মর্নিংওয়াক থেকে ফিরে এসে বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, “এবারে পাড়ার দুর্গাপুজোর থিমটা দেখেছ?”
কাজ করতে করতে ঝিমলি উত্তর দিল, “না, প্যান্ডেলের দিকে যাওয়ার সময় হয়নি। কেন কী থিম করেছে?”
বাবা গম্ভীর গলা যেন আরও গম্ভীর করে বললেন, “গ্রাম-বাংলা।”
গ্রাম-বাংলা শুনেই ঝিমলির হাতের কাজ থেমে গেল। বড়ো বড়ো চোখ করে বলল, “আবার!”
কয়েকবছর আগেও তাদের পাড়ায় গ্রাম-বাংলা থিম হয়েছিল। ষষ্ঠীর সকালে পাড়ার সকলে প্যান্ডেলে গেছেন। আজ দেবীর বোধন। অর্থাৎ, আজ থেকেই পুজোর শুরু। সারাবছর বাঙালি মন ছটফট করতে থাকে এই ক’টা দিনের জন্য। গ্রাম-বাংলা থিমে মা দুর্গা একজন গ্রাম্য বাঙালি বধূ। পরনে লালপাড় সাদা শাড়ি। হাতে অস্ত্রশস্ত্রর বদলে শাকপাতা, ধানের শীষ, কুলো ইত্যাদি। মা দুর্গার ছেলেমেয়েদের মধ্যেও দৈব কিছু নেই। নিতান্তই সাধারণ গ্রাম্য ছেলেমেয়ে। ছেলেদের পরনে হাফ প্যান্ট, মেয়েদের পরনে ফ্রক। গণেশের হাতে আখ, কার্তিকের হাতে গুলতি। বলাই বাহুল্য, তাদের কোনও বাহন নেই। মায়ের সাথে এতটা পথ হেঁটেই তারা মামারবাড়ি এসেছে। এহেন মা দুর্গার তো পায়ের নিচে অসুর বা সিংহ থাকার কথা নয়। গ্রাম-বাংলায় সিংহ আসবেই বা কোত্থেকে? মা দুর্গার পায়ের দিকে তাকাতেই সকলের চোখে পড়ল ব্যাপারটা। ও মা, ও কী! মা দুর্গার পায়ের তলায় কে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে? আরে এ তো ফোচন, ফোচন চক্রবর্তী, ডাকনাম ফুচকা। ফুচকার মতোই গোলগাল চেহারা। গায়ের রঙটা ধবধবে ফরসা। দেখে মনে হয় ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। আসলে সাংঘাতিক বিচ্ছু।
ঝিমলি মনে মনে বলল, “হ্যাঁ রে, তোর কি আর শোয়ার জায়গা জোটে না?”
প্যান্ডেলে ততক্ষণে হাসির রোল উঠেছে। ঝিমলিও প্রায় হেসে ফেলেছিল, কিন্তু বাবার রক্তচক্ষু দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখটা গম্ভীর করার চেষ্টা করল। এদিকে এত সোরগোলের মাঝে ফোচনের ঘুম গেল চটকে। ঘুম ভাঙতেই সে উঠে একলাফে দৌড়ে পালাতে গেল। মা দুর্গার গলায় মালা পরানোর জন্য মইটা রাখা ছিল সামনে। ফোচনের ধাক্কায় ঘট উল্টে গেল আর সেই ঘট সামলাতে এসে জনৈকা মাসীমা ধাক্কা খেলেন মইতে। মই ধাক্কা খেয়ে পড়ল অল্পদূরে রাখা কিছু ঝাড়বাতির ওপর। মুহূর্তের মধ্যে ঝাড়বাতি কাঁচের গুঁড়োয় পরিণত হল। ঝিমলির মুখ লজ্জায় লাল। সেও দৌড় লাগাল ফোচনের পেছনে।
বাড়ি ফিরেই বাবা আদেশ দিলেন বাকি পুজোয় ফোচন যেন বাড়ি থেকে না বেরোয়। কিন্তু ফোচনকে আটকে রাখা কি চাট্টিখানি কথা! রাগী রাগী মুখে ফোচনকে ধমকাতে এসে ঝিমলি দেখল, সে পরম তৃপ্তিসহকারে দুধভাত খাচ্ছে। দেখে মায়া হল। আহা রে, খাওয়ার সময় ছেলেটাকে বকব? এমনিতে ঝিমলি বেশি বকাঝকা করে না। অবশ্য আজকের মতো এতবড়ো দুর্ঘটনাও ফোচন আগে কখনও ঘটায়নি। তবুও সারাপুজোয় বাড়ি থেকে বেরোতে না দেয়াটা একটু বাড়াবাড়ি। কিন্তু বাবা যখন একবার বলে দিয়েছেন, তখন আর কিছু করার নেই। বাবার ওপর কথা বলার সাহস বাড়িতে কারুর নেই। ছাদের ঘরে ফোচনকে আটকে রাখা হল। ঝিমলি নিজের হাতে বাইরে থেকে তালা দিল। ভাবল, দুপুরে ভালোমন্দ রান্না করে এনে ছেলেটাকে অনেক আদর করে দেবে। ভাবতে ভাবতে খেয়াল হল, এ মা, আজ তো ষষ্ঠী। আজ তো নিরামিষ। আজ তো এমনিতেই ফোচনের মুখে খাবার রুচবে না।
নিরামিষের মধ্যেই একটু ভালো রান্না করে দুপুরে ঝিমলি গেল তার আদরের ফুচকাকে খাওয়াতে। তালা খুলে থালা হাতে ভেতরে ঢুকে ঝিমলি অবাক। কোথায় ফোচন! সারাঘরে তার চিহ্ন নেই। হঠাৎ ঝিমলির খেয়াল হল, আরে! জানলাটা তো খোলা। এই জানলা দিয়েই ফোচন পালিয়েছে। রাগ বা চিন্তা হওয়ার বদলে ঝিমলি ফিক করে হেসে ফেলল।
নীচে নেমে কথাটা মাকে বলতেই তিনি রেগে উঠলেন। “কী যে করে তোর বাবা! দুপুরে খেতে পর্যন্ত দিল না ছেলেটাকে। কে জানে কখন ফিরবে আর কখন কী খাবে।”
সন্ধে অবধি ফুচকার পাত্তা নেই। কে জানে কোথায় চড়ে বেড়াচ্ছে। ঝিমলির মা অস্থির হয়ে উঠেছেন। এই নিয়ে একচোট ঝগড়াও হয়ে গেল ঝিমলির বাবার সাথে। একমাত্র ঝিমলিই খুব একটা বিচলিত নয়। সে নিশ্চিত, খিদে পেলে ফুচকা ঠিক বাড়ি ফিরে আসবে। সে অন্য কারো বাড়ীতে কিছু খায় না, সে যতই লোভনীয় খাবার হোক না কেন।
ঝিমলির বাবার মনটাও ততক্ষণে খচখচ করছে। ভাবছেন, এতটা কড়া হয়তো না হলেও চলত। ছেলেটা কোথায় আছে, কী করছে কে জানে। এসব ভেবে তিনি নিজেই ফোচনকে খুঁজতে বেরোলেন। ঝিমলি ডাইনিং টেবিলে বসে নারকেলনাড়ু পাকাছে। টিভিতে পুজো পরিক্রমা চলছে। হঠাৎ পায়ে নরম নরম কিছু একটা ঠেকতে ঝিমলি টেবিলের নীচে তাকাল আর তাকাতেই সস্নেহে হেসে উঠল। তার আদরের ফুচকা তার পায়ে মুখ গুঁজে লেজ নাড়ছে। ঝিমলি তৎক্ষণাৎ ওকে কোলে তুলে আদর করতে করতে চেঁচাল, “মা, শীগগির ফুচকাকে কিছু খেতে দাও, ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে।” বলে অধৈর্য হয়ে নিজেই উঠে পড়ল টেবিল ছেড়ে।
ঝিমলির পায়ে পায়ে ফোচনও ম্যাও ম্যাও করতে করতে রান্নাঘরে চলল।
ছবিঃ মৌসুমী