বনের ডায়েরি-পাখি দেখা -পাপিয়া-অলোক গাঙ্গুলী-শীত-২০২২

আগের পর্ব ধনেশ, মাছরাঙা, মুনিয়া, কাজল পাখি , দোয়েল-কোকিল-ময়না বুলবুল, বকপাখি, মোনাল দেখার গল্প, পাঁচ বউয়ের কাহিনি, ঘুঘুর বাসা, টুনটুনি, বাঁশপাতি, মোহনচূড়া , হাট্টিমাটিমটিম থেকে হটিটি, রামগাংড়া, ডাহুক কেন ডাকে, বাদামি কোকিল

বাংলায় বোধহয় প্রতিটি পাখির সঙ্গে একটা গান বাঁধা রয়েছে, আর রয়েছে মেয়েদের নাম রাখার প্রচলন পাখিদের নামের সঙ্গে। পাপিয়া তেমনই একটি পাখি। যেমন সুন্দর নাম আর তেমনই মধুর এর গানের গলা। আমরা প্রত্যেকেই এর গান শুনেছি। হয়তো মনে নেই, তবুও আমি মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। পুরোনো একটি জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবি, ধন্যি মেয়ে—একটি দৃশ্যে আমাদের খুবই পছন্দের একজন অভিনেত্রী, এখন মুম্বাই নিবাসী, জয়া বচ্চন, গান গাইতে গাইতে চলেছেন গ্রামের রাস্তা দিয়ে—চোখ গেল, বয়ে গেল। এবার হয়তো মনে পড়েছে আমরা এই পাখিকে ‘চোখ গেল পাখি’ বলেও জেনে থাকি।  তাছাড়া কাজী নজরুল ইসলামও একে নিয়ে গান বেঁধেছেন:

চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে
চোখ গেল পাখি রে!
তোরও চোখে কাহার চোখ পড়েছে নাকি রে
চোখ গেল পাখি রে!

ইংরাজিতে এই পাখির নাম হল Common Hawk Cuckoo, আমরা বাংলাতে এই পাখিকে পাপিয়া বলে জানি। আবার এই পাখিকে Brainfever Bird-ও বলে হয়ে থাকে। এই পাখির বৈজ্ঞানিক নাম হল Hierococcyx Varius। গায়ের রঙ ধূসর রঙের, হলুদ-কালো ঠোঁট, হলুদ চোখ, হলুদ পা, তাতে মাংসল বলয় থাকে। গলার অংশের রঙ সাদা হয়ে থাকে। গলার তলার দিকে বুকের অংশের রঙ হালকা লালচে খয়েরি হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালের ভরদুপুরবেলায় এদের ডাক সবথেকে বেশি শোনা যায়। এরা বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় শিকার করে তা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে।

bonerdiary01

এই পাখিকে শীতকালে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন, কারণ শীতকালে এরা ডাকে না। গরম পড়ার সঙ্গে এরা আনন্দে ডেকে ওঠে এবং এদের ডাক ধীরে ধীরে উপরের দিকে ওঠে ও হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে সারারাত ধরেও ডাকতে শোনা যায়। এইজন্য একে ব্রেনফিভার বার্ডও বলা হয়। এরাও কাক্কু (Cuckoo), অর্থাৎ কোকিল পরিবারের পাখি আর পরনির্ভরশীল। তার মানে নিজেরা বাসা বাঁধে না আর পরের বাসায় ডিম পাড়ে, বিশেষ করে ছাতার আর পেঙ্গা পাখির বাসায়, কারণ এই পাখিদের ডিমের সঙ্গে পাপিয়ার ডিমের মিল রয়েছে। আরও জানা যায়, পাপিয়ার ছানা ডিম ফুটে বেরোবার সঙ্গেই অন্য পাখির ডিম ঠেলে বাসার থেকে ফেলে দেয় যাতে সেই পাখিরা এদের অযত্ন না করতে পারে। কী অসাধরণ বুদ্ধি ওই শিশু বয়েস থেকেই, ভাবা যায়!

 চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই পাখি এমন সুন্দর গান গাইতে পারে। যেখানে বসে থাকে, দেখলে মনে হবে এ বুঝি কোনও শিকারি পাখি হবে, বিশেষ করে ওর চোখ দেখলে তাই মনে হয়। সেজন্যেই হয়তো চোখ গেল গান করে সকলকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা। প্রথম দর্শনে আমারও সেরকম মনে হয়েছিল যে এরকম কদর্য একটা পাখি কী করে এত সুন্দর গান গায়! তাই বোধহয় বলা হয়ে থাকে, সবসময় রূপের বিচার না করে গুণের কথা ভাবতে। এর সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনলে পরে মন এমনিতেই আত্মহারা হয়ে ওঠে।

পাখি নিয়ে যখন কৌতূহল বাড়ল, তখন থেকেই এই পাখিকে খঁজে বের করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছি। বাড়ি থেকেই প্রতিদিন ওর ডাক শুনতে পাই, কিন্তু দেখতে পাই না। দূরের কোনও গাছের ডালে বসে একমনে গান গেয়ে চলেছে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই এক সুন্দর ঘাসভূমি; সেখানে অনেক প্রজাতির পাখির বসবাস। গেলেই কিছু না কিছু সুন্দর পাখি চোখে পড়বেই। সেবারও বেরিয়ে পড়েছি শীতের বেলায় সেই ঘাসভূমিতে পাখির খোঁজে। কী অদ্ভুত সমাপতন, প্রথমে এক বিদ্যুতের তারে এক পাখি পেলাম, ছবি তুললাম পরে দেখব বলে, কারণ ওই রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বেশিক্ষণ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। তাই ঘাসভূমির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গাড়ি কিছুটা দূরে রেখে হেঁটেই প্রবেশ করতে হয় সেই ঘাসভূমির দিকে। খুব সুন্দর স্থান, দূর থেকে মনে হবে কোনও গভীর অরণ্যে প্রবেশ করছি। কিছুটা এগোলেই দু-দিকে খোলা ঘাসভূমি, কিছুটা জলাভূমি—একবারে পাখিদের জন্য আদর্শ বলা যায়। প্রবেশের মুখেই একটি বড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছ; দুটি বড়ো ডাল দু-দিকে চলে গেছে আর ঠিক সঙ্গম স্থানে, অর্থাৎ মাঝখানে একটি পাখি, সেই পাখি যাকে কিছুক্ষণ আগে বিদ্যুতের তারে বসে থাকতে দেখলাম। তাই বললাম অদ্ভুত সমাপতন। একই দিনে দু-বার একই পাখি, নাকি সেই পাখি যাকে মোড়ের মাথায় দেখলাম আর সে আমার পৌঁছবার আগেই উড়ে এসে জুড়ে বসেছে—যাই, একটু ভালো করে সুন্দর জায়গায় বসে পোজ দিয়ে আসি। ভদ্রলোক ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বেরিয়েছেন আমার ছবি তুলতে, তাই একটু ভালো করে তুলে সবাইকে দেখান, এই ভেবেই সেই পাখিটা ওখানে উড়ে এসে বসেছে? এটা অবশ্যই আমার খেয়াল পাখিটার মনের কথা ভেবে। হতেই তো পারে। সেই রাস্তার মোড় থেকে এই স্থান এক কিলোমিটারের বেশি হবে না। আর ওই ব্যস্ত মোড়ে ওর মন লাগার কথাও নয় এত ভালো জায়গা থাকতে।

bonerdiary02

ছবি- লেখক

বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s