গল্প -ভাই আর বোনের গল্প সহেলী চট্টোপাধ্যায় শীত ২০১৬

golpobhaiarbon01

কুশলের কথা

আমার অনেকদিনের শখ বাড়ি থেকে একবার পালাব। কিন্তু এই সাধ কোনওদিনই পূর্ণ হবার নয়। তোমরা ভাবছ, এ আবার কী বিদঘুটে খেয়াল রে বাবা! কই, আমাদের তো এমন শখ কখনও হয় না! আসলে তোমাদের থেকে আমি একটু অন্যরকম। একটু ডানপিটে বলতে পার।

বাড়িতে আমার অবস্থা খুবই খারাপ। বাবা, মা, জেঠু-জেঠিমা, ঠাম্মার চাপে প্রায় চেপ্টে যাবার জোগাড়। গুরুজন সম্পর্কে এমন কথা বলতে নেই। কিন্তু বন্ধুদের সাথে নিজের দুঃখের কথা তো শেয়ার করতেই পারি। তোমরা তো আমার বন্ধুই। দুঃখের কথাগুলো একে একে বলি শোনো।

আমার সকাল শুরু হয় জেঠুর ধমক খেয়ে। রোজ সকালে লোকে চা-বিস্কুট দিয়ে দিন শুরু করে। কিন্তু আমার কপাল মন্দ।

‘এখনও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস! ওঠ বলছি! না হলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না’!

প্রতিদিন ভোর চারটেয় আমাকে উঠিয়ে দেয়। শীত হোক, বর্ষা হোক আর গরম হোক। আমার দরকার থাকুক আর না থাকুক, সেই ভোর চারটের সময়ই উঠতে হবে।

আমার টিভি দেখারও উপায় নেই। বাবা আর জেঠুর জন্য। আমি নাকি সবসময়ই টিভি দেখি। আমি না দেখলেও বলবেন দেখি। কিন্তু টিভি সৃষ্টিই হয়েছে দেখার জন্য।

ঠাকুরমার কথা বলি এবার। দরকার পড়লে বলবেন, “লক্ষ্মীসোনা আমার, চশমাটা খুঁজে দিয়ে যা।” যেই দরকার মিটে গেল অমনি নিজমূর্তি ধারণ করলেন, “তবে রে হনুমান! দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি মজা!”

আমার নামটা বলে দিই এবার। এতক্ষণ আড্ডা দিচ্ছি অথচ এখনও নিজের নামটাই বলিনি। আমি কুশল ব্যানার্জি। ক্লাস নাইনের ছাত্র। আমার এক দিদি আছে। দিদি আমার থেকে অনেক বড়ো। কলেজে পড়ে। দিদিকে আমি খুব ভালবাসি। দিদি আমাকে কখনও বকে না। ঠাণ্ডা মাথায় বোঝানোর চেষ্টা করে। আমি রোজ স্কুলে চলে যাই। কিন্তু এই গরমের ছুটি পড়ল তো বোর হওয়া শুরু। আমার সব বন্ধুরা গরমের ছুটিতে বেড়াতে যায়। কেউ দার্জিলিং তো কেউ দীঘা। আমার কোথাও যাওয়া হয় না। কেউ নিয়েই যায় না কখনও। তাই তো ঠিক করেছি, চুপি চুপি কাউকে না বলে বেরিয়ে পড়ব। আমাদের এই বটতলার মোড় থেকে দূরপাল্লার বাস ছাড়ে। আমি জলপাইগুড়ির বাসে উঠে পড়ব। ছোটোবেলা থেকেই পাহাড় আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু কখনও দেখিনি। ইস, এতবড়ো ছেলে, এখনও পাহাড় সমুদ্র কিছুই দেখেনি! আমার ছোটোবেলার বন্ধু রাতুলরা থাকে নিউ জলপাইগুড়ি। আমি বাস থেকে নেমেই ওকে ফোন করে দেব।

রাতুলেকে মেল করেছি। ও উত্তরে জানিয়েছে, ক’দিন এসে থেকে যা, আবার সব ঠাণ্ডা হলে ফিরে যাবি।

ঠাণ্ডা এরা কোনওদিনই হবে না। হেলিকপ্টার থেকে বরফ ঢাললেও হবে না। মায়ের সাথে জেঠির, জেঠির সাথে জেঠুর, জেঠুর সাথে বাবার, বাবার সাথে মায়ের, মায়ের সাথে বাবার – ঝগড়া চলতেই থাকে। এই চক্র চলতেই থাকবে। এই সমস্যার সমাধান ভগবানই করতে পারছেন না। তার চেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে চলে যাই কিছুদিনের জন্য। বেশ মজা করে ঘুরে-টুরে আসি।

গরমের ছুটি পড়ে গেছে। পালাবার উপযুক্ত সময় উপস্থিত। আজ রবিবার। সকালে একটা লোহার চাটুকে কেন্দ্র করে মা আর জেঠিমার মধ্যে একচোট ঝগড়া হয়ে গেছে। চাটু খুঁজে পাচ্ছিল না। দু’জনেই দু’জনকে দোষ দিতে লাগল। খুন্তি লড়াইটাই যা বাকী রয়ে গেল। বড়োরা একদম বোঝে না যে তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করলে আমাদের ছোটোদের কতটা খারাপ লাগে, দুঃখ হয়! আমরা ছোটোরা যখন মারপিট করি, ঝগড়া করি তোমাদেরও তো খারাপ লাগে!

