আগের পর্ব ধনেশ, মাছরাঙা, মুনিয়া, কাজল পাখি , দোয়েল-কোকিল-ময়না বুলবুল, বকপাখি, মোনাল দেখার গল্প, পাঁচ বউয়ের কাহিনি, ঘুঘুর বাসা, টুনটুনি, বাঁশপাতি, মোহনচূড়া , হাট্টিমাটিমটিম থেকে হটিটি, রামগাংড়া, ডাহুক কেন ডাকে, বাদামি কোকিল, পাপিয়া
একে তো মুরগি, তাও নাকি আবার জলে। আমি তো সত্যিই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম শুনে, মুরগি নাকি জলে সাঁতার কাটে। এই পাখি প্রথমবার দেখি কাশ্মীরের ডাল হ্রদে—অনেক দূরে, মানুষের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে থাকে। তবে আমার লেন্স থেকে রেহাই পায়নি, ঠিক ধরে ফেলেছিলাম। হাঁস ও মুরগির ছানাকে নিয়ে রূপকথার গল্প বেশ মজার—এটি রুশ ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন ননী ভৌমিক মহাশয়, যাতে বলা হয়েছে ডিম ফুটে বেরোনোর থেকে জলে যাওয়া পর্যন্ত, শেষে মুরগির ছানার আর জলে নামতে পারল না। মূল গল্পটি রুশ লেখক ভ্লাদিমির সুতেয়েভ। আমার মনে হয় ভ্লাদিমির সুতেয়েভ বোধহয় গৃহপালিত মুরগির কথা বলেছিলেন তাঁর গল্পে; তিনি সেই সময় হয়তো জল-মুরগি দেখে উঠতে পারেননি। আর এই পাখি কিন্তু সর্বত্রই দেখা মেলে, প্রায় সব দেশেই। এই কিছুদিন আগেও আমি ডিসকভারি চ্যানেলে দেখছিলাম সুদূর চিলির অ্যাটাকামা মরুভূমির এক জলাশয়েও দেখা গেছে। কাশ্মীরে আমি দেখেছি আর আমার বাড়ির কাছাকাছি সমস্ত জলাজমিতে এরা বিতরণ করে বেড়ায়। তাহলে রাশিয়ার এই লেখক নিশ্চয়ই জল-মুরগি দেখেননি। সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবান।
ঠোঁটের গোড়ার লাল বর্ণটা বাদ দিলে ডাহুক মনে হবে। এ পাখি লম্বায় ৩০-৩৮ সেন্টিমিটার। ঠোঁটের গোড়া প্রবাল লাল, দেখতে অনেকটাই ডাহুকের মতো। অগ্রভাগ হলদেটে। মাথা, গলা কালো। পিঠ, ডানা পিঙ্গল। ডানা গোটানো অবস্থায় সাদা ডোরা দেখা যায়। লেজের ওপর কালচে, নীচের দিক সাদার ওপর কালো ছোপ। চোখের তারা লালচে। পা ও পায়ের পাতা সবুজাভ-হলুদ, হাঁটুর ওপর লাল বলয়। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একইরকম। আমিষ-নিরামিষ সব ধরনের খাবার এদের পছন্দ। বলা যায় সর্বভুক পাখি এরা। প্রজনন সময় মে থেকে আগস্ট। বাসা বাঁধে ঘাস বনের ভেতর অথবা জলের ওপর নুয়ে পড়া গাছের ডালে। দেখে বেশ ভালোই লাগল যে অবশেষে মুরগিও জলে সাঁতার কাটছে।
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে এক আত্মীয় এসেছিলেন মুম্বই থেকে। তাঁর ইচ্ছে হল একবার হাওড়া, শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখার—বিশেষ করে সেই বিখ্যাত বটগাছটি। সেই সময় অবশ্য করোনা ভাইরাসের দাপাদাপি খানিকটা কম ছিল, তাই খুব একটা কড়াকড়িও ছিল না। একটা বড়ো ইনোভা গাড়িতে করে সবাই মিলেও যাওয়া হল। আমার উদ্দেশ্য বটগাছ নয়, সে আমার একাধিক বার দেখা। শীতকালে যেতে ইচ্ছে হয় কেবল পাখি দেখার জন্য। সেই সময় ভিড় একদমই ছিল না; পরিবেশ বেশ শান্ত, মানুষের উপদ্রব অনেক কম তাই পাখিদের দেখা পাওয়া সহজ। আর এমনিতেই বোটানিক্যাল গার্ডেন ছোটো ছোটো জলাশয়ে ভরপুর আর তার মধ্যে জলজ পাখি দেখতে পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। সবক’টি জলাশয়েই জল পিপি আর জল-মুরগি অনেক সংখ্যায় দেখতে পেলাম। যেহেতু জল-মুরগির সাক্ষাৎ আমি এর আগেই ভূস্বর্গ কাশ্মীরে পেয়েছিলাম, তাই একবারেই চিনতে অসুবিধে হয়নি। এখন আমি জানি এই পাখি সর্বত্রই দেখা যায়, কিন্তু ওই সময় আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে আমি বোধহয় নতুন কোনও প্রজাতির মুরগি আবিষ্কার করে ফেলেছি যা নাকি আবার সাঁতার কাটতে পারে।
ভূস্বর্গের ডাল ঝিল পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। কাশ্মীরে বেড়াতে গেলে ডাল ঝিলের শিকারায় না উঠে পারা যায়? কী অপূর্ব দৃশ্য চারদিকের—পাহাড়ঘেরা, তার পেছনের পাহাড় আবার তুষারাবৃত। আমরা দু-রাত হাউস-বোটে কাটিয়েছিলাম। সেই হাউস-বোটের অলিন্দ থেকে সামনের পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত শঙ্করাচার্যের মন্দির দেখা যায়। এই ডাল ঝিল শীতকালে বরফে জমাট বেঁধে যায়, অর্থাৎ সম্পূর্ণ হিমায়িত হয়ে পড়ে। তখন পর্যটক কম থাকে আর স্থানীয়রা ওই বরফজমা ঝিলের ওপর হেঁটে হাউস-বোটের দিকে যাতায়াত করে। এই দৃশ্যের আমি একজান প্রত্যক্ষদর্শী। আমার শৈশবের দু-বছর কেটেছে ভূস্বর্গ কাশ্মীরে। বাবার হাত ধরে বহুবার গিয়েছি ডাল ঝিলের ধারে—গ্রীষ্মে এবং শীতে। আর শীতকালে যদি কখনও আকাশ পরিষ্কার পাওয়া যায় তাহলে চারদিকের দৃশ্য সম্মোহিত করার মতো হয়ে ওঠে। শৈশবে তো আর পাখি দেখার বাতিক ছিল না, তাই জল-মুরগি তখন সাঁতার কাটত কি না জানি না তবে এই মধ্য বয়েসে এসে যখন পাখি দেখার পোকা মাথায় নড়ে উঠল তখন এই ঝিলে মুরগির সাঁতার দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। বড়োসড়ো জলাশয় এই ডাল ঝিল; প্রচুর পরিমাণে পর্যটকের শিকারায় চড়ে নৌকাবিহারে বেরিয়ে পড়েন আর তাঁদের পীড়ায় পাখিরা আর জলের কাছে আসতে পারে না, ঝিলের ধারে গাছের ডালে বিশ্রাম নেয়। তবে এই ঝিলের একদিক একদম ফাঁকা এখন, পর্যটকেরা আর ওদিকে যায় না আর অন্যদিকে রয়েছে ভাসমান বাজার। কী না পাওয়া যায় সেখানে—রকমারি ফুল, বাহারি শাকসবজি, ফলমূল, খেলনা, নানা ধরনের সব গৃহসজ্জার সামগ্রী আরও কত কিছু। আমরা এক ভাসমান হাউস-বোটে কাশ্মীর এম্পোরিয়াম নামে এক পণ্যসামগ্রীর প্রদর্শশালায় প্রবেশ করে বেশ কিছু কাশ্মীরি কম্বল ও চাদর কিনেছিলাম। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। তখনই লক্ষ করলাম, কাছেই দুটো হাউস-বোটের মাঝে একটা পাখি জলের মধ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রথমে কোনও হিমালয়ের হাঁস মনে করলাম অথচ ঠোঁটটা ঠিক হাঁসের মতো নয়। একটু খটকা ছিল। অনেকটা মুরগির মতো দেখতে, কিন্তু আমি জানতাম মুরগি জলে নামে না—ঠিক সুতেয়েভের ছড়ার মতো—মুরগি আবার সাঁতার কাটে নাকি। কলকাতায় ফিরে এসে সেই ছবি যখন বিষেশজ্ঞদের দেখালাম আর আমার মনের কথা বললাম, তাঁরা তো হেসেই অস্থির। তাঁরা বলেন, কতরকমের মুরগি আছে তা জানো কি? আমি মাথা নাড়ালাম। তাঁরা বললেন, যাও বাড়ি গিয়ে বই দেখো, নিজেই জানতে পারবে। পরে জানলাম যে এই পাখি ক্রেক ও রেল পরিবারের সদস্য যাদের দেখতে অনেকটাই মুরগির মতো। আমার ধোঁয়াশা কাটল। এ জলজ পাখি, আর জলে থাকতেই পছন্দ করে। তারপর কেবল বোটানিক্যাল গার্ডেন নয়, সুদূর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জেও দেখা পেয়েছি এই পাতি জল-মুরগির। এই পাখির জলকেলি অন্যান্যদের চেয়ে কম কিছু নয়। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে দীর্ঘ সময় ধরে।
বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে