টাইম মেশিন-বাংলার বাঘ ও ডাকাত-সুনীতি দেবী। অনুবাদ শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়-শরৎ২০২১

আগের এপিসোড- ঝিয়ের গল্প

ডাকাতের কবলে

timemachine78

১৯১৬ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় রানী সুনীতিদেবীর বেঙ্গল ডেকয়েটস অ্যান্ড টাইগারস। বইটি ইংরিজি ভাষায় লেখা হয়েছিল। সুনীতিদেবী ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেন-এর মেয়ে। ১৮৬৪ সালে তাঁর জন্ম হয়। ১৮৭৮ সালে কুচবিহারের রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ-এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। শিক্ষা ও নারীর অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সারাজীবন কাজ করেছেন রানী সুনীতিদেবী। ১৯৩২ সালে রাঁচিতে তার মৃত্যু হয়। এবারে জয়ঢাকের পাতায় তাঁর বইটির বঙ্গানুবাদ শুরু হল। প্রতি সংখ্যায় প্রকাশিত হবে একটি করে গল্প।

timemachine78

খুব বেশিদিন আগেকার কথা নয়, একজন বিবাহিতা তরুণী, একাই পথে বেরিয়েছিল। ভারতে তরুণী মেয়েদের, তা সে বিবাহিত হলেও, একলা বাইরে বেরোনোটা রীতিবিরুদ্ধ। পর্দাপ্রথার কারণে তাদের সে স্বাধীনতা নেই। পালকি করে সামান্য দূরত্ব হোক কিংবা গাড়ি চেপে হাওয়া খাওয়াই হোক, একজন সহচরী চাইই।

তবু এমনটা তো হতেই পারে যে মেয়েটিকে বাইরে বেরোতেই হবে আর সেসময় এমন কাউকে পাওয়াই গেল না বা বাড়ির সদস্য কাউকে ছাড়া গেল না যে সঙ্গে যেতে পারে। তখন অগত্যা চাকরবাকরদের সঙ্গে যেতে হয়। শুনতে আশ্চর্য লাগতে পারে যে তরুণী মেয়েদের চাকরদের সঙ্গে একা একা যেতে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে কী করে! কিন্তু যে পাঠকেরা ভারতবর্ষকে জানেন, অবাক হবেন না মোটেই, কেননা তাঁরা জানেন পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় বাড়ির কাজের লোকেরা ঠিক কতখানি বিশ্বস্ত, বিশেষ করে যারা পুরুষানুক্রমে কোনো বাড়িতে কাজ করছেন। এমনকি ঠিকে কাজের লোকটিও, যখন পরিবারের চেনাজানা হয়ে যায়, তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা চলে, যেমন এই গল্পের গাড়িচালক।

সেদিন তরুণী মেয়েটি বাপ মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চলেছে তার বাপের বাড়ি। ভারতীয় সমাজে শ্বশুর শাশুড়ি তাদের বৌমার বাপের বাড়িতে দেখা করতে যায় না, ফলে বৌমা তার পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে একলাই চলেছে।

দূরত্ব বেশি নয়, কলকাতা থেকে দুর্গাপুর, শহর থেকে কয়েক মাইল দূরের একখানা গ্রাম। ফলে একটা ছ্যাকরা গাড়ি ভাড়া করতে হল চালক-সমেত, এই চালক লোকটিকে মেয়েটির শ্বশুর আগেও বহুবার কাজে বহাল করেছেন, ফলে সকলেই নিশ্চিন্ত – বৌমা ঠিকঠাক নিরাপদে পৌঁছে যাবে।

শাশুড়ি গাড়িতে তুলে দিতে এলেন। ছোটো ছেলেটাকে মায়ের পাশে তুলে দিয়ে চালককে পই পই করে বলা দেওয়া হল সাবধানে গাড়ি চালাতে; দেখেশুনে, বেশি জোরে যেন না চালানো হয়, ইত্যাদি নানা উপদেশের মাঝেই ড্রাইভার ঘোড়াতে চাবুক কষিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল।

বৌমা রাস্তাঘাট ভালোমতোই চিনত। বিয়ের পর প্রথম প্রথম প্রায়ই সে এই রাস্তায় যাতায়াত করেছে, এমনকি খোকা হবার পরও সে বাপের বাড়িতে ঘনঘনই যেত।

গাড়িটা বদ্ধ; সিল্কের শাড়ি পড়ে মেয়েটির বেশ গরম লাগছিল বলে সে খড়খড়ি ফাঁক করে মাঝে মাঝে আলগা চোখে বাইরের পরিচিত দৃশ্য দেখছিল। সকাল সকাল বেরোনো হয়েছে যাতে দিনে দিনেই যাত্রা শেষ হয়, বেলা গড়িয়েছে কিন্তু তখনো বাড়ি পৌঁছতে ঢের দেরি। যেতে যেতে মেয়েটি বেশ কিছু গাছপালা ঝোপঝাড় খেয়াল করে কেমন হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। সে ভাবল নিশ্চিত এটা অন্য রাস্তা। লাল বলের মতো সোনালি সূর্যটা ওদিকে মেঘের আস্তরের মধ্যে দিয়ে ডুবতে বসেছে, তবু তো তারা এখনো গন্তব্যে পৌঁছোলো না! বৌমা এবারে অজানা বিপদের আঁচ পেল।

গাড়িটা হঠাৎ বাঁক নিল। ভয়ের চোটে মেয়েটি দেখল যে তারা এবারে একটা এবরোখেবড়ো কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলেছে, দুধারে ধানখেত। জায়গাটা শুনশান, লোকজন নেই। দ্রুত সন্ধ্যা নেমে আসছে; ভারতে সূর্য ডুবে যাওয়ার পর রাত্রি আসতে বেশি দেরিটেরি হয় না। অশুভ কোনো কিছু ঘটার আশংকা চেপে বসল বৌমার বুকে। সে তার ছোটো ছেলেটাকে ফিসফিস করে বলল, চালক দাদাকে জিজ্ঞাসা কর আমরা কোথায়, আর কতক্ষণই বা লাগবে পৌঁছোতে। ভারতে মেয়েদের কেবল বাপ ভাই কিংবা স্বামী ছাড়া পরপুরুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার উপায় নেই।

তো ছোটো ছেলেটি মায়ের কথা শুনল, জিজ্ঞাসাও করল, কিন্তু চালক কোনো উত্তর দিল না।

“ আবার শুধো।” মা ফিসফিস করে বলল, “হয়তো তোর কথা শুনতে পায়নি।”

ছেলেটি আবার জিজ্ঞাসা করল, বার বার জিজ্ঞাসা করেই চলল, “হ্যাঁগো, আমরা কখন পৌঁছোব?”

কিন্তু চালক কোনো জবাবই দিল না।

বৌমা এবারে প্রমাদ গণেছে, সে গাড়ির জানালাগুলো ধাক্কাতে লাগল আর ছেলেকে বলল, তুই জোরে জোরে চ্যাঁচা। ছেলেটা গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে শুরু করল, “তুমি জবাব দিচ্ছ না কেন? এটা কোন রাস্তা?”

চালক এইবার খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দিল, “শিগগিরই বুঝবি কোথায় যাচ্ছিস।” বলেই বিশ্রিরকম হেসে উঠল।

ওর অভদ্র, ঠেঁটা আর পাশকাটানো জবাবে বৌমার চরম আশঙ্কাটাই সত্যি হল। মনের মধ্যে ভয়ানক “ডাকাত” শব্দটা জ্বলজ্বল করে উঠল। ভয়ে আতঙ্কে ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে এল। ছেলেটাকে কোলের কাছে টেনে এনে, মুখে হাত চাপা দিয়ে চুপ করতে বলল সে, “কথা বলিসনি!” কী বিপদ যে আছে কপালে তাই ভাবতে লাগল মেয়েটি।

এবড়োখেবরো রাস্তা দিয়ে লাফাতে লাফাতে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চলেছে গাড়ি। একসময় সেটা থামল। এদিকে প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। গাড়ির দরজাটা খুলে গেল, আর একটা কর্কশকণ্ঠ বলে উঠল, “নেমে আয়, গাড়ি থেকে।” বৌমা চিনতে পারল, ওটা চালকেরই গলা। প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই, তাই একটিও কথা না বাড়িয়ে সে নেমে এল, ছেলেকেও নামিয়ে আনল গাড়ি থেকে।

আবার হুকুম হল, “পেছন পেছন আয়।”

নিঃশব্দে তাই করল মেয়েটি। লোকটা রাস্তা ছেড়ে ওকে খানিকটা দূরে গাছপালার আড়ালে নিয়ে গেল।

“গয়নাগুলো খুলে দে।”

মেয়েটির বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। তাড়াতাড়ি গলার নেকলেসটা খুলে সে বাড়িয়ে ধরল। লোকটা লোভীর মতো এক হাতে ওটা নিয়ে আরেক হাত বাড়ালো আরো গয়নার জন্য। এক এক করে মেয়েটি ওর হাত থেকে সুন্দর সুন্দর ব্রেসলেট আর চুড়ি খুলে খুলে লোকটার হাতে তুলে দিতে লাগল।

“আর কই?” লোকটা খেঁকিয়ে উঠল।

মেয়েটি হাতের আংটি, কানের দুল, নাকের নথ সব খুলে দিল।

“কোমরের বিছেটা,” লোকটা আবার কিড়মিড় করে উঠল।

মেয়েটি কোমর থেকে খুলে ভারী সোনার বিছেটা লোভি লোকটার হাতে তুলে দিল।

“নূপুরটা খোল, সবকিছু চাই আমার।” খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল লোকটা। 

মেয়েটি হাঁটু মুড়ে বসে নূপুরদুটো খুলে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার হাতে তুলে দিয়ে ভাবতে লাগল, এবারে কী? আর কী চাই ওর।

এরই মধ্যে বাচ্চাটা চিলচিৎকারে কাঁদছিল আর মায়ের গয়না নিয়ে নিয়েছে বলে চালকটাকে শাপ-শাপান্ত করছিল, চোর, ডাকাত এইসব বলে।

“হ্যাঁ রে, আমি ডাকাত।” বদমাইশটা ছেলেটার গালাগালির উত্তরে বলে উঠল, “আর তুই যদি না থামিস, তোকে শেখাব কী করে চুপ করতে হয়।”

তাই শুনে ভয় পেয়ে বৌমা খুব করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছেলেকে শান্ত করল, তাকে চুপ করাল, এই বলে, “ভাবিস না! তোর বাপ আমাকে আরো অনেক ভালো ভালো সোনার গয়না গড়িয়ে দেবে।”

পরের সাংঘাতিক হুকুমটা এল, “শাড়িটা খুলে দে।”

শুনেই বাচ্চা ছেলেটা রাগের চোটে আবার জ্বলে উঠল। মেয়েটি এবারে এক পা এগিয়ে এসে বলল, “গয়নাগুলো নিয়ে শান্তি হয়নি তোমার, এবারে শাড়িটাও খুলে নিতে চাও?”

“ওই, তোর শাড়ি আর যা যা আছে সব চাই রে। আর ছেলেটাকে চুপ করা নইলে ওকে এখানেই মেরে ফেলব আমি।” লোকটার ভয়ানক রূঢ় কথাগুলোয়, মনে হচ্ছিল ও ঠিক করেই ফেলেছে কী করবে। বৌমা ভয়ে স্থির হয়ে গেল। অনুনয় বিনয়ে আর কোনো লাভ নেই। সে তার বহুমূল্য কাজকরা সিল্কের শাড়িটা পাকে পাকে খুলে ফেলল গা থেকে, খুলে নেবার পর সোনাদানা আর সবুজ শাড়িখানা লোকটার পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে বলল, “এই নে।”

“তুই আমার মায়ের গা থেকে শাড়ি খুলিয়ে নিয়েছিস!” বাচ্চা ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠল।

বদমাশটা শাড়িটা নিয়ে ভীষণ একটা দিব্যি গেলে ছেলেটার দিকে ফিরে বলল, “এইবারে তোকে দেখাচ্ছি। ওই পাঁজা থেকে একটা ইঁট এনে তোর ভবলীলা এখুনি সাঙ্গ করছি।” এই বলে সে শাড়ির মধ্যে গয়নাগুলো বাঁধতে বাঁধতে চলে গেল। মেয়েটি আর নিতে পারছিল না, তার হাত পা ছেড়ে দিয়েছিল, ভয়ে দুঃখে সে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল। তাদের দুজনের কান্না বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে থাকল। কিন্তু ডাকাতটা ফিরে এল না।

অনেক রাতে গ্রামের চৌকিদার পাহারা দিতে বেরিয়ে তাদের কান্না শুনতে পেল। প্রথম চোটে সে অত কান দেয়নি তাতে। গ্রামে রাত্তিরবেলা শেয়ালটেয়াল এসে অমন উপদ্রব করে। আবার কান্নাটা শোনা গেল, কেঁপে কেঁপে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল সেটা। মানুষেরই আওয়াজ তো। চৌকিদার দাঁড়িয়ে পড়ল, কান পেতে শুনল। কান্নাটা আবার শোনা গেল। এইবারে সে আওয়াজ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। যত এগোয়, চিৎকারটা তত জোরে হয়, পরিষ্কার বিপদে পড়ার আওয়াজ, আর এবারে সে বুঝতে পারল, ওটা একটা বাচ্চা আর একজন মহিলার গলা। সে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছোল। লন্ঠনের আলোয় চৌকিদার দেখে কি, মা আর ছেলে একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদছে।

“তোমরা কারা গা? কী হয়েছে তোমাদের?” সে জিজ্ঞাসা করে।

অভাগী মা সময়ের হিসেব টিসেব ভুলে গিয়েছিল, সে ভাবল সেই পাষণ্ড ডাকাতটা ফিরে এসেছে, এইবারে তার ছেলেটাকে মেরে ফেলবে; সে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে তার পায়ে পড়ে বলল, “আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও গো, তার বদলে আমার প্রাণ নাও।”

“আরে আ হা হা হল কী? আমি চৌকিদার গো।”

কিন্তু ভয়ে, বেদনায় মেয়েটির এমন অবস্থা যে সেকথা তার কানে ঢুকল না, ফলে চৌকিদারকে আবার বলতে হল। চৌকিদারের কথাটা যখন মেয়েটি ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারল, অমনি সে কান্নায় ভেঙে পড়ল, “ওগো! আমার ছেলেটাকে বাঁচাও।” বিপদ কেটেছে একথা বুঝে তার সম্বিত ফিরেছিল, তার নিজের লজ্জা আর দুর্দশার কথাও মনে এল; সে বলল, “কিছু একটা যা হোক পরবার মতো দাও।”

চৌকিদার মেয়েটির হাল দেখতে পেয়েছিল। সে তার পাগড়িটা মেয়েটির পায়ের সামনে খুলে দিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়াল। পাগড়ির পাক খুলে টানটান করে নিয়ে সেইটেই গায়ে জড়িয়ে নিল মেয়েটি। এইবারে সে সবকথা খুলে বলল, আর লুটেরাটা কোনদিকে গেছে সেদিকটাও দেখিয়ে দিল।

তখন চৌকিদার একহাতে লন্ঠন উঁচিয়ে এবং আরেক হাতে শক্ত করে লাঠিটা বাগিয়ে ধরে এক পা এক পা করে সেইদিকে এগোল। কয়েকগজ দূরে একটা পুরোনো ইঁটের ভাঁটি। এইখানে ভাঙাচোরা ইটের পাঁজার মধ্যে হতভাগা ডাকাতটা তার শিকারের চেয়েও বেশি দুর্দশায় পড়েছিল। একটা বিশাল কেউটে সাপ ব্যাটার ডান হাত পাকে পাকে জড়িয়ে বসেছিল, আর ওর বাঁহাতে শাড়ি আর গয়নাগুলো ঝুলছিল। লণ্ঠনের আলো পড়ায় সাপটা এবারে নড়ে উঠল এবং রেগে গিয়ে ফোঁস ফোঁস করে উঠে পাক খুলে পালিয়ে গেল। ডাকাতটার ততক্ষণে সাপের মরণ-কামড়ের ভয়ে আধমরা অবস্থা। ওকে সহজেই বন্দি করা গেল। ক্রমে একে একে ওদের গোটা দলটাকেই পাকড়াও করা গেল, দেখা গেল ব্যাটাদের সবকটাই  ছ্যাকরাগাড়ির চালক।

জয়ঢাকের টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s