বনের ডায়েরি-বন বন্দুকের ডায়েরি-অরণ্যের সন্তান জুয়াং-মার্ভিন স্মিথ অনু-দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য-বর্ষা২০২২

বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়, আলাদিনের গুহা, শিকারী বন্ধু গোন্দ, হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (১), হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (২)বোয়া সাপের খপ্পরে, বে-ডর লছ্‌মণ, মানুষখেকো নেকড়ে , নেকড়ে মানুষ সিয়াল, বাঘমারা ভীম, ডাইনি প্যান্থার, মহিষাসুরের খপ্পরে

boneriarybonbonduk

সভ্যতার মূলস্রোত থেকে দূরে থাকা মানুষজনের কাছাকাছি যাবার জন্য মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাটার জুড়ি নেই। এ-পেশার মানুষকে নতুন নতুন খনির সন্ধানে শহর ছেড়ে চলে যেতে হয় শ্বাপদসঙ্কুল দুর্গম অরণ্য-পাহাড়ে। সেখানকার বাসিন্দারা আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি।  

১৮৯০-এর শীতকালে সোনার খনির খোঁজে আমাকে পাঠানো হল বোনাই আর কেওঞ্ঝর নামের দুই দেশীয় রাজ্যের সীমানার পাহাড়ি এলাকায়। বাংলা প্রেসিডেন্সির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের এই গোটা এলাকাটাকে ছোটা নাগপুর, কিংবা আরো ঠিকভাবে বলতে গেলে চুটিয়া নাগপুর বলে। উড়িষ্যার কিছু করদ মহল আর এই ছোটা নাগপুর মিলে বিস্তীর্ণ একটা অঞ্চল গভীর অরণ্যে ঢাকা। এদিক-ওদিক এক থেকে চার হাজার ফিট উঁচু পাহাড়ের দল। শাল, ধোর, অর্জুন এবং আরও নানা কিসিমের দামি কাঠের গাছের ছড়াছড়ি এই জঙ্গলে।

এই অরণ্যের বুক চিরে এগিয়ে গেছে বেঙ্গল নাগপুর রেল। সে রেল তৈরি হবার আগে এই এলাকার বিষয়ে ইউরোপিয়ানরা বিশেষ কিছুই জানত না। কিছুকাল আগে অবধি এই এলাকার আদিবাসীদের মধ্যে ডাইনি পোড়ানো, নরবলি কিংবা নরমাংস খাওয়ার ব্যাপক প্রচলন ছিল। চাইবাসা আর রাঁচির আদালতের কাগজপত্র দেখলে বোঝা যায় এখনও সে-সব প্রথা এই অঞ্চল থেকে পুরোপুরি মুছে যায়নি। এখানকার আদিবাসীদের মধ্যে বেশির ভাগই কোল বা তাদের উত্তরসূরী। কোলদের উৎস সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে দ্বিমত আছে। কারো মতে এরা উত্তর-পুব থেকে ভারতবর্ষে আসা কোনো লড়াকু জাতের বংশধর। আবার অনেকে মনে করেন এরা এখানকারই ভূমিপুত্র।

যে এলাকায় আমি চলেছি তখন, সে হল সে-তল্লাটের সবচেয়ে কম চেনাজানা অঞ্চল। জায়গাটা পাহাড়ি। আকাশের দিকে চার হাজার ফিটেরও বেশি মাথা উঁচোনো পাহাড়গুলোর শরীর ঘন জঙ্গলে ঢাকা। গভীর অরণ্যের মধ্যে দূরে দূরে খানিক চাষজমি ঘিরে লুরকা, কোল, ভূমিজ আর গোন্দদের ছোটো ছোটো গ্রাম। এখানকার স্থানীয় এক রাজা আমায় গর্ব করে বলেছিলেন, “আমার রাজত্বে ঘোড়ায় চেপে  চল্লিশ মাইল সিধে গেলেও একটা মানুষের মুখ দেখতে পাবেন না সাহেব।”

সমতল ছাড়িয়ে উঁচু এলাকায় ঢুকলে চাকাওয়ালা গাড়ির কোনো চলই নেই। ফলে বলদের পিঠে মালপত্র চাপিয়ে বহু কষ্টে আমি তখন সে-এলাকায় এসে পৌঁছেছি। ব্রাহ্মণী নদীর একটা শাখা বয় এলাকাটা দিয়ে। তার নাম কোর্সুয়া। তার ধারেই তাঁবু ফেলে আমি তখন কেওঞ্ঝরের দিকে ঠেলে উঠছি।

একদিন দুপুরবেলা নদীর ধার ধরে ধরে জঙ্গল ঠেলে চলেছি। মাঝে মাঝে এক-একটা জায়গায় সোনা পাবার সম্ভাবনা দেখলে থেমে যাই। মাটির থালায় করে নদীর ধারের বালি চেলে দেখি সোনার খোঁজে। তারপর ফের পথ চলি। তবে ক্বচিৎ দু-এক কুঁচি সোনা বৈ তখনও বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। আমার সঙ্গে ছিল মুকরু নামে এক কোল চাকর আর সোনা ধোবার কাজের জন্য দুজন ঝোরা সহকারী।

রোদ বেজায় চড়ে উঠতে আমরা গিয়ে বসলাম একটা বিরাট শাল গাছের ছায়ায়। এ-অঞ্চলের ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে সবাই নস্যি নেয়। ছায়ার একধারে বসে আমার লোকজনও সেই নস্যি নিতে ব্যস্ত।

টানটান হয়ে শুয়ে একটা বিস্কুট চিবোচ্ছি সবে এমন সময় একটা শব্দ শুনে আমরা সবাই একসঙ্গে চমকে উঠে দাঁড়ালাম। খানিক দূরে নদীর মধ্যে একটা জায়গায় জল খানিক গভীর। সেখান থেকে একদল মেয়ের হাসির শব্দ উঠেছে তখন হঠাৎ।

ব্যাপারটা অদ্ভুত। কাছাকাছি মাইলদশেকের মধ্যে কোনো গ্রাম নেই। তাহলে এই বিজন জঙ্গলে মেয়েদের গলায় হাসে কে? আওয়াজ পেয়েই মুকরু উঠে চলে গিয়েছিল ব্যাপারটা কী দেখে আসতে। খানিক বাদে সে ফিরে এসে জানাল, নদীতে একদল জুয়াং এসেছে। এরা বুনো মানুষ। তাদের দলের মেয়ে আর বাচ্চারা নদীতে স্নান করতে নেমেছে। ছেলেরা সম্ভবত নদীর ওপাড়ের জঙ্গলে গিয়েছে।

এই জুয়াংদের কথা আমি আগেও শুনেছি। কেউ বলে এরা এক ধরনের বিরাট চেহারার বাঁদর। আবার কারো কারো মতে এরা এ-জঙ্গলের কোনো বুনো মানুষের সম্প্রদায়। গাছে বাসা বেঁধে থাকে। কাপড়চোপড় পরতে শেখেনি। মুকরু বলল, এদের দেখতে চাইলে যেন সাবধানে এগোই। বেজায় ভিতু এরা। সামান্য শব্দ পেলেই হরিণের মত ছুট দেবে জঙ্গলের ভেতর।

নিঃশব্দে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘুরপথে এগিয়ে জলের কাছাকাছি পৌঁছে একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। জনাদশেক জুয়াং নদীর অন্য পাড়ে জড়ো হয়ে স্নান করতে ব্যস্ত। ছেলেদের পরনে বুনো কলার খোলের টুকরো দিয়ে তৈরি লেংটি। মেয়েদের শরীরে স্বর্গ থেকে নির্বাসনের সময় ইভ যেটুকু পোশাক পরেছিলেন তার চাইতে খানিক কম ঢাকাঢুকি। একটা সরু লতা কোমরে জড়িয়ে তার সামনে দুটি করে শালপাতা আর পেছনে একবোঝা শালপাতা ঝোলানো। পরে জেনেছিলাম, ওইটুকু পোশাকও জুয়াং মেয়েরা একমাত্র বিয়ে হবার পরেই পরবার অনুমতি পায়। অবিবাহিত মেয়েরা একেবারেই উদোম থাকে।

মুকরুকে বললাম, “এদের কোনোভাবে এপারে ডেকে আনতে পারবে?”

শুনে সে তাদের দিকে তাকিয়ে হাত উড়িয়ে কোল ভাষায় ডেকে উঠল, “হেজুমে হেজুমে..”

সঙ্গে সঙ্গেই গোটা দলটা চমকে উঠে একদম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি একটা ঘাসের ডগাও নড়ছে না সেখানে। তাড়াতাড়ি জায়গাটায় গিয়ে গোটা এলাকাটা তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম আমরা। কিন্তু তাদের কোনো চিহ্নই খুঁজে পেলাম না। তখন মুকরু বলে, “হুজুর আপনি ঝোরাদের নিয়ে তাঁবুতে ফিরে যান। আমি এখানে থেকে যাচ্ছি। খুঁজে বের করে তামাকের লোভ দেখিয়ে ঠিক নিয়ে আসব আপনার কাছে।”

সেইমত, তাকে সেখানে রেখে আমরা ক্যাম্পে ফিরে গেলাম। বিকেলবেলা পাঁচটা নাগাদ সবে এক কাপ চা নিয়ে বসেছি এমন সময় দেখি মুকরু আসছে। তার পেছনে জুয়াংদের দলটা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে। তাদের সামনে রয়েছে পাকাচুলো এক বুড়ো। বাকি দলটায় দুজন কমবয়েসি তরুণ, একজন বয়স্ক মহিলা, তিনজন যুবতী ও তিনটি শিশু। তাদের চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, তাদের দেখবার জন্য আমার যত না কৌতূহল, তার দ্বিগুণ কৌতূহল হয়েছে তাদের সাদা মানুষ দেখবার জন্য।

খানিক চাল, মোটাদানার চিনি আর তামাক দিয়ে তাদের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা করে ফেলতে দেরি হল না এরপর। তখন দেখা গেল ভয়টয় ঝেড়ে ফেলে তারা দিব্যি আমাকে ঘিরে এসে বসেছে। কোল ভাষারই কোনো একটা উপভাষায় তারা কথা বলে। ফলে মুকরুকে দোভাষী বানিয়ে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে বিশেষ সমস্যা হচ্ছিল না আমার।

তাদের ছেলেদের হাতের তিরধনুক। ধনুক তারা বানায় বাঁশ দিয়ে। বাঁশেরই ছাল চেঁছে তাই দিয়ে তৈরি হয় ধনুকের ছিলা। তাদের তিরগুলো খানিক আলাদা। শরজাতীয় ঘাসের কাণ্ড দিয়ে তৈরি তিরের মাথায় বাঁশের একটা করে ভোঁতা টুকরো লাগানো। তিরের পালকগুলো প্রচলিত ঢঙ-এ তিনটে সরলরেখায় লাগানো নয়। তার বদলে স্ক্রুয়ের মত প্যাঁচালোভাবে তাদের আঁটা হয়েছে তিরের ল্যাজায়। এর ফলে উড়ন্ত তির সোজা না গিয়ে পাক খেতে খেতে ছোটে। ভোঁতা মাথার তিরগুলো দিয়ে তারা পাখি মারে। ছেলেদের গায়ে, কলার খোলের কৌপিন বাদে পুঁতির গয়না আছে। মাথায় পাখির পালক গোঁজা।

এর কয়েক মাস বাদে সোমিজ-এ সতেরোজন জুয়াং আমার বাংলোতে এসে কাজ চেয়েছিল। তাদের কাজ করাতে গিয়েই জেনেছিলাম, ঘরের ভেতর থাকা তাদের না-পসন্দ্‌। নাকি ওতে তাদের দম আটকে আসে। তারা ঘুমোতে যেত বনের ভেতর। গাছের নিচে।

সাধারণত তারা ঘর বাঁধে কোনো বড়ো পাথরের ছায়ায়। তার গায়ে গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা পাতাওয়ালা ডাল দাঁড় করিয়ে দিয়ে দু’পাশে দুটো দিকে দরজার মত করে ফাঁকা রেখে দেয়। রাতে ওর ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে ফাঁকা মুখগুলোতে অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে ঘুমোতে যায়।

অবশ্য কাজেকম্মে মোটেই দড় নয় জুয়াংরা। একটানা পরিশ্রম করতে তাদের বেজায় অনিচ্ছা। দুপুর হতেই দলের মেয়েরা এসে জঙ্গলে যাবার ছুটি চাইবে। নাকি কোমরের পাতা বদলাবার সময় হয়েছে। কথাটা অবশ্য মিথ্যে নয়। সকাল থেকে রোদ লেগে লেগে তাদের কোমরে ঝোলানো পাতারা ততক্ষণে শুকিয়ে উঠে খসে পড়তে শুরু করেছে।

কয়েকদিন এই দেখে আমাদের স্টোরকিপার মশায়ের খানিক দয়া হয়েছিল মেয়েগুলোর ওপরে। একদিন দেখা গেল সে মেয়েদের ডেকে খানিক খানিক করে কাপড়ের টুকরো দান করছে। ভাবখানা যেন, আহা গরিব মানুষ! কাপড়চোপড় পায় না! আমরাই দান করি খানিক।

ব্যাপারটা যে আদৌ সে’রকম নয় সেটা টের পাওয়া গেল এর পরের দিন। সেদিন সকালে উঠেই দেখা গেল জুয়াংরা ধর্মঘট করেছে। কারণটা কী জানতে চাইতে তাদের ছেলেরা বেজায় চটে উঠে বলে, “আমাদের মেয়েরা কি দুশ্চরিত্র নাকি যে কাপড় পরবে? জোর করে কাপড় পরাতে গেলে আমরা কিন্তু কাজ ছেড়ে দেব এই বলে দিলাম।” নগ্নতাই তাদের কাছে সতীত্বের চিহ্ন। তাদের মেয়েরা বহুগামিনী, কারণ বিবাহিত মেয়েরা গোটা সম্প্রদায়ের সম্পত্তি। এক ও বহু ভিন্ন, সংখ্যার আর কোনো সংজ্ঞা তাদের কাছে নেই। ‘দুই’ শব্দটার অর্থ তারা বোঝে না। তাদের এক মেয়েকে আমি একবার প্রশ্ন করেছিলাম তার ক’টি সন্তান। জবাবে সে বলল, “অনেক। এক নয়। অনেক।” খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম তার সন্তান দু’জন। তবু, যেহেতু তা এক নয় তাই তার কাছে তার সন্তানের সংখ্যা ওই ‘অনেক।’

সময়কে তারা মাপে শালপাতার ঝরে পড়া দিয়ে। যদি প্রশ্ন করতাম, “ও জায়গাটা কত দূর রে?” তাহলে জবাব আসত, “দুটো শালের পাতা শুকিয়ে উঠতে যত সময় লাগে ততক্ষণের পথ।” একটা শালের পাতা শুকিয়ে উঠতে সময় নেয় প্রায় ছ’ঘন্টা। সেই হিসেবে সে-পথ বারো ঘন্টার সফর, বা ঘন্টায় হাঁটার গতি তিন মাইল ধরলে, প্রায় ছত্রিশ মাইল দূর।

ঋতুর সংজ্ঞা তারা দিত এইভাবেঃ ময়ূরের ডিম পাড়বার ঋতু, মহুয়াফুলের ঋতু, ধান কাটবার ঋতু, ঠাণ্ডা রাতের ঋতু।

একবার তারা আমাকে জুয়াংদের নাচ দেখিয়েছিল। দুনিয়ার যতরকম নাচ দেখেছি তার মধ্যে এমন মজার নাচ আমি আর দেখিনি। সে-নাচে মেয়েরাই আসল। ছেলেদের ভূমিকা খুব কম।

আমার বাংলোর সামনে তারা নাচবে না। নাচ দেখতে আমাকে তাই যেতে হয়েছিল গভীর অরণ্যের ভেতর। গিয়ে দেখি সেখানে একটা জায়গার ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। তার একপাশে আমাদের বসবার বন্দোবস্ত।

প্রথমেই শুরু হল ময়ূর নাচ। ফাঁকা জায়গাটা ছেড়ে জুয়াংরা তখন কোথায় যেন সরে গেছে। হঠাৎ কিছুদূরে বনের ভেতর থেকে ময়ূরের ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দ জেগে উঠল। একদম নিখুঁত নকল।

ডাকটা ওঠবার সঙ্গে সঙ্গেই ঝোপঝাড়ের মধ্যে খসখস শব্দ উঠল একটা। তাকিয়ে দেখি ঝোপের ভেতর থেকে ফাঁকা জায়গাটার দিকে তিন জুয়াং যুবতীর মুখ উঁকি দিয়েছে। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে হাতদুটো দু’পাশে ডানার মত ছড়িয়ে দিয়েছে তারা। সেইসঙ্গে ময়ূরের মতই ঘাড় টানটান করে আমাদের দিকে দেখছে।

কয়েকমুহূর্ত ভারী মিষ্টি সেই দৃষ্টি আমাদের দিকে ধরে রেখে এইবার তারা হাঁটু গেড়েই ছোটো ছোটো লাফ দিয়ে এগিয়ে এল। তারপর একে অন্যকে তাড়া করে তাদের সে কী সুন্দর খেলা। তাদের সাবলীল শরীরগুলো এঁকিয়ে বেঁকিয়ে ময়ূরের মতই কখনো মাথাগুলো তারা মাটিতে ঠেকায়, আবার পরমুহূর্তেই মুখ বাড়িয়ে ছুটে যায় সখিদের দিকে।

খেলতে খেলতে ঠিক ময়ূরীর মতই ডাক ছাড়ছিল তারা। সকালের আলো ফুটলে অরণ্যের বুকে খেলা করতে করতে ময়ূরীরা যেমন কিচিরমিচির করে ডাকে, অবিকল সেই সুর তুলে আনছিল গলাতে। একজন হয়ত পা দিয়ে শুকনো পাতা, ধুলোবালি সরিয়ে মুখ নিচু করে খাবার  অভিনয়  করছে।  দেখে  অন্য এক ময়ূরী এগিয়ে এল তার ভাগ

বসাতে।

অমনি প্রথমজন মুখ তুলে তাকে তেড়ে যাবে ক্যাঁ ক্যাঁ করে ডাক তুলে। দু’নম্বর পালাবার চেষ্টা করবে বটে কিন্তু ততক্ষণে প্রথমজন ছুটে গিয়ে তার পেছনে বাঁধা শালপাতার কয়েকটাকে ছিঁড়েই ফেলল হয়ত এক ঠোকরে।  

খানিক বাদে আসরে এলেন কর্তাময়ূর। মেয়েদের সঙ্গে তাঁর চেহারার তফাৎ গড়া হয়েছে পেছনের শালপাতার ঢাকনাটিকে অনেকটা বড়ো করে বানিয়ে। সেইসঙ্গে মাথার ওপরেও চাপানো হয়েছে একগোছা পাতা। মাথার পাতায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তিনি গর্বিত পদক্ষেপে ময়ূরীদের ঘিরে ঘোরাফেরা করেন।

হঠাৎ দূরে জঙ্গলের ভেতর থেকে কোনো প্রতিপক্ষ ময়ূরের কেকাধ্বনি বেজে উঠতে হাঁটা থামিয়ে চুপ করে দাঁড়ালেন কর্তাময়ূর। তারপর বুক চিতিয়ে, মাথা উঁচু করে, শালপাতার লেজটিকে প্রায় মাটিতে ছুঁইয়ে গুটিগুটি শত্রুর উদ্দেশ্যে এগোনো শুরু করলেন।

ওদিকে হাঁক ছাড়তে ছাড়তে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ময়ূরও তখন এগিয়ে এসেছে কাছে। অতএব এইবার যুদ্ধ শুরু হল। এইটেই ছিল গোটা নাচের সবচেয়ে মজার দৃশ্য।

গ্রামগঞ্জে কখনো মোরগের লড়াই দেখে থাকলে তার কিছুটা আন্দাজ পাবেন। ধরে নিন সেখানে দুটো মোরগ বেজায় হম্বিতম্বি জুড়েছে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কিন্তু একে অন্যের কাছে আসতে ভয় পাচ্ছে। এখানকার দৃশ্যটাও ঠিক সেইরকম।      

দুই যোদ্ধা মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের একজন মাথাটা প্রায় মাটিতে মিশিয়ে লেজ উঁচিয়ে অপেক্ষায়। যেন অন্যজনকে চ্যালেঞ্জ করছে, ‘সাহস থাকলে এগিয়ে আয়।’ দেখে অন্যজন রণহুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে লাফিয়ে লাফিয়ে তার কাছে এসে পৌঁছোবে। মুখোমুখি হয়ে মাথাদুটো ভীষণ যুদ্ধের ভঙ্গিতে খানিক ওঠানামা চলবে। লেজগুলোয় ঝাঁকুনি উঠবে বারবার। তারপর হঠাৎ পাক খেয়ে উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে। তাদের লেজগুলো একে অন্যের গায়ে ধাক্কা খেয়ে খড়মড়িয়ে উঠবে। তারপর এক ছুটে দুজন যুদ্ধক্ষেত্রের দুপাশে। তারপর ফের একবার শুরু হয়ে মুখোমুখি হম্বিতম্বির পালা।

সেই চলতে চলতে ঠোকাঠুকির চোটে তাদের লেজ আস্তে আস্তে পাতা খসিয়ে ছোটো হতে হতে একসময় দেখা যাবে দুজনেরই লেজের আয়ু শেষ। তারপর দুই যোদ্ধার একজন ক্লান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে

পড়বে আর অন্যজন সগর্বে চিলচিৎকার ছেড়ে ময়ূরীদের নিয়ে রওনা দেবে।

ময়ূর নাচের পর শকুন নাচের পালা। এইটে আরো সুন্দর। ওতে একটা ছেলে সাজবে মরা জন্তু। মেয়েরা সাজবে শকুন। একটা মেয়ে শকুন (আগের মতই হাঁটু গেড়ে, হাত ছড়িয়ে) ঘুরতে ঘুরতে খালি জায়গাটার একেবারে মাঝখানটায় মরা জন্তুকে খুঁজে পাবে। চোখে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সে একটু থেমে শরীরটাকে ভাল করে দেখবে। তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে ‘মড়া’ ঘিরে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে তার ঘোরা শুরু হয়। মাঝে মাঝেই খানিক থেমে ‘মড়া’টাকে ভাল করে দেখে নিয়ে ফের ঘোরার পালা।

এমনটা চলতে চলতেই দু’নম্বর শকুনের প্রবেশ ও ‘মড়া’ ঘিরে ঘোরা শুরু। তারপর একে একে শকুনের গোটা একটা দঙ্গল এসে জড়ো হবে ‘মড়া’ ঘিরে। ঘুরতে ঘুরতে তারা তখন আস্তে আস্তে ‘মড়া’র আরও কাছে এগিয়ে আসছে।

‘মড়া’র একেবারে কাছাকাছি এগিয়ে আসবার পর, দলের ভেতর থেকে একটা শকুন এগিয়ে এসে ‘মড়া’র পায়ের বুড়ো আঙুলে ছোট্টো কামড় বসিয়ে টান দেবে একটা। নিয়ম হল, কামড় খেয়েও ‘মড়া’কে একেবারে স্থির হয়ে থাকতে হবে। যদি তা নড়ে ওঠে বা কোনো আওয়াজ করে, সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের দল আর দর্শককুলের হাসির হট্টগোল উঠবে চারপাশে।

আর স্থির হয়ে থাকলে সবাই মিলে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে ‘মড়া’র ওপর।  কেউ তার চুল ধরে টানবে, কেউ আঙুল মটকে দেবে। এমনি চলতে চলতে শেষে একজন সাহসী শকুন হঠাৎ বিরাট এক লাফ মেরে সোজা গিয়ে ‘মড়া’র বুকের ওপর উঠে পড়বে। সঙ্গে সঙ্গে আরো পাঁচ-ছটা শকুনও লাফিয়ে উঠে আসবে ‘মড়া’র গায়ে। সেইসঙ্গে অনর্গল ঠিসিঠাট্টা আর রঙ্গরসিকতার ঢেউ উঠবে তাদের মধ্যে।

এহেন অত্যাচার বেশিক্ষণ সহ্য করা মুশকিল। অতএব গোটাকয়েক ‘শকুন’ গায়ে এসে চাপতেই দেখা যাবে ‘মড়া’ নড়ে উঠেছে। তারপর এঁকেবেঁকে শকুনদের খপ্পর ছাড়িয়ে সে জঙ্গলের দিকে ভোঁ দৌড়। তখন তার পেছন থেকে সবাই মিলে এমন হাসির হররা তুলবে যে  লজ্জায় ‘মড়া’ আর সেদিক মুখো হবে না বেশ কিছুক্ষণ।

ওর পরে শেয়াল আর কুমিরের নাচও ছিল তবে সে নাচেরা আর তত মজাদার নয়। তাদের কথা না লিখেই এই অধ্যায় শেষ করা গেল।

বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s