আমি দিদির ঘরে চলে এলাম। আমার জেঠতুতো দিদি দিয়া। কিছু শলা-পরামর্শ করার ছিল। বিকেলে খেলতে যাবার নাম করে বাস ডিপোয় চলে এলাম। আজ আমি পালাবই। তোমরা এবার বাকি গল্পটা শোনো আমার দিদির মুখ থেকে। টাটা।

দিয়ার কথা

golpobhaiarbon02ভাইটা আমার ওপর একটা দুরূহ কাজ সঁপে দিয়ে পালাল। সকালে ঝগড়ার সময় পরামর্শ করতে এসেছিল। ভীষণ নরম মনের ছেলে ও। এইসব ঝগড়াঝাঁটি ওর একদম ভালো লাগে না। সংসারে ও অনেক কষ্ট পাবে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে গেল। ভাই ফিরল না। বাড়িতে আবার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। বাবা আমায় বকলেন, ভাইয়ের খেয়াল রাখতে পারি না কেন?

কাকিমা আর মা কাঁদতে বসলেন। ঠাকুরমা ঠাকুরঘরে বসে পড়েছেন। মা বললেন, “পুলিশে খবর দাও। ছেলেটাকে নিশ্চয় কেউ কিডন্যাপ করেছে।”

এই রে! পুলিশ এলে সামলাব কী করে? বললাম, “পুলিশ আর কী করবে মা? তোমরা সবসময় ঝগড়া করছ। যে বাড়িতে কাক-চিল বসতে পারে না, সেখানে মানুষ থাকে কী করে?”

মা আর কাকিমা একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে। এ এক বিরল দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হল। বাবা হাত রেখেছে কাকুর কাঁধে।

ঠাকুমা বললেন, “বেশ করে কাঁদো সবাই। ছেলেটাকে সবাই মিলে বকার সময় মনে ছিল না?”

এই বকাবকির দলে কিন্তু ঠাকুমাও ছিলেন। বাবা আর কাকু সম্ভাব্য সবরকম জায়গায় ফোন করে খবর নিচ্ছেন।

“মা, আমি আর ওকে কোনওদিন বকব না। কাজের প্রেশারে থাকি, তাই মাঝে মাঝে মুখ ঝুক করে ফেলি।” কাকু বললেন।

“আগে ভালোয় ভালোয় ফিরে আসুক ও। তারপর দেখিয়ে দেব ছেলে মানুষ করা কাকে বলে। আদর-যত্নে রাখব এবার থেকে।” কাকিমা বললেন কাঁদতে কাঁদতে।

“আমরা আর কোনওদিন বাড়ির মধ্যে অশান্তি করব না। আমাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া অশান্তি দেখলে ওরা বড়ো দুঃখ পায়।” আমার মা বললেন।

বাবা উদ্বিগ্নমুখে একের পর এক ফোন করে চলেছেন। বললেন, “আমরা চরম ভুল করে ফেলেছি। সবসময় যদি মেজাজ না দেখাতাম তাহলে ওরাও আমাদের বন্ধু হতে পারত।”

ঠাকুমা বললেন, “একবার ফিরে আয় দাদা! তারপর তুই যেমন বলবি আমরা তেমন চলব।”

রাত ন’টা পর্যন্ত এই চলল। আরও কিছুক্ষণ হয়তো চলত যদি কলিংবেলটা বেজে না উঠত। আমরা সবাই দৌড়ে এলাম ড্রয়িংয়ে। দরজাটা আমিই খুললাম। সামনে দেখি ভাই। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম, কিন্তু আমার থেকে টেনে নিলেন ঠাকুরমা। “তবে রে হতচ্ছাড়া! এখন বাড়িতে ঢোকার সময় হল!”

এ কোন ঠাকুরমাকে দেখছি আমি! একটু আগেই তো ভাইয়ের জন্য কাঁদছিলেন।

বাবা বললেন, “এইসব তোমাদের আশকারার ফল, মা।”

কাকু বললেন, “থাক সারাক্ষণ বাইরে। এখন এলি কেন? খিদে পেয়েছে বুঝি?”

ও কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই কাকিমা এক ধমকে চুপ করিয়ে দিলেন। “আর সাফাই গাইতে হবে না! তা কোন বন্ধুর বাড়ি আড্ডা হচ্ছিল এতক্ষণ?”

মা বললেন, “আশ্চর্য ছেলে বাপু! তা আসতে দেরি হবে এই খবরটাও তো ফোন করে জানিয়ে দিতে পারতিস! যতবার ফোন করছি ধরছিস না! ছিঃ ছিঃ! কত চিন্তায় ছিলাম বল তো আমরা!”

এই একটু আগেই সবার চোখমুখের অবস্থাই বদলে গিয়েছিল। এখন দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না যে একটু আগে এরাই এত কাঁদছিলেন, চিন্তা করছিলেন। যাই হোক, একদিনের জন্যও হলেও আমার ভাই বাড়ির সবাইকে এক করতে পেরেছে।

বাকিটা আমার ভাইয়ের থেকে শোনো। শুরু ও করেছিল, শেষও ওই করবে।

কুশলের কথা

না ভাই, পালানো অত সোজা নয়। আমি বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে রাতুলের বাড়ি চলে এলে ওরা বিপদে পড়ে যেত। তবে একবার আমি দার্জিলিং যাবই। তার জন্য আমাকে অনেক পড়াশোনা করতে হবে। রাতুলের বাড়িও আসব অবশ্যই। অনেকটা বড়ো হয়ে যাই আগে। তোমরা কী বলো?

ছবিঃ মৌসুমী

জয়ঢাকের গল্প ঘর