টাইম মেশিন-বাংলার বাঘ ও ডাকাত -প্রাণ বাঁচাল ভালুকে-সুনীতি দেবী। অনুবাদ শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়-শীত২০২১

আগের এপিসোড- ঝিয়ের গল্প্‌ ডাকাতের কবলে

timemachine79

হুগলি নদীতে সন্ধ্যা নামছিল। চারপাশটা ক্রমশ নিস্তব্ধ হয়ে আসছে, ঠিক সে-সময় এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ নদীর কোনও একটা ঘাটমুখো রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছিল।

সারাদিন কলকাতা থেকে যে ডিঙিগুলো লোকজন নিয়ে যাতায়াত করেছে সেগুলো এখন রাতের মতো পাড়ে বাঁধা। কয়েকজন নৌকোর মাঝি রাতের রান্নাবান্না করছিল, বাকিরা ছইয়ের বাইরে বসে হুঁকো টানছিল আর গান গাইছিল। সবক’টা নৌকো পাড়ের কাছে এনে একসঙ্গে পরপর বেঁধে রাখা। কিন্তু একখানা নৌকো এদের থেকে আলাদা হয়ে একটু দূরে জলে ভাসছিল। নৌকোর মাঝি গলুইতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছইয়ের বেড়ার ছাউনি ঠিক করছিল। সে আলগোছে তাকিয়ে দেখল ব্রাহ্মণ পাড় ধরে নামছে। বামুনের চাদরের তলা দিয়ে একটা পোঁটলা উঁকি দিচ্ছে, আর বামুন সেটাকে এমন জাপটে আছে, যে সেটা নির্ঘাত দামি জিনিস, নজর করে দেখে ভাবল মাঝি। বামুন কাছাকাছি এলে মাঝি বুঝল ওটা একটা টাকার থলে।

বৃদ্ধ লোকটা পাড় ধরে নীচে নেমে এসে একের পর এক নৌকোকে শুধোয় যাবে কি না, সে উলটোদিকে শ্রীরামপুর গ্রামে ফিরতে চায়। তখন তো আর রেলগাড়ি ছিল না। কেউই অতদূর যেতে রাজি হল না। এরই মধ্যে দূরের নৌকোটার মাঝি আর তার ধারি ফিসফিস করে পরামর্শ করছিল। বামুন যখন শেষে তাদের সঙ্গে দরদাম করতে গেল, তারা প্রথমে অনিচ্ছার ভাব করল আর তারপর ভাবখানা এমন করল যেন একরকম নিমরাজি হল ভাড়ায় যেতে।

নৌকোটা প্রায় ছেড়ে দেয় দেয় এমন সময় এক মাদারি তার ভালুকটাকে নিয়ে পাড় ধরে হুড়মুড় করে দৌড়ে নেমে এল। “হ্যাঁ গো! তোমরা কোথায় যাচ্ছ?” সে জিজ্ঞাসা করে।

মাঝি কিছু বলার আগেই ব্রাহ্মণ বলে ওঠে, “শ্রীরামপুর।”

“আমার বাড়ি ওই কাছেই।” লোকটা খুশি হয়ে বলে। বলেই লাফ দিয়ে নৌকোয় চড়ে বসে, পেছন পেছন ভালুকটাকেও তুলে নেয়।

মাঝি রেগে যায়। সে গলা তুলে বলে, “নামো, নেমে যাও, আমরা অদ্দুর যাব না।”

কিন্তু সে-লোক আর নামে না। মাঝি আবার তাকে শাসায়। বলে, জোর করে নৌকোয় উঠে তার আর তার ভালুকের কিছুই লাভ হবে না।

লোকটি বামুনের দিকে চেয়ে বলে, “এ মাঝিগুলো আজব চিড়িয়া বটে।” তারপর হেসে ফেলে মাঝিদের দিকে ফিরে বলে, “লাভ হবে না! হে হে, কেন রে বাপু! বাড়ি পৌঁছোব না?”

“তাই বলো!” তারা উত্তর করে।

মাদারি মনে মনে ভারি অবাক হয়। এ মাঝিগুলো তাকে নৌকোয় নিতে এত আপত্তি করছিল কেন? বুড়ো বামুনের সঙ্গে তার একটা দুটো কথা হয়। তারপর দুজনেই চুপ করে থাকে।

নৌকো এদিকে ক্রমে প্রায় তীরের কাছে এসে গেছে, এমন সময় মাদারি হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, “অ মাঝি, শ্রীরামপুর পেরিয়ে গেল না?”

“তুমি কে হে আমার গুরুঠাকুর, যে আমায় জিজ্ঞাসা করো?” মাঝি ঝাঁঝিয়ে ওঠে। আর তারপরেই কথাটা সামাল দিতে একটু নরম হয়ে বলে, “একটু উজানে গিয়ে পার হব, এদিকে স্রোতের খুব টান।”

ব্যাখ্যাটা যথাযথ। তবুও মাদারির মনের সন্দেহ গেল না, সে সতর্ক হয়ে রইল।

ব্রাহ্মণ শান্তভাবে তার থলেটা আঁকড়ে বসে ছিল। মাদারিও খেয়াল করেছিল ওতে টাকা আছে। মাদারি দেখছিল, মাঝিও আড়ে আড়ে বামুন আর তার থলের দিকে নজর করছে।

নদী পার করে নৌকো একসময় তীরে ভিড়ল। নৌকো পুরোপুরি থামতেই মাঝিদের একজন নৌকোর দড়ি হাতে লাফ দিয়ে পাড়ে নেমে একটা গাছের সঙ্গে সেটা বেঁধে ফেলল। ব্রাহ্মণ আর মাদারি একসঙ্গেই বলে উঠল, “কী হল গো? এখানে এই অদ্ভুত জায়গায় নৌকো থামালে যে?”

“শিগগিরই জানতে পাবে। শিগগিরই দেখতেও পাবে।” চিবিয়ে চিবিয়ে কথাক’টা বলতে বলতে মাঝি আর সাঙ্গপাঙ্গরা এ-ওর পেছন পেছন পাড়ে নেমেই ধা হয়ে গেল।

বয়স্ক ব্রাহ্মণ উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল ওদের যাওয়া। তারপর নিজের থলেটা দু-হাঁটুর মধ্যে রেখে নৌকোর বাতার ওপর পা মুড়ে বসে দু-হাত জড়ো করে উপুড় হয়ে প্রার্থনা শুরু করে দিল।

মাদারি মনে মনে ভাবল, বামুন প্রার্থনায় থাক, আমায় কাজে নামতে হবে। সে ফিসফিস করে ব্রাহ্মণকে বলল, “অ বামুনঠাকুর, কিছু একটা ঘোঁট পাকাচ্ছে। আমি একবার দেখে আসি।” এই বলে সেও তীরে নামল।

গাছটা থেকে বেশি দূর যেতে হয়নি, দেখে কী, একখানা খোড়ো চালার পেছনে অনেকগুলো মানুষ জড়ো হয়েছে। ভয়ে ভয়ে সে আরও খানিকটা এগিয়ে দেখে। দলটার মধ্যে নৌকোর মাঝিকে সে এবারে চিনতে পারল। ‘ডাকাত!’ মনে মনেই বললে সে। কোত্থেকে তার মনে হঠাৎ বিপুল সাহস এল। সে ফের দৌড়ে নৌকোয় ফিরে এল। বামুনঠাকুরকে বলল, সে যেন পেছনের হালে গিয়ে বসে আর মাদারি ইশারা করলেই যেন নৌকো ছেড়ে দেয়। মাদারি নিজে গিয়ে গলুইতে বসে ভালুকটাকে আদর করতে থাকল।

কয়েক মিনিট বাদেই সেই লোকগুলি উদয় হল। তারা ডিঙির দিকেই আসছে। ওদের মধ্যেই মাঝিরা কয়েকজন, সবক’টাই ডাকাত।

মাদারি ভালুকের দড়িটা খুলে দিয়ে বলে উঠল, “যা যা, যা ব্যাটা, গিয়ে ধর ওদের!”

তালিম পাওয়া জানোয়ারটা তার মালিকের আদেশ পেয়েই ডাকাত দলের দিকে ভীষণ বেগে ধেয়ে গেল। দলটা অমনি ভয়ের চোটে যে যেদিকে পারল এদিক সেদিক ছুটে পালাল।

লোকগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে এ-বিষয়ে নিশ্চিত হতেই মাদারি ভালুকটাকে নৌকোয় ডেকে নিয়ে তার গলার দড়িটা আটকে পাড় থেকে নৌকো ঠেলে দিল। তারপর অতিকষ্টে  ব্রাহ্মণ আর মাদারি মিলে নৌকো বেয়ে কলকাতায় ফিরে পুলিশে খবর দিল। পুলিশ ডিঙিটাকে বাজেয়াপ্ত করল। দেখা গেল সেটা ডাকাতদেরই নৌকো, ভেতরে ডাকাতি আর খুন-জখম করার যাবতীয় জিনিসপত্রই মজুত করে রাখা। কিন্তু ডাকাতদলের কেউই আর ধরা পড়েনি।

সে-যাত্রা ব্রাহ্মণ আর মাদারি, দুজনেরই জীবন ওই বুদ্ধিমান ভালুকটার জন্য বেঁচে গিয়েছিল।

জয়ঢাকের টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s