘোড়া ছুটতেই থাকে, ছুটতেই থাকে।
হুঁশ ফিরতেই মায়ের গতকালের কথাটা মনে পড়ে গেল। মা বলেছিল, পাখিটার পা-টা খোঁড়া। গাছ থেকে পাড়তে গিয়ে নিশ্চয়ই কেউ ওর পা-টা ভেঙে ফেলেছিল। তাছাড়া টুকাই নিজেও দেখেছে, তুয়া ঠিকমতো বসতে পারছে না। নিতাইদাকে বললও সেকথা। নিতাইদা আশ্বস্ত করে বলল, “ওসব কিছু নয়। গতকাল সকাল থেকে ওর পায়ে দড়িটা বাঁধা ছিল বলে পা-টা অসাড় হয়ে গেছে। দড়িটা খুলে পায়ে একটু চুন লাগিয়ে দিস, ঠিক হয়ে যাবে।”
বাড়ি ফিরেই নিতাইদার বলে দেওয়া কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে টুকাই। সারাদিনের পর বাড়ি ফিরে তুয়ার সব কীর্তিকলাপ শুনেছে মায়ের মুখে। মাকে খুব ভালো চিনেছে তুয়া। মা খাঁচার কাছে যেতেই তুয়া ঠোঁট ফাঁক করে খাঁচার ধারে চলে এসেছে। অর্থাৎ, খেতে দাও। আর মাও প্রতিবারই কিছু না কিছু খাইয়েছে। তুয়াকে রাখার ব্যাপারে মায়েরই সবথেকে বেশি আপত্তি ছিল। অথচ মা-ই সারাক্ষণ দেখছে ওকে। স্নান করানো, খাওয়ানো, পটি পরিষ্কার করা—সব কাজ মা নিজের হাতে করছে। তুলিও মাঝে মাঝে তুয়ার ঘরের সামনে এসে আপনমনেই বকবক করে।
এইভাবে দিন কাটছিল। মাস দুয়েক হল। সেবাশুশ্রূষায় তুয়ার পা-টা এখন ঠিক হয়ে গেছে। একটু একটু উড়তেও শিখেছে। তবে খোলা জায়গায় এতদিন ছাড়ার ভরসা পায়নি টুকাই। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ থাকলে ঘরেই খেলা করে। উড়ে বেড়ায়। আলমারির মাথায় উঠে বসে। আবার খাওয়ার সময় ঠিক হাতে এসে খেয়ে যায়। এখন নিজে নিজে খেতেও শিখেছে। মুখের কাছে খাবার ধরলে টুকটুক করে খেয়ে নেয়—রুটি, মুড়ি, ভাত, ছাতু সব।
এদিন ছুটির দিন ছিল। টুকাইয়ের কী ইচ্ছা হল, তুয়াকে ছাদে নিয়ে গেল। এতদিন তো ও ঘরের বাইরে বের হয়নি। এখন একটু একটু করে আশেপাশের পরিবেশটাকে চেনানো দরকার। তা না হলে নিতাইদার বলা কথাগুলো কোনোদিন সত্যি হবে না। নিতাইদা বলেছিল, ‘পোষ মেনে গেলে তোর পাখি এমনিই গাছে গাছে ঘুরে বেড়াবে। আবার ঘরে এসে খেয়ে যাবে।’ আজ তারই পরীক্ষা যেন।
তুয়ার কাছাকাছিই আছে টুকাই। হাতে করে চাল ভিজিয়ে ওকে খাওয়াল। তুয়া খাচ্ছে, ছাদময় পায়চারি করছে, আবার এসে খেয়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর খোলা আকাশ। টুকাইয়ের আনন্দের সীমা নেই। ওর তুয়া উড়ে যাচ্ছে না কোথাও।
আচমকাই তুয়া উড়ে ছাদের পাঁচিলে গিয়ে বসল। টুকাই ছুটে যেতেই উড়ে পাশের বাড়ির কার্নিশে।
“তুয়া! অ্যাই তুয়া!” করে চিৎকার করছে টুকাই। “তুলি, শিগগির আয়, তুয়া উড়ে গেছে।”
পাগল পাগল অবস্থা টুকাইয়ের। ওদিকে কার্নিশে বসেই টুকাইয়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তুয়া। ফিরে আসবে কি না ভাবছে? নাকি দুষ্টুমি করার জন্য আরো একটু দূরে উড়ে যাবে ভাবছে? আচমকা কোথা থেকে একটা হতচ্ছাড়া কাক এসে তুয়াকে ঠোঁটের মধ্যে তুলে নিল। টুকাইয়ের পা থেকে মাটি সরে গেল যেন। তুয়ার চিৎকার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে টুকাই। তুয়া বলতে চাইছে, ‘আমাকে বাঁচাও!’ এখনই কাকটা আস্ত খেয়ে ফেলবে তুয়াকে আর তা না হলে ঠুকরে ঠুকরে মারবে। না, আর কিছু ভাবতে পারছে না টুকাই।
পাগলের মতো চিৎকার করছে টুকাই। ওদিকে কাকটারও ছাড়ার কোনো লক্ষণ নেই। আচমকাই টুকাই ছাদের মধ্যে পড়ে থাকা একটা মাটির ভাঙা টুকরো ছুড়ে মারল কাকটাকে লক্ষ্য করে। সোজা গিয়ে কাকটার গায়ে লাগতেই তুয়াকে ছেড়ে দিল। ছেড়ে তো দিল, কিন্তু মুখের গ্রাস এইভাবে হুট করে পালিয়ে যাবে কাকটা ভাবতেও পারেনি। তুয়া প্রাণভয়ে উড়ছে, পিছনে কাকটাও কা-কা করে চিৎকার করে ওকে ধরতে ছুটছে। চিৎকার শুনে আশেপাশের আরো কাক ছুটে এসে তুয়াকে ধরতে আসছে।
অসহায় টুকাই ছাদের মধ্যে ‘তুয়া তুয়া’ করে চিৎকার করে যাচ্ছে। ওর আর্তনাদ খোলা আকাশের অনেক দূর অবধি ছড়িয়ে পড়ছে। টুকাই দেখছে ওর ছোট্ট তুয়া বাজপাখির বেগে উড়ে যাচ্ছে। পিছনে তিন-চারটে কাকও ওর পিছু নিয়েছে। উড়তে উড়তে তুয়া ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখছে টুকাই। দূরে, দূরে, আরো দূরে যেতে যেতে তুয়া একসময় বটগাছের মাথা ছাড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। বুকের ভেতরটা উথালপাতাল করে উঠল টুকাইয়ের। ওর আদরের ছোট্ট তুয়া হারিয়েই গেল।
কাঁদছে, কাঁদছে, বুকের সমস্ত আগল খুলে কাঁদছে টুকাই। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যে এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটে যাবে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি টুকাই। তুয়া আর কোনোদিন ওর কাছে ফিরবে না, ওর হাতে খাবে না, ওর কাঁধে বসবে না ভাবতে ভাবতেই টুকাইয়ের চোখদুটো জলে টলমল করে উঠল।
(৪)
খাঁচাটা বারান্দায় ঝোলানোই ছিল। খাঁচা তো নয়, ওটা তুয়ার ঘর। ঘর চিনে যদি কোনোদিন আবার ফিরে আসে, এই আশায়। ফেরেনি। ফেরার কথাও নয়। যে একবার চলে যায় সে কি কখনো ফিরে আসে?
তুয়া চলে যাওয়ার পর টুকাই কিছু খেতে পারেনি সেদিন। রাত-দিন শুধু কেঁদেছে। তুয়া কি সেটা জানে? ওর ভালোবাসা বুঝতে পারলে নিশ্চয়ই ফিরে আসত। ফিরে যখন আসেনি তখন ওর ভালোবাসা একটুও বোঝেনি তুয়া। পরক্ষণেই টুকাই ভেবেছে, ফিরে আসবেই বা কী করে? রাস্তাঘাট, পরিবেশ সবই তো তুয়ার অচেনা। ফিরে আসতে চাইলেও পথ চিনে ফিরতে পারবে না। তাছাড়া তুয়া আদৌ বেঁচে আছে কি না কে জানে? রাক্ষুসে কাকগুলো হয়তো তুয়াকে মেরেই ফেলেছে। না, আর কিছু ভাবতে পারে না টুকাই। ভাবতে গেলেই চোখদুটো জলে ভরে আসে।
নিতাইদা বলেছিল, তুয়া বেঁচে থাকবে। ও তো খুব ছোটো নয়। উড়তেও শিখে গেছিল। নতুন পরিবেশে পাখিদের মধ্যে ঠিক নিজের আস্তানা খুঁজে নেবে। তাছাড়া ও বুঝে গেছে কে ওর শত্রু আর কে বন্ধু। তাই কাকেদের থেকে দুরত্ব রেখেই চলবে। এসব কথা সত্যি, না টুকাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কে জানে। তবু মনে মনে নিতাইদার কথাগুলো বিশ্বাস করেছে আর ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছে, তুয়াকে ভালো রেখো।
বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা।
সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় আসতেই টুকাইয়ের চোখদুটো ছানাবড়া। বারান্দার রেলিংয়ে তুয়া বসে।
“মা, দ্যাখো কে এসেছে! তু-লি-ই-ই, জলদি আয়।”
মা-তুলি দুজনেই অবাক। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে। কেউই খেয়াল করেনি, একটু দূরে আরো একটা শালিক বসে রয়েছে। তুয়া কিচিক করে ডাকতেই সেও এসে বারান্দায় বসল।
“ওমা! তুয়া বিয়ে করেছে! নতুন বউ নিয়ে এসেছে!”
টুকাই দেখছে খুশিতে মার আর তুলির চোখদুটো চিকচিক করছে। টুকাইয়ের দিকে তাকিয়ে মা বলল, “দুজনের পক্ষে ঘরটা অনেক ছোটো হয়ে যাবে।”
“আমি কালই একটা বড়ো খাঁচা নিয়ে আসব যাতে দুজনের থাকতে কোনো অসুবিধা না হয়।”
মা বাধা দিয়ে বলল, “কোনো দরকার নেই। এই ঘরটা চিনেই তুয়া ফিরে এসেছে। এটাই থাকুক। শুধু খাঁচার দরজাটা খোলা রাখিস সবসময়। তাহলে এই ঘরটাই অনেক বড়ো লাগবে।”
অলঙ্করণ: শিমূল সরকার
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস