বৈশাখী ঠাকুর
আমার শিলিগুড়িতে পোস্টিং হচ্ছে শুনেই মনটা নেচে উঠেছিল। আসলে শিলিগুড়ির সাথে যে আমার নাড়ির টান! আমার জন্ম হয়েছিল শিলিগুড়ির ডাক্তার মিত্রর নার্সিং হোমে। শৈশব কেটেছে ঐ পাহাড়ের সমতলভূমিতে। যেদিন ওয়েদার ভাল থাকত সেদিন ঘরে বসেই আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেতাম। জানালা খুলেই মায়ের কাজ ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফাকীর্ণ শ্বেত-শুভ্র শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে কিনা লক্ষ করা। নজর করতে পারলেই উচ্ছ্বাসে- আবেগে চীৎকার করে উঠতেন। বাবা ভারী বিরক্ত হতেন। এমনিতেই শিলিগুড়িতে বেশ ঠান্ডার আমেজ।
“আহা রুমা , একটু ঘুমুতে দাও না! চিৎকার করছ কেন?”
“করব না! লোকে কত পয়সা খরচ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে আসে। আর আমরা ঘরে বসে দেখতে পাচ্ছি। এ কি কম কথা নাকি!”
প্রায় উইক এন্ডে আমরা দার্জিলিং বা জলদাপাড়ায় পাড়ি দিতাম। পিকনিকে কালিঝোরা বা জয়ন্তিয়া পাহাড়। বড়ো সুন্দর সময় কেটেছে ওখানে। সোনালী দিনগুলোর কথা মনে করতেই মনটা অনাবিল আনন্দে ভরে গেল।
গত দশ বছরে যদিও শিলিগুড়ি দুর্দান্তভাবে উন্নতি করেছে তবুও আনাচকানাচ ঘুরে আমি আমার শৈশবের মণিমাণিক্যর খোঁজ অর্থাৎ সেই স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো ঠিক খুঁজে বার করব বলেই মনস্থ করলাম। ট্রেন থেকে নেমে তো কোম্পানির গেস্টহাউসেই ওঠার কথা। দিন পনেরর মধ্যে একটা বাড়ি ভাড়া দেখে নিতে পারব বলেই আমার আশা। একটা নামিদামি মশলার কোম্পানির অ্যাকাউন্টসের হেড করে আমাকে পাঠান হয়েছে শিলিওগুড়িতে। বি কম পাশ করার পরই এমন একটা চাকরির প্রস্তাব ঠেলে ফেলে দিতে পারিনি এই বাজারে। কলকাতায় ছ’মাস চাকরি করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর আমি শিলিগুড়িতে পা রেখেছি।
এসে ইস্তক পুরনো স্মৃতি মনপ্রাণ ছেয়ে আছে। দার্জিলিং মেল-এ সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে চারপাশের বহুল পরিবর্তনটা ধরা পড়ল। ইট- কাঠ- পাথরের হাজার অদলবদল হলেও মানুষগুলো যেন সব আমার পরিচিত বলেই মনে হল। এমনই আকর্ষণ জন্মস্থানের!সবাই আমার আপজন! একটু ফ্রেশ হয়ে জলখাবার খেয়েই অফিসে দৌড়তে হয়েছে। প্রথম দিন আর বাচ্চাছেলে দেখে শিলিগুড়িতে ভারপ্রাপ্ত সুভাষদা আমাকে অব্যহতি দিয়েছেন, “যাও আজকে দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে রেস্ট নাও। কাল আবার এস। সেকেন্ড হাফে আর আসতে হবে না।”
আমি যৎপারানাস্তি আহ্লাদিত হয়ে ফিরে এসেছি। ভাল করে স্নান করে খেতে বসলাম। দেখলাম গেস্টহাউসের ঠাকুরের হাতের রান্নাটা বেশ ভালোই। ভাত, তেতোর ডাল, আলুপোস্ত আর রুইমাছের কালিয়া খেয়ে একটা পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যা বাকি ছিল। ফের একটা জম্পেশ ঘুম। বিকেলে এমনি আর কোনও কাজ নেই। জরুরি কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনতে হবে।
রোদ পড়লে ধীরে ধীরে বেরোলাম। হিলকার্ট রোডের ওপরেই আমাদের কোম্পানির গেস্টহাউস। সামনেই মণিহারী দোকান। জিনিসগুলো কিনে বড্ড মন হচ্ছিল আমার সেই ছোটবেলার পাড়া মানে হাকিমপাড়ায় যেতে। এমনিতেই তো আমাকে বাড়ি ভাড়া খুঁজতেই হবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। রিকশা সওয়ার হয়ে চললাম চারদিক দেখতে দেখতে।
পাড়াটার মধ্যে ঢুকে দেখি আমার স্মৃতিশক্তি এখনও অটুট। সব কেমন ধীরে ধীরে মনে পড়ে যাচ্ছিল। এবার ডানদিকে বেঁকে নাকবরাবর গেলেই একটা মোড়মতন পড়বে। তার বাঁ হাতেই গ্রিন হাউস। আমরা তো ওখানেই ভাড়া থাকতাম।
আমি রিকশাওয়ালাকে নির্দেশ দিতেই সে আমায় সঠিক জায়গায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল। আমার স্মৃতিশক্তিতে আমি নিজেই চমৎকৃত। আসলে জীবনের প্রথম দশটা বছর যে এখানেই কাটিয়েছি! শৈশব বলো বা বাল্যকাল বলো তা তো এই জল-হাওয়ার মধুর রেশে- সারা অঙ্গে তার গন্ধ মেখে- ধুলোবালি ঘেঁটেই তো বড়ো হওয়া! দেখেই মনটা ভাল হয়ে গেল।
আগের চেয়ে গ্রিন হাউসের কৌলীন্য ফিকে হয়েছে ঠিকই কিন্তু একদম মলিন হয়ে যায়নি। এই গ্রিন হাউস নাম নিয়েও এক কাহিনী আছে। আমি জন্মে ইস্তক মা বাবার সাথে এই বাড়িতেই থাকতাম একতলাটায়। সুবিমল স্যানাল অর্থাৎ যিনি এই বাড়ির মালিক ছিলেন, তাঁর স্ত্রী বন্দনাদেবী আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। ভাবলাম খুব বেশিদিনের ব্যবধান তো নয়। একবার নক করে পরিচয় দিয়েই দেখি ওঁরা মনে রেখেছেন কিনা। নিঃসন্তান থাকার দরুন আমি ওঁদের অপত্য স্নেহের একমাত্র দাবিদার ছিলাম।
তো সেই স্নেহমমতার ভরসাতেই আমি দরজায় টোকা মারলাম। এক প্রৌঢ়া দরজা খুলে দিলেন। জেঠু-জেঠিমার নাম করাতে ভেতরে এসে বসতে বললেন। একতলার যে ঘরটায় বসলাম সেটা এককালে আমার বাসস্থান ছিল। কত স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে চোখে ভিড় করে এল।
আমি ঠিক যেখানটায় বসেছিলাম, সেখানটায় আমারই আবদারে একটা অ্যাকোরিয়াম থাকতো। ব্ল্যাক অ্যাঞ্জেল, টাইগার সার্ক,সিলভার শার্ক, গোল্ডেন ফিশ ইত্যাদি শোভা পেত হরেক জলজ উদ্ভিদের সাথে। ভারী প্রিয় ছিল আমার সেটা। এই মাছগুলোর মত একটা বেড়ালও বড়ো প্রিয় ছিল। আমি নাম দিয়েছিলাম ভূতুড়ি। মিশমিশে কালো ছিল দেহটা। কেবল লেজ আর মুখটা সাদা। সাদাকালোর এমন মিশেল কিন্তু রাতের অন্ধকারে আমায় বেশ ভয় পাইয়ে দিত।
বেড়ালটা বেশ ন্যাওটা ছিল আমার। কেবল পায়ে পায়ে ম্যাও ম্যাও করে ঘুরে বেড়াত। রোজ মা ওকে দুধ ভাত মেখে দিত। চেটে পুটে সাফ করে খেত কি আনন্দ করে! খুব সভ্য ভদ্র বেড়াল নেহাত তাই কক্ষনো মাছটা বা ছানাটা অযাচিতভাবে ছোঁ মেরে নিয়ে নিত না। বায়না করত মায়ের কাছে গিয়ে। লেজ তুলে ম্যাও ম্যাও করে মায়ের কাছে সে কী আবদার! মা কিংবা আমি নিজে হাতে খেতে দিলে তবেই সে মুখে তুলত।
“কে বলতো তুমি? ঠিক চিনতে পারলাম না তো!”
আমার স্মৃতি রোমন্থনে ছেদ পড়ল। বয়স্ক এক ভদ্রমহিলা এসে ঘরে প্রবেশ করেছেন।
“আমি জেঠিমা। ইন্দ্রাশিস চক্রবর্তী। এখানে ভাড়া থকতাম। আজ থেকে প্রায় দশ বারো বছর আগে। আমার বাবার নাম ছিল ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী।”
ততক্ষণে মায়াময় দুটো চোখে চেনার আভাস। অকৃত্রিম ভালবাসার সেই দৃষ্টি। ফোকলা দাঁতে এক চিলতে হাসি।
“কাছে আয়। কাছে আয়। আমাদের ইন্দ্র যে! কই দেখি কত বড়ো হয়েছিস।”
কাছে যেতেই বুকে জড়িয়ে নিলেন। তার পরের খানিকক্ষণ আবেগে উচ্ছ্বাসে কেটে গেল। জেঠুও এসে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা যে সত্যি আমাকে কাছে পেয়ে দারুন খুশি সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মুড়ি তেলেভাজা সহযোগে চা পানও হল। ঘন্টাদুয়েক আড্ডায় কেবল সেই সব পুরনো দিনের কথা ফিরে ফিরে এল।
এবার উঠতে হবে। যাওয়ার আগে আমি কথাটা পেড়ে দেখলাম, “এ তলাটা তো দেখছি ফাঁকাই পড়ে আছে তোমাদের। আমি বাড়ি ভাড়া খুঁজছি। আবার একসঙ্গে থাকার সুযোগ হবে নাকি গো? “
জেঠিমা তো লাফিয়ে উঠলেন, “আয় আয় মানিক আমার। আজই চলে আয়। একা একা থাকতে ভাল লাগে না। আর তুই তো আমাদের নিজেদের লোক!”
হঠাৎ ভ্রু কুঞ্চিত করে জেঠু দাঁড়ালেন।
“কিন্তু তার আগে আমার একটা কথা আছে। তোমাকে সাবধান করা দরকার।”
আমি ঘুরে তাকাতেই জেঠিমা পরিত্রাতার ভূমিকায় নেমে পড়লেন, “ওরে ওর কথা তুই কানে নিস না। কেমন হয়ে গেছে একা থাকতে থাকতে। মানুষজন আর সহ্য হয় না।”
“কিন্তু বন্দনা, ওর জানা দরকার।”
“আহা! ও কি জানে না যে আমরা মাছ মাংস ডিম খাই না? ও বাচ্চা মানুষ। ও বেশি বেশি করে খাবে। ওপরে নিয়ে যাবে না। তাহলেই হবে। আর কোন সমস্যা থাকবে না। না রে মানিক আমার। তুই কালই চলে আয়। তুই তোর মত সবই খাবি। নিজের বাড়ি মনে করে গুছিয়ে নিয়ে থাকবি।”
কথাবার্তা কিঞ্ছিত অসংলগ্ন লাগলেও প্রকাশ করলাম না। মনে হল বয়সের ভারে মানুষের তো কতরকম বিকারই তো হয়! জেঠু হয়তো এখন আর আমিষের গন্ধই সহ্য করতে পারেন না। নিরামিষাশী তো হয়েছেন বহুকাল। এই নিয়ে একটা মজার ব্যাপার আছে।
প্রথম আসার পর এই বাড়িটার নাম ছিল ইয়েলো হাউস। সারা বাড়ি হলুদ রং করা ছিল বলেই এমন নাম। তারপর আচমকা দীক্ষা নিয়ে জেঠু নিরামিষাশী হয়ে উঠলেন। হলেন যখন তখন একেবারে কট্টর নিরামিষাশী। পুঁইশাক পর্যন্ত ঘরের চৌকাঠ মাড়াতে দেন না। অঢেল সবুজ গাছপালা পুঁতলেন। বাড়ির রং বদলে সবুজ করলেন। নতুন নামকরণ হল-গ্রিন হাউস।
আগে বাড়ির আনাচে কানাচে ঘোরা পশুপাখিদের জন্যও খাবার নিয়ে আসতেন। সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতে কুকুরগুলো আর বাড়ির রোয়াকে শুত না। বেড়ালগুলো এ বাড়ি সে বাড়ি করে পাততাড়ি গোটাল। রয়ে গেল কেবল ভূতুড়ি- জেঠিমার আর আমার ভালবাসার টানে। কিন্তু কেবল নিরামিষ দুধে কি আর তার পোষায়! বড়ো হলে খিদেও বাড়ছিল। তাই সেও এদিক ওদিক খাবারের সন্ধানে যাওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু জেঠিমা তো তাকে চোখে হারাতেন। খানিকক্ষণ দেখতে না পেলেই সন্তান হারানোর মত বিলাপ জুড়ে দিতেন। ঘরেই তাকে জানালার পাশে চেন দিয়ে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা হল। এ’রকম কত কথা যে আমার মনে পড়ে যেতে লাগল!
ঠিক হল আমি পরদিনই গ্রিন হাউসে চলে আসছি। আবারও চিন্তান্বিত জেঠু বলে উঠলেন, “সব দিক ঠিক সামাল দিতে পারবে তো বন্দনা? ভাবনা চিন্তা করে ওকে আসতে বলছ তো? আমার কিন্তু বেশ চিন্তা হচ্ছে।”
“আঃ! তুমি থাম দেখিনি। দেখছিস তো কেমন হয়ে গেছে মানুষটা! সারাদিন ঘরের মধ্যে গুমরে গুমরে থেকে এই হাল হয়েছে। তুই চলে আয় দেখিনি। তবু মনে বল পাই। একটু অন্য কথা বলে প্রাণের সাধ মেটাই।”
প্রথম দিন এসে আমায় কোনওরকম অসুবিধেতে পড়তে হয়নি। ঘরদোর গুছিয়ে দেয়া থেকে খাওয়াদাওয়ার সমস্ত ভার জেঠিমা নিজে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। মায়ের মত এমন আদর যত্ন করে বিদেশ বিভুঁয়ে আর কে খাওয়াবে! আমিও নিশ্চিন্ত হলুম। ব্যাচেলার ছেলের আর কবে এ সব করতে ভাললাগে!
**********
আরামের ঘুম ঘুমচ্ছিলাম রাত্রে হঠাৎ মনে হল জানালায় কিসের আওয়াজ। আমার খাটটা জানালার পাশেই। চোরছ্যাঁচড়ের উপদ্রবের জন্য জেঠিমা জানালা বন্ধ করে শুতে বলেছেন। আমিও বিনা বাক্যব্যায়ে মেনে নিয়েছে। অনেকদিন বাদে এসেছি। এখানকার হালচাল জানা নেই বিশেষ। আমার চেয়ে ওঁরাই জানবেন ভাল।
উঠে বসে বালিশের তলা থেকে টর্চ বের করে জানালায় ফেলতেই দেখলাম এক চারপেয়ে প্রাণীর ছায়া নিমেষে সরে গেল। এখানে খুব ভামের উপদ্রব আমায় বলেছিলেন সুভাষদা । তাই হবে হয়তো! আমি এই নিয়ে আর কারুর কাছে কিছু উচ্চবাচ্চ্য করিনি। সামান্য ঘটনা।
প্রথম দফায় তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু তারপর প্রতিদিন এমন উপদ্রব শুরু হল। ইদানীং সাথে একটা গড়গড় আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি। ভীষণ রেগে আছে যেন। গত পরশু রাতে আমি পার্সেল নিয়ে এসেছিলাম। মাটন বিরিয়ানি আর চিকেন কষা। সেদিন জেঠিমাদের একটা নেমন্তন্ন ছিল। আমার জন্যও আলাদা করে রাঁধতে বারণ করেছিলাম। সেদিন জমিয়ে বিরিয়ানি সহযোগে ডিনারটা সেরে সবে শুতে গেছি। রাত বারোটা হবে তখন। আগাথা ক্রিস্টির স্পারক্লিং সায়ানাইড পড়তে পড়তে আমার দে্রি হয়ে গিয়েছিল।
চোখটা প্রায় লেগে এসেছে যখন আচমকা আওাজটা শুনে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। মুখ ঘোরাতেই দেখি জানালায় সেই চারপেয়ে প্রাণীটা টিকটিকির মত জানালার কাচ বেয়ে উঠছে। আমি টর্চটা হাতে নিয়ে ছিটকিনিটা খুলতে গেলাম। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেটা একটা বিশাল লাফ দিয়ে জামরুল গাছটায় চলে গেল। তার সাথে একটা হালকা শিসের শব্দ শুনতে পেলাম।
কাঠবেড়ালী? লেজটা ওরকমই লোমশ মনে হল। টিকটিকির তো আর যাই হোক এত বড়ো কলেবর নয়। বাঁদরও নয় তাহলে অমন লোমশ লেজ হত না! মুখায়বয়ব যতটুকু কাচে ধরা পড়েছিল ঐ হালকা আলোয় দুটো কান আর গোল মুখ বুঝতে পেরেছিলাম। তবে কী ওটা? এমনিতে এবারে এসে জামরুল গাছটায় একটাও কাঠবেড়ালি দেখতে পাইনি। ছোটবেলায় জামরুল গাছটা মুখর থাকত ঐ ছোট্ট প্রাণীগুলোর অদ্ভুত ভাষায়।
অথচ দিনের বেলা কোথাও কোনও সমস্যা নেই। এমনি দিনে তো অফিস থাকে। ছুটির দিনেও কোণ সমস্যা দেঝি না। শান্তিপ্রিয় এলাকা। নিরামিষ সুস্বাদু রান্না রোজই জেঠিমার হাতের পাই। দুপুরে ক্যান্টিনে আমিষ খাই। কোনও অসুবিধে হয় না।
সেদিন শখ জাগলো একটু চিকেনে হাত পাকাব। মা নিজে হাতে গুছিয়ে আমায় সব সরঞ্জাম দিয়ে দিয়েছেন। ইন্ডাকশান ওভেন থেকে বাসনপত্র সবই আছে আমার। বাড়ির সামনে একটা মুর্গীর দোকান আছে। সেখানে গিয়ে পাঁচশো গ্রাম মুর্গীর অর্ডার দিলাম। আমাকে দেখেই লোকটা বলল, “ওহো! মাসিমা আজকে আপনাকে পাঠিয়েছে। আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসতাম।”
আমি থতমত খেয়ে বললাম, “আপনার বোধ হয় ভুল হচ্ছে।”
“আরে আপনিই গ্রিন হাউসে নতুন ভাড়া এসেছেন তো একতলায়।”
“হ্যাঁ কিন্তু…।”
“আরে যান না মশাই। আমি ভাল করে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে আসব। ওঁরা আমার রোজের খদ্দের।”
কথাটায় কেমন খটকা লাগল। তবে ভাবনাচিন্তার বেশি অবকাশ পেলাম না। আমার মোবাইলটা বেজে উঠল দুর্দান্ত ঝঙ্কারে। রিসিভ করে দেখি আমার মাসতুতো ভাই টোটা। দার্জিলিং বেড়াতে এসেছিল। মায়ের মুখে শুনেছ আমি শিলিগুড়িতে আছি। তা ফেরার পথে দু’চারদিন আমার কাছে থেকে যাবে।
আমার তো মেঘ না চাইতেই জল। টোটা আর আমি প্রায় সমবয়সী। ও আমার থেকে মাসছয়েকের ছোট। তাই ও ভাই কম বন্ধু বেশি। ওর সাথে আমার জমেও খুব।
জমিয়ে চিকেন রান্না করলাম। মোড়ের মাথায় রুটি কিনতে গিয়ে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে ঢুকলাম।তখন রাত নটা মতন বাজে। তাই আর জলখাবারের ব্যবস্থা না করে সটানে রুটি আর চিকেন কষা দিয়ে ডিনার সারলাম।তাড়াতাড়ি পেটপুজো হলেও আড্ডা মারতে মারতে সেই একটা দেড়টা বেজেই গেল।
বিছানা করে শুয়েছি কি না শুয়েছি সেই অদ্ভুত প্রাণীর অদ্ভুত আওয়াজ শুরু হল। আমি জানালার দিকে টোটার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে টর্চ হাতে ও বেড়িয়ে এল। ফের সেই হালকা শিসের সুর। সেই প্রাণীটাও কালবিলম্ব না করে তার লম্বা পা ফেলে জামরুল গাছটায় গিয়ে উঠল। ওর বিদায় নেবার এটাই সিগন্যাল।
টোটা চিরকালই অদম্য সাহসী। সে টর্চের আলো ফেলল জামরুল গাছটার দিকে। কিছু ডালপাতা নড়া ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। আর সেই মুহূর্তেই জেঠিমা দোতলার বারান্দায় বেড়িয়ে এসে চেঁচাতে লাগলেন, “কে কে ? কে ওখানে আলো ফেলছে? কে ? কী ব্যাপার?”
আমি বেরিয়ে এসে বললাম, “আমি জেঠিমা, ইন্দ্র।”
“এত রাতে কী করছ বাগানে? আর তোমার সাথে ওটা কে?”
“আমার মাসতুতো ভাই টোটা।”
“কই ও আসবে আগে বলনি তো! কী করছ কী তোমরা রাতবিরেতে? এটা ভদ্রলোকের পাড়া। যাও ভেতরে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়।”
আমরা ভেতরে গেলাম আর শুয়েও পড়লাম। জেঠিমার ব্যবহারটা একটু বেশিই রূঢ় মনে হল! আর ব্যাপারটা যে ঠিক কী ঘটল তা নিয়ে মন থেকে খচখচানিটা গেল না।
পরের দু’দিন কোনোরকম উপদ্রব হয়নি। জেঠিমা টোটাকেও দু’বেলা খাওয়াতে লাগলেন। কৃতজ্ঞতার ভারে নুয়ে পড়ে আমরা জেঠিমার জয়গান গাইতে লাগলাম।
তা সেদিন খেতে বসে আচমকাই টোটা কথাটা বলল, “জেঠিমা ইন্দ্র তো সারাদিন অফিসে থাকে। আমি তো বসে বসে বোর হই। আমি একটু আপনার ছাদ-বাগান এইসব একটু ঘুরে দেখতে পারি।”
এক লহমায় অমন স্নেহশীলা মহিলার গলার স্বর বদলে গেল, “খবরদার না। একদম না। তাছাড়া আমার ছাদে ওঠার সিঁড়ি নেই।”
থতমত খেলেও আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, “আগে তো ছিল। আমি তো কত উঠেছি ছাদে!”
“এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
বলে ইশারা করলেন যে দিকটায় সেদিকে দেখে খেয়াল করলাম, সত্যিই তো! এ যে পুরো কংক্রিটের
গাঁথনি! সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যাবার রাস্তাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তারপর মুহূর্তের মধ্যে জেঠিমা আবার যে কে সেই, “-বোর তো হবেই। বাচ্চা ছেলে! সারাক্ষণ কি আর বুড়োবুড়ির কাছে ভাললাগে! তা একটু সিনেমা দেখে আসতে পার তো! কত মল আছে এখানে! কত অ্যামিউজমেন্ট পার্ক!
টোটার মাথা থেকে কিন্তু ভূত নামেনি। ও তক্কে তক্কে আছে। আমার থেকে বারবার সব ঘটনা শুনে মনে হয়েছে এ প্রাণী মাংসতে আকৃষ্ট। অনেক দূরের এক বাজার থেকে ফের চিকেন নিয়ে এসে নিজেই রান্না করেছে টোটা। সে ইচ্ছে করেই দু’কিলো মাংস রেঁধেছে যাতে দুজনে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়ার পরও পড়ে থাকে।
রাত তখন ক’টা হবে কে জানে! অচমকা বাসনকোসনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। রিফ্লেক্স অ্যাকশানের মত টোটা মোবাইলের আলোটা জ্বালল। অবাক হয়ে দেখলাম বড়োসড়ো বেড়ালের শরীরে কে যেন লম্বা লম্বা পায়ের জোগান দিয়েছে। আমি ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, “ঢুকল কী করে?
“তুই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি দরজা খুলে দিয়ে এসেছিলাম ইচ্ছে করে।”
প্রাণীটা রাগত স্বরে অদ্ভুত ভাবে গজরাচ্ছিল। টোটা মোবাইলের ক্যামেরা ফ্ল্যাশ করে একটা ছবি তুলে নিল। যেমনি চোখে আলো পড়েছে ওমনি বাঘের মত দাঁত-মুখ খিচিয়ে আক্রমণের জন্যও উদ্যত হল সে তার লম্বা লম্বা পা বাড়িয়ে। আমিও টর্চটা দিয়ে মুখে মেরেছি তাক করে। চোখে আলো পড়তেই থতমত খেয়ে সে একটা ‘ম্যাও’ শব্দ করে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল। ততক্ষণে উচ্চৈঃস্বরে সেই শিসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তার খানিক বাদেই মেয়েদের গলার একটা তীব্র চিৎকার শুনলাম। আমি যাবার উদ্যোগ নিতেই টোটা আমায় আটকাল।
গোটা রাতটা যেন ঝড় বয়ে গেল। একটু থিতু হয়ে আমি টোটার কাছে মোবাইলে তোলা ছবিটা দেখতে চাইলাম। হিংস্র বাঘের ছোটখাটো একটা সংস্করণ। কিন্তু ডান চোখের তলায় ওটা কিসের কাটা দাগ? ফের স্মৃতির আলপথ বেয়ে কিছু কথা মনে পড়ে গেল।
শিলিগুড়ি ছেড়ে চলে আসার দিনতিনেক আগের ঘটনা। আমার তখন কত বয়স হবে? দশ! আমি একটা গাড়ি নিয়ে মন দিয়ে খেলা করছিলাম। আচমকা একটা শব্দে চমকে উঠে দেখি অ্যাকোরিয়ামটা মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেছে আর ভূতুড়ি সেখান থেকে একটা মাছ নিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে। মাথাটা তড়াক করে গরম হয়ে গেল আমার। আমার প্রিয় মাছগুলোর এমন পরিণতি আমি যেন ভাবতেই পারছিলাম না। দিলাম হাতে থাকা মজবুত হট উইলস গাড়িটা তাক করে ছুঁড়ে। লাগবি তো লাগ একেবারে ওর ডান চোখের তলায় গিয়ে লাগল সেটা। কেটে গলগল করে রক্ত পড়ছিল তবু শিকার সে ছাড়ল না। মা হাঁ হাঁ করে ছুটে এসে দেখে বলল, “বেড়ালটা ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। সেদিন দেখলকাম জামরুল গাছটায় উঠে কেমন চুপিসারে ওঁত পেতে বসে একটা কাঠবেড়ালিকে ধরল। আবার সেদিন একটা চড়াই পাখিও মুখে নিয়ে ছুটতে দেখলাম।”
“মানুষ পেটের চিন্তায় চুরি-চামারি-জচ্চুরি কী না করছে! আর পশুরা করলেই দোষ। বাবা বলেছিল কথাগুলো।
আমি সবিস্তারে সব বললাম টোটাকে। ও চিন্তিত মুখে বলল, “এ যে ভূতুড়ি তাতে কোনও সন্দেহ নেই তাই তো?”
“কাটা দাগটা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু ভূতুড়ি একদম স্বাভাবিক বেড়াল ছিল।
“কিন্তু জেঠিমা যে ওকে কোথাও যেতে দিতেন না বললি! জানালার কাছে চেন দিয়ে বেঁধে রাখতেন। ওর সব চাহিদা মিটবে কোথা থেকে? এখন বুঝতে পারছি কেন রোজদিন চিকেনের প্রয়োজন পড়ে গ্রিন হাউসে! কিন্তু পরাধীনতায় কে থাকিতে চায় হে ? কে থাকিতে চায়? তাই রাতের বেলা ওকে ছেড়ে দিতেই হত।”
“কী বলতে চাইছিস বলতো তুই?”
“ও জানালার কাছে বাঁধা থাকত। আর জানালার কাছেই তো জামরুল গাছটা। সেখান থেকে কাঠবেড়ালিগুলোকে টার্গেট করার চেষ্টা করত। ক্রমাগত চেষ্টার ফলে হয়তো পাগুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেছিল ওর। আর গ্রিন হাউসে খাবার অভাব ওকে মাংসাশী করে তুলেছিল। ফলে ঐ দাঁতের আকৃতিও ধীরে ধীরে বদলে যায়। ডারুইন সাহেবের মতবাদ মনে আছে তো? সারভাইভ্যাল অফ দ্যা ফিটেস্ট। স্পিশিস হুজ ইন্ডিভিজুয়ালস আর বেস্ট অ্যাডাপ্টেড সারভাইভ; আদারস বিকাম এক্সটিঙ্কট।
“কিন্তু এক জীবনে? সম্ভব?”
“সম্ভবত একটা আকস্মিক মিউটেশান। বেঁচে থাকবার তীব্র তাড়নায় জেনেটিক বদল। অথবা তোর সেই ছোটোবেলায় ওকে করা আঘাতটাও তার জন্য দায়ী হতে পারে। কে জানে! প্রকৃতির অনেক রহস্যই তো এখনো আমাদের অজানা। তবে কারণটা যাই হোক, আসল কথা হল, এই খাদ্যাভাব তো দিনে দিনে প্রকট হবে। জাঙ্ক ফুড, ইটিং আউট, রেডি টু কুকের জাঁতাকলে তো স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস এমনিই হাঁসফাঁস করছে। তায় আবার কৌটো বন্দি এখনকার বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি। খাবার খুঁজতে যাবে কোথায় এই প্রাণীগুলো!
“অতঃপর ব্রাদার বিবর্তন। নিজেকে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যও যা যা প্রয়োজন হবে প্রকৃতি ঠিক সময়ে ঠিক সেটা গড়ে দেবে। বিবর্তনের ফলে নতুন প্রজন্মের বেড়াল এমন হবে না তাই বা কে বলতে পারে!”
সেই রাতে দু চোখের পাতা আমরা এক করতে পারিনি। এমন একটা অভিনব ঘটনা মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কিন্তু সে রাতেই জেঠিমাকে নিয়ে ছুটতে হল নার্সিং হোমে। জেঠুর বয়স হয়ে যাওয়াতে আমরাই ছোটাছুটি করলাম। অভূক্ত এবং আহত অবস্থায় ফিরে যাওয়ার ফলে সামনে জেঠিমাকে পেয়ে তার ওপরই মোক্ষম আক্রমণ চালিয়েছে ভূতুড়ি। অবস্থা সঙ্গিন।
পরদিন ভোরবেলা বাড়ি ফিরে আরও বাজে খবরটা পেলাম। ভূতুড়িও প্রাণত্যাগ করেছে। এবং জেঠূ তাকে দূরে কোথাও কবর পর্যন্ত দিয়ে এসেছেন।
এ এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। ইচ্ছে ছিল কোনরকমে ধরে তাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে কোনও জুলজিস্টকে বা বিজ্ঞানীকে দেখাব। কিন্তু সে আর হল না।
“ও এমনিও আর বেশিদিন বাঁচত না।”
“কেন?” টোটার এই কোথায় আমি উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলাম।
“তুই যখন শিলিগুড়ি ছেড়েছিলি তখন ওর বয়স বছরখানেক ছিল। তোর প্রায় এগার-বারো বছর পর আবার এখানে আগমন। বেড়ালেরা খুব যত্নে থাকলে ঐ বারো থেকে চোদ্দ বছর বাঁচে। এর বেশি না।”
“তা সেই কবরটা কোথায় আমরা খোঁজ করতে পারি না!”
“থাক না! দুটো বয়স্ক মানুষের সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে।”
কথাটা শুনে আমারও বুকটা কেমন টনটন করে উঠল। সন্তানহারার শোক পাচ্ছেন জেঠিমা আর জেঠু । কোথাও একটা অপরাধবোধ আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আমি না এলে হয়ত এতকিছু ঘটতই না!
ছবিঃ শিমুল