দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নিজের প্রপিতামহের দুরন্তপনা সামলাতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে গেল পুটকাই। ভদ্রলোক যেমনি চঞ্চল, তেমনি ডানপিটে! তাঁর একহাত লম্বা পাকা দাড়ি, মাথায় উসকো খুসকো চুল, সেসব কামাবেন না, কাটবেন না, মাথায় তেল দেবেন না। কেবল দিনরাত এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে মাটি খুঁড়ে এটা সেটা খুঁজে বেড়াবেন আর বলবেন, “হায় হায়, কোথায় যে রেখে গেলাম জিনিসটা। কিছুই মনে পড়ছে না।”
গতকালই বাবা, দাদু-ঠাকুমা সবাই মিলে গেল বোলপুরের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে। যাবার সময় পুটকাইকে সঙ্গে তো নিলই না বরং উল্টে নিজেদের মধ্যে গজগজ করে আলোচনা করল, “পুটকাইকে না নিয়ে যাওয়াই মঙ্গল! লাল মাটি পেলে তো ছেলের মাথা ঠিক থাকে না। সেবার বোলপুরে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে – গ্রাম ছাড়া এই রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে – গান শুনে কোথায় যে হারাল! খুঁজে খুঁজে হয়রান! এবার আবার লালমাটি দেখে কী যে অনর্থ করবে কে জানে!”
যাক গে, নিয়ে যায়নি বলে পুটকাইয়ের অবশ্য তেমন দুঃখ নেই। ছোটবেলা থেকে সে মাকে কখনও দেখেনি। বাবা আপনভোলা মানুষ, দিনরাত ব্যস্ত থাকেন গবেষণায়। দাদু নামকরা কল্পবিজ্ঞান লেখক। এক ঠাকুমা আছেন, সবসময় পুটকাইকে আগলে রাখেন, নানারকম বিধিনিষেধ জারি করে। ঠাকুমা না থাকলে বরং কদিন নিজের খেয়ালখুশি নিয়ে চলার একটু স্বাধীনতা পাওয়া যায়।
তাই ছাড়া পাওয়ার লাগামছাড়া আনন্দে পুটকাই বারণ না মেনে ঢুকেছিল বাবার গোপন গবেষণাগারে। নেড়ে চেড়ে দেখছিল এটা ওটা। কত রকম যন্ত্রপাতি নিয়ে বাবা কাজ করে, বাপ রে বাপ! টেবিলের ওপর পড়েছিল টাইম-গানটা। এটা সেই যেদিন পুটকাই লুকিয়ে এঘরে ঢোকার পাসওয়ার্ডটা জেনে নিয়েছিল সেদিন প্রথম দেখেছিল। পুটকাই টাইম-গানটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। অদ্ভুত রোমাঞ্চ হচ্ছিল পুটকাইয়ের। এটা দিয়ে ফায়ার করে কোনও বস্তুকে কিছুটা অতীত সময়ে পৌঁছে দেওয়া যায়। খুদে খুদে জেমস চকলেটের মতো লাল নীল কঠিন জমাট-বিন্দুদের স্থিতিস্থাপক রাসায়নিক সুতো দিয়ে গেঁথে গেঁথে একটা জটিল প্রাণের ডিএনএ-এর মডেল সামনে বানিয়ে রেখেছিল বাবা। মডেলটাকে হাতে নিয়ে বেশ মজার খেলনা মনে হয়েছিল পুটকাইয়ের। তাই সেটাকে টাইম গান দিয়ে ফায়ার করে একঘণ্টা আগের সময়ে পাঠাতে চেয়েছিল পুটকাই। আর দেখতে চেয়েছিল কেমন করে সেটা আবার বর্তমানে ফিরে আসে। কিন্তু হাতে নিয়ে লুফতে লুফতে টপ করে সেটা গিয়ে পড়ল বাবা বানানো নতুন সময় যন্ত্রটার মধ্যে। ব্যাস পুটকাই যেই না দরজা খুলে ভেতরটা দেখতে গেছে, ভোঁ ও ও! কী বন বন ঘোরা সময়-যন্ত্রটার। বাবারে! ওটা যে সময়-যন্ত্র সে কি আর পুটকাই জানত! ব্যাস, ঠাকুরদার বাবা স্যার হংসরাজ মজুমদার এসে জলজ্যান্ত হাজির হলেন অতীত থেকে।
এসেই মাথা চুলকে বললেন, ঠিক সময়েই এসেছি মনে হচ্ছে। তুই নিয়ে এলি আমাকে?
“আমি?” পুটকাই বিস্ময়ে গালে হাত দিল। কী থেকে যে কী হয়ে গেল! এখন কী হবে!
হংসদাদু চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললেন, “বাঃ! আমার ল্যাবরেটরিটার বেশ উন্নতি হয়েছে দেখছি।”
পুটকাই বলল, “বাবা,দাদু,ঠাকুমা ফিরে এসে বকাবকি করবে।”
হংসদাদু একগাল হেসে বললেন, “ফিরে এসে মানে – বাড়িতে কেউ নেই নাকি? তাহলে তো মজাই মজা।”
পুটকাই গম্ভীর মুখে তাকাল হংসদাদুর দিকে। মানুষটাকে ছবিতে তো বেশ শান্তশিষ্ট মনে হয়েছিল। বাবা ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল – ইনি তোর দাদুর বাবা। মস্ত বড় জীববিজ্ঞানী ছিলেন। কিন্তু সেই মানুষটাই যে বাড়ি ফাঁকা পেয়ে মন খুলে দস্যিপনা শুরু করবেন পুটকাই ভাবতে পারেনি। এখন তাঁকে ভুলিয়ে ভালিয়ে অতীতে ফেরত পাঠানোরও কোনও আশা দেখছে না পুটকাই। সবচেয়ে সর্বনাশ হবে আলোমাসির সামনাসামনি পড়ে গিয়ে আসল পরিচয়টা ফাঁস হয়ে গেলে। এমনিতেই আলোমাসি ভয়ে ভয়ে কাজ করে এবাড়িতে। লাইব্রেরিতে ঢুকতে ভয় পায়, ল্যাবরেটরির আসেপাশে যেতে ভয় পায়। বলে, জায়গাগুলো মোটেই সুবিধের নয়। কখন কী হয়ে যায়। শেষে না ডাইনোসর বেরিয়ে পড়ে। সেই আলোমাসি এখন দাদুর বাবাকে চাক্ষুষ দেখে না “বাবা গো!” বলে মূর্ছা যায়।
পুটকাইকে তো আলোমাসির দায়িত্বেই রেখে গেল বড়রা। আপাতত লাইব্রেরি আর ল্যাবরেটরিতেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে হংসদাদুকে। কিন্তু তিনি লুকিয়ে থাকতে চাইছেন কোথায়? রাত হলেই তিড়িং করে লাফ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তারপর সারা বাগান তন্ন তন্ন করে খুঁড়ে চলেছেন খুরপি দিয়ে।
পুটকাই হংসদাদুর কাণ্ড দেখে তাই জিজ্ঞাসা করেছিল, “কী খুঁজছো দাদু?”
“ঘোড়ার ডিম!”
এই উত্তর শুনেই পুটকাইয়ের মেজাজটা চটকেছে। কী খুঁজছেন বললে পুটকাই তো খুঁজতে সাহায্য করতে পারত। এই বাড়িটা সেই পঞ্চাশ বছর আগে যেমন ছিল এখন কি আর তেমনি আছে?
ওদিকে পুটকাই আলোমাসির বালিশের নীচে একটা বোতামের মতো ছোট রিসিভার রেখে এসেছে। যাতে আলোমাসির নাকডাকার আওয়াজটা কানে হেড-ফোন লাগালেই শোনা যায়। আলোমাসি যখন ঘড়র ঘঁড়র ছেড়ে খোঁৎ খোঁৎ আওয়াজ করে তখন বোঝা যায় পাশ ফিরছে। এই সময় বড় কিছু গোলমাল হলে ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তাই হংসদাদুকে সাবধান করতে হয় পুটকাইকে।
রাতে জ্যোৎস্না ফুটেছিল চমৎকার। বসন্তের হাওয়া বইছিল মিষ্টি মিষ্টি। পুটকাই চিন্তামগ্ন হংসদাদুকে ঠেলা মেরে বলল, “চলো না, বাইরেটা একটু বেড়িয়ে আসি। কত দিন মাঝরাতে খোলা জানলার বাইরে জ্যোৎস্না দেখে মাঠে ছুটে বেড়াতে ইচ্ছে হয়েছিল। সাহস করে পালাতে পারিনি। সেই বোলপুরের বাড়িতে গিয়ে একবার পেরেছিলাম। মনে হয়েছিল আকাশে উড়ে যাই।”
হংসদাদু পুটকাইয়ের হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “সে সব ব্যবস্থাই করে ফেলতাম। ডিমটা চুরি না গেলে।”
পুটকাই মুখ বেজার করে বলল, “আবার সেই ঘোড়ার ডিম নিয়ে পড়লে। দাদুর কল্পবিজ্ঞানের বইগুলোতেও এমন উদ্ভট আইডিয়া থাকে না।”
হংসদাদু গলাটা কর্কশ করে বললেন, “কখনও খোঁজ নিয়ে দেখেছিস আমার সুপুত্র তাঁর গল্পের সূত্রগুলো কোথা থেকে পায়? সব আমার ডাইরি থেকে।”
“কই কখনও তো দাদুর লেখা গল্পে ঘোড়ার ডিম পাড়ার কথা পড়িনি কখনও।”
হংসদাদু মুচকি হেসে বললেন, “আরে, আমি মজা করে ওটার নাম দিয়েছিলাম ঘোড়ার ডিম। ওটা আসলে খোলের মধ্যে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা একটা ভ্রূণ। আমার সমস্ত কল্পনা দিয়ে বানানো একটা জীবনের স্বপ্ন বলতে পারিস। ওই ভ্রূণ থেকে জন্ম নেবে এমন একজন মানুষ যে – ”
বলতে বলতে হংসদাদু উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকালেন। চাঁদের আলোর দাপটে বেশিরভাগ তারাই আড়ালে চলে গেছে। কয়েকটা রাত পাখি সেই দামাল জ্যোৎস্না ছুঁয়ে উড়ে গেল ওদের মাথার ওপর দিয়ে।
হংসদাদু বললেন, “চোরটাকে একবার হাতে পাই।”
পুটকাই বলল, “চোরকে আর এত বছর বাদে কখনও পাওয়া যায় দাদু? হয়তো বা সে চোর মরেই গেছে। তাছাড়া অমন ঘোড়ার ডিম চুরি করবেই বা কেন?”
“মানে? তুই কী আমার আবিষ্কারকে হেজিপেঁজি ভাবছিস না কি? জানিস কত ডলার দাম দিতে চেয়েছিল সাহেবরা ওই ঘোড়ার ডিমের? আবার আমারই বানানোর প্রাণের জেনেটিক মডেল বানানো হয়েছে! কে বানিয়েছে? তোর বাবা? ওটা টপ করে কুড়িয়ে পেয়েই চটপট দৌড়ে অতীত থেকে এলাম ভবিষ্যতে। তার মানে এখানেই কিছু রহস্য লুকোনো আছে।”
পুটকাই মনে মনে ভাবল, এই রে! এই বাবার বানানো ওই মডেলটাই তাহলে হংসদাদুকে ডেকে এনেছে অতীত থেকে। আর পড়বি তো পড় জিনিসটা একেবারে টাইম-মেশিনে গিয়ে পড়ল!
হংসদাদু মাথা চুলকে বলল, “সে সময় ডন সাহেব কত গুণ্ডা লাগিয়েছিল জিনিসটা হাতাতে! আমি বাগানে এমন জায়গায় লুকিয়েছিলাম না। ব্যাটারা খুঁজে খুঁজে হয়রান। শেষে রাগের চোটে হাত পা বেঁধে আমায় মারধোর করবে ভেবেছিল। এসেছিল দলবেঁধে এক রাতে। আমার হাত পা বেঁধে যেই মুখের সামনে হম্বিতম্বি, ধমকানো, চমকানো শুরু করেছে, ব্যাস, দিলাম গায়ে কাতুকুতু লাগার ওষুধ ছিটিয়ে। ডাকাতি করতে এসে হেসে গড়াগড়ি বাড়ির উঠোনে। কিন্তু তার পরের দিন নিজেই সেই গুপ্ত জায়গায় গিয়ে দেখি “ঘোড়ার ডিম” নেই। কিন্তু আজ ওই ডিএনএ-এর মডেলটা দেখে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে ঘোড়ার ডিমটা কেউ ভবিষ্যৎ থেকে গিয়েই সরিয়েছে।”
“তোমার ওই ঘোড়ার ডিমের খবর ভবিষ্যতে কে ছাই জানবে …!” বলতে গিয়ে থমকে গেল পুটকাই, “আরে দাঁড়াও দাঁড়াও! গল্পের প্লটটা খুব চেনা চেনা লাগছে।”
“কী হল?” হংসদাদু ও চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়ল পুটকাইয়ে কথা শুনে।
চারপাশের শহরে তখন হাওয়ায় জ্যোৎস্নায় মিশে রূপকথা নেমে এসেছে। আকাশে টুকরো কয়েকটা সাদা মেঘ চাঁদের গায়ে ঘেঁষে রূপালী জ্যোৎস্না মেখে নিচ্ছে। তারপর ভেসে যাচ্ছে নিরুদ্দেশে।
“দাদুর লেখা উপন্যাসেই তো পড়েছি। অতীতের রূপকথার দেশের কোন এক তেপান্তর থেকে ডক্টর মজুমদার কুড়িয়ে এনেছিল একটা পক্ষীরাজের ডিম। তারপর সেই ডিম ফুটে পক্ষীরাজের বদলে বেরল একটা ফুটফুটে রাজকুমার …।”
পুটকাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হংসদাদুকে তাড়া দিয়ে বলল, “চলো একবার বাবার ল্যাবে ফিরে যাই। একটা ছোট্ট সময়-সফর করতে হবে। তুমি টাইম-মেশিনে চেপে পিছিয়ে যাওয়াটা কন্ট্রোল করতে পারবে তো?”
বিজ্ঞানী স্যার হংসরাজ মজুমদার আমতা আমতা করে বললেন, “আমি জীববিজ্ঞানের লোক। ওই সব পদার্থবিদ্যার ব্যাপার স্যাপার একটু কম বুঝি। তবু আমার আবিষ্কারের চুরি ঠেকাতে আমি সবকিছু করতে পারি। তবে …!”
“তবে মানে? উল্টো পালটা সময়ে নিয়ে চলে যাবে না তো? বেঘোরে প্রাণটা যাবে তাহলে। কেউ জানতেও পারবে না।” এই সব বিপদের সম্ভাবনার কথা বলতে বলতে পুটকাই হংসদাদুকে সঙ্গে নিয়ে বাবার ল্যাবরেটরিতে ঢুকে টাইম মেশিনে চেপে বসল।
তারপর ওরা হুস্ করে কেমন একটা সাদাকালো পৃথিবীতে গিয়ে পৌঁছল। সেখানে নেমে একপাল লোকের অট্টহাসির শব্দ শুনে থমকে গেল।
পুটকাই চুপিচুপি বলল, “মনে হচ্ছে কিছু দুষ্টু লোক অট্টহাসি হাসছে।”
হংসদাদু উত্তেজনায় পুটকাইয়ের হাত চেপে ধরে বললেন, “চুপ কর ওই দ্যাখ কে যেন ল্যাবরেটরি থেকে ছাদে ওঠার গুপ্ত কাঠে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠছে।”
পুটকাই লোকটাকে দেখে বিস্ময়ে থ হয়ে গেল।
লোকটা ছাদ থেকে একটা দড়ি ঝোলাল বাগানে। তারপর সেই দড়ি বেয়ে নেমে বাগানের হাসনুহানা গাছের গোরাটা খুঁড়ে একটা ছোট কাঁচের জার বার করল। জারটার রঙ ঠিক বোলপুরের লালমাটির মতো। তার মধ্যে একটা ডিমের মতো কিছু সংরক্ষণ করে রাখা রয়েছে। এরপর লোকটা চুপিসারে আবার ল্যাবরেটরিতে এসে হাজির হল।
আরে এই গল্পটা তো দাদুর লেখা। এখন চোখের সামনে ঘটছে।
হংসদাদু আর থাকতে পারলেন না। বললেন, “এখান থেকে চলে চল পুটকাই। ও ভবিষ্যতটা যেমন করে সাজাতে চাইছে সাজাক। তার জন্য আমরা যে সময়-যন্ত্রে এখানে এসেছি সেটা চেপে ওর ফিরে যাবার জন্য দরকার, না হলে এই সাজানো-গোছানো ভবিষ্যৎ সব গণ্ডগোল হয়ে যাবে।”
হংসদাদু পুটকাইকে এক ঝটকা মেরে টেনে নিয়ে গেলেন শোবার ঘরে। এরপর পুটকাইয়ের হাতে একগাছা দড়ি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “কাতুকুতুর ওষুধের প্রভাবে ডন সাহেব লোকজন নিয়ে হেসে মরুক। বাড়ির উঠোনে গড়াগড়ি খাক। এখন তুই আমাকে এখানে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে যা। যাতে সব ঘটনা আবার আগের মতো সাজিয়ে যায়!
সব কিছু দাদুর আদেশ মতো করতে করতে পুটকাইইয়ের চোখ ছলছল করে উঠল। সে ভেজা গলায় বলল, “বাবা-ই তাহলে ভবিষ্যৎ থেকে এসে তোমার আবিষ্কার নিয়ে পালিয়েছিল।”
দড়িতে বাঁধা হংসদাদু শান্ত হেসে বলল, “পালিয়েছিল নয়, বল পালাল। ডন সাহেবের লোভের হাত থেকে আবিষ্কারটা বাঁচাতে সেটা সে ঠিকই করেছে বুঝলি। আমি বৃথাই আকাশ পাতাল ভেবে মরলাম! ভাগ্যিস তুই ভবিষ্যতে ডেকে নিয়ে গেলি। যাক, সব ভালয় ভালয় জেনে বুঝে আবার নিজের সময়ে ফিরে এসে বেশ আরাম লাগছে।”
পুটকাই করুণ চোখে দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আর আমি? আমি কী করে নিজের সময়ে ফিরব? বাবা,দাদু, ঠাকুমা এসে আমায় খুঁজে পাবে না। আলোমাসিকে বকাবকি করবে। সবাই মিলে কান্নাকাটি জুড়ে দেবে।”
হংস দাদু মৃদু হেসে বললেন, “তোর দাদুর লেখা গল্পে ডিম ফুটে যে রাজকুমার জন্মেছিল। সে যেন কী পারত? বোলপুরে সেই জ্যোৎস্না রাতে তোর কোথায় যেতে ইচ্ছে করেছিল পুটকাই?” যা, চুপিসারে ল্যাবরেটরির ওই গুপ্ত সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে যা। গিয়ে দেখ বোলপুরের সেই রাতের মতো আজও কেমন ফুটফুটে জ্যোৎস্না উঠেছে।”
পুটকাই ছাদে গিয়ে দেখল সেই ক্ষুদে সাদা মেঘগুলো চাঁদের রঙ মেখে উড়ে যাচ্ছে। পুটকাই সেই গল্পের রাজকুমারের মতো হাতদুটো ডানার মতো মেলে দিল। সে এবার উড়ে যাবে সময়ের আকাশে। পুটকাই জ্যোৎস্না ভেতর ঘুরপাক খেল কয়েকবার গাছের মাথার ওপরে। তারপর উড়তে লাগল মেঘেদের সঙ্গে মায়া জ্যোৎস্নায়। এরপর হাতদুটো কোমরের সঙ্গে টানটান রেখে হাউইয়ের মতো উড়ে গেল আকাশের গায়ে সাদা দাগ টেনে।
আলোমাসি এখনও নাক ডেকে ঘুমচ্ছে। পুটকাই ছাদে ঝুপ করে ল্যান্ড করল, আস্তে আস্তে গুপ্ত সিঁড়ি বেয়ে নীচের ল্যাবরেটরিতে নেমে এল। তারপর পা টিপে টিপে ঘরে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। হেডফোনে কান রেখে শুনতে টের পেল আলোমাসির নাক ডাকা থেমে গেছে। এবার সে উঠে বসে পুটকাই ঘুমচ্ছে কিনা পরীক্ষা করতে আসবে।
পুটকাই চাদর টেনে নিল গায়ের ওপর।
সকাল সকাল বাবা ফোন করল। একবার কথা বলেই ছাড়বে। “আরলি টু বেড এণ্ড আরলি টু রাইজ…”। এত বেলা পর্যন্ত পুটকাই বিছানায় শুয়ে কী করছে! পুটকাইয়ের ঘুম ভাঙতে চাইছিল না। সে যেন একটা সুন্দর স্বপ্নের মধ্যে ডুবে রয়েছে, জেগে উঠলেই স্বপ্নটা ভেঙে যাবে।
আলোমাসি কর্কশ গলায় কাউকে বলছিল, “কাল ভোর রাতে দেখি একটা মস্ত বড় লক্ষ্মীপেঁচা বাড়ির মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে। যেন স্বয়ং মা লক্ষ্মীর বাহন, স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। আমি তাই উঠে দেখতে গেলাম, কোথাও পেঁচাটাকে দেখতে পেলাম না।”
“লক্ষ্মীপেঁচা?” পুটকাই বাবার ফোনটা শেষ করে ঘুমচোখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের মুখটা আয়নায় ভাল করে আয়নায় দেখল কিছুক্ষণ।
এরপর চেঁচিয়ে বলল, “আলোমাসি তোমার চোখটা সত্যিই খারাপ হয়েছে। ডাক্তার দেখাও!”
গ্রাফিক্স্- ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের গল্পঘর