গল্প-গণপতি বেহেরা-রাজকুমার রায়চৌধুরী

galpoganapati (Medium) তিতিরের বয়স যখন পনেরো, তখন ওদের বাড়িতে গণপতি বেহেরা প্রথম এসেছিল। তিতিরদের রান্নার লোক কৃষ্ণের গ্রামের ছেলে গণপতি। খুব গরিব ঘরের ছেলে, লেখাপড়ায় খুব ভালো, কিন্তু লেখাপড়া দূরের কথা ছেলেকে দুবেলা খেতে দেবার ক্ষমতাও নেই বাবা মা”র। কলকাতায় পাঠিয়েছেন দুবেলা খেতে পাবে এই আশায়। রোগা চেহারা কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত মুখের ছেলেটিকে দেখেই ভালো লেগেছিল তিতিরের। গণপতিকে “গোনু” বলে ডাকে কৃষ্ণ। এ বাড়িতেও ওর নাম হল গোনু।

তিতির লেখাপড়ায় বেশ ভালো, কিন্তু সারাদিন বইতে মুখ গুঁজে থাকার ছেলে সে নয়। লাট্টু, ঘুড়ি, ফুটবল সব খেলাতেই তার সমান উৎসাহ। মাঝেমাঝেই খেলতে গিয়ে পা মচকে যেত। মা খুব একটা বকতেন না, তবে বলতেন পড়ায় আর একটু মন দিলে ক্লাসে তিতির প্রথম হতে পারত।

তিতিরের বাবা মানবেন্দু রায় একটা সরকারি কলেজে পড়ান। উনি তিতিরকে প্রশ্রয় দিতেন। বলতেন শুধু লেখাপড়া করে কেউ মানুষ হয় না। তিতিরের স্বভাব ভালো বলে সবাই ওকে ভালোবাসে। দিদি মানসী কলেজে পড়ে ইতিহাস অনার্স নিয়ে। মানসীও তিতিরকে খুব ভালোবাসে, তবে মা”র মতো তারও মনে হয় তিতির খেলায় বেশি সময় নষ্ট করে।

গোনু কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ির একজন সদস্য হয়ে গেল। মানবেন্দুবাবু ওকে একটা কর্পোরেশনের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। এখন এসব স্কুলে ইংরাজিও পড়ায়। গোনু বাংলা ভালোই জানে। তিতির নিজেও ওকে রোজ পড়াতে শুরু করল।

এরকম মনোযোগী ছাত্র পেয়ে তিতিরের পড়ানোয় উৎসাহের অন্ত নেই। মাঝে মাঝে দাবা ও খেলত ওর সঙ্গে। দাবা গোনুকে তিতির-ই শেখায়, কিন্তু কিছুদিন পরে গোনু গুরুমারা বিদ্যে আয়ত্ব করে তিতিরকেই হারাত। মা মাঝে মাঝে বলতেন, “ওকে সারাক্ষণ পড়ালে তুই কখন পড়বি?” বাবা অবশ্য বলতেন, “জানোতো, বিদ্যা এমন জিনিস, যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে।”

গোনুর একটা ভালো গুণ ছিল – ও খুব ভালো সেলাই করতে পারত। টুকটাক সেলাই-এর কাজ সব বাড়িতেই দরকার, গোনু থাকায় এসবের জন্য দরজির কাছে যেতে হত না। তিতিরের মাও এর জন্য গোনুর খুব প্রশংসা করতেন।

তিতিরের মা বিভাবতী একটা স্কুলে পড়াতেন। এখন একটা কলেজে পার্ট-টাইম কাজ করেন।

দু বছর কেটে গেছে। গোনু ক্লাস নাইনে উঠেছে। ক্লাসে সেকেন্ড হয়েছে। স্কুল থেকে বই ও টাকা পেয়েছে। মানবেন্দুবাবু খুব খুশি। গোনুকে উনিও দু হাজার টাকা দিয়েছেন। তিতির হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় বেশ ভালো ফল করে যাদবপুরে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।

একদিন রাত প্রায় দশটা নাগাদ, তিতির কম্পিউটারে একটা প্রোগ্রাম লিখছিল, হঠাৎ গোনু ঘরে ঢুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

“কী রে আবার অঙ্ক আটকেছে?”

“না তিতুদা, আমি একটা কারখানায় চাকরি পেয়েছি, কৃষ্ণকাকু করে দিয়েছে। এখন মাইনে বেশি নয় তবে পরে বেশি হবে। বড়ো কারখানা। তুমি মেসোমশায়কে বল, যদি কিছুদিন এখানে থাকতে পারি। কারখানায় একটা মেস খালি হলে চলে যাব।”

গোনুর কথা শুনে তিতির কী বলবে ভেবে পেল না।

“তুই পড়াশুনা ছেড়ে দিবি?”

“মেস পেলে নাইট স্কুলে পড়ব।”

তিতির ওর বাবাকে জানাল। গোনুর কথা শুনে মানবেন্দুবাবু অবাক হন, বলেন, “তুই অন্তত মাধ্যমিকটা এখান থেকে দিয়ে যা।”

“কাকাবাবু এত ভালো সুযোগ আর পাব না। বাবা-মা খুব কষ্টে আছে, কোনরকমে বেঁচে আছে। কাকাবাবু আমি পড়াশুনা ছাড়ব না, দেখবেন অন্তত গ্র্যাজুয়েট হব।”

মানবেন্দুবাবু ওকে আর কিছু বললেন না। ও নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, এটাতে উনি বাধা দিতে চাননা। তবুও ওঁর চোখ ছল্‌ছল্‌ হল। তিতিরের মা ও দিদি তো কান্না চেপে রাখতে পারলনা।

তিতিরের মনে হয় সময় আলোর চেয়ে বেশি জোরে ছোটো। ওদের বাড়ি ছেড়ে গোনু চলে গেছে আট বছর হল। নাইট স্কুল থেকে মাধ্যমিক দিয়ে গোনু খুব ভালো ফল করেছিল। মিষ্টি নিয়ে বাড়িতে এসেছিল কিন্তু তারপর অনেক দিন কোন খোঁজ নেই। গোনু বোধহয় মোবাইলও কেনেনি। ইতিমধ্যে তিতির আমেরিকা থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে এম টেক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরেছে। বিদেশে থাকাকালীন ও একটা ভালো চাকরির অফার পেয়েছিল। তিতির দেশে ফিরে এক মাস সময় চেয়েছিল। ওর নিজের ইচ্ছে ছিল বাবার মত অধ্যাপক হবে। তবে

চাকরির শর্তটা ওর ভালোই মনে হল। অন্ধ বা চোখে যারা কম দেখে তাদের জন্য কম্পানি কম্পিউটার বানাচ্ছে। তিতিরের কাজ হবে তার সফ্‌টওয়্যার বানানো। বাবাকে বলতে উনি খুব উৎসাহ দিলেন। চাকরিটা করতে হবে পুণেতে, ট্রেনিং নেবার জন্য সুইজারল্যান্ড যেতে হবে, থাকতে হবে এক বছর।

জয়েন করার আগে কিছুদিন ছুটি হাতে আছে। তিতির আর ওর যাদবপুরের কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করল উড়িষ্যার কোন জঙ্গলে বেড়াতে যাবে। ইন্টারনেট থেকে একজন একটা জায়গাও খুঁজে বার করল। কুলদিহা। বালাসোর থেকে তিরিশ কিমি রাস্তা। ঠিক হল ওরা ট্রেনে বালাসোর যাবে, ওখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে নেবে। পাঁচ বন্ধু মিলে যাবে, একটা টাটা সুমো গাড়িতেই হয়ে যাবে। বালাসোর থেকে কুলদিহা যেতে এক ঘণ্টা লাগে।

galpoganapati02 (Medium)১৬-ই অক্টোবর তিতিররা যখন কুলদিহাতে পৌঁছল তখন সন্ধে হয়ে গেছে। অনলাইনেই ওরা ফরেস্ট বাংলো বুক করেছিল, তবুও তিতির ভাবল একবার ডেপুটি ফরেস্ট অফিসারের সঙ্গে দেখা করা দরকার সব ঠিকঠাক আছে কিনা জানার জন্য।

ডেপুটি ফরেস্ট অফিসার অফিসে ছিলেন না; তিতিরদের পিয়ন অফিসের ঘরে বসতে বলল। একটা জিনিস তিতিরের নজরে পড়ল – দেয়ালের গায়ে যে বোর্ড লাগানো আছে তাতে শেষ নামটা হল জি বেহেরা, হিন্দি ও ওড়িয়াতে লেখা। কিছুক্ষণ পরেই ডেপুটি ফরেস্ট অফিসার এসে হাজির। তিতির দেখে অবাক হয়ে গেল, এতদিন পরেও ওর গোনুকে চিনতে অসুবিধা হল না। গোনুও তিতিরকে দেখে বিস্মিত হল। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল।  প্রণাম করতে গেলে তিতির বারণ করল।

“গোনু তুই শুধু আমার ভাই নস, বন্ধুও, মনে আছে?”

“তিতুদা তুমি এখানে বেড়াতে এসেছ নিশ্চয়ই?”

তিতির ওদের বেড়াতে যাবার সব প্ল্যান গোনুকে বোঝাল।

“ইস্‌ তুমি আসবে জানলে আমি ছুটি নিয়ে তোমাদের সঙ্গে যেতাম। যাই হোক, তোমাদের কোন প্রব্লেম হবে না, আমাকে আবার ছুটতে হবে চোরাই কাঠ চালানিদের ধরতে।”

“বাবা আমাকে বলছিল তুই নাকি আদিবাসিদের সঙ্গে আন্দোলন করেছিলি কাঠ মাফিয়াদের বিরুদ্ধে।”

গোনু সলজ্জ হাসল। “এখনও করছি। তবে এবার সরকারও তৎপর হয়েছে।”

তিতিরের সব বন্ধুরাই গোনুর কথা তিতিরের মুখে শুনেছে, ওরা তাই ওদের কথা শুনে অবাক হল না।

“তুই আর লেখাপড়া করলি না? বাবা খুব দুঃখ করছিল।”

“তিতুদা তুমিতো আমার বাড়ির অবস্থা জান, এখানে এসে আই এফ এস পরীক্ষা দিয়ে চাকরিটা পেলাম। আমার খুব পছন্দ এই চাকরিটা। বাবা মাকে কোয়ার্টারে নিয়ে এলাম।”

“তোর বাবা মা এখানে আছেন?”

“বাবা আর নেই তিতুদা, অপুষ্টিতে শরীরের সব যন্তরই বিকল হয়ে গেছিল।”

গোনুর কথা শুনে তিতির খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আর তোর মা?”

“মা বেঁচে আছেন তবে শরীরে হাড়ক’টাই আছে।”

দুজনেরই চোখে জল।

তিতির এসেই লক্ষ করেছিল গোনুর ডান হাতে চামড়ার দস্তানা, কিন্তু বাঁ হাতে দস্তানা নেই। গণপতির সেটা চোখ এড়ায়নি।

“তিতুদা তোমাকে বলছি কিন্তু কাকুকে বোলনা – কাঠ মাফিয়েদার গুলি লেগেছিল ডান হাতে, চারটে আঙুল কেটে বাদ দিতে হয়েছে।”

তিতির কী বলবে ভেবে পেলনা। ফেরবার সময় গণপতির বাসায় যাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওরা রওনা হল।

গণপতি ওদের সঙ্গে একটা চৌকিদার পাঠিয়েছিল, ফলে তিতিরদের কোথাও কোন অসুবিধা হয়নি।

জঙ্গলটা সত্যিই খুব সুন্দর। এখানে বেশ কয়েকটা পাহাড় আছে। সব চেয়ে উচ্চতা যে পাহাড়ের, সেটার নাম দেবগিরি, উচ্চতা প্রায় দু হাজার ফুট। তিতিরের এক বন্ধু সুমন আবার বার্ড ওয়াচার। অনেক নতুন পাখি ওরা দেখল। সুমন পাখিগুলোর নাম বলে দেওয়াতে ওদের খুব মজা লাগছিল। নানান ধরনের কোয়েল, শ্যামা, বারবেট, বালি হাঁস, এরকম অনেক জানা-অজানা পাখি। সুমন পাখির ছবি তুলছিল আর নাম একটা নোটবুকে টুকে রাখছিল।

তিতির কিন্তু কিছুতেই গোনুর কথা ভুলতে পারছিল না। বেশ হইহই করে কয়েকটা দিন কাটল। তিতির গোনুকে বলেছিল ফেরার সময় ওর কোয়ার্টারে যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ও গোনুর জীবনে আবার নিজেকে নতুন করে জড়াবে না। গোনু এখনও বিয়ে করেনি। জীবনের যে অধ্যায়টা গোনু পার হয়ে এসেছে সেটা আর ওকে বারবার মনে করিয়ে দেবার দরকার নেই। এখন কিছুদিন হয়তো দুজনেরই মন খারাপ করবে, কিন্তু সময় আর জীবন কারো জন্যে থেমে থাকে না।

তিতির ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কলকাতায় ফিরে এল। ওর নিজের জীবনেও তো একটা নতুন অধ্যায়ের শুরু হবে।

ছবিঃ মৌসুমী