ডিভানের যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে নানা রকম বই। ঘরের মেঝেতে কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে রয়েছে অনেক ছেঁড়া পাতা। লেখার টেবিলের রাত জাগা টেবিল ল্যাম্পের ক্লান্ত আলো ঘিরে রয়েছে ঘরটাকে। ভোর হতে আর দেরি নেই। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে তিনটে প্রায়। লেখার পাতাগুলি গুছিয়ে নিচ্ছে সায়ন। লেখাটা প্রায় হয়েই এসেছে ; কাল সকালেই বাকিটা শেষ করে ফেলবে সে। ঘুমে তার দু’চোখ জড়িয়ে আসছে। একটু না ঘুমোলেই নয়। তাই বিছানায় গা এলিয়ে দু চোখের পাতা এক করল, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চোখে ঘুম নেমে এল।
কয়েকমুহূর্তেই তার চোখের সামনে ফুটে উঠল এক অচেনা জগৎ। যেখানে প্রকৃতি সেজে উঠেছে নতুন নতুন রঙে। সবুজ গাছ , রঙিন ফুল, রঙবেরঙের প্রজাপতি আর হলুদ ভোমরা। আর সেই সৌন্দর্যের বুকে খেলে বেড়াচ্ছে ফুলের মতো ছোটো ছোটো শিশুরা। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। তার মনে হল সে যেন স্বর্গে এসেছে। প্রকৃতির এই রূপ তার আবেগকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক এই রকম সবুজ স্বপ্নই যে সে বার বার দেখতে চেয়েছে। তার পায়ের পাতা যখন সবুজ ঘাসের শিশির বিন্দুগুলোকে স্পর্শ করল তখন সমগ্র শরীরে যেন শান্তির বার্তা ছড়িয়ে পড়ল। কোকিলের মিষ্টি গানের শব্দে পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠেছিল। সায়নের গলা থেকেও অস্ফুট গানের কলি ভেসে এল ,
“আজি দখিন দুয়ার খোলা
এসো হে এসো হে .”
সবুজ ঘাসের বিছানার ওপর দিয়ে সে হেঁটে চলল। বাতাসে আবীরের চেনা গন্ধ। লাল, হলুদ, গোলাপি , সবুজ নানা রঙের আবীরের খেলা চলছে। সায়নও তাদের ভিড়ে মিশে গেল। দু হাতে মুঠো মুঠো আবীর ছড়াতে লাগল।
আচমকা কে যেন তার চোখ লক্ষ করে আবীর ছুঁড়ল। আর সেই আবীরে জ্বলে উঠলো সায়নের চোখ। দুহাতে চোখ ঢেকে সে চিৎকার করে উঠলো। গান থেমে গেল। আনন্দের উল্লাস হঠাৎ থমকে গেল। চারিদিকে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল। ঠাণ্ডা বাতাস বইতে আরম্ভ করল। সেই বাতাসের আলতো ছোঁয়ায় সায়নের চোখের জ্বালা শান্ত হল। সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল।
তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো রাশি রাশি শ্বেত পর্বতমালা; সাদা তুষারে মোড়া আরেক নতুন জগৎ। যেদিকে তাকাও শুধুই সাদা বরফের আস্তরণ। সেই বরফ বিছানো পথ দিয়ে হেঁটে চললো সায়ন। আকাশের কোলে মাথা তুলে জেগে থাকা পর্বতগুলো তাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাদের আহ্বানে সাড়া দিতে সেও ছুটে চললো কোনও অচেনা দেশের খোঁজে। কোনও অলৌকিক ক্ষমতা বল যেন তাকে পথ চিনিয়ে একটি নির্দিষ্ট দিকে টেনে নিয়ে চলেছে।। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় তার রোম কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঠাণ্ডা হাওয়া তীরের ফলকের মতো তার গোটা শরীরে যন্ত্রণা বিঁধে দিচ্ছে।
এভাবে কতক্ষণ ছুটেছে তার খেয়াল নেই। একসময় বরফ শেষ হয়। প্রকৃতি আবার সবুজ হয়ে ওঠে। দিকে দিকে কাশফুল দোলা দিয়ে যায়। শোনা যায় মানুষের কোলাহল। বাতাসে পুজোর গন্ধ। ঢাকের বাদ্যি গমগমিয়ে ওঠে। পথ চলার মাঝেই গড়ে ওঠা ছোটো বড়ো নানা মাপের পুজো প্যান্ডেলে ছোটো ছেলেমেয়েরা ছুটোছুটি শুরু করেছে। খুব আনন্দ হচ্ছিল সায়নের। সেই চেনা শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘেদের আড্ডা। মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা দর্শনের ভিড়। কী দারুণ সুন্দর সব সাজানো মণ্ডপ আর মূর্তি প্রতিমা! ঢাকের তালে তাল মিলিয়ে চলছে ধুনুচি নৃত্য। সায়ন আনন্দে ভাষা হারিয়ে অবাক চোখে দেখছিল। কিন্তু কীভাবে যেন সেই পবিত্র পরিবেশকে অশান্ত করে হঠাৎই আরম্ভ হলো উদ্দাম নৃত্য, অসম্ভব হুল্লোড়, সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে শব্দবাজি। আর পাল্লা দিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে বাজতে থাকে ঝিক ঝ্যাক গান;
এই অসুস্থ পরিবেশ সায়নের অসহ্য লাগে। সে দ্রুত সেই স্থান ছেড়ে সামনে এগিয়ে চলে , কোলাহলময় জগৎটাকে পেছনে ফেলে রেখে। সে যতই এগিয়ে যাচ্ছিল দুপাশের পরিবেশটা একটু একটু করে বদলাচ্ছিল। একটা অস্পষ্ট শব্দ দূর থেকে ভেসে আসছে। আকাশ তার নীল রঙ হারিয়ে কালো মেঘের চাদরে ঢেকে যাচ্ছে। অস্পষ্ট শব্দটা যত কাছে আসছে প্রকৃতি তত দ্রুত তার রঙ হারিয়ে ধুসর রূপ নিচ্ছে। এ কী দেখছে সায়ন! সে যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। কালো আঁধি শোঁ শোঁ শব্দে দ্রুত এগিয়ে আসছে তার দিকে। সে প্রাণপণে দৌড়োবার চেষ্টা করল কিন্তু কে যেন তার পা দুটো আঁকড়ে ধরে রইলো মাটির সঙ্গে ; সে পড়ে গেল। তার মাথার ওপর দিয়ে ঘূর্ণি ঝড়টা সব রঙ উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। পড়ে রইলো মরুপ্রায় ধুসর প্রান্তর।
ঝড় থামলে পায়ের নীচে পড়ে রইলো শুধু বালি আর বালি। মাথার ওপর গনগনে সূর্য আগুন ঢালছে। সায়নের সমস্ত শরীর যেন পুড়ে যেতে থাকল। অসম্ভব গরমে তেষ্টায় তার বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম। সেই ধূসর মরুভূমির মাঝে না ছিল কোনও গাছের আশ্রয় , না ছিল কোথাও কোনও জলের চিহ্ন। প্রচণ্ড তাপে সায়নের সারা শরীর অবশ হয়ে এল। তার পা চলার ক্ষমতা হারাল। তৎক্ষণাৎ তার শরীরটা গরম মাটিতে আছড়ে পড়ল।
ঠিক সেই সময়েই মেঘের গর্জন শোনা গেল। সায়ন তার তেতে ওঠা ক্লান্ত শরীরটা টেনে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করল , কিন্তু পারল না। প্রকৃতি বুঝি সায়নের কষ্ট বুঝল তাই বিন্দু বিন্দু জলকণা ঝরে পড়ল মরুভূমির বুকে। শীতল জলকণার ছোঁয়ায় রুক্ষ প্রকৃতি তার ধূসর রঙের আবরণ ছেড়ে বেরিয়ে ধীরে ধীরে আবার সবুজ হয়ে উঠল। রুক্ষ মরুর বুক চিরে জেগে উঠল সবুজ প্রাণ।
সায়ন আস্তে আস্তে উঠে বসলো। চোখ বন্ধ করে অনুভব করল বৃষ্টির ঠাণ্ডা ফোঁটাগুলি। বৃষ্টির জলের ছোঁয়ায় তার শরীর আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো। তার দুই গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে স্বস্তি, আনন্দের ধারা। সবুজের দোলা লাগলো আকাশে বাতাসে। এতক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে যে জলই হল জীবনের উৎস। জলের স্পর্শেই বীজের মধ্যে প্রাণের স্পন্দন ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক যেভাবে এখন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে সেই চেনা সুর ….. “ আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে ……… ” ঘুম চোখ মেলে তাকায় সায়ন। তাকিয়ে দেখে সে তার বিছানায় শুয়ে। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসেছে ঘরে। একটা চড়াই জানালার গ্রিলে বসে তাকিয়ে ছিল সায়নের দিকে ; সে তাকাতেই হুশ করে উড়ে পালাল। হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো সায়ন। আজ আকাশ অনেকটাই পরিষ্কার। একটানা ৩-৪ দিন প্রবল বৃষ্টির পর আজ ঝলমলে রোদ উঠেছে। ন’টা বেজে গেছে। চট করে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে লেখার টেবিলে বসল সায়ন। গত রাতের লেখার পাতাগুলো দুমড়ে মুচড়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আরেকটা নতুন পাতা নিয়ে বোর্ডে ক্লিপ দিয়ে সাঁটলো। পাতার ওপরে গোটা গোটা অক্ষরে লিখল “ আমার প্রিয় ঋতু বর্ষা।”
ছবিঃ তন্ময় বিশ্বাস