টাইম মেশিন-বাংলার বাঘ ও ডাকাত -দুই চিনা ডাকাত-সুনীতি দেবী। অনুবাদ শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়-শরৎ ২০২২

আগের এপিসোড- ঝিয়ের গল্প্‌ ডাকাতের কবলে, প্রাণ বাঁচাল ভালুকে, অকারণে 

timemachineA boy's experience

কলকাতার একটা পেল্লায় বাড়িতে এক ইংরেজ তার বউ আর শালিকে নিয়ে বসবাস করত। শ্রীমতী সি ছিল খুবই পরিবার ন্যাওটা আর নার্ভাস প্রকৃতির। আর যেহেতু তার স্বামীকে ব্যাবসার কারণে প্রায়ই বাড়িতে অনুপস্থিত থাকতে হত, তারা শ্রীমতীর বোন ইথেলকে পীড়াপীড়ি করে ভারতে আসতে বলেছিল তাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় থাকার জন্য।

ইথেল খুব উজ্জ্বল প্রাণবন্ত মেয়ে, খুবই বাস্তববাদী এবং তার দিদির একেবারেই উলটো। দিদির মিনমিনে ভাব নিয়ে প্রায়ই পেছনে লাগত সে। একবার যখন অ্যালিস স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছিল, ইথেল বলেছিল, “মনে হয় আমিও যদি একটু তোর মতো হতাম অ্যালিস—আতুপুতু, নার্ভাস আর বোকাসোকা। আমিও তোর মতোই হয়তো এমন বর পেতাম যে আমায় নিয়ে আদিখ্যেতা করত, চার্লি যেমন তোকে নিয়ে করে।”

অ্যালিস বোনের স্পষ্ট কথায় হেসে ফেলে। বলে, “ধুর, তুই যদি এত শক্তপোক্ত আর শক্ত মনের না হতি, তুই আমায় আর একটু ভালোমতো বুঝতে পারতি ইথেল।”

খুব বেশিদিন পর নয়, দুই মহিলাকে কিছুদিনের জন্য একলা রেখে মিস্টার চার্লসকে ব্যাবসার কাজে বাইরে যেতেই হল। ও যখন চলে গেল, ইথেল তার দিদির সঙ্গেই ঘুমোত। তখন শীতের দিন, তাড়াতাড়ি সন্ধে নামে আর রাতগুলোও লম্বা। শ্রীমতী চার্লি রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেতে ভালোবাসত, আর তারপরেই এসে শুয়ে পড়ত। ইথেল ভালোবাসত গোটা সন্ধে জুড়ে পড়তে বা লেখালেখি করতে—কখনো-কখনো গভীর রাত অবধি জেগে থাকত সে।

একদিন দুপুরবেলা তারা খেতে বসেছে, টেলিগ্রাম এল। অ্যালিস টেলিগ্রামটা খুলেই উল্লসিত হয়ে উঠল—“চার্লি ডিনারের আগেই এসে যাবে লিখেছে।”

সন্ধে গড়াল, ডিনারের সময় পার হল, কিন্তু মিস্টার চার্লি এল না। দুই মহিলা ন’টা অবধি অপেক্ষা করল, তারপর খেয়ে নিল। ক্রমে দশটা বাজল, তবুও কারও আসার নাম নেই দেখে অ্যালিস বলল যে সে শুতে যাবে। কেননা চার্লি নির্ঘাত ট্রেন ফেল করেছে আর পরের ট্রেন মাঝরাতের আগে নেই।

ইথেল তার বই থেকে মুখ তুলে বলল, “ঠিক আছে। আমি আমার ঘরেই ঘুমোচ্ছি।”

“ওহ্‌! তুই জানিস আমি একলা থাকতে পারি না!” অ্যালিস বলে উঠল, “চার্লি না আসা অবধি তুই আমার ঘরে এসে শো।”

“অ্যালিস, বড্ড স্বার্থপর তুই।” ইথেল জবাব দিল, “ও আসার হয়তো কয়েক মিনিট আগে আমি শুতে যাব। ফলে সন্ধের পোশাকেই তোর ঘরের বিছানায় শুতে হবে।”

“কী বোকা রে!” অ্যালিস বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বলল, “রোজকার মতো পোশাক বদলে আসতে পারবি না কেন? চার্লি হয়তো সারারাতে এলই না, আর আমি একলা থাকতে ভয় পাই তো জানিস।”

“বেশ, বেশ।” ইথেল বলে, “আমি তোর ঘরে এসেই পড়াশোনা করছি চার্লি না আসা অবধি। আমি এমন মানুষকে বিয়ে করব না যে ব্যাবসার কাজে খালি বাইরে থাকে।” এই বলে সে তার হেলানো চেয়ার থেকে উঠে দিদির সঙ্গে বড়ো শোবার ঘরে গেল। বিছানার একদিকে ফের বই মুখে করে বসে পড়ল সে।

অ্যালিস পোশাক ছেড়ে বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুম। ইথেল হাতের বইটা শেষ করে শুয়ে শুয়ে জামাইবাবুর অপেক্ষায় রইল। বাইরের ঘর আর সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে আলো নেভানো হয়নি, বাড়িটা শান্ত এবং নিস্তব্ধ। বারোটা নাগাদ অ্যালিস বিড়বিড় করে বলল, “মিস্টার চার্লি কি আর আসবে? ভালো হবে ইথেল পোশাক ছেড়ে এসে এখানেই শুয়ে পড়ুক।” ঠিক তখুনি ইথেল সিঁড়িতে হালকা পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল।

‘ওই যে চার্লি।’ সে মনে মনে বলল, ‘কী সন্তর্পণে সিঁড়ি দিয়ে আসছে। কী ভালো বর, কেমন খেয়াল রাখে।’ সে দিদির দিকে দেখল, গভীর ঘুমে ডুবে রয়েছে। ‘আমিও ঘুমের ভান করি।’ ইথেল নিজেই নিজেকে বলল আর চাদরটা টেনে ওর সান্ধ্য পোশাকটা ঢেকে দিল আর মাথার ওপরে একটা বালিশ টেনে চাপা দিয়ে দিল।

চার্লির দেরি হচ্ছে। হতাশ হচ্ছিল ও। ভাবছিল, চার্লি কি ডিনার করছে? ঠিক সে-সময় দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল, কিন্তু চার্লির বদলে দুটো চিনা লোক ঢুকে এল ঘরে। ইথেল বালিশের ফাঁক দিয়ে বিস্ময়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রথমটা ওরা দরজার পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর আওয়াজ না করে সেটা বন্ধ করে ঘরের ভেতরে এল। ওদের অদ্ভুত পোশাক, লম্বা গোছ বাঁধা চুল, লাল চোখ আর নিঃশব্দ চলাফেরা এই গভীর রাতে ঘরের মধ্যে গা-ছমছমে আবহাওয়া তৈরি করেছে এবং জীবনে এই প্রথমবার ইথেল বুঝতে পারল স্নায়ুচাপ কাকে বলে। তার নাড়ির গতি হঠাৎ করে বেড়ে এমন দ্রুত কখনও হয়নি যেমনটা এখন হচ্ছে। অতিকষ্টে চেঁচিয়ে ওঠা থেকে সে নিজেকে নিরস্ত করে লোকগুলোকে বালিশের ফাঁক দিয়ে জরিপ করতে থাকল।

ওরা ঘরটা খুঁজেপেতে দেখল। তারপর ওদের একজন সাজার টেবিলের কাছে গিয়ে ওপরে রাখা রুপোর গয়না আর দামি রত্নগুলো একটা বড়ো ব্যাগে ভরে নিল। অন্যজন পকেট থেকে একটা বড়ো সিগার বার করে ধরাল। তারপর শ্রীমতী চার্লির পাশটাতে গিয়ে ওর মুখে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। সে চিত হয়ে ঘুমোচ্ছিল। ধোঁয়ায় প্রথমটা নড়েচড়ে উঠলেও শিগগিরই আরও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ও। কয়েক মিনিট পর চিনে লোকটা ঘুরে ইথেলের দিকে এল, কিন্তু ওর মুখে বালিশ চাপা আর ওকে গভীরভাবে ঘুমোতে দেখে লোকটা ওর স্যাঙাৎকে সাহায্য করতে চলে গেল।

এই সময় মিস্টার চার্লির গলার আওয়াজ পাওয়া গেল বাইরের হলে। শিস দিতে দিতে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত ওপরে আসছে চার্লি। ডাকাত দুটো দ্রুত নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে বিপদ বুঝে লুটের মালসহ ব্যাগটা নিয়ে একটা বড়ো আলমারির পেছনে গিয়ে লুকোল।

চার্লি দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এল—“অ্যালিস! কোথায় তুমি?” খাটের কাছে এসে সে বলল, “কী ঘুম!” বলে স্ত্রীর ওপর ঝুঁকে এল।

কিন্তু সে তখন এমন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন যে স্বামীর উপস্থিতি টেরই পেল না। চার্লি এবার বিছানার অন্যদিকে ইথেলের উপস্থিতি টের পেল। সে আস্তে আস্তে ঘুরে ইথেলের পাশটাতে গিয়ে ওর হাতটা ছুঁয়ে বলল, “তুমিও ঘুমে নাকি?”

ইথেল বালিশটা সরিয়ে হাতটা টানটান করে আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসল। ওর পরনে সান্ধ্য পোশাক লক্ষ করল চার্লি। বলতে শুরু করল কেন ওর এত দেরি হল ইত্যাদি।

এসব বলার মাঝেই ইথেল বিছানা ছেড়ে আচমকা লাফ দিয়ে উঠল—“তোমার বউকে দেখো, মরার মতো লাগছে না?” বলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

চার্লি বউয়ের পাশটায় ফিরে গিয়ে কাছ থেকে ভালোভাবে দেখল। ওর মুখটা অদ্ভুত ফ্যাকাশে আর হাতগুলো ঠান্ডা। ওকে জাগানোর অনেক চেষ্টা করল ও। চেষ্টা জারি আছে এমন সময় ইথেল ফিরে এল চাকরবাকরদের সঙ্গে নিয়ে। তাদের ভয়ানক উত্তেজিত লাগছিল।

“অ্যালিসের কী হয়েছে?”

চার্লির প্রশ্নের উত্তরে ইথেল বলল, “দুটো চোর আলমারির পেছনে লুকিয়ে আছে। চাকরদের সাহায্যে ও-দুটোকে পাকড়াও করো, তখনই বুঝবে অ্যালিসের কী হয়েছে।”

অচিরেই দুটো চিনাকে আলমারির পেছন থেকে বার করে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হল। একজন ডাক্তারকেও ডাকা হল এবং অ্যালিসকে জাগিয়ে তোলা হল। ওকে আফিমের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলা হয়েছিল।

জয়ঢাকের টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s