শুভারম্ভ
বালক রবীন্দ্রনাথ চলেছেন হিমালয় ভ্রমণে। বাবার সঙ্গে। শান্তিনিকেতন হয়ে যাওয়া। প্রথমে থামা হলো গঙ্গার তীরে চন্দননগরে। ফরাসি উপনিবেশ। শহর কলিকাতা থেকে মাত্র মাইল পঁচিশেক। সালটা ইং ১৮৭৩.
বছর পাঁচ সাত পরে এ-শহরে এলেও সেদিন এর জাঁকজমক নজর এড়ায়নি মহর্ষির। বিপণীগুলি ঝকমক করছে, নানা নতুন নতুন পশরায় উপচে পড়ছে।
“কই, এতসব জিনিসপত্তর তো কলকেতার দোকানে দোকানে এখনও পাওয়া যায় না?” মহর্ষির বয়স্য কিশোরীনাথ চাটুজ্জের প্রশ্ন ফরাসি দোকানীকে।
উত্তর যা পাওয়া গেল তা শুনে আক্কেল গুড়ুম।
বছর তিন-চার হলো ইউরোপ থেকে ভারতে আসবার একটা শর্টকাট জলপথ নাকি খোলা হয়েছে, আর তাতেই দূরত্ব কমে গেছে সাড়ে পাঁচ হাজার মাইল, আর সময় লাগছে তিন সপ্তাহ কম!
অর্থাৎ, মহর্ষির পিতৃদেব প্রিন্স দ্বারকানাথ বা তারও আগে তাঁর গুরু রামমোহনের চাইতে অনেক কম সময়ে ও আয়াসে এখন বিলাত যাওয়া যাবে!
মিশরদেশে এমন একটা খাল নাকি কাটা হচ্ছে—সে খবর ঠারেঠোরে কানে আসছিল বটে পাঁচ-সাত বছর আগে থেকেই, কিন্তু তা যে আদৌ বাস্তবে সম্ভব, আদৌ যে বিলেত-কলকেতার দূরত্ব এতো কমিয়ে দেওয়া যায়, এটাই তো ছিল ধারণার ঊর্ধ্বে!
অবিশ্যি এই ফিরিঙ্গি গোরাদের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়!
জানা গেল, এই জলপথ বানিয়েছে ফরাসি ইঞ্জিনিয়রেরা, চালাচ্ছেও ফরাসি কোম্পানি। তাই তাদের জাহাজগুলোরই রমরমা। মরিশাস-পণ্ডিচেরি-চন্দননগরের মতো ফরাসি কলোনিগুলোর অতি রমরমা তাই উপচে পড়ছে।
***
অবশ্য, ঐ ‘সংক্ষিপ্ত জলপথে’ ফরাসি কব্জা বেশিদিন বজায় থাকেনি। ১৮৬৯-এ খালের উদ্ঘাটনের পর থেকে ইংরেজের কেপ-বাণিজ্য হু হু করে পড়তে থাকে। কিন্তু বেনিয়া ইংরেজের ইহুদী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরেলি বছর চারেকের মধ্যে অটোমান রাজাগজাদের (‘খদিব’) হাতে থাকা ঐ কোম্পানির চুয়াল্লিশ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়ে পালের হাওয়াটা ব্রিটেনের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন এতোটাই, যে এর পর থেকে অন্তত অর্ধশতাব্দী সুয়েজ খালের রাজনীতি ব্রিটেন আর ভারতবর্ষকেই প্রভাবিত করেছিল সর্বাধিক। আর এর দশ বছরের মধ্যে তো পুরোপুরি এক যুদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটেন সম্পূর্ণ কব্জা করে নিল ঐ খাল।
কিন্তু এ-সব অনেক পরের গল্প আমরা আগেই করে ফেললাম।
আমাদের আজকের গল্পের শুরু হওয়া উচিত আড়াই হাজার বছর আগে থেকে।
বলি সে গল্প।
২
শুরুর শুরু
মাত্র দু’শো কিলোমিটারের দৈর্ঘ্য। না, তার চেয়েও একটু কম। হাওড়া থেকে আসানসোল, ধরো। এই সামান্য পথটুকু পৃথিবীর ইতিহাস, বাণিজ্য, ভূগোল ও রাজনীতিকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে, আর কোত্থাও তার জুড়ি মেলে না ।
উত্তরে তার ভূমধ্যসাগর। দক্ষিণে লোহিত সাগর। পশ্চিমে আফ্রিকা মহাদেশ, তো পূবে শুরু হয়ে গেল সুবিশাল এশিয়া মহাদেশ।
নাম তার সুয়েজ। যেখানেই কাটা আছে ঐতিহাসিক সুয়েজ খাল , যাকে নিয়ে আমাদের আজকের গল্প। প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় ‘সুয়েজ’ মানে ‘শুরু’!
কী আশ্চর্য, তারা কি জানত যে এখান থেকেই শুরু হবে এক নয়া ইতিহাস?
***
আমাদের দেশে মগধে যখন নৃপতি বিম্বিসার রাজত্ব করছেন, মোটামুটি সেই সময় নাগাদ, অর্থাৎ যীশুখ্রিস্ট জন্মানোর ছ’শো বছর আগে মিশরের ফারাও (রাজা ) দ্বিতীয় নেকো নীলনদ থেকে একটা খাল কেটে এনে বিটার হ্রদে ফেলেন। এই বিটার হ্রদ আজও বহাল তবিয়তে রয়েছে আধুনিক সুয়েজ খালের মাঝ বরাবর। এখান থেকে দক্ষিণে লোহিত সাগরের পোর্ট সুয়েজ বন্দর মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। মরুভূমির বালির মধ্যে আদ্যিকালের সেই খালের অবশেষ আজও কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ খুঁজে পাওয়া যায়। এ খাল নির্মাণ সম্পূর্ণ করবার কৃতিত্বের আর এক দাবীদার ছিলেন পারস্যরাজ দারায়ুস। তাঁর বিখ্যাত সুয়েজ প্রস্তরলিপিতে এবং হেরোডোটাসের লেখাতেও সে দাবী করা হয়। তবে পরবর্তী সময়ে অ্যারিস্টটল, স্ট্রাবো, প্লিনিদের মত ইতিহাসবিদরা সে সাফল্যের দাবীকে মেনে নেননি। অনেকে আবার দাবী করেন খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ফারাও দ্বিতীয় নেকো-র আমলে সেই খাল কাটবার কাজ শুরু হলেও শেষমেষ সে কাজ শেষ করেছিলেন, মিশরের গ্রিক অধিপতি দ্বিতীয় টলেমি।
তবে এ খাল তৈরির ওপরে মিশরীয়, পারস্য কিংবা গ্রিক শাসকদের এইসব বিভিন্ন দাবিদাওয়া থেকে একটাই দরকারি তথ্য উঠে আসে, দূর অতীতে সুয়েজ দিয়ে জাহাজ চলবার একটা কৃত্রিম খাল কাটা হয়েছিল মানুষের হাতে। সেইটুকুই আমাদের কাছে এই মুহূর্তে জরুরি খবর।
প্রায় এক সহস্রাব্দি এই ‘ফারাওদের খাল’ এরপর মানুষের সেবা করেছে। শেষমেষ ইতিহাস বলছে, ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে এসে, মক্কা মদিনায় এক বিদ্রোহ শুরু হতে, তাদের রসদের সরবরাহ আটকে দেবার জন্য এ খালকে বন্ধ করে দেয়া হয়।
তবে খাল বুঁজে গেলেও তবে জলপথের কিংবদন্তীটা ঠিকই চলে আসছিল লোকমুখে, যেটা কিনা সেকালে সম্রাট নেপোলিয়নের কানেও এসেছিল।
***
১৭৯৮-এর এক গ্রীষ্ম-সকালে সম্রাট নেপোলিয়ন ঠিক করলেন তিনি নিজেই তাঁর চল্লিশ হাজার নৌসেনার নেতৃত্ব দিতে জাহাজের সওয়ার হয়ে মিশরদেশে যাবেন। জ্যাক মেনু, জাঁ ক্লেবারের মতো নৌসেনাধ্যক্ষেরা তো অবাক!
তা গেলেনও সম্রাট মিশর দেশে। ঐ বছরের শেষদিকে দিন দশেক সম্রাট অবস্থান করেছিলেন সুয়েজ যোজকে—কারণ তাঁর কানে এসেছিল সেই প্রাচীন মিশরীয় খালের কথা। যোজক, তোমরা জানো, হলো এক সংকীর্ণ ভূখণ্ড যা বৃহৎ দুই স্থলভাগকে জুড়ে রাখে—যেমন দুই আমেরিকা মহাদেশের মাঝে পানামা যোজক, বা আফ্রিকা-এশিয়ার মাঝে এই সুয়েজ যোজক।
এরও তিনশ’ বছর আগে, আমরা জানি, পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-ডা-গামা সরাসরি ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষে আসবার জলপথ খুঁজে পেয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার টিপ্ ঘুরে আসা এই পথ ইউরোপের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা খুলে দিয়েছিল, এবং এই বাণিজ্য রমরম করে বাড়তেই থাকল। ষোড়শ শতাব্দী থেকে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর রমরমার এ’ছিল এক বড় কারণ। কিন্তু ক্রমে ক্রমে এই কেপ-পথ (Cape-route) পর্তুগিজদের হাত থেকে পিছলে ডাচ ও ইংরেজদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। তীক্ষ্মধী ফরাসিসম্রাট নেপোলিয়ন ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে ব্রিটেনের কোমর ভাঙতে প্রথমে তার নৌবাণিজ্যের উপর কব্জা বসাতে হবে। আর, সে কাজ করতে সুয়েজের ওপর দিয়ে কাটা একটা খাল যতটা সাহায্য করবে ততটা আর কিছু নয়। কারণ এর ফলে পুবদেশে নৌযাত্রার দৈর্ঘ হয়ে যাবে চার ভাগের এক ভাগ; সুদীর্ঘ কেপ-রুট হয়ে পড়বে অর্থহীন। পণ্যের মূল্যও সে-অনুপাতে কমবে। পূর্বদেশের বাণিজ্য এসে পড়বে ফরাসিদের হাতের মুঠোয়।
***
সুয়েজে নেপোলিয়নের সাথী ছিলেন এঞ্জিনিয়র জ্যাক মারী লে-পেয়ার। তাঁর ওপরে ভার পড়ল সুয়েজ খালের নীল-নকশা বানানোর। তিনি মেপেজুপে জানালেন লোহিত সাগরের জলতল নাকি ভূমধ্যসাগরের চাইতে তেত্রিশ ফিট উপরে আছে। অতএব জটিল এক ‘লক’ পদ্ধতিতে জাহাজকে তুলে/ভাসিয়ে নিয়ে নিয়ে গিয়ে পরপারে নামাতে হবে।
কিন্তু হায়, ওঁর এই গণনা নিছকই ভ্রান্ত ছিল!!
এবং এই ভ্রান্তিটির জন্যে সুয়েজ খাল খোঁড়া পিছিয়ে গেল আরও ষাট বছর, কারণ সেকালে এতো দীর্ঘ পথে এই জটিল ‘লক’ পদ্ধতির রূপায়ণ প্রায় অসম্ভব ছিল।
প্রায় একশ’ বছর পরে আমেরিকার পানামা খাল এই পদ্ধতিতে খোঁড়া হয়েছিল, এবং আজও সেখানে ‘লক’ পদ্ধতিতে জাহাজ ভাসিয়ে/তুলে পারাপার করানো হয়।
খালে ঢোকবার আগে আরেকটি গল্প বলে নিই। নাম ছিল তাঁর ফ্রান্সিস রডন চেসনি (১৭৮৯-১৮৭২ খৃ.)। আইরিশ। ভারতে বৃটিশ রয়াল আর্টিলারির ক্যাপ্টেন ছিলেন । ভারত সরকারই তাঁকে মিশরে পাঠিয়েছিলেন সুয়েজ খালের ছানবিন করতে। ফরাসি এঞ্জিনিয়র জ্যাক মারী লে-পেয়ার যে ভুল করেছিলেন, চেসনি সে ভুল করলেন না। সন ১৮৩৫-এ তিনি দেখিয়য়ে দিলেন, ভূমধ্য ও লোহিতসাগরের মধ্যে যে জলতলের ফারাক নেই কোনো। তবে তা সত্ত্বেও, খালপথ নয়, তার বদলে ও এলাকা দিয়ে রেলপথের সুপারিশ করেছিলেন তিনি। প্রস্তাব দিয়েছিলেন, দক্ষিণ তুরস্কের মার্সিন বন্দর থেকে পারস্য উপসাগরের বসরা/আবাদান/কুয়েত পর্যন্ত (মাত্র) দু’হাজার কিলোমিটার ‘ইউফ্রেটিস রেলওয়েজ’ পাতা হোক, যার মাধ্যমে অতি দীর্ঘ কেপ-রুট এড়িয়ে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইরাকের মধ্যে দিয়ে ভারতের করাচি বা বোম্বাই বন্দরে আসা দ্রুত হবে [এ’লেখা পড়তে পড়তে পাশে ম্যাপখানি রাখলে ভালো হয়। রুট দুটি দেখে নেওয়া যায়।] এবং খরচও পড়বে অনেক অনেক কম।
১৮৩৬’এ বৃটিশ পার্লামেন্টে এ’ প্রস্তাব পাশও হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এ-প্রস্তাবে বাদ সাধল অন্যত্র। এর মধ্যে যে পালতোলা জাহাজের স্থানে স্টিমশিপ আসতে শুরু করেছে, এবং অনেক অনেক বেশি পরিমাণে পণ্য নিয়ে! ইউরোপের মিল থেকে আসা সে-সব মালপত্র তুরস্কে খালাস করে, পারস্য উপসাগর পর্যন্ত রেলপথে এনে ফের সেখান থেকে বোম্বাই/কলকাতার জন্য জাহাজে চাপানো ঝঞ্ঝাটের কাজ, সময় ও খরচসাপেক্ষও বটে।
অতএব?
অতএব, খালপথ নির্মাণই হলো একমাত্র সমাধান।
সুয়েজ খালের নির্মাণ এইভাবে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল।
৩
এগিয়ে চলো
‘কলম্বাস যা পারেননি, লেসেপ্স তা পারলেন।’ সুয়েজ খালের মাধ্যমে পূর্ব-পশ্চিমকে মিলিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গে লিখেছিলেন শ্রী অন্নদাশংকর রায়।
কে এই লেসেপ্স?
সেটা ১৮৩১। ফ্রেঞ্চ ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসের এক তরুণ অফিসার সদ্য পোস্টিং পেয়ে এসে পৌঁছোলেন মিশরে। আজকের কোভিড-কোয়ারান্টাইনের মতো সেকালেও নতুন কোন স্টেশনে পৌঁছলে ডিপ্লোম্যাটদের অবশ্য-নিভৃতবাস করতে হতো, কারণ পীতজ্বর-কলেরা-প্লেগের মতো ব্যাধি বারংবার প্লাবিত করেছে পৃথিবীকে।
ইং ১৮৩১সনে ছাব্বিশ বছর বয়সী ঐ ফরাসি রাজদূত আলেকজান্দ্রিয়ায় (মিশর) পোস্টিং পেয়ে কাছের এক দ্বীপে আবশ্যিক নিভৃতবাসে যেতে বাধ্য হলে তাঁর বস্ কয়েকটি বই-টই দিলেন পড়ে সময় কাটানোর জন্য। তার মধ্যে সেই ফরাসি এঞ্জিনিয়র জ্যাক মারী লে-পেয়ারের সুয়েজ-রিপোর্টখানিও ছিল, যাতে একটি খালের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে লোহিতসাগর যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এমনই ভবিতব্য, এই রিপোর্ট এরপর
থেকে সেই নওজোয়ান ফরাসি রাজদূতের ধ্যানজ্ঞান হয়ে পড়ল! উনি এর মধ্যে ব্যাবসাজাত মুনাফার অপার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন, যার বিপণন করে এরপর সুয়েজ প্রকল্পের জন্য টাকা তোলা হয়েছিল।
আর এর মধ্যে দিয়ে যে প্রযুক্তিগত বিস্ময় (engineering marvel) প্রকাশিত হয়েছিল, তার আগে মানবসভ্যতায় এমনটা দেখা গিয়েছিল কিনা সন্দেহ।
ফার্দিনান্দ দ লেসেপ্স (১৮০৫-১৮৯৪ খৃ.). অতি অভিজাত ও ধনী পরিবারের সন্তান, যাঁদের পূর্বপুরুষগণ বেশ দু’-তিন শতাব্দী ধরে রাজদূতিয়ালী করে আসছিলেন। ফার্দিনান্দের পড়াশুনো প্যারিসে, এবং পঁচিশ বছর বয়সে পড়তে-না-পড়তেই তিনি ফ্রেঞ্চ ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়ে ফেললেন।
এ’প্রসঙ্গে একটা কথা, ফার্দিনান্দ দ লেসেপ্স স্বয়ং ছিলেন একজন এঞ্জিনিয়র, এবং সুয়েজ খালের প্রযুক্তি তাঁরই, এমন একটা ভুল ধারণা অনেকের মনের মধ্যেই ঘুর ঘুর করে। এমনকি অন্নদাশংকরও তাঁকে ‘স্থপতি’ বলে বর্ণনা করেছিলেন [‘পথে প্রবাসে’]।
লেসেপ্স নিজে কিন্তু স্থপতি ছিলেন না, কিন্তু ছিলেন সুয়েজ খাল প্রকল্পের আসল মাথা! প্রকল্পটির চিফ এঞ্জিনিয়রের নাম ছিল ইউজিন মৌজেল বে, যদিও লেসেপ্সের কিংবদন্তি-স্তরে উত্তরণ অন্য অন্যদের ম্লান করে রেখেছিল।
***
লেসেপ্সের স্বপ্ন কিন্তু রাতারাতি সাকার হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘ প্রায় তিনটি দশক ধরে তিনি সুয়েজ খাল কাটানোর স্বপ্ন পোষণ করে রাখেন মনের মধ্যে, পুষ্ট করেন চিন্তাভাবনা। শেষে সন ১৮৫৩তে, মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে তাঁর রাষ্ট্রদূতের চাকুরিখানি পাকাপাকিভাবে ছেড়ে দিয়ে খাল-নির্মাণের কাজে পূর্ণ নিবেদিত হলেন। এর মধ্যে কিন্তু ওই অঞ্চলের কাছাকাছি ‘ক্রিমিয়ার যুদ্ধ’ (১৮৫৩-৫৬ খৃ.) সংঘটিত হওয়ায় ইঙ্গ-ফরাসি-অটোমান সম্পর্কের সমীকরণ বদলে গেছে।
ইং ১৮৫৮ সনে লেসেপ্স তৈরি করলেন ‘সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি’, হেড অফিস যার ফরাসি-রাজধানী প্যারিসে। অভূতপূর্ব এই খালপথ বানাতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে তো। সেটা আসবে কোত্থেকে? সেকালে কুড়ি কোটি ফ্রেঞ্চ ফ্রাঁ ধার্য হয়েছিল খাল কাটবার খরচ (যদিও বাস্তবে খরচা হয়েছিল এর দ্বিগুণ)। ‘আইপিও’ আনা হয়েছিল পাঁচশ’ ফ্রাঁ দামে চার লক্ষ শেয়ার বেচার জন্যে। ব্রিটেন-রাশিয়া-আমেরিকা থেকে কেউ কেনেনি শেয়ার কারণ এই প্রচেষ্টাকে অত্যন্ত দীর্ঘসূত্রী ও খরচসাপেক্ষ বলে সন্দেহ করে নিয়েছিল তারা । বালির দেশে আদৌ এতো দীর্ঘ খাল কাটা যাবে তো? কোম্পানির পঞ্চাশ শতাংশ শেয়ার নিল ফরাসি লগ্নীকারীরা, বাকি অর্ধেক মিশরের শাসক [‘ওয়ালি’] মহম্মদ আলি পাশার হাতে রইল।
৪
কাজের অগ্রগতি
কোম্পানি তো তৈরি হলো, টাকার জোগাড়ও হলো, কিন্তু আসল নির্মাণের কাজ?
২৫শে এপ্রিল ১৮৫৯-এ শুরু হয়ে ১৮৬৯-এ সম্পূর্ণ হয়। ঐ বছরে ১৮ই নভেম্বর উদ্ঘাটন হয়েছিল খালটির। তার আগের সন্ধ্যায় মিশর-অস্ট্রিয়া-জার্মানি-রাশিয়া প্রভৃতি দেশের রাজা-রানি-প্রিন্সদের নিয়ে মহা ঢক্কানিনাদের মধ্যে দিয়ে এক অনুষ্ঠান হয়েছিল… ফের পরের গপ্পো আগে করে ফেলছি!
