ভ্রমণ-পরিব্রাজক (৭ম পর্ব)-স্বামী বিবেকানন্দ (সম্পাদনা: অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়)-শরৎ ২০২১

পরিব্রাজক(প্রথম পর্ব),পরিব্রাজক (২য় পর্ব) পরিব্রাজক (৩য় পর্ব), পরিব্রাজক (৪র্থ পর্ব), পরিব্রাজক (৫ম পর্ব)  পরিব্রাজক (৬ষ্ঠ পর্ব)

(সপ্তম পর্ব)

স্বামী বিবেকানন্দ

কলকাতা বন্দর থেকে বাষ্পচালিত জাহাজ গোলকোন্ডায় তিন সন্ন্যাসীকে সঙ্গে নিয়ে বিবেকানন্দ চলেছেন পশ্চিমের উদ্দেশ্যে। জাহাজে বসে উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন

জাহাজ তো রেড-সীর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পাদ্রী বললেন, “এই হল রেড-সী… ইহুদী নেতা মুসা সদলবলে পদব্রজে পার হয়েছিলেন। আর তাদের ধরে নিয়ে যাবার জন্যে মিশরের বাদশা ‘ফেরো’ যে ফৌজ পাঠিয়েছিলেন, তারা কাদায় রথচক্রে ডুবে, কর্ণের মত আটকে, জলে ডুবে মারা গেল।” পাদ্রী আরও বললেন,“এ-কথা এখন আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা প্রমাণ হতে পারে। এখন সব দেশে ধর্মের আজগুবী ব্যাপারগুলো বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করবার এক ঢেউ উঠেছে। মিঞা! যদি প্রাকৃতিক নিয়মে ঐ সবগুলি হয়ে থাকে তো আর তোমার য়াভে-দেবতা মাঝখান থেকে আসেন কেন? বড়ই মুশকিল! যদি এসব বিজ্ঞান বিরুদ্ধ হয়, তো ওই কেরামতগুলি আজগুবী এবং তোমার ধর্ম মিথ্যা। যদি বিজ্ঞানসম্মত হয়, তাহলেও তোমার দেবতার মহিমাটি বাড়ার ভাগ, অন্য সব প্রাকৃতিক ঘটনার মত আপনা-আপনি হয়েছে।”

পাদ্রী বোগেশ বললে, “আমি অত শত জানিনি, আমি বিশ্বাস করি।” এই কথাটি মন্দ নয়। তবে ওই যে একদল আছে, পরের বেলা দোষটি দেখাতে, যুক্তিটি আনতে কেমন তৈরি। যারা নিজের বেলায় বলে, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমার মন সাক্ষ্য দেয়’—তাদের কথাগুলো একদম অসহ্য। নিজে একটা কিম্ভূত-কিমাকার কল্পনা করে কেঁদেই অস্থির!!

জাহাজ ক্রমেই উত্তরে চলেছে। এই রেড-সীর কিনারা—প্রাচীন সভ্যতার এক মহাকেন্দ্র। ওই ওপারে আরবের মরুভূমি, এপারে মিশর। সেই প্রাচীন মিশর… এই মিশরীয়রা দেশ হতে রেড-সী পার হয়ে, কত হাজার বৎসর আগে, ক্রমে ক্রমে রাজ্য বিস্তার করে মানুষ উত্তরে পৌঁছেছিল। এদের আশ্চর্য শক্তিবিস্তার, রাজ্যবিস্তার, সভ্যতাবিস্তার। যবনেরা এদের শিষ্য। এদের বাদশাদের পিরামিড নামক আশ্চর্য সমাধিমন্দির, নারীসিংহী মূর্তি। এদের মৃতদেহগুলি পর্যন্ত আজও বিদ্যমান। বাবরি-কাটা চুল, কাছাহীন ধপ‍্ধপে ধুতি পরা, কানে কুণ্ডল পরা লোক এই দেশে বাস করত। এই—হিক‍্স বংশ, ফেরো বংশ, ইরানী বাদশাহী, সিকন্দর, টলেমী বংশ এবং রোমক ও আরব বীরদের রঙ্গভূমি—মিশর। সেই কতকাল আগে এরা আপনাদের বৃত্তান্ত পাপিরস্ পত্রে, পাথরে, মাটির বাসনের গায়ে চিত্রাক্ষরে তন্ন তন্ন করে লিখে গেছে।

এই ভূমিতে আইসিসের পূজা, হোরসের প্রাদুর্ভাব। এই প্রাচীন মিশরীয়দের মতে—মানুষ মরলে তার সূক্ষ্ম শরীর বেড়িয়ে বেড়ায়, কিন্তু মৃতদেহের কোন অনিষ্ট হলেই সূক্ষ্ম শরীরে আঘাত লাগে, আর মৃত শরীরের ধ্বংস হলেই সূক্ষ্ম শরীরের একান্ত নাশ, তাই শরীর রাখবার এত যত্ন। তাই রাজা-বাদশাদের পিরামিড। কত কৌশল! কী পরিশ্রম! সবই বিফল! ঐ পিরামিড খুঁড়ে, নানা কৌশলে রাস্তার রহস্য ভেদ করে রত্নলোভে দস্যুরা সে রাজ-শরীর চুরি করেছে। আজ নয়, প্রাচীন মিশরীয়রা নিজেরাই করেছে। পাঁচ সাত-শ বৎসর আগে এই সকল শুকনো মরাগুলো ইহুদী ও আরব ডাক্তারেরা মহৌষধি-জ্ঞানে ইওরোপ-সুদ্ধ রোগীকে খাওয়াত।

এই মিশরে টলেমী বাদশার সময়ে সম্রাট অশোক ধর্মপ্রচারক পাঠান। তারা ধর্ম প্রচার করত, রোগ ভাল করত, নিরামিষ খেত, বিয়ে করত না, সন্ন্যাসী শিষ্য করত। তারা নানা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করল—থেরাপিউট, অসসিনী, মানিকী ইত্যাদি, যা থেকে বর্তমান ক্রিশ্চানী ধর্মের সমুদ্ভব। এই মিশরই টলেমীদের রাজত্বকালে সর্ববিদ্যার আকর হয়ে উঠেছিল। এই মিশরেই সে আলেকজান্দ্রিয়া নগর, যেখানকার বিদ্যালয়, পুস্তাকাগার, বিদ্বজ্জন, জগৎপ্রসিদ্ধ হয়েছিল। আলেকজান্দ্রিয়া মূর্খ গোঁড়া ইতর ক্রিশ্চানদের হাতে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেল। পুস্তকালয় ভস্মরাশি হল। বিদ্যার সর্বনাশ হল! শেষ বিদুষী নারীকে ক্রিশ্চানেরা নিহত করে, তাঁর নগ্নদেহ রাস্তায় রাস্তায় সকল প্রকার বীভৎস অপমান করে টেনে বেড়িয়ে, অস্থি থেকে টুকরা টুকরা মাংস আলাদা করে ফেলেছিল!

আর দক্ষিণে—বীরপ্রসূ আরবের মরুভূমি। কখনও আলখাল্লা ঝোলানো, পশমের গোছা দড়ি দিয়ে একখানা মস্ত রুমাল মাথায় আঁটা। বদ্দু আরব দেখেছ? একেবারে ঠিক সেই চলন, সেই দাঁড়াবার ভঙ্গী, সেই চাউনি, আর কোন দেশে নাই। আপাদমস্তক দিয়ে মরুভূমির অনবরুদ্ধ হাওয়ার স্বাধীনতা ফুটে বেরুচ্ছে—সেই আরব। যখন ক্রিশ্চানদের গোঁড়ামি আর গথদের বর্বরতা প্রাচীন ইউনান ও রোমান সভ্যতালোককে নির্বাণ করে দিলে, যখন ইরান অন্তরের পূতিগন্ধ ক্রমাগত সোনার পাত দিয়ে মোড়বার চেষ্টা করছিল, যখন ভারতে পাটলিপুত্র ও উজ্জয়িনীর গৌরবরবি অস্তাচলে, উপরে মূর্খ ক্রূর রাজগর্ব, ভিতরে ভীষণ অশ্লীলতা ও কামপূজার আবর্জনারাশি—সেই সময়ে এই নগণ্য পশুপ্রায় আরবজাতি বিদ্যুদ্বেগে ভূমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ল।

bhromonporibrajok02

ওই দেখি ষ্টীমার মক্কা থেকে আসছে, যাত্রী ভরা। ইওরোপী পোষাক পরা তুর্ক, আধা ইওরোপীবেশে মিশরী, ওই সূরিয়াবাসী মুসলমান ইরানীবেশে, আর ওই আসল আরব ধুতিপরা—কাছা নেই। মহম্মদের পূর্বে কাবার মন্দিরে উলঙ্গ হয়ে প্রদক্ষিণ করতে হত, কিন্তু তাঁর সময় থেকে একটা ধুতি জড়াতে হয়। তাই আমাদের মুসলমানেরা নমাজের সময় ইজারের দড়ি খোলে, ধুতির কাছা খুলে দেয়। আর আরবদের সেকাল নেই। ক্রমাগত কাফ্রি, সিদি, হাবসি রক্ত প্রবেশ করে চেহারা উদ্যম—সব বদলে গেছে, মরুভূমির আরব পুনর্মূষিক হয়েছেন। যারা উত্তরে, তারা তুরস্কের রাজ্যে চুপচাপ বাস করে। কিন্তু সুলতানের ক্রিশ্চান প্রজারা তুরস্ককে ঘৃণা করে, আরবকে ভালবাসে। আর খাঁটি তুর্করা ক্রিশ্চানদের উপর বড়ই অত্যাচার করে।

মরুভূমি অত্যন্ত উত্তপ্ত হলেও সে গরম দুর্বল করে না। তাতে কাপড়ে গা-মাথা ঢেকে রাখলেই আর গোল নেই। শুষ্ক গরম—দুর্বল তো করেই না, বরং বিশেষ বলকারক। রাজপুতানার, আরবের, আফ্রিকার লোকগুলি এর নিদর্শন। মারোয়াড়ের এক এক জেলায় মানুষ, গরু, ঘোড়া—সবই সবল ও আকারে বৃহৎ। আরবী মানুষ ও সিদিদের দেখলে আনন্দ হয়। যেখানে জোলো গরম— যেমন বাঙলা দেশ, সেখানে শরীর অত্যন্ত অবসন্ন হয়ে পড়ে, আর সব দুর্বল।

রেড-সীর নামে যাত্রীদের হৃৎকম্প হয়—ভয়ানক গরম, তায় এই গরমকাল। ডেকে বসে যে যেমন পারছে, একটা ভীষণ দুর্ঘটনার গল্প শোনাচ্ছে। কাপ্তেন সকলের চেয়ে উঁচিয়ে বলছেন। তিনি বললেন, “দিন কতক আগে একখানা চীনি যুদ্ধজাহাজ এই রেড-সী দিয়ে যাচ্ছিল, তার কাপ্তেন ও আট জন কয়লাওয়ালা খালাসী গরমে মরে গেছে।”

এই সকল গল্প শুনে হৃৎকম্প হবার তো যোগাড়। কিন্তু অদৃষ্ট ভাল, আমরা বিশেষ গরম কিছুই পেলুম না। হাওয়া দক্ষিণী না হয়ে উত্তর থেকে আসতে লাগল—সে ভূমধ্যসাগরের ঠাণ্ডা হাওয়া।

(ক্রমশ)

কৃতজ্ঞতা: উদ্বোধন কার্যালয়, রামকৃষ্ণ মিশন

ভ্রমণ সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s