সন্দীপ মিত্রের আগের লেখা- ভয়ংকর সুন্দর মার্চিসন ফলস ন্যাশনাল পার্ক

বাংলার ইতিহাসে একটা সময় ছিল, যখন নবাবি আমল শেষ হতে চলেছে, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব পাকাপাকি ভাবে কায়েম হয়নি। এইধরণের সন্ধিক্ষণে সব দেশেই অস্থিরতা, অরাজকতা দেখা দেয়। মোটামুটি ১৮৪১ থেকে ১৮৫৭র প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে মহারানি ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার নিজের হাতে নেওয়ার আগে পর্যন্ত আমাদের বাংলাতেও এইরকম অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল। তারই সুযোগ নিয়ে সর্বত্র গজিয়ে উঠেছিল ছোট বড়ো ডাকাতের দল ।
লাঠি সড়কি বল্লম নিয়ে, মুখে কালি-ঝুলি মেখে এই ডাকাতেরা অবস্থাপন্ন গৃহস্থ থেকে শুরু করে ছোটখাটো জমিদারদেরও রেহাই দিত না। শোনা যায় এদের অনেকে রীতিমতো আগাম নোটিশ দিয়ে ডাকাতি করতে আসত। কেউ কেউ আবার গল্পের রবিনহুডের মতো ধনীর কাছ থেকে লুঠ করা সম্পদ গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিত। বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসের ভবানী পাঠকের কাহিনী মোটেও গল্পকথা নয়।
যে ডাকাতের দল যত বড়ো, যে যত সাহসী তার তত নামডাক ছিল। এই ডাকাত সর্দারদের মধ্যে রঘু ডাকাত, বিশু ডাকাত, চিতু ডাকাতদের নাম এখন ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। অনেক পন্ডিতদের মতে, কলকাতার চিৎপুর রোডের একেবারে শেষ প্রান্তে যে কালীমন্দির আছে, চিতু ডাকাতের নামেই তাঁর নাম “চিত্তেশ্বরী কালী মন্দির।”
এই ডাকাত সর্দারদের মধ্যে রঘু ডাকাতের এলাকা ছিল নদীয়া জেলা জুড়ে। সেযুগের নদীয়া ছিল অনেক বড়ো – আজকের বাংলাদেশে” কুষ্টিয়া, চূয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ইত্যাদি এলাকা ছিল নদীয়া জেলার অংশ। আজও দেখা যায় কুষ্টিয়ার অনেক পুরনো অফিস বাড়ির গায়ে লেখা, ‘সদর কৃষ্ণ নগর, নদীয়া।’ রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত শিলাইদহ কুঠিবাড়িও কুষ্টিয়াতেই। সম্ভবত ঐ অঞ্চলের কোনো এক ‘বুড়ো মোহন সর্দার’-এর কাছে শিশু রবি রঘু ডাকাতের গল্প শুনেছিলেন, এবং পরে তাঁর ‘পিলসুজের উপর পিতলের প্রদীপ’ কবিতায় তাকে অমর করে গেছেন । আজ আমার শোনা রঘু ডাকাতের একটা গল্প বলব।
গল্পটা শোনা আমার বৃদ্ধা দিদিমার মুখে, এবং আমার মামার বাড়ির সঙ্গে এই গল্পের ছিল প্রত্যক্ষ যোগ। তাই সেই বাড়িটার কথা একটু বলতেই হয়।
নদীয়ার জেলা সদর কৃষ্ণনগরকে আমরা বলতাম কেষ্টনগর। সেই কেষ্টনগরে রেলস্টেশনের কাছেই আছে এক প্রাচীন দেবীমন্দির – আনন্দময়ীতলা। আনন্দময়ীতলার ঠিক উল্টোদিকে একটা খোয়ার রাস্তা ছিল যেটা ছিল রাজবাড়ির ‘গড়’ বা পরিখার পাশ দিয়ে দুটো বড়োবড়ো দিঘীর ধার দিয়ে স্টেশনে যাবার শর্টকাট পথ। আর ঐ গড়ের ধারেই ছিল আমার মামার বাড়ি। স্টেশনে সাইকেল রিকশায় উঠে আমরা বলতাম, “আনন্দময়ীতলা সেনপাড়া যাব।”
বাড়িটা ছিল খুব বড়ো । দুপাশে দুটো বাগান – কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, সুপুরি আর নারকোল গাছ ছাড়াও ছিল নানারকম ফুলের গাছ। বাইরের বৈঠকখানাটা ছিল একতলা আর ভিতর বাড়িটা দোতলা। মধ্যিখানে একটা চৌকোনা উঠোন, একটা বাঁধানো ইঁদারা আর মস্ত এক আমগাছ। ইঁদারার জলতোলার কপিকলটার উপর ছিল আমার বিশেষ টান। আমি এই বাড়িতে শেষ গিয়েছিলাম প্রায় চল্লিশ বছর আগে। তারপর বাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। এখন বোধহয় সে জায়গায় অন্য বাড়িঘর উঠেছে।
গরমের ছুটিতে মামা-মাসীমাদের ছেলে মেয়েরা আর আমরা হাজির হতাম বাড়ি সরগরম করতে। তোমাদের মতো আমাদের সময়ে এত পড়ার চাপ ছিলনা। সারা মাসের ‘ছুটির কাজ’ এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ করে কবে যে খুব ভোরে শিয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠব সেদিকে তাকিয়ে থাকতাম। রাণাঘাটের পর চূর্ণী নদীর পুল এলেই আমরা আর বসে থাকতে পারতাম না – মাঝে তো মাত্র দুটো স্টেশন ।
অত বড়ো বাড়িতে বছরভর থাকত মাত্র তিনটি প্রাণী – বিধবা দিদিভাই, বড়োদাদু (আমার মায়ের জ্যাঠামশাই) আর একজন রান্না করার বিধবা মহিলা। মামারা সবাই কলকাতায়। বৈঠকখানা বাড়িটায় কৃষ্ণনগর কলেজের কিছু ছাত্র একটা মেস করে থাকত। দিদিভাইকে তারা দিদিমা বলে ডাকত। তাদেরই ভরসায় বলতে গেলে ‘বুড়োবুড়ি’ ঐ বাড়িতে থাকতেন।
বড়োদাদু প্রায় সারা সময়টা খাটে শুয়ে থাকতেন, স্নান আর খাওয়ার সময়টা ছাড়া; যদিও তাঁর কোন বিশেষ অসুখ ছিল না। পাড়ার একটি ছেলে বাজার দোকান করে দিত কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে।
সারা দুপুর হুল্লোড় আর ছুটোছুটির পর সন্ধ্যে নামলেই কিন্তু আমাদের সব বীরত্ব শেষ। যদিও ইলেকট্রিক আলো ছিল, সেগুলো ছিল একেবারেই টিমটিমে। সেই আলোছায়ায় আমরা চারদিকেই ভূত আর চোর-ডাকাত দেখতাম। ওখানে গেলে মায়েরা দেখতাম আমাদের দিকে খুব একটা নজর দিতনা। দিদিভাই ছিলেন আমাদের ভরসা, বিশেষ করে সন্ধ্যের পর।
নামেই “নগর”। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজলেই খেতে বসা লম্বা বারান্দায় আসন পেতে। ন’টার আগেই বাড়ি নিঃঝুম। উপরের টানা বারান্দায় লম্বা বিছানায় মশারীর মধ্যে আমরা শুতাম। আমাদের গল্প বলার আবদার মেটাতে দিদিভাই শুতেন আমাদের সঙ্গে।
তখনকার দিনের প্রথামতো দিদিভাই ওবাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন খুব কম বয়সে। কাজেই ওঁর শোনা গল্প আর দেখা ঘটনা ছিল অজস্র। নানারকমের মানুষের মজার মজার কাহিনী এত সুন্দর করে বলতেন যে মনে হত আমরা যেন চোখের সামনে সেগুলো ঘটতে দেখছি । এরকম একটা নিঝুম রাতে কড়িবরগা-ওয়ালা ছাদ থেকে ঝোলানো বড়োবড়ো পাখার নীচে শুয়ে শুয়ে এক আশ্চর্য ডাকাতির গল্প শুনেছিলাম দিদিভাইয়ের মুখে। সেটাই তোমাদের বলছি।
“এসব তোদের দাদু তার দাদুর কাছে শুনেছিল। সে অনেক বছর আগের কথা। তখন এই পাড়াটা ছিল একদম ফাঁকা । আমাদের এই বাড়িটাই ছিল বড়ো, আর একটু দূরে দূরে আমাদের জ্ঞাতিদের বাড়ি। রাজবাড়ি ছাড়িয়ে কয়েক মাইল গেলেই শুরু হত জঙ্গল, যেখানে সন্ধ্যেবেলা ‘ফেউ’ ডাকত, আরে সবাই বাচ্চাদের বলত – ওই শোন ফেউ ডাকছে। এখুনি বাঘ বেরোবে। শীগগির ঘুমিয়ে পড়।
“সে রাতেও সব কাজকর্ম মিটিয়ে বাড়ির গিন্নিরা আর মেয়েরা শুয়েছে। বুড়ো-কর্তা আফিমের ঘোরে আচ্ছন্ন। অন্য পুরুষমানুষরা তো সব নিজের নিজের কাজের জায়গায় – সপ্তাহে বা মাসে এক-দুদিনের জন্য আসে। চাকরবাকর-রান্নাবান্নার লোক ছিল। তারা থাকত ‘বার বাড়িতে’। সেদিকের দরজা এপাশ থেকে বন্ধ থাকত। তখন তো ব্যাঙ্ক-ট্যাঙ্ক ছিলনা, তাই বউ-ঝিদের গয়না গায়েই থাকত। কাজেই, বাড়ির দরজা-জানালা এঁটে বেশ ভয়ে ভয়েই রাত কাটত সবার। প্রায়ই শোনা যেত রোমহর্ষক সব ডাকাতির গল্প।
“তা সেই রাত তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। একটু পরেই ভোর হবে। এমন সময় সদর দরজায় দুমদাম ঘা পড়ল আর তার সঙ্গে দরজা খুলে দেবার হুঙ্কার।
“খড়খড়ির ফাঁকে চোখ রেখে বড়ো গিন্নির প্রায় মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। বাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ইয়া মুশকো জনাকুড়ি কালো কালো জোয়ান। তাদের হাতে বড়ো বড়ো লাঠি, বল্লম আর রাম-দা। কারো কারো হাতে জ্বলন্ত মশাল। তাদের মধ্য থেকে একজন জানলার কাছে এসে চিৎকার করে বলল – আমি রঘু। দরজা খুলে দাও। নইলে কাউকে জ্যান্ত রাখব না।
“প্রথমটা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেও জাঁদরেল বড়ো গিন্নি নিজেকে সামলে নিলেন চট করে। জানলা দিয়েই বললেন – দিচ্ছি দোর খুলে। কিন্তু বাড়িতে শুধু আমরা বউ আর মেয়েরা আছি। আমাদের গায়ে হাত দেবেনা। টাকাপয়সা গয়নাগাটি যা আছে নিজেরা দিয়ে দেবো। রঘু বলল, আগে দরজা খুলুন ।
“বাড়ির ভিতরে ঢুকে রঘু নিজের দলবলকে বারান্দায় বসতে বলে, সবাইকে অবাক করে বড়ো গিন্নিকে বলল “মা, আমাদের বড্ড খিদে পেয়েছে। পেটভরে খাওয়াতে পারেন? তেমন কিছু নয় – লুচি আর তরকারি।”
“বড়ো গিন্নির ডাকে বাড়ির অন্য বউরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে রান্না ঘরে এসে সেই ভোর রাতেই উনুন ধরিয়ে লুচি তরকারি রান্না করল। আর বারান্দায় বসে ডাকাতের দল মহানন্দে খাওয়াদাওয়া করল।
“খাওয়া হয়ে গেলে রঘু বড়ো গিন্নির পায়ে ঢিপ করে একটা পেন্নাম করে বলল, “মা, আমি রোঘো ডাকাত কথা দিয়ে গেলাম, আপনার বাড়ির দিকে আমরা কখনও কু-নজর দেব না। আমরা আসি। আপনারা নিশ্চিন্তে ঘুমোন।
“সেই থেকে এ-বাড়িতে সত্যিই আর কখনও ডাকাতি হয়নি সে-যুগে। আর তার পরে তো মহারানির রাজত্ব শুরু হল। সেইসব ডাকাতেরা কেউ কেউ ধরা পড়ে জেলে গেল, আর বাকিরা আবার চাষ-বাস শুরু করল।”
দিদিভাইয়ের গল্পও শেষ হ’ল, আর আমরাও ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম – বোধহয় রঘু ডাকাতের কথা ভাবতে ভাবতেই।
Wonderful
LikeLike