***
প্রথমদিকে বালির দেশে পানীয় জল পাওয়াই কঠিন ছিল। খোঁড়ানো হলো অনেক কূপ। দাস-শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে দিচ্ছিল না মিশর সরকার, কাজের গতিতে তাই ঢিলে পড়েছিল। নানান দেশ থেকে ভাগে ভাগে প্রায় পনের লক্ষ শ্রমিক সুয়েজ প্রকল্পে কাজ করে গেছেন দশ বছর ধরে, যাদের মধ্যে এক লক্ষ বিশ হাজার জনের মৃত্যু হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট নাসের খালটির জাতীয়করণ করবার সময়ে (১৯৫৬)।
খালপথ চালু হবার পর তাতে লগ্নী করা বিপুল অর্থ উঠিয়ে আনাই ছিল একটা বড় চাপ।
আমাদের যেমন নিবেদিতা সেতু বা অন্য কোনো টোল রাস্তায় গাড়ি-বাস-লরি ইত্যাদি নিয়ে যেতে ভিন্ন ভিন্ন রকম টোল ট্যাক্স ভরতে হয়, সুয়েজ খাল দিয়ে যেতেও কন্টেনার/ট্যাঙ্কার/বাল্কারের মতো জাহাজগুলিকে আজকের দিনে পাঁচ থেকে সওয়া ছয় লাখ ডলার টোল ভরতে হয়ে। হ্যাঁ, একবারের জন্যে- সে উত্তরের পোর্ট সৈয়দ দিয়ে ঢোকো বা দক্ষিণের পোর্ট তিউফিক (সুয়েজ) দিয়ে। যদিও, প্রথমদিকে কয়েক বছর টোল আদায় আশানুরূপ হচ্ছিল না বলে কোম্পানি দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল।
বলা বাহুল্য, সুয়েজের উদ্ঘাটন বিশ্ববাজারে পণ্যের দামের উপরে অভূতপূর্ব প্রভাব ফেলেছিল। তদ্দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম তটের সান ফ্রানসিসকো থেকে পুবের নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত রেলরোডও তৈরি হয়ে গেছে। তাই আফ্রিকা-চীন-ভারতের বাজারে বাজারে সে-দেশের পণ্যের আমদানি হয়ে আসতে জাহাজকে আর দক্ষিণ অতলান্তিক মহাসাগর ঘুরে আসতে হত না, সুয়েজ হয়ে ভূমধ্যসাগরের মধ্যে দিয়েই প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার পথ বাঁচিয়ে তাদের পণ্য চলে আসতে শুরু করল পূর্বদেশে।
সুয়েজের এই বাণিজ্যিক দিকটা নিয়েই একটা লম্বা গল্প হয়ে যায় যে কীভাবে পুব দেশের মানুষের রুচি ও ফ্যাশনকে প্রভাবিত করেছিল এই খাল। শুরুতে তার একটা ইঙ্গিত দিয়েছি। পরে কখনও সে-গল্প বিস্তারিত করা যাবে এখন।
কিন্তু, আমাদের বৃটিশ ‘মহাপ্রভু’ তো আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন যে তাদের কেপ-বাণিজ্য বুঝি যায় যায়। বস্তুত, সুয়েজ খোলবার পর থেকে কেপের সুদিন আর ফিরে আসেনি।
তাই বলা হয়ে থাকে, সুয়েজ খালের খনন যতটা না প্রযৌক্তিক (technological) ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল কূটনৈতিক (diplomatic). দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মিশরের প্রেসিডেন্ট সুয়েজ খাল কোম্পানির রাষ্ট্রীয়করণ করে ফেললেন। হ্যাঁ, সে-ও তো আরেক গল্প ।
৫
আমার কথা ফুরোয় না
যুগে যুগে দেশে দেশে মানুষের প্রয়োজনীয়তা/চাহিদা (need) বদলে চলেছে, আর তার সঙ্গে বদলেছে সেই চাহিদা পূরণের উপায়। যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে, হয়েছে নূতন নূতন আবিষ্কার । এক রাজা এসেছে, আরেক রাজা চলে গেছে। মনুষ্যসভ্যতার রথের চাকা এগিয়ে চলেছে। চলবে।
তবুও এরই মধ্যে মহাকালের অঙ্গে সুয়েজ খালের নির্মাণ ও প্রভাব এক উল্লেখযোগ্য স্থান নিয়ে থেকে যাবে ভবিষ্যতেও।
আর অমর হয়ে থাকবেন এক ফরাসি মানুষ—ফার্দিনান্দ দ্য লেসেপ্স।
জয়ঢাকের টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে
অসাধারণ লাগলো। কত অজানারে, ঋদ্ধ হলাম।
LikeLike
অনবদ্য। পাঠে ঋদ্ধ হলাম।
LikeLike
ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, বাণিজ্য, প্রযুক্তি সব কিছু অনায়াস দক্ষতায় এক জায়গায় এনেছেন লেখক। কুর্নিশ।
LikeLike