গল্প -মিনু আর আমদুসিয়াসের সুর সায়ক আমান শীত ২০১৬

golpominu

অনেকদিন ধরেই বাজছে সুরটা। মিহি তানপুরার মতো। দিনে অন্তত চারবার সেটা শুনতে পায় মিনু। কিন্তু সুরটা যে কোথা থেকে আসছে সেটা ঠাওর করতে পারে না। কখনও মনে হয় ছাদে বসে কেউ বাজাচ্ছে, আবার কখনও মন বলে একতলার ভাড়াটেদের কেউ রেডিওতে শুনছে। একই সুর একইভাবে মিনিটখানেক বাজতে থাকে। তারপর আবার নিজে থেকেই মিলিয়ে যায়। বড়োরা কিন্তু কেউ শুনতে পায় না। বাবা, মা, খেন্তিমাসি, কেউ না। মিনু ছাড়া বাড়ির একটি মাত্র প্রাণী শুনতে পায় সেটা – প্লুটো। সুরটা বাজলেই সে তটস্থ হয়ে ওঠে, কান খাড়া করে এদিক ওদিক তাকায়, না হলে টেবিলের তলায় লুকিয়ে পড়ে। এমনিতে প্লুটো ভীতু নয়। বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে কুকুর দেখতে পেলে দিব্যি মুখ ভেংচাতে পারে। কিন্ত ওই আজব সুরটা শুনলে সেই মহাবলী প্লুটো সটান মিনুর পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে। ভারী মুশকিল হল। ব্যাপারটা বড়োদের কয়েকবার বলার চেষ্টা করেছে মিনু। কিন্তু ফল হয়নি, উল্টে বিপদ বেড়েছে। সমস্ত ঘটনা শুনে বাবা খুশি হয়ে বলেছেন, “মেয়ের গানে সখ আছে দেখছি। তাহলে তো মাস্টার রাখতে হয়।”

এই ব্যাপারটা মিনুর একদম পছন্দ নয়। পাশের বাড়ির শ্যামলীকে রোজ বিকেলে গান শেখাতে আসে। সে বেচারি খেলা ছেড়ে যেতে চায় না। ফলে খানিকটা টানাটানি চড় থাপ্পড় আর কান্নাকাটির পরে যখন সে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে তখন তার গলা থেকে সাত সুরের বদলে একটি মাত্র সুর বেরিয়ে আসে, ‘ওঁয়া…’

সে দেখে ভারী মায়া লাগে মিনুর। শ্যামলী অনেকক্ষণ দম ধরে রেখে চু করতে পারে, এককোট থেকে আর এককোট বিড়ালের মতো লাফাতে পারে, তাকে কিনা বিকেল হলেই বউবসন্ত ছেড়ে চিলচিৎকারে বাড়ি মাথায় করতে হচ্ছে। অবশ্য তার থেকেও বেশি চেঁচায় তার দিদিমণি। মিনু একবার দোতলার জানলা দিয়ে দেখেছিল। এইসা হোঁৎকা মোটা, চুলগুলো লাল, ঠোঁটদু’টোয় এমন কষে লিপস্টিক মাখে যে দেখলে মনে হয় এই বুঝি কারও রক্ত খেয়ে এল। হাতদু’টো বিছানার পায়ার মত চওড়া। ওই হাতে একটা কিল খেলে পিঠটা মনে হয় সি-হর্সের মতো বেঁকে যাবে। কী ভয়ঙ্কর! বাবা যদি শেষপর্যন্ত মিনুকে তার কাছেই গান শিখতে পাঠায়? এইসব ভেবেই মিনু চিন্তায় ছিল। তার উপর আবার এই সুরের উৎপাত। এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে ওই হোঁৎকা দিদিমণির কাছে না গিয়ে আর উপায় নেই। শ্যামলীকে ইদানীং আর খুব একটা বাড়ির বাইরে দেখা যায় না। কখনও জানলায় দেখতে পেলে এমনভাবে হাসে যে মনে হয় ঠোঁটদু’টোই ফাঁক হচ্ছে। হাসছে না।

বিকেল শেষ হয়ে আসছিল। এমনিতে শীতকাল, স্কুল থেকে ফিরতেই পাঁচটা বেজে যায়। তারপর আর খেলার সময় থাকে না বললেই চলে। তাছাড়া মিনুর বন্ধুবান্ধবদেরও সবার ঠাণ্ডা লেগে সর্দি-কাশি-জ্বর। অগত্যা সে মাঠে একাই খানিকটা দৌড়োদৌড়ি করে। পুকুরের জলে গোল চাকতি ছুঁড়ে ব্যাঙবাজি করে প্লুটোকে তাক লাগিয়ে দেয়। আবার সন্ধে হলে ঘরে ফিরে আসে। আজ কিন্তু বাড়ির সামনে এসে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। পাশেই শ্যামলীদের বাড়িটা কেমন যেন থমথম করছে। অন্যদিন দোতলার জানালা থেকে রেওয়াজের শব্দ ভেসে আসে। আজ আসছে না। মিনুর মনটা কেমন যেন করে উঠল। শ্যামলী দিনদিন কীরকম হয়ে যাচ্ছে। আগেকার মতো খেলতে আসে না। কারও সাথে বেশি কথা বলে না, দেখা হলেও মুখ ঘুরিয়ে নেয়। গায়ের চামড়াটা সাদা হয়ে যাচ্ছে। এইমুহূর্তে মিনুর তাকে দেখতে ইচ্ছা করল। অন্যসময় হলে ব্যাপারটা কঠিন হত না। কিন্তু এখন মনে হয় সে নতুন দিদিমণির কাছে গান শিখছে। ঘরে ঢুকতে দেবে না।

মিনুর রোখ চেপে গেল। ইচ্ছা হয়ছে যখন তখন একবার দেখবেই। কী করা যায়? দোতলার জানলাটা বন্ধ। সেটার ঠিক পাশ দিয়ে লম্বা জলের পাইপ নেমে গেছে। পাইপটায় খানিকটা দূরে দূরে খাঁজ কাটা আছে। সেগুলো দেখেই মিনুর মাথায় একটা বুদ্ধি এল। বিকেলের আলো পড়ে এসেছে। রাস্তায় তেমন লোকও নেই। তাও পাইপ বেয়ে দোতলায় ওঠাটা সহজ নয়। বিশেষ করে পুরনো পাইপ জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা হয়ে পিচ্ছিল হয়ে আছে। সেখানে একবার বেকায়দায় পা পড়লেই সটান নিচে। কিন্তু সেসব ভেবে মিনু ভয় পেল না। একটা ব্যাপার যখন ঠিক করে নিয়েছে তখন করেই ছাড়বে। ছোটো থেকে এই একটাই দোষ তার। মা মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলেন, “এত জেদ যদি পড়াশোনায় দেখাতিস তাহলে রোল নম্বর চিতুর আগে চলে আসত।”

যাই হোক, মিনু এগিয়ে এসে পাইপের নিচের দিকটা ভালো করে চেপে ধরল। প্লুটো এতক্ষণ পায়ের কাছে দাঁড়িয়েছিল। এবার সে খানিকটা এগিয়ে এল। মিনু খাঁজে খাঁজে পা রেখে বেশ কিছুটা উঠল। এখান থেকে হাত বাড়ালেই জানলাটা ধরা যাবে। হঠাৎ মনে হল কীসের একটা মিহি আওয়াজ আসছে। ভালো করে শুনে সে বুঝতে পারল সেই সুরটা! এতদিন শুধু বাড়ির ভিতরেই শুনতে পেত। আজ প্রথম বাড়ির বাইরেও শোনা যাচ্ছে। মিনু নিচে তাকিয়ে দেখল প্লুটোর গায়ের সবক’টা লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। থাবা থেকে বেরিয়ে এসেছে নখগুলো। আস্তে আস্তে সে পিছিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ প্লুটো এত ভয় পাচ্ছে কেন! মিনু পাইপ চেপে ধরে আবার উঠতে লাগল। জানলাটা কাঠের, তবে একটা কোণের দিক বাইরে খসে পড়ায় সেখানে চোখ রাখলে ঘরের ভিতরটা দেখা যায়। সেই ফুটোতে চোখ রাখতে যাবে এমন সময় তার পিঠের উপর দিয়ে কী যেন একটা জিনিস লাফিয়ে পাইপের ওপারে চলে গেল। প্লুটো! সেও উঠে এসেছে পাইপ বেয়ে! তার হাবভাব কেমন যেন পালটে গেছে। এর আগে কোনোদিন তাকে এত ভয় পেতে দেখেনি মিনু। মনে হচ্ছে এক্ষুনি যেন কেউ হামলা করবে তার উপর। সেই ভয়েই সতর্ক থাকছে। পাইপ থেকে বারান্দায় ঝাঁপ দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল প্লুটো। ব্যাপারটা মিনুর ভালো লাগল না। কী দেখতে গেল প্লুটো? এরকম তো সে সচরাচর করে না। মিনু জানলার ফাঁকে চোখ রাখল।

ঘরের ভেতরে হালকা অন্ধকার, ভালো করে দেখা যায় না। দু’জন মানুষ বসে আছে ঘরের ভেতরে। শ্যামলী আর তার গানের দিদিমণি। খুব ফিসফিস করে কী যেন বলছে দু’জনে। যেন গোপন কিছু। অন্য কেউ যেন শুনতে না পায়। মিনু ফাঁক থেকে চোখ সরিয়ে কান রাখল। না, কথা বলছে না। কীসের যেন মন্ত্র পড়ছে, সুরেলা অথচ কেমন যেন ভয়ঙ্কর। যেন কেউ খুব নিচু স্বরে কীসের ষড়যন্ত্র করছে। হঠাৎ ঘর থেকে অন্যকিছুর শব্দ পাওয়া গেল, বাঁশি বাজছে। আগের মতোই হালকা স্বরে। ওই মন্ত্রর কথাগুলোর সাথে মিলে যাচ্ছে বাঁশির সুর। মিনুর মনে হল তার মাথাটা যেন দুলছে, আর একটু হলেই পড়ে যাবে পাইপ থেকে। এমন সময় কীসের যেন আচমকা শব্দে বাঁশিটা থেমে গেল। একটা হালকা চিৎকার ভেসে এল ঘর থেকে। মিনু তাড়াতাড়ি ফুটোতে চোখ রেখে দেখল শ্যামলী প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে ঘরের মেঝেতে। তার ঠিক পাশেই পড়ে আছে তার গানের দিদিমণি এবং তার একদম পাশেই একটা একহাত লম্বা বাঁশি। বিছানার উপর উঠে রাগে গজগজ করছে প্লুটো। সম্ভবত সে এসে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওদের উপর। কিন্তু কেন? সে লক্ষ করল, গানের দিদিমণি প্লুটোর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। তার চোখমুখ উজ্জেজনায় থরথর করে কাঁপছে। শুধু ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে শব্দগুলো। প্লুটো কিন্তু আগের মতোই গজরাচ্ছে। মিনুরও এতক্ষণে পা কাঁপছে। ভেতরে মারাত্মক একটা কিছু হচ্ছে নিশ্চয়ই। এইবার শ্যামলী উঠে দাঁড়িয়েছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে প্লুটোর দিকে। কিন্তু এ কী! শ্যামলীর নখগুলো হঠাৎ করে এত বড়ো হয়ে গেল কী করে? নাকটাও যেন ছুঁচলো হয়ে এসছে।

মিনু আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। সমস্ত ব্যাপারটা তার কাছে গুলিয়ে গেছে। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে যে প্লুটোর বিপদ। যেকোনোভাবে ওই ঘরে ঢুকতেই হবে। সে তড়বড়িয়ে পাইপ বেয়ে নিচে নেমে এল। শ্যামলীদের দরজার কলিং বেল বাজাল। মনের ভেতর উত্তেজনাটা ক্রমশ বাড়ছে। এরই মধ্যে খারাপ কিছু হয়নি তো? একমিনিট পরে শ্যামলীর মা দরজা খুলে দিলেন। মিনু তাকে কিচ্ছু না বলে হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল। দোতলার সিঁড়িতে পা দিতেই একটা চেনা গলা শুনতে পেল।

“এইসব বেড়াল-টেরাল ঘরের মধ্যে কে এনেছে? কালই বিদেয় করে দেবে। না হলে আমি আর আসব না। ছি ছি ছি, কোথায় না কোথায় ঘুরে বেড়ায়, একবার আঁচড় খেলে ডিপথেরিয়া অবধারিত।” শ্যামলীর দিদিমণি।

মিনু উঁকি দিয়ে দেখল তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তার পেছন পেছন শ্যামলীও। সে আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। শুধু গায়ের রঙটা আরও ফ্যাকাসে, চোখদু’টো প্রাণহীন। মিনু সদর্পে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল। ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে বলল, “আমার বেড়াল কই?”

“ওটা তোমার বিড়াল?” মোটা দিদিমণি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জরিপ করলেন মিনুকে।

“হ্যাঁ,” বলে সে ঘরের ভেতর ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে দেখল বিছানার একটা পায়ার নিচে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে প্লুটো। মিনুকে দেখেই তার চোখের হিংস্রদৃষ্টিটা নিভে এল। সিঁড়ি থেকে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। অর্থাৎ, ওরা দু’জনে নিচে নেমে গেল। মিনু নিচু হয়ে প্লুটোকে তুলতে যাবে এমন সময় কীসে যেন তার চোখ আটকে গেল। বিছানার নিচের অন্ধকারে একধারে পড়ে আছে সেটা। চৌকো, নির্জীব। কাছে এসে ভালো করে দেখে বুঝল একটা বই। খয়েরি মলাট, একটা