পরিব্রাজক(প্রথম পর্ব),পরিব্রাজক (২য় পর্ব) পরিব্রাজক (৩য় পর্ব), পরিব্রাজক (৪র্থ পর্ব), পরিব্রাজক (৫ম পর্ব)
(পঞ্চম পর্ব)
স্বামী বিবেকানন্দ
কলকাতা বন্দর থেকে বাষ্পচালিত জাহাজ গোলকোন্ডায় তিন সন্ন্যাসীকে সঙ্গে নিয়ে বিবেকানন্দ চলেছেন পশ্চিমের উদ্দেশ্যে। জাহাজে বসে উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন—
আটাশে জুন প্রাতঃকাল জাহাজ কলম্বো ছাড়ল। এবার ভরা মনসুনের মধ্য দিয়ে গমন। জাহাজ যত এগিয়ে যাচ্ছে, ঝড় ততই বাড়ছে, বাতাস ততই বিকট নিনাদ করছে। মুষলধারে বৃষ্টি, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঢেউ গর্জে গর্জে জাহাজের উপর এসে পড়ছে। ডেকের ওপর তিস্টানো দায়। খাবার টেবিলের উপর আড়ে লম্বায় কাঠ দিয়ে চৌকো চৌকো খুপরি করে দিয়েছে, তার নাম ‘ফিডল’। তার উপর দিয়ে খাবার দাবার লাফিয়ে উঠছে। জাহাজ ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ করে উঠছে, যেন বা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন বলছেন, “তাইতো! এবারকার মনসুনটা তো ভারি বিটকেল!”
ক্যাপ্টেনটি বেশ লোক। চীন ও ভারতবর্ষের নিকটবর্তী সমুদ্রে অনেক দিন কাটিয়েছেন। আমুদে লোক, আষাঢ়ে গল্প করতে ভারি মজবুত। কত রকম বোম্বেটের গল্প—চীনে কুলি জাহাজের অফিসারদের মেরে ফেলে কেমন করে জাহাজ শুদ্ধ লুটে নিয়ে পালাত—এই রকম বহু গল্প করছেন। আর কী করা যায়? লেখা পড়া তো এই দুলুনির চোটে মুশকিল। কেবিনের ভেতর বসা দায়। ঢেউয়ের ভয়ে জানালাটা এঁটে দিয়েছে। এক দিন তু-ভায়া(*) জানলাটা একটু খুলে রেখেছিলেন। একটা ঢেউয়ের টুকরো এসে জলপ্লাবন করে গেল! উপরে সে ওছল-পাছলের কী ধুম! তারই ভেতরে তোমার ‘উদ্বোধন’-এর কাজ অল্প স্বল্প চলছে মনে রেখো। জাহাজে দুই পাদ্রী উঠেছেন। একটি আমেরিকান—সস্ত্রীক, বড় ভাল মানুষ, নাম বোগেশ। বোগেশের সাত বৎসর বিয়ে হয়েছে। ছেলে-মেয়েতে ছটি সন্তান। একখানা কাঁথা পেতে বোগেশ-ঘরণী ছেলেপিলেগুলিকে ডেকের উপর শুইয়ে চলে যায়। তারা নোংরা হয়ে কেঁদেকেটে গড়াগড়ি দেয়। যাত্রীরা সদাই সভয়ে। ডেকে বেড়াবার যো নেই, পাছে বোগেশের ছেলেপেলেদের মাড়িয়ে ফেলে। খুব ছোটটিকে একটি কানাতোলা চৌকা চুবড়িতে শুইয়ে, বোগেশ আর বোগেশের পাদ্রিনী জড়াজড়ি হয়ে কোণে চার ঘণ্টা বসে থাকে। তোমার ইওরোপীয় সভ্যতা বোঝা দায়। আমরা যদি বাইরে কুলকুচো করি, কী দাঁত মাজি—বলে, ‘কী অসভ্য’! তোমরা আবার এই সভ্যতার নকল করতে যাও! যাহোক প্রোটেষ্টাণ্ট ধর্মে উত্তর ইওরোপের যে কী উপকার করেছে, তা পাদ্রী পুরুষ না দেখলে তোমরা বুঝতে পারবে না। যদি এই দশ কোটি ইংরেজ সব মরে যায়, খালি পুরোহিতকুল বেঁচে থাকে, বিশ বছরে আবার দশ কোটির সৃষ্টি হবে।
জাহাজের টাল-মাটালে অনেকেরই মাথা ধরে উঠেছে। টুটল বলে একটি ছোট মেয়ে বাপের সঙ্গে যাচ্ছে, তার মা নেই। আমাদের নিবেদিতা টুটল ও বোগেশের ছেলেপিলের মা হয়ে বসেছে। টুটল বাপের কাছে মাইসোরে মানুষ হয়েছে। বাপ প্লাণ্টার। টুটলকে জিজ্ঞাসা করলুম ‘টুটল! কেমন আছ?’ টুটল বললে, ‘এ বাঙলাটা ভাল নয়, বড্ড দোলে, আর আমার অসুখ করে।’ টুটলের কাছে ঘর দোর সব বাঙলা। বোগেশের একটি এঁড়ে লাগা ছেলের বড় অযত্ন, বেচারা সারাদিন ডেকের কাঠের ওপর গড়িয়ে বেড়াচ্ছে! বুড়ো ক্যাপ্টেন মাঝে মাঝে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাকে চামচে করে সুরুয়া খাইয়ে যায়, আর তার পা-টি দেখিয়ে বলে, ‘কী রোগা ছেলে, কী অযত্ন!’
অনেকে অনন্ত সুখ চায়। সুখ অনন্ত হলে দুঃখও যে অনন্ত হত, তার কী? তা হলে কি আর আমরা এডেন পৌঁছুতুম। ভাগ্যিস সুখ দুঃখ কিছুই অনন্ত নয়, তাই ছয় দিনের পথ চৌদ্দ দিন করে, দিনরাত বিষম ঝড়-বাদলের মধ্য দিয়েও, শেষটা এডেনে পৌঁছে গেলুম। কলম্বো থেকে যত এগুনো যায় ততই ঝড় বাড়ে। ততই আকাশ পুকুর, ততই বৃষ্টি, ততই বাতাসের জোর, ততই ঢেউ। সে বাতাস, সে ঢেউ ঠেলে কি জাহাজ চলে? জাহাজের গতি অর্ধেক হয়ে গেল, সকোত্রা দ্বীপের কাছাকাছি গিয়ে বেজায় বাড়ল। কাপ্তেন বললেন, ‘এইখানটা মনসুনের কেন্দ্র। এইটা পেরোতে পারলেই ক্রমে ঠাণ্ডা সমুদ্র।’ তাই হল। এ দুঃস্বপ্নও কাটল।
৮ই সন্ধ্যাকালে এডেন। কাউকে নামতে দেবে না, কালা-গোরা মানে না। কোন জিনিষ ওঠাতে দেবে না, দেখবার জিনিষও বড় নেই। কেবল ধুধু বালি, রাজপুতানার ভাব—বৃক্ষহীন তৃণহীন পাহাড়। পাহাড়ের ভেতরে ভেতরে কেল্লা, ওপরে পল্টনের ব্যারাক। সামনে অর্ধচন্দ্রাকৃতি হোটেল আর দোকানগুলি জাহাজ থেকে দেখা যাচ্ছে। অনেকগুলি জাহাজ দাঁড়িয়ে। একখানি ইংরেজী যুদ্ধজাহাজ, বাকীগুলি মালের বা যাত্রীর জাহাজ। গতবারে এডেন দেখা আছে। পাহাড়ের পেছনে দিশী পল্টনের ছাউনি, বাজার। সেখান থেকে মাইল কতক গিয়ে পাহাড়ের গায় বড় বড় গহ্বর তৈয়ারী করা, তাতে বৃষ্টির জল জমে। পূর্বে ঐ জলই ছিল ভরসা। এখন যন্ত্রযোগে সমুদ্রজল বাষ্প করে আবার জমিয়ে পরিষ্কার জল হচ্ছে। এডেন ভারতবর্ষেরই একটি শহর যেন—দিশী ফৌজ, দিশী লোক অনেক। পারসী দোকানদার, সিদ্ধি ব্যাপারী অনেক। এডেন বড় প্রাচীন স্থান। রোমান বাদশা কনষ্টান্সিউস (Constantius) এখানে এক দল পাদ্রী পাঠিয়ে ক্রিশ্চান ধর্ম প্রচার করান। পরে আরবেরা সে ক্রিশ্চানদের মেরে ফেলে। তাতে রোমি সুলতান প্রাচীন ক্রিশ্চান হাবসি দেশের বাদশাকে তাদের সাজা দিতে অনুরোধ করেন। হাবসি-রাজ ফৌজ পাঠিয়ে এডেনের আরবদের খুব সাজা দেন। পরে এডেন ইরানের সামানিডি বাদশাদের হাতে যায়। তাঁরাই নাকি প্রথমে জলের জন্য ঐ সকল গহ্বর খোদান। তারপর মুসলমান ধর্মের অভ্যুদয়ের পর এডেন আরবদের হাতে যায়। কিছুকাল পরে পর্তুগীজ সেনাপতি ওই স্থান দখলের বৃথা উদ্যম করেন। পরে তুরস্কের সুলতান ওই স্থানকে পোর্তুগীজদের ভারত মহাসাগর থেকে তাড়াবার জন্য জাহাজের বন্দর করেন।
আবার এই শহর নিকটবর্তী আরব-মালিকের অধিকারে যায়। পরে ইংরেজরা ক্রয় করে বর্তমান এডেন করেছেন। এখন প্রত্যেক শক্তিমান জাতির যুদ্ধপোত পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াচ্চে। কোথায় কি গোলযোগ হচ্ছে, তাতে সকলেই দু-কথা কইতে চায়। নিজেদের প্রাধান্য, স্বার্থ, বাণিজ্য রক্ষা করতে চায়। কাজেই মাঝে মাঝে কয়লার দরকার। পরের জায়গায় কয়লা নেওয়া যুদ্ধকালে চলবে না বলে, আপন আপন কয়লা নেওয়ার স্থান করতে চায়। ভাল ভালগুলি ইংরেজ তো নিয়ে বসেছে। তারপর ফ্রান্স, তারপর যে যেথায় পায়…কেড়ে, কিনে, খোশামোদ করে এক একটা জায়গা করেছে এবং করছে। সুয়েজ খাল হচ্ছে এখন ইওরোপ-এশিয়ার সংযোগ স্থান। সেটা ফরাসীদের হাতে। কাজেই ইংরেজ এডেনে খুব চেপে বসেছে, আর অন্যান্য জাতও রেড-সীর ধারে ধারে এক একটা জায়গা করেছে। কখনও বা জায়গা নিয়ে উল্টো উৎপাত হয়। সাতশ বছর পরপদদলিত ইতালী কত কষ্টে পায়ের উপর খাড়া হল। হয়েই ভাবলো—‘কী হলুম রে! এখন দিগ্বিজয় করতে হবে।’ ইওরোপের এক টুকরোও কারও নেবার যো নেই, সকলে মিলে তাকে মারবে! এশিয়ার বড় বড় বাঘ-ভালুক—ইংরেজ, রুশ, ফ্রেঞ্চ, ডচ—এরা আর কি কিছু রেখেছে? এখন বাকী আছে দু-চার টুকরো আফ্রিকার। ইতালী সেই দিকে চলল। প্রথমে উত্তর আফ্রিকায় চেষ্টা করল। সেথায় ফ্রান্সের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এল। তারপর ইংরেজরা রেড-সীর ধারে একটি জমি দান করল। মতলব—সেই কেন্দ্র হতে ইতালী হাবসি-রাজ্য উদরসাৎ করেন। ইতালীও সৈন্যসামন্ত নিয়ে এগুলেন। কিন্তু হাবসি বাদশা মেনেলিক এমনি গো-বেড়েন দিলে যে, এখন ইতালীর আফ্রিকা ছেড়ে প্রাণ বাঁচানো দায় হয়েছে। আবার রুশের ক্রিশ্চান এবং হাবসির ক্রিশ্চানি নাকি এক রকমের—তাই রুশের বাদশা ভেতরে ভেতরে হাবসিদের সহায়।
(*) স্বামী তুরীয়ানন্দ, বিবেকানন্দের সফরের সঙ্গী
(ক্রমশ)
কৃতজ্ঞতা: উদ্বোধন কার্যালয়, রামকৃষ্ণ মিশন