গল্প প্রতিযোগিতা-ষষ্ঠ

কেজো ভূতের গল্প- অপর্ণা গাঙ্গুলি

আমাদের পাড়া দিয়ে সম্প্রতি রোজ রাতদুপুরে একটি তালশিড়িঙ্গে লোক হেঁকে যায়।

“ভূত চাই, ভূত…

ভালো ভালো ভূত আছে

ভালোভূত, আলোভূত, মেছোভূত, গেছোভূত, ছানাভূত, দানোভূত, কেজোভূত, হেজোভূত, বাসিভূত, কেশোভূত, মেসোভূত, হরেক রকম ভূত চাই-ই-ই-ই…”

প্রথম প্রথম ভারী অবাক হয়েছিলুম। ভয়ে ভয়ে জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দেখতুম লোকটাকে। সোজা নাক বরাবর হেঁটে যেত সেই লম্বাগিজাং লোকটা পরিত্রাহি ডাকতে ডাকতে। আর লোকটার ডাক শুনেই যে কটা বাড়ির জানলা খোলা থাকত, সব দুদ্দাড় করে বন্ধ হয়ে যেত। সত্যি তো , এতো আর ‘সিলললললল কাটাউউউউউউউ’-এর ডাক নয়, কিম্বা জয়নগরের মোয়াওয়ালার মধুর ডাক নয়। নিদেনপক্ষে ‘ছাতাসারাই’ কিম্বা ‘এইনাআআআআ বাসুনলাগবেননননননন’ এর ডাকও না। এ হলো রীতিমত যাকে বলে রাতদুপুরে ভূত কেনার আমন্ত্রণ। কে আর শখ করে বাঁশঝাড় ঘাড়ে নেয় বাপু।

আমি একলা থাকি এই তিন কামরার একতলা বাড়িটিতে। বিয়ে থা করিনি। একটা শক্ত অসুখে এখন হুইলচেয়ারে আটক। তবে মাঝেমাঝে আমার কিছু উদ্ভট খেয়াল চাপে। হঠাৎ মনে হল, তাই তো একটা ভূত কিনলে বেশ হয়। একা থাকি, মানুষ না হোক, ভূতই সই। আর আজকাল মানুষজনের যা নমুনা দেখছি, তাতে বরং ভূতই ভালো সঙ্গী। দরদস্তুর করে যদি একটা ভালো দেখে ভূত কেনা যায়, মন্দ কী? কী খায়-দায় অবশ্য জানা নেই। তা সে জিজ্ঞাসা করলেই হবে’খন। এই না ভেবে একদিন তক্কেতক্কে ছিলুম। যেই না ভূতওয়ালা হাঁক পেড়েছে, অমনি ডাক দিলুম – “ও ভাই ভূত, শোনো, এই যে এদিকে…”

লোকটি আমাকে দেখতে পেয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এসে পড়ল, “এগ্গে আপুনি আমাকে ভূত বলে ডাকতেছিলেন কেন ? আমি ভূত নই, আমি ভূত বেচি গো বাবু।”

“হা? ও ভুল হয়ে গেছে খুব বাবা, ঠিক খেয়াল করিনি তো।” আমিও ততোধিক বিনয় করেই বলি।

protijogita01মনে ভাবি, কী জানি বাবা তুমি ভূত কিনা, অমন মূলোর মতো দাঁত আর কুলোর মতো কান কেন তোমার? আমার গা শিরশিরিয়ে ওঠে লোকটার ভাঁটার মতো চোখ দেখে। আর গায়ে কী একটা বিকট গন্ধ। তা হতে পারে। সব ভূতগুলো ওর পিঠের ওই বস্তায় কিনা। ভূতেদের গায়ে শুনেছি একটা বিজাতীয় গন্ধ বের হয়।

সে যাকগে, অনেক ভেবে ঠিক করলুম একটা কেজো ভূত কিনব। এমনিতে একটু আধটু লেখালেখি করি, তাই অনেক সময় কাজ করার সময় পাইনে। ভূত যদি কাজকম্ম গুলো সেরে দেয়, আমার খুব উপকার হবে। লোকটা অভয় দেয়, “বাবু, এ আপনার সমস্ত কাজ করবে, কোনও সময় একটু বসতে পারবে না। আপনাকে ওকে সারাক্ষণ কাজ দিয়ে রাখতে হবে। আর এদের বয়স চারশ বছরের উপরে, ছানা ভূত কেউ নয় এরা।” আমিও ভাবলুম, যাক বাপু, শিশুশ্রমিক দিয়ে তো আর কাজ করাচ্ছি না।

তা সে আর এমন কী কথা। কাজ তো মেলাই থাকে, করবে এখন। শেষকালে ঠিক তিনশ তিন টাকা দিয়ে একটা জম্পেশ কেজোভূত কিনে ফেললুম। আর আমার এহেন প্রগতিতে আমি নিজে যারপরনাই খুশি হলুম। তিনটে একশ টাকার কড়কড়ে নোট আর তিনটি এক টাকার কয়েন গুণে নিয়ে লোকটা পিচিক করে একটা বোতল থেকে কী যেন বের করে ঘরের কোণে ছেড়ে দিয়ে সেই যে হাঁটা দিল, আর এমুখো হল না।

ও মাগো, ওটা কী! এইটুকু একটা ছাই রঙের জেলির মতো। ওমা! ওই তো একফুট উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল দেখো। আবার হেঁট হয়ে ও কী করছে? নমস্কার? তাই বোধ হয়। আমিও প্রতিনমস্কার করি। “হা বাপু কেজো ভূত, নমস্কার। যাও বাবা ঘরদোর বেশ পোষ্কার করে ফেলো তো। পুজোবার্ষিকী লেখার তাগিদে এসব কাজে মন দিতে পারিনি। একা থাকি, লোকজন রাখার ঝামেলি নিই না বড়ো।”

কেজো ভূত চোখের সামনে থেকে উধাও হল। ঠিক দশ মিনিটে আমার বাড়ি একেবারে ঝকঝকে তকতকে। এমন পরিষ্কার যে নিজের ছবি ঘরের লাল মেঝেতে দেখে আমি প্রায় চমকে উঠেছিলুম। আমার আর কিচ্ছু বলার নেই। ভূতওয়ালাকে মনে মনে খুব আশীর্বাদ করলুম। আর মিষ্টি জেলিপারা ওই কেজো ভূতটিকে মনে মনে চুমো দিলুম।

মুখে অবশ্য বললুম, “বেশ করেছ।”

এরপর যাই কাজ দিই, নিমেষের মধ্যে সারা।বলব কী আমাকে রাতে যা ভালো রুটি আর আলুর দম করে খাওয়ালে, আমি অমন আলুর দম মা গত হবার পর থেকে আর খাইনি। কেজো তো কিচ্ছু খায় না। বলে গেছে লোকটি, “বাবু ওরা বায়ুভুক নিরাশ্রয় প্রাণী, এই আপনি ওকে আশ্রয় দিলেন… খুব ভালো হোক আপনার।”

এরপর একটু মুশকিলে পড়লুম। জামাকাপড় কাচা, রান্নাবান্না করা, একতলার ছাদের এক টুকরো ঘরের জমা জিনিস পরিষ্কার করা, কুয়ো থেকে জল তোলা, উনুন পরিষ্কার করা, আমার পিঠ মালিশ করা সেরেও যখন ভূতের এনার্জি অটুট, তখন আমার প্রায় কাজ দেওয়ার ক্ষমতা শেষ হয়ে আসছে। কী করি, কী করি। বেজায় বিপাকে পড়লুম। কাজ না পেলে কী করবে জানা নেই। ঘাড় মটকাবে কিনা কে জানে। তখন আমার নিরেট মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আমি একা মানুষ বলে মনে একটু দুঃখু-টুঃখু আছে, সে সব চেপেচুপে রাখি। সটান শুয়ে পড়ে কেজো ভূতকে হুকুম করলুম, “কেজো ভূত, আমার মনের দুঃখুগুলো একে একে বের করতে পারো?” সে আর দ্বিরুক্তি না করে লেগে গেল দুঃখু বের করার কাজে।

হলো কী, একটা একটা করে দুঃখু টেনে টেনে বের করে সে আর আমার আরামে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় বুকের ভেতর একটা সুখের পালক কে বুলিয়ে দিচ্ছে যেন। সেই ইস্তক অন্য কাজ শেষ হয়ে যাবার পর, কেজো এখন যা দুঃখু জমা হয় বের করে দেয়। এই করে করে আমার যদি আর দুঃখই না থাকে? তাই তো ভাবছি কী করা যায়। আমি ভাবছি, সব দুখী মানুষদের  ডেকে তাদের দুঃখগুলো বের করবার কাজে লাগাব কেজো ভূতকে। ভালো লাগাও হবে আর মানবসেবাও হবে। কী বলো, তোমরা?

পৃথিবীতে এত দুঃখু কষ্ট, বড়ো খারাপ লাগে।

ছবিঃ শ্রী শাম্ব

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে