অনেক অনেক বছর আগের কথা। গঙ্গা নদী তখন ছিল বিশাল চওড়া আর গভীর। ঘন নিবিড় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এর বিপুল জলধারা প্রবাহিত হতো বঙ্গোপসাগরের দিকে। এই পথে ছিল পর্তুগীজ জলদস্যুর আনাগোনা।
শোনা যায় এখানে জঙ্গলের মধ্যে এক পাতার কুটিরে আত্মারাম ব্রহ্মচারী নামে এক ব্রাহ্মণ তপস্যা করতেন। এক সন্ধ্যায় তপস্যা করতে বসে তাঁর চোখে পড়ে জ্যোতির্ময় এক আলোকছটা। সেই আলো অনুসরণ করে তিনি বর্তমান কালীঘাটের কালীকুন্ডের কাছে পৌঁছান। সেখানে তিনি পাথরের কালীর মুখ, আর পাথরের মতো একটা পদাঙ্গুলি দেখতে পান। তারপরই দেবীর প্রত্যাদেশ পান, “যে অঙ্গুলি তুমি পাইয়াছ, তাহা বিষ্ণু কর্তৃক সুদর্শন-ছেদিত সতী অঙ্গ। আর ঐ যে কৃষ্ণবর্ণের প্রস্তরফলক দেখিতে পাইতেছ, তাহা ব্রহ্মার নির্মিত কালীমূর্তি।”
পরে ঐ ব্রাহ্মণ গভীর জঙ্গলের ভেতরে নকুলেশ্বর শিবলিঙ্গও পেলেন। যত্ন করে তিনি এঁদের পূজা শুরু করলেন। ক্রমে এই জায়গার স্থানমাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ল জনসমাজে। কলকাতার উত্তরে তখন চিৎপুর খাল, দক্ষিণে আদিগঙ্গা, পূর্ব দিকে লবণ হ্রদ, আর পশ্চিমে হুগলি নদী। আদিগঙ্গার উত্তর পাড়ের বিস্তৃতি ছিল আজকের চৌরঙ্গী অবধি। সুতানুটি, কলকাতা আর গোবিন্দপুর গ্রামের চারদিক ছিল গভীর জঙ্গলে ঢাকা। চৌরঙ্গী, কালীঘাট, ভবানীপুর অঞ্চল তখন কেবল খাত আর পাঁকে ভরা বাদাতে পরিপূর্ণ ছিল।
তবু সেই আদিযুগেই শেঠ বসাকরা সপ্তগ্রাম ছেড়ে গোবিন্দপুর গ্রামে চলে এসেছিলেন। চতুর ব্যবসায়ী বসাকরা অনুমান করেছিলেন, আগামি দিনে সুতানুটি, কলকাতা, গোবিন্দপুর এই তিনটি নগণ্য গ্রামই বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে সপ্তগ্রামের স্থান নেবে। তাঁরা এক বিরাট তন্তুবয়ন ওয়ার্কশপ স্থাপন করলেন গোবিন্দপুর গ্রামে। আদি কলকাতায় কোঠাবাড়ি তৈরি করে থাকতে শুরু করলেন।
এঁরা সপরিবারে এসেছিলেন, আর সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন পুরোহিত, নাপিতসহ গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থাও। নতুন জায়গায় এসেও যাতে তাঁদের গ্রামীণ সংস্কৃতি বজায় থাকে তাই এই ব্যবস্থা।
এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লক্ষীকান্ত ধর। ইনিই কলকাতার পোস্তা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ইংরেজরা কলকাতায় আসেন আরো অনেক বছর পরে। তাঁরা নাকি নিতান্তই দুর্ঘটনাবশত পা রেখেছিলেন হুগলি নদীর তীরে! দিল্লিতে তখন মুঘল বাদশাহের রাজত্ব চলছে। তাঁদের অধীনে নবাবরা বাংলায় রাজত্ব করছেন। ১৬৯৮ সালে ইংরেজরা দিল্লির বাদশাহকে ১৬০০০ টাকা দিয়ে সুতানুটি, কলকাতা, গোবিন্দপুর গ্রামের প্রজাস্বত্ব কিনে নেন। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ শুরু হয়। তারপর ইংরেজরা বিশাল বিশাল অট্টালিকা, গির্জা এসব নির্মাণ করে কয়েকটা ছোটো গ্রামকে পরিণত করে ফেললেন শহরে।
এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। গোবিন্দপুর গ্রামে দেব পরিবারে জন্ম হয়েছে এক শিশুপুত্রের। তার নাম রাখা হয়েছে নবকৃষ্ণ। সময়টা ১৭৩৩ সাল। আদি গঙ্গার ধারা তখন ক্রমশ শুকিয়ে আসছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে কলকাতায়। মৌদগল্য গোত্রধারী দেব পরিবারের কর্তা রামচরণ দেব আগে ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলী খাঁয়ের একজন নিমক কালেক্টর। বর্তমানে তিনি কটকের দেওয়ান পদে আছেন। স্ত্রী, তিন পুত্র আর পাঁচ কন্যা নিয়ে বড়ো সংসার তাঁর।
তবে সন্তানদের বেশি সময় দিতে পারেন না রামচরণ। কাজের চাপে ব্যস্ত থাকতে হয়। সম্প্রতি পিন্ডারি দস্যুর উৎপাত প্রবল হয়ে উঠেছে। তা দমন করার দায়িত্বে আছেন রামচরণ।
অন্যদিকে গোবিন্দপুরে দেব পরিবারের সন্তানরা তাদের মায়ের ছত্রছায়ায় বড়ো হয়ে উঠছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী নবকৃষ্ণ। সে এই পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান। স্কুলের পরীক্ষায় তখন এই শিশুর দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল। এর মধ্যে ঘটে গেল অঘটন। দস্যুদের মোকাবিলা করতে গিয়ে মেদিনীপুরের জঙ্গলে প্রাণ হারালেন রামচরণ। তাঁর বিধবা স্ত্রী ছোটো ছোটো সন্তানদের নিয়ে অসহায় হয়ে পড়লেন। গোবিন্দপুর গ্রাম থেকে শোভাবাজারে এসে থাকতে শুরু করল এই পরিবার। বিপদের দিনে আত্মীয়-স্বজন কাউকে পাশে পেলেন না রামচরণের স্ত্রী। সন্তানদের বুকে আঁকড়ে স্বামীর সঞ্চিত পুঁজি সম্বল করে কোনোক্রমে তাঁর দিন কাটতে লাগল।
ক্রমে অবিভক্ত বাংলায় এল এক অস্থির সময়। বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এই সময় নিয়মিত লুঠতরাজ চালাত বর্গীরা। অষ্টাদশ শতাব্দীর লুঠতরাজ প্রিয় এক অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদলকে তখন ‘বর্গী’ বলা হতো।
বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁ অনেক চেষ্টা করেও বর্গীদের দমন করতে পারছিলেন না। বর্গী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার ঘরে ঘরে। বাঙালি মায়েরা সন্তানদের ঘুম পাড়াত বর্গীর গল্প বলে –
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে।
ধান ফুরালো পান ফুরালো খাজনার উপায় কি
আর ক’টা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি।
বালক নবকৃষ্ণও তখন তার মায়ের কাছে বর্গী আক্রমণের গল্প শুনত। এই বালকের মধ্যে অনেক সদগুণ বিকশিত হচ্ছিল। সে হয়ে উঠছিল বিনয়ী, ভদ্র, শিষ্ট, অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী। তাই পাড়াপড়শীরাও তাকে ভালোবাসত। বড়ো দাদা রামসুন্দরও তাকে অত্যন্ত স্নেহ করত। আর তাদের মা নবকৃষ্ণকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন “খোকা, মন দিয়ে লেখাপড়া কর। তোকে যে অনেক বড়ো হতে হবে। তোর বাবাকে হারিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা সামলে তোদের মানুষ করছি। কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। সমাজে খাটো হয়ে আছি। তোকে সবকিছুর জবাব দিতে হবে একদিন।” নবকৃষ্ণ ছোটো থেকেই ধীর, স্থির, কম কথা বলে। তাই সে চুপ করে মায়ের কথা শুনত। মনে মনে ভাবত – সত্যিই একদিন অনেক বড়ো হব। তখন তোমাকে, ঘরের সবাইকে, এই অঞ্চলকে, কলকাতা শহরটাকে দেখব আমি।
তখন ১৭৫৭ সাল। পলাশীর যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। যুদ্ধে আলীবর্দী খাঁর দৌহিত্র নবাব সিরাজদ্দৌল্লার শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। মীরজাফরের পুত্র মীরন ছুটেছেন নবাবকে খুঁজে বার করতে। আমজনতার সামনেই পরাজিত নবাবকে কোতল করা হবে।
যুদ্ধশিবির থেকে সামান্য দূরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের তাঁবু। তার বাইরে বসে এক মনে চিঠি লিখছে এক যুবক। পাশেই আমবাগান। সেখানে কামানের গর্জন থেমে গেছে। যুদ্ধ শেষে চারদিকে স্তব্ধ নীরবতা।
যুবক লিখছে, “পলাশীতে আমাদের বড়ো জয় হয়েছে। রোজগারও মন্দ হয়নি। ক্লাইভ সাহেব খুশ। আমাদের ভাগ্য একেবারে তুঙ্গে। কলকাতায় খুব বড়ো করে দুর্গোৎসব করতে হবে। ক্লাইভ সাহেব কথা দিয়েছেন, তিনিও আসবেন সেই উৎসবে।”
যুবকের মাথায় বৈষ্ণবদের মতো টিকি, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। দেখতে আহামরি না হলেও চোখেমুখে বুদ্ধির দীপ্তি। বয়েস চব্বিশ বছর, নাম নবকৃষ্ণ দেব। চিঠি লেখা শেষ করে আমবাগানের দিকে চেয়ে থাকল সে। সে যেন এখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে। একজন নবাবের কোষাগারে এতো ধনসম্পদ থাকতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না তার। কোটি কোটি টাকার ধন, হীরা, জহরত, সোনা…উফ! ভাগ বাঁটোয়ারা করেও যা পেয়েছে, তাতে তার কয়েক পুরুষ রাজার হালে কাটাতে পারবে। ভগবানের অশেষ কৃপা তার উপর, আর তার গর্ভধারিনী মায়ের আশীর্বাদ। এর জোরেই আজ কোথা থেকে কোথায় এসেছে! আনন্দেও মানুষ কাঁদে। নবকৃষ্ণও কাঁদছিল, ডুবে যাচ্ছিল অতীতে।
মায়ের উৎসাহে তখন সে ইংরাজির সঙ্গে আরবি আর ফারসি ভাষাও ভালোভাবে রপ্ত করে ফেলেছে। তখনও বর্গীদের আক্রমণ চলছিল বাংলায়। বর্গীদের একটা দুর্বলতা ছিল, ওরা নদীপথে বিশেষ সুবিধা করতে পারত না। তাই ইংরেজরা কলকাতায় খাল কেটে বর্গী আক্রমণ আটকে শহরকে সুরক্ষিত রাখতে চেষ্টা করছিল। ইংরেজরা সেইজন্য সাত মাইল দীর্ঘ একটা খাল খনন করার পরিকল্পনা করে ফেলেছিল। নবকৃষ্ণ মুগ্ধ হয়ে ভাবত কতো বুদ্ধিমান জাত ইংরেজরা! তখন গভীর মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করত সে। ইচ্ছা হতো শিক্ষা দীক্ষায় ইংরেজদের মতো করে নিজেকে গড়ে তুলতে। কিন্তু ঘরে অর্থাভাব ছিল। তাই কিছু অর্থের সুরাহার জন্য কিশোর বয়েসেই ব্যবসায়ী লক্ষীকান্ত ধরের মুন্সি হিসেবে প্রথম কাজ করতে শুরু করেছিল।
এই সময় নবকৃষ্ণ আরো একটা কাজ পেয়েছিল – ওয়ারেন হেস্টিংসকে ফারসি ভাষা শেখানোর কাজ। ১৭৫০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দিয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস এই সময় ভারতে এসেছিলেন। ভারতকে ভালোভাবে জানার জন্য তিনি ফারসি শিখতে আগ্রহী হয়েছিলেন। নবকৃষ্ণের এই ভাষায় দক্ষতার কথা শুনে তার কাছে এই ভাষা শিখতে চাইলেন। এই সুবাদে প্রায় সমবয়সী দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। ওয়ারেন হেস্টিংস আর নবকৃষ্ণ – দুজনেরই ছিল প্রবল জ্ঞানস্পৃহা।
এরপর নবকৃষ্ণের জীবনে এলো আরো একটা সুযোগ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ তখন কোম্পানির জন্য একজন কেরানি তথা দোভাষীর খোঁজ করছিলেন। লক্ষীকান্ত ধরের সঙ্গে ইংরেজদের সুসম্পর্ক ছিল। তিনি কোম্পানিকে অর্থসাহায্য করতেন। তিনিই কেরানি তথা দোভাষীর জন্য ইংরেজদের কাছে নবকৃষ্ণের নাম সুপারিশ করলেন। বয়েসে তরুণ, উচ্চাকাঙ্মী নবকৃষ্ণকে স্নেহ করতেন তিনি।
ততদিনে রাজ্যপাটের পরিবর্তন হয়েছে। আলীবর্দী খাঁ মারাঠাদের সঙ্গে চুক্তি করে বর্গী আক্রমণ বন্ধ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলার নবাব পদে বসেছেন তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজদ্দৌল্লা। এই সময় মুর্শিদাবাদের কিছু সম্ভ্রান্ত মানুষ সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ড্রেক সাহেবের কাছে ফারসি ভাষায় একখানা চিঠি লিখে পাঠান। তাঁরা অনুরোধ করেন কোনো মুসলিম মুন্সিকে দিয়ে যেন এ-চিঠি পড়ানো না হয়। ব্রিটিশরা তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। ফারসি জানে এমন হিন্দু কোথায় পাবেন।
ঠিক সেই সময় এগিয়ে গিয়েছিল নবকৃষ্ণ। ফারসি ভাষাটা সে ভালোই রপ্ত করেছিল। চিঠি পড়ে আবার ইংরাজিতে তার ব্যাখ্যাও করে দিয়েছিল। এমনকি ফারসিতে চিঠির উত্তরও লিখে দিয়েছিল নবকৃষ্ণ। ইংরেজরা খুশি হয়ে তাকে মুন্সি পদে নিয়োগ করেছিলেন। এতে মাসে ষাট টাকা বেতন পেত সে।
কোম্পানির সঙ্গে তখন নবাব সিরাজের তুমুল বিরোধ চলছিল। নবকৃষ্ণ গোড়া থেকে ইংরেজদের প্রতি বিশ্বস্ত ছিল। তাইতো একসময় এই সিরাজের কাছেই ক্লাইভ তাকে উপঢৌকনসহ পাঠিয়েছিলেন। নবাবের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে তখন কিছুটা কোনঠাসা ক্লাইভ মরীয়া হয়ে উঠেছিলেন। নবাবের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করেছিল ইংরেজরা। তখন নবাব-বিরোধীদের একত্র করে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে ইংরেজদের যথাসাধ্য সাহায্য করেছিল সে।
আরেকজনও এইসময় ইংরেজদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি নদীয়ার শাসক কৃষ্ণচন্দ্র রায়। সেই সুবাদে এই গুণী, বিদ্বান মানুষটার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছিল নবকৃষ্ণের। কৃষ্ণচন্দ্রই তখন বাংলার হিন্দু রাজাদের বুঝিয়েছিলেন – তাঁদের সনাতন হিন্দু ধর্ম মুসলমান শাসকদের হাতে মোটেও নিরাপদ নয়, বরং ব্রিটিশদের হাতেই নিরাপদ। হিন্দু রাজারা সবাই তাঁকে সমর্থন করেছিলেন।
নবকৃষ্ণও সমর্থন করেছিল কৃষ্ণচন্দ্রকে। নবকৃষ্ণের কাছে আসলে মুসলিম শাসন বা ইংরেজ শাসন নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না, এখনো নেই। তাকে যেভাবেই হোক, এ জীবনে ধন, মান, প্রতিষ্ঠা পেতে হবে। তাতে যদি ইংরেজের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে হয়, ক্ষতি কী! ব্রিটিশরা শক্তিশালী, বুদ্ধিমান জাত। শক্তিধরের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলাই তো বুদ্ধিমানের কাজ।
বেচারা সিরাজদ্দৌল্লা! ইংরেজদের সঙ্গে বিরোধিতা করে মরতে হলো অকালে। যুবক নবাব হয়তো তারই বয়েসী ছিলেন – ভাবল নবকৃষ্ণ। একটু সমঝোতা করে চললে নবাবের পদ, ধনসম্পদ, প্রাণ সবই রক্ষা পেত।
ভাবনায় তলিয়ে গেছিল নবকৃষ্ণ, সম্বিত পেল এক ভৃত্যের ডাকে, “আপনাকে ক্লাইভ সাহেব তাঁর তাঁবুতে ডাকছেন।”
নবকৃষ্ণ বলল “হ্যাঁ আমি এখুনি যাচ্ছি।” কিন্তু মনে মনে ভারী বিরক্ত হলো। সে জানে ক্লাইভ আবার তাকে নবাবের কোষাগারের তালিকা অনুযায়ী পাওয়া ধনরত্নের হিসাব মিলিয়ে দেখতে বলবেন। অথচ নবাবের দেওয়ান রামচাঁদ বাবু নিজে এই তালিকা প্রস্তুত করে কোষাগার লুঠ করার সময় হাজির ছিলেন। হাজির ছিলেন ক্লাইভও। সেখানেই কোষাগারের প্রায় তিরিশ কোটি মূল্যের সম্পদ ভাগ করে নিয়েছে সে- দেওয়ান, ক্লাইভ, নবাবের সেনাপতি মীরজাফরের সঙ্গে। এছাড়া ভাগ পেয়েছেন নবাবের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ ধনী জগত শেঠও। তারপরও ক্লাইভ বারবার ধন সম্পদের খোঁজ নিচ্ছেন। উনি কি কিছু সন্দেহ করছেন? না, না কিছুতেই ওঁকে নবাবের অন্দরমহলের সম্পদের খবরটা জানানো যাবে না। ওটা দেওয়ান, মীরজাফর,আর আমীর বেগের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে সে গোপনে। এসব ভাবতে ভাবতে নবকৃষ্ণ আমবাগান থেকে এগোল ক্লাইভের তাবুর দিকে।
মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা ফিরে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নবকৃষ্ণ। শোভাবাজারে সে আগেই ধনী বণিক শোভারাম বসাকের কাছ থেকে চোদ্দ বিঘা জমিসহ একখানা প্রাসাদ কিনেছিল। এখন তড়িঘড়ি সেখানে আরো কিছু নির্মাণ করে ফেলল সে। তৈরি হল দেওয়ানখানা, নাচঘর, নহবতখানা, পাইক-বরকন্দাজদের থাকার জায়গা, সাত খিলানের বিশাল ঠাকুর দালান। ঘটা করে দুর্গা পূজা করতে হবে যে! তার সঙ্গে তদারকিতে ব্যস্ত তার বড়দা রামসুন্দরও। বড়দার পুত্র ছোট্ট গোপীমোহন ছুটে বেড়াচ্ছে নবনির্মিত সেই দালানে। নিজের পুত্র নেই বলে বড়দার পুত্রকে খুব স্নেহ করে নবকৃষ্ণ। বাড়ির বউরাও ব্যস্ত অন্দরে। আর দুদিন পরে এ-বাড়িতে দুর্গাপূজা। বাড়ির মেয়েরাও এসেছে তাদের শ্বশুরবাড়ি থেকে। নবকৃষ্ণের বিরাট সাফল্যে বাড়িতে খুশির হাওয়া। মায়ের শরীর ভালো যাচ্ছে না। তবু তিনি বারবার পূজার খোঁজখবর নিচ্ছেন। নবকৃষ্ণকে সাবধান করছেন, “দেখিস খোকা, সাহেবরা সব পূজায় আসবে, এ নিয়ে সমাজে যেন কোনো কথা না ওঠে। এমনিতেই তো তোর সৌভাগ্যে সব জ্বলে মরছে!”
নবকৃষ্ণ মাকে আশ্বস্ত করে। সে সাবধানী মানুষ। তাই আগেই বিষয়টা মাথায় রেখে ইংরেজদের বসার ব্যবস্থা বাইরেই করেছে। ওখান থেকেই প্রতিমা দর্শন করবেন তাঁরা, ঠাকুর দালানে প্রবেশ করবেন না।
সেইমতো ব্যবস্থায় পূজা শুরু হয়ে গেল ধুমধাম করে। ক্লাইভ এসেছেন সপারিষদ। বহির্বাটির নাচঘরে তাঁদের বসার ব্যবস্থা হয়েছে। নাচঘরে কাচ দিয়ে ঘিরে ঝাড়বাতি লাগানো হয়েছে। সেখানে নানা আলোর চমক। লখনউ থেকে এসেছে নিকি বাইজি। তার এখন সবচেয়ে বেশি নামডাক। তাই তাকেই এনেছে নবকৃষ্ণ। সাহেবদের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখতে চায় না সে। উইলসন হোটেল থেকে আনা হয়েছে গরু আর শুয়োরের মাংস, সঙ্গে আকন্ঠ পানের ব্যবস্থা।
এদিকে মূল বাড়ি আর ঠাকুর দালানে এসবের কোনো আঁচ লাগতে দেয়নি নবকৃষ্ণ। সেখানে নিষ্ঠার সঙ্গে পূজা হচ্ছে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির সভাপন্ডিত জগন্নাথ তর্ক পঞ্চাননের কাছ থেকে সে নিয়ে এসেছে পূজার বিধি। মা দুর্গাকে সাজানো হয়েছে মাথায় সোনার মুকুটে, হাতে সোনার অস্ত্রে। দেবীর চুলে ছাব্বিশটা সোনার স্বর্ণচাঁপা, নাকে সোনার নথ, কপালে সোনার টিপ। দেবীর সামনে ১০৮টি সোনার প্রদীপ জ্বলছে। ধূপধুনার গন্ধে, মন্ত্রোচ্চারণে সারা বাড়ি জমজম করছে। জাঁকজমক দেখে অতিথি অভ্যাগতরা অবাক হয়ে গেছে।
কামানের তোপ দেগে শুরু হওয়া পূজা শেষ হলো দশমীতে নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে, ব্রাহ্মণদের মহাসমারোহে দক্ষিণা দিয়ে।
এরপর নবকৃষ্ণকে আর পেছনে তাকাতে হলো না। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে যেতে থাকল সে। পলাশির যুদ্ধে জয়ী হয়ে ক্লাইভ সন্তুষ্ট ছিলেন নবকৃষ্ণের প্রতি। এখন দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে নিজের বাড়িতে যেভাবে আপ্যায়ন করল নবকৃষ্ণ, তাতে কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে গেলেন ক্লাইভ। কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতি দিতে দিল্লির মুঘল বাদশাহের কাছে নবকৃষ্ণের জন্য সুপারিশ করলেন তিনি। তাতে নবকৃষ্ণ পেল “মহারাজা বাহাদুর” উপাধি। সময়টা তখন ১৭৬২ সাল।
নবকৃষ্ণ রাজা হলেন, সুতরাং এবার থেকে আমরা তাঁকে ‘আপনি’ সম্বোধন করব। তো সেই উপাধি পেয়ে আনন্দে নবকৃষ্ণ ফিরে এলেন হাতির পিঠে চড়ে রাস্তার দুধারে অর্থ ছড়াতে ছড়াতে। ক্লাইভ নবকৃষ্ণের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করে দিলেন, যা একজন গণ্যমান্য মানুষ পান। নবকৃষ্ণ পেলেন ছয় হাজারি মনসবদারী পদ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখন তাঁকে অনেক দায়িত্ব দিয়েছে। মুন্সি দফতর, আজবেগী দফতর, উত্তর চব্বিশ পরগনার দেওয়ানি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কালেক্টরি সামলাতে হচ্ছে তাঁকে। তিনি এখন পালকি চড়ে যাতায়াত করেন, যে পালকির বাঁট হাতির দাঁত, আর সোনার কাজ করা। তিনি এখন চৌকো টুপি পড়েন, যার মাথায় পালক দেওয়া। তাঁর কাছে এখন রাজার মতো অস্ত্রশস্ত্র থাকে, দেউরিতে থাকে পাহারাদার। কলকাতা সাম্রাজ্যের রাজা হয়ে উঠলেন নবকৃষ্ণ -এক মুকুটহীন রাজা।
কোম্পানির অধীনে চাকরি করে এই সময় প্রচুর অর্থ রোজগার করেছিলেন আরো অনেকে -ভূকৈলাসের মহারাজ জয়নারায়ণ ঘোষাল, দেওয়ান হরি ঘোষ, শান্তিরাম সিংহ, রামহরি বিশ্বাস, রামসুন্দর বন্দোপাধ্যায়, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণরাম বসু এঁরাও। নবকৃষ্ণের দেখাদেখি কলকাতার এইসব নব্য ধনীরা অনেকেই চক মেলানো বাড়ি হাঁকিয়ে, তিন ফুকুরি, পাঁচ ফুকুরি ঠাকুর দালান করে জাতে ওঠার জন্য দোল, দুর্গাপূজা শুরু করে দিলেন।
এঁরা অনেকেই নবকৃষ্ণের বাড়বাড়ন্ত সহ্য করতে পারছিলেন না। রাতারাতি তাঁর মস্ত ধনী হয়ে যাওয়াটা সন্দেহের চোখে দেখছিলেন। নবকৃষ্ণ পলাশি জয়ের পর নবাবের কোষাগার লুঠের ভাগ পেয়েছেন – একথাও রটে যায়।
বিশ্বস্ত এক অনুচরের কাছে এ-খবর শুনে মুচকি হাসেন নবকৃষ্ণ – কথাটা তো মিথ্যে রটেনি! অনেকে তাঁকে ইংরেজের দালাল বলে। এমনকি কলকাতার আদি জমিদার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার পর্যন্ত তাঁর উন্নতিকে বাঁকা চোখে দেখেন। এই সবই জানেন নবকৃষ্ণ। তবে ভ্রুক্ষেপ করেন না। তিনি জানেন সফল ব্যক্তির শত্রু থাকেই। দলাদলিও থাকে সব জায়গায়। এই যেমন কিছুদিন আগেই কলকাতায় প্রধান দুটো দল ছিল। একটা নেতা মদনমোহন দত্তের দল, অন্যটা দলপতি কৃষ্ণচরণ মিত্রের দল। সবাইকে কোনো না কোনো দলে থাকতে হয়। নবকৃষ্ণ ছিলেন মিত্র মশাইয়ের দলের সদস্য। আর এখন তিনি নিজেই একজন দলপতি হয়ে উঠেছেন। তাঁর দলে নাম লিখিয়েছেন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তিনি যেসব উঁচু কুলীন ব্রাহ্মণদের কলকাতায় বসবাসের জন্য জমি দান করেছিলেন, তাঁরাই এখন তাঁর দলের অনুগত।
আবার দানধ্যানের জন্য ইদানিং বেশ নামডাক হয়েছে তাঁর। কলকাতায় মাদ্রাসা শুরু করার জন্য অর্থ দিয়েছেন, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় ৫০ কিলোমিটার রাস্তাও নির্মাণ করিয়েছেন। তিনি এখন রাজা, রাজাকে তো এসব করতেই হয়!
তবে তাঁর কর্মকাণ্ডে সবথেকে গাত্রদাহ হচ্ছে তাঁর প্রতিবেশি চূড়ামণি দত্তের। প্রতিটা বিষয়ে তাঁকে টেক্কা দিতে মরীয়া লোকটা। কারবারি মানুষ, শোভাবাজারে তাঁরও প্রকাণ্ড বাড়ি। চাকরবাকর, দেওয়ান, আমলা কিছু কম নেই তাঁরও। দানধ্যানও আছে। তবে রূঢ়ভাষী বলে এলাকায় বদনাম আছে।
তবে নবকৃষ্ণ এবার তাঁর মায়ের শ্রাদ্ধ উপলক্ষে নয় লক্ষ টাকা খরচা করে দেখিয়ে দিয়েছেন চূড়ামণিকে, তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সাজে না। যতোই হোক সে তো আর রাজাবাহাদুর নয় নবকৃষ্ণের মতো!
এর মধ্যে নবকৃষ্ণের খাস ভৃত্য এসে এক খবর দিল। চূড়ামণির কাছে নাকি এক ব্রাহ্মণ তার কন্যার বিয়ের জন্য সাহায্য চাইতে এসেছিল। চূড়ামণি তার স্বভাববশত তাকে বলে বসেছিল “বিয়ের করার সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলি? কন্যা জন্মাবার পর পরামর্শ করেছিলি? এখন এসেছিস সাহায্য চাইতে!”
এতোসব গালমন্দ করেও নাকি সেই ব্রাহ্মণকে ষোড়শোপচারে খাইয়েছেন। ব্রাহ্মণ একশত টাকা সাহায্য চাইলে তাকে তিনশত টাকা দিয়েছেন। ব্রাহ্মণ নাকি আপ্লুত হয়ে বিদায় নিয়েছেন। একথা শুনে ভারী ক্ষুণ্ণ হলেন নবকৃষ্ণ। কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি বললেন, “বিদ্বান পন্ডিতদের আমন্ত্রণ জানানো হোক। একটা সম্মেলন করতে চাই।
কিছুদিনের মধ্যেই এক মস্ত সম্মেলন হলো শোভাবাজার রাজবাড়িতে। তাতে হরেকৃষ্ণ দীর্ঘাঙ্গী, নিতাই বৈষ্ণবরা এসেছিলেন অতিথি হয়ে। এঁদের সবাইকে বহু মূল্যবান উপহার, মোটা টাকা দক্ষিণা দিলেন। তৃপ্ত হয়ে নবকৃষ্ণ ভাবলেন, চূড়ামণিকে এবার ঠিক জবাব দেওয়া গেছে।
সময় এগিয়ে চলেছে অনিবার্য গতিতে। ক্লাইভ ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করলেন। সেই খুশিতে নবকৃষ্ণ কালীঘাটে মাকালীকে সোনার মুণ্ডমালা দান করে এলেন। নবকৃষ্ণ কিছুটা চিন্তিত- তাঁর এত সম্পদ বৈভবের উত্তরসূরী তবে কে হবে? এখনো যে পুত্র সন্তানের মুখ দেখলেন না।
তিনি তাঁর দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে গোপীমোহনকে দত্তক নিলেন। এদিকে দিল্লীতে তখন মুঘল সাম্রাজ্যের নামমাত্র অস্তিত্ব ছিল। বাংলায় তখন নবাব মীরজাফরের পর তাঁর জামাতা… পালাবদল চলছেই। সিরাজের পরাজয় আর মৃত্যুর পর প্রতিশ্রুতি মতো ইংরেজরা মীরজাফরকে নবাব পদে বসালেও তিনি ছিলেন কোম্পানির হাতের পুতুল মাত্র। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন যাকে ইচ্ছা তাকে নবাবের পদে বসানোর ক্ষমতা রাখতেন। আবার যখন খুশি তখন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারতেন। প্রত্যেক নবাবকেই তখন কোম্পানিকে বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়া ছাড়াও নানারকম উপঢৌকন দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতে হতো।
১৭৭২ সালে ক্লাইভের পরে ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। ফারসি ভাষা শেখানোর সময় থেকে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল নবকৃষ্ণের। সেই সুসম্পর্ক এখনো বজায় থাকল। কোম্পানি নবকৃষ্ণকে তাঁর সেবার পুরস্কার দিতে চাইলেন। ১৭৭৪ সালে হেস্টিংস তাঁকে সুতানুটির চিরস্থায়ী তালুক অর্পণ করলেন।
এদিকে সুতানুটির তালুকদারি এভাবে হস্তান্তর হওয়া মেনে নিতে পারলেন না কলকাতার বিশিষ্ট কিছু মানুষ। তাঁরা এর প্রতিবাদ জানালেন। কোম্পানির তরফ থেকে জানানো হলো – তাঁরা যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন, রাজা নবকৃষ্ণকে এখন কোম্পানি সেই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার ক্ষমতা দিয়েছেন। সুতরাং সকলে যেন তাঁকে কোম্পানির প্রকৃত তালুকদার হিসেবে মান্য করেন।
কাজেকাজেই প্রতিবাদ এখানেই থেমে গেল। এর মধ্যেই নবকৃষ্ণের বাড়িতে সুসংবাদ এলো। দেরিতে হলেও পুত্র সন্তানের মুখ দেখলেন নবকৃষ্ণ। পুত্রের নাম রাখা হলো রাজকৃষ্ণ।
কিন্তু অন্য এক অঘটন ঘটে গেল এসময়। অনেক টাকা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন হেস্টিংস। মামলা চলতে থাকল। নবকৃষ্ণের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলো তাঁর। আসলে নবকৃষ্ণই তাঁকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন। তিনি অনুমান করেছিলেন, মামলায় অর্থসম্পত্তির তল্লাশি শুরু হলে তাঁর আয়েরও তল্লাশি শুরু হবে। সতর্ক, সাবধানী নবকৃষ্ণ চাননি তাঁর তিলেতিলে গড়ে ওঠা সুনাম, প্রতিপত্তিতে এতটুকু কালির আঁচড় পড়ুক। তাই তিনি সরিয়ে নিলেন নিজেকে। আর হেস্টিংস ১৭৮৫ সালে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে গভর্নর জেনারেল পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে গেলেন।
নবকৃষ্ণ এখন রাজবাড়িতে বসেই দপ্তরের কাজ করতেন বেশি। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা করে দিলেন দুই পুত্রের মধ্যে। গোপীমোহনের জন্য থাকল পুরনো প্রাসাদ। রাজকৃষ্ণের জন্য তিনি পৃথক একখানা প্রাসাদ নির্মাণ করে দিলেন। বড়ো তরফ অর্থাৎ দত্তক পুত্র পেলেন গোবিন্দ জিউ ঠাকুরকে। ছোটো তরফ অর্থাৎ নিজের পুত্রকে দিলেন গোপীনাথ জিউ ঠাকুরকে। এই গোপীনাথ জিউ অগ্রদ্বীপের বিখ্যাত দেবতা। এঁকে কৌশলে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন নবকৃষ্ণ।
এখন নিশ্চিন্ত নবকৃষ্ণ অনেকটা সময় গোপীনাথ জিউয়ের সেবা করেন। গোপীমোহনের পুত্র রাধাকান্ত তাঁর বড়ো আদরের নাতি। ১৭৮৯ সালে পাঁচ বছরের এই নাতির শিক্ষার ব্যবস্থা করে ফেললেন তিনি কৃষ্ণমোহন বসুর কাছে। নাতি যে তাঁরই মতন ছোটো থেকে লেখাপড়ায় আগ্রহী।
দশ বছরে ঘটা করে তার বিয়েও দিলেন গঙ্গামণি নামে এক বালিকার সঙ্গে। নাতিকে নিয়ে সময় কাটাতে ভালো লাগে তাঁর। তিনি এখন একটু বিশ্রামে থাকতে চান। অনেক উত্থানপতনের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটিয়ে আজ ক্লান্ত। জীবনের কাছ থেকে আর কিছু চাওয়ার নেই তাঁর। আজ কি নেই? অর্থ, মান, খ্যাতি- সব দিয়েছেন ভগবান দু’হাতে।
পালঙ্কে শুয়ে একথা ভাবছিলেন নবকৃষ্ণ। ইদানিং শরীর ভালো যাচ্ছে না। আজ একটু বেশিই দুর্বল লাগছে। তাঁর জীবনদীপ কি তবে নিভে আসছে? চৌষট্টি বছর কি খুব বেশি বয়েস? মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা, পলাশির যুদ্ধের পর ক্লাইভের উল্লাস, বাড়িতে প্রথম দুর্গাপূজা, রাজাবাহাদুর খেতাব পেয়ে হাতির পিঠে চেপে বাড়ি ফেরা- সব মনে পড়ছে। তিনি চলে গেলে এরা সব ঠিকমত চালাতে পারবে তো? তাঁর সাধের রাজবাড়ি, গোপীনাথ জিউ, আদরের নাতি – এদের ছেড়ে কোথায় যাবেন!
তিনি ভৃত্যকে ডাকতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু ক্ষীণ স্বর বোধহয় পৌঁছলো না ভৃত্যদের কানে। কেউ এল না। এক বিষাদ ছুঁয়ে গেল নবকৃষ্ণের মনে। এভাবে সবার অগোচরে কি তবে চিরবিদায় নিচ্ছেন? তিনি রাজা, তাঁর মৃত্যুও তো রাজকীয়ভাবে হতে পারত!
জয়ঢাকের টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে