বনের ডায়েরি-বন বন্দুকের ডায়েরি-বাঘমারা ভীম-অনুঃদেবজ্যোতি ভট্টাচার্য-শরৎ ২০২১

বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়, আলাদিনের গুহা, শিকারী বন্ধু গোন্দ, হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (১), হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (২)বোয়া সাপের খপ্পরে, বে-ডর লছ্‌মণ, মানুষখেকো নেকড়ে , নেকড়ে মানুষ সিয়াল

মূল: বন বন্দুকের ডায়েরি-মার্ভিন স্মিথ

bonerdiarybonbonduk

“লোকগুলোকে যে কেমন করে তোমরা সহ্য কর কে জানে। আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে চাবকে এদের এলাকাছাড়া করে দিতাম। যে’রকম কাপুরুষের মত রাস্তায় এরা বাঘ মারে তা দেখলে মাথা নীচু হয়ে যায়। ছি ছি! এই রাসকেলগুলোকে না আটকালে এ-দেশে একদিন শিকার করবার জন্য একটা বাঘও মিলবে না আর!”

বাঘমারি ভীমের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার পর আমার এক প্ল্যান্টার বন্ধু এহেন মন্তব্যটি শুনিয়েছিলেন আমাকে। তবে আমি তাঁর সঙ্গে একমত নই একেবারেই। বরং বিশ্বাস করি, এই বাঘমারিরা সমাজের বন্ধু।

বাঘমারি ভীমের নিজের দাবি অনেক বেশি। কিন্তু সে যে এ-অবধি অন্তত দুটো প্যান্থার, দুটো চিতা, একটা বাঘ আর একটা ভালুক শিকার করেছে তার প্রমাণ আছে আমার কাছে। জন্তুগুলোর চামড়া আমার বাংলোর দেয়ালে সাজানো আছে। ছোটোনাগপুর জেলার সোমজি গ্রামের এক মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে এদের প্রত্যেকটিকে শিকার করা হয়। সবক’টা শিকারই করা হয়েছিল দু’মাস সময়ের ভেতর।

বাঘ আর প্যান্থার মিলে ভারতবর্ষের ঠিক কত পোষা গরুছাগলের প্রাণ নেয় তার হিসেব করলে বোঝা যাবে কেন ভীমকে আমি সমাজের বন্ধু বলেছি। গত এক বছর সময়ে কেবল আমার বাংলোর আশপাশেই ছাব্বিশটা গরু বা মোষ বাঘের মুখে গেছে। গ্রামবাসীদের চাষবাসের একমাত্র সহায় এই পুষ্যি জন্তুর দল। ভীম এগিয়ে না এলে তাদের অপূরণীয় এই ক্ষতি আরও বাড়ত বই কমত না।

তবে সে-সব কথা থাক। বাঘমারি ভীমের গল্প শোনা যাক এবার-

“আগে আমি বাঘমারি ছিলাম না হুজুর, জাতে আমি তাঁতি। কিন্তু একটা ছোটা বাঘ (প্যান্থার) আমায় এ-পথে এনেছে। তবে আদৌ সে বাঘ ছিল না কোনো। ও এক ডাইনি। বাঘের শরীরে ভর করেছিল আমায় মারবার জন্য। আমিও ছাড়বার পাত্র নই। গাজি গোন্দকে দু’টাকা দিয়ে একটা তাবিজ নিলাম। তিন বছরের মাথায় ও বাঘ আমার হাতে মারা পড়ল। সে খবর তো আপনিও জানেন হুজুর। সে-বার মাধোর ছেলেটাকে খাবার পর আপনার বাবুর্চিখানার পেছনেই তো ওটাকে মারলাম আমি!

“ওটাই যে সেই ডাইনি বাঘ সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই হুজুর। ওকে আমি মারবার পরেই চিনেছি। তিন বছর আগে আমার গাঁ বারহা-তে আমি ওর একটা কান কেটে নিয়েছিলাম বাল্লুভা( শিকারের কুড়ুল)-র এক কোপে। সেই দিয়েই তো গাজি আমায় তাবিজটা বানিয়ে দিল! এই যে-, দেখুন, এখনো সেটা আমার গায়ে পরা আছে। আর ওই যে, আপনার দেওয়ালে শয়তানটার চামড়া টাঙানো।

“ওই ডাইনির ওপরে বদলা নিতে নেমেই আমার বাঘমারি হওয়া। এই যে আমার মাথাটা দেখুন! একগাছি চুল পাবেন না। তিন বছর আগে ওই ডাইনি আমার মাথায় টাক করে দিয়েছিল। ঘটোনাটা বলি শুনুন। আমাদের গাঁয়ের লাগন নামের এক বুড়ির জন্য আমি একটা কাপড় বুনে দিয়েছিলাম। খরচ হয়েছিল একটাকা দু আনা। ছ-আনা লাভ রেখে দাম চাইলাম, তা বুড়ি হাতে দিল ওই একটাকা দু-আনা। যখন লাভের ছ-আনা চাইতে গেলাম, বুড়ি পয়সা তো দিলই না, উলটে আমায় অভিশাপ দিল, ‘তোকে বাঘে খাক।’

“তার কয়েক রাত বাদে ঐ ছোটা বাঘ আমার ছাগলের খোঁয়ারে ঢুকে দুটো ছাগল মারল। তিন নম্বরটাকে যখন মারতে গেছে তখন আমি আওয়াজ পেয়ে সেখানে গিয়ে কুড়ুল দিয়ে কোপ মারতে মাথায় না লেগে কোপ লাগল তার কানে। বাঘটা আমার মাথায় এমন আঁচড়ে দিল যে তাইতে সব চুলগুলো খসে গেল আমার হুজুর।

বড়ো রাগ হয়ে গেল হুজুর। ঠিক করলাম লাফানে ধনুক (স্প্রিং বো) আর বিষের তির দিয়ে মারব জানোয়ারটাকে। চলে গেলাম কৌটিয়া। সেখানে মৌন সিং-এর থেকে তার কায়দাকানুন শিখে এলাম।

“তা শিখলাম তো কাজেই লাগাই না কেন? সেই যে শুরু হল, সেই থেকে আমি বাঘমারি। দুটো বাঘ, দশটা প্যান্থার দুটো চিতা আর পাঁচখানা ভাল্লুক মেরেছি হুজুর গত তিন বছরে। একেকটা বাঘের জন্য সরকার থেকে পঁচিশ টাকা পাই। আর একেকটা চিতা বা ছোটা বাঘের জন্য পাঁচ টাকা করে। ভালুকের জন্য সরকার কোনো পয়সাকড়ি দেয় না। গাঁয়ের কারো গোরুমোষ বাঘে নিলে, সে বাঘ মারলে গ্রাম থেকে পাই চার সের চাল। সেইসঙ্গে যে-কদিন সে গ্রামে থাকি সে-কদিনের খোরপোষ। বারহার দশ মাইলের মধ্যে আমি একমাত্র বাঘমারি। বাইরের এলাকায় আরো বাঘমারি আছে।

“কুচিলার শেকড়ের বিষ লাগাই আমরা তিরের মাথায়। ওর শেকড় বেশ মোটা হয়। তোলায় চার আনা দরে চাইবাসার গাছগাছড়ার দোকান থেকে কিনে আনি। খানিক ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে হামানদিস্তায় পিষে মলমের মত করে নিই ওকে প্রথমে। তারপর তাকে ন্যাকড়ায় মাখিয়ে তিরের ফলায় ভাল করে জড়িয়ে দিই। বিষ-কাপড় জড়ানো তিরের ফলাটা আলগাভাবে তিরের লাঠির গায়ে আটকানো থাকে। কোনো জন্তুর দিকে তাক করে ছুঁড়লে ওই কাপড়ের টুকরো শুদ্ধু ফলাটা তার গায়ে গেঁথে যায় আর তিরের লাঠিটা খসে পড়ে। একবার গায়ে গাঁথলে কয়েক ঘন্টার ভেতর খেল খতম। তারপর রক্তের দাগ ধরে ধরে তাকে খুঁজে নিলেই হল।

“তবে হ্যাঁ, ভালুক মারা সবচেয়ে কঠিন। বিষের তির শরীরে নিয়ে ওরা এক দিনেরও বেশি বেঁচে থাকতে পারে। ওদিকে, বাঘ কিন্তু মরে বেজায় তাড়াতাড়ি।

“তবে মুশকিল হল, একে তো কুচিলার গাছ এদিকে গজায় না। সেই কলকাতা থেকে আনা হয়। তার ওপর, বেশিদি রেখে দিলে ওর বিষ ফিকে হয়ে যায়। সেদিক দিয়ে আবার কেউটের বিষ বেজায় ভাল জিনিস। যতদিনই ফেলে রাখুন, নষ্ট হবে না।

“আমি তাই করেছি কী, দুটো কেউটে পুষেছি বাড়িতে। মাসে একবার তাদের বিষ গেলে নিই। তবে সেখানেও মুশকিল। দুতিনমাসে একবার খোলশ ছাড়ে ওরা। সে-সময় একফোঁটা বিষ থাকে না দাঁতে। কিছুতেই কলায় কামড় দেবেই না!”

“কলায় কামড়? সে আবার কী?”

“আহা ওই করেই তো কেউটের বিষ গেলে নিই আমরা হুজুর! করি কি, লাঠির আগায় একটা পাকা কলা বেঁধে নিয়ে তাই দিয়ে কেউটের মাথায় বারকয়েক মারলে সে রেগে গিয়ে কলায় ছোবল বসাবে। ছোবল মেরে মাথাটায় যদি প্যাঁচ দেয় তাহলে কলায় বিষ চলে আসবে। নইলে নয়। এরপরের কাজটা সোজা। বিষভর্তি কলাটাকে কাপড়ের টুকরোর গায়ে ঘসে নিয়ে সেইটে তিরের ফলায় পেঁচিয়ে নিলেই হল। দুবার ছোবলানো একখানা কলায় যতটুকু বিষ আসে তাই দিয়ে হেসেখেলে একটা বড়োসড়ো বাঘকে কাত করে দেওয়া যায়।

“বাঘ মারবার জন্য ঠিকঠাক জায়গায় ধনুক লাগাতে হয় হুজুর। ও জন্তু ঝোপঝাড় ভেঙে কক্ষণো চলে না। ওতে শিকার আওয়াজ পেয়ে পালাবে কি না! ওরা তাই ঝোপজঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে চলবার জন্য শুঁড়িপথ খোঁজে। ঝোপের গায়ে গোঁফ ঠেকিয়ে ঠিক টের পায় ওর মধ্যে কোথা দিয়ে চলবার পথ আছে। তারপর সেই পথে খানিক নীচু হয়ে গুটি গুটি এগোবে।

“শুকনোর দিনে জঙ্গলে হরেক শূঁড়িপথ। কোন্‌ পথ দিয়ে সে চলবে তা বোঝা মুশকিল। তাই গরমের দিনে আমরা কক্ষণো এ-ভাবে শিকার করি না। বর্ষাকালে যখন ঝোপঝাড় বেড়ে গিয়ে দুএকটা মাত্র বাঘ চলবার পথ বেঁচে থাকে তখন, যে-পথে তাকে বেশি যাতায়াত করতে দেখা গেছে তেমন রাস্তায়  ফাঁদ পাতি আমরা। রাস্তার একপাশে মাটি থেকে দেড় ফুট মতন উঁচুতে পাশাপাশি দুটো শক্তপোক্ত ডাল খুঁজে নিয়ে ধনুকের দুটো মাথা আটকানো হয় প্রথমে। তাইতে একসঙ্গে দুটো বিষের তির পরাই।

“তারপর ছিলাটাকে একটা লম্বা সুতোর এক মাথায় বেঁধে টেনে ধরা হয়। সেই অবস্থাতেই সুতোটাকে অন্য একটা ডালে পাক দিয়ে বাঘের রাস্তার অন্যধার অবধি টেনে নিয়ে যাই। তারপর সুতোর অন্য মাথা সেদিকে কোথাও একটা বেঁধে দিলেই লাফানে ধনুকের ফাঁদ পাতা শেষ। বাঘকে এবার সে-রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে মাটি থেকে দেড় ফুট উঁচুতে রাস্তার এপাড়-ওপাড় করা সুতো ছিঁড়ে তবে যেতে হবে। আর সুতো ছিঁড়লেই তির ছুটবে ধনুক থেকে। ধনুকের নিশানা বাঁধা থাকে রাস্তা পেরোনো সুতোর দিকে। কাজেই তির গিয়ে লাগে বাঘের পাঁজরায়। ঘন্টাকয়েকের ভেতর, ফাঁদের কয়েকশো ফিটের মধ্যে তার খেলা সাঙ্গ হয়ে যায়।”

“কিন্তু কোনো মানুষ বা গরুমোষ যদি সে-পথে আসে?”

“তার বন্দোবস্তও আছে। কোনো রাস্তায় তেমন সম্ভাবনা থাকলে সুতো একটা নয়, দুটো বাঁধা হয়। এমনভাবে সুতো নেয়া হয় যে, তার যেকোন একটা ছিঁড়লেই অন্যটা ছিলার টান একলা সামলাতে না পেরে নিজেনিজেই ছিঁড়ে যাবে। দু’নম্বর সুতোটা তিরের নিশানা থেকে চার-পাঁচ গজ দূরে সাড়ে তিন ফিট উঁচু দিয়ে রাস্তা পেরোয়। বাঘ এলে তার মাথা সে সুতোর নাগাল পাবে না।  কিন্তু মানুষ বা গরুমোষ এলে নিশানার জায়গায় আসবার আগেই উঁচু সুতো ছিঁড়বে তার গায়ে লেগে। অমনি তির ছুটবে, কিন্তু কারো গায়ে লাগবে না।

“আপনারা যখন বাঘকে গুলি করেন হুজুর, তখন গুলিখাওয়া বাঘের পিছু নিলে প্রাণের ভয় থাকে। কিন্তু বিষের তির খাওয়া বাঘের পিছু নিলে ভয়ের কিছু থাকে না। ও তির তাকে এমন দুবলা করে দেয় যে মুখ ঘুরিয়ে কামড়াবার ক্ষমতাও থাকে না তার। কুড়ুলের এক কোপে আমরা তার দফারফা করে দিই। ঐ ডাইনি প্যান্থারের আঁচড় খাবার পর থেকে এতগুলো শিকার তো করলাম হুজুর, কিন্তু এখন অবধি একটা বাঘের আঁচড়ও লাগেনি আমার গায়ে।   

তা এই হল গিয়ে বাঘমারিদের বিষয়ে কিছু খবরাখবর। ভীমকে বারবার নানা প্রশ্ন করে করে এই খবরগুলো জোটানো গেছে। এর পরের অধ্যায়ে তাহলে তার আসল গল্প, ডাইনি-প্যান্থারের গল্প বলা যাবে।

বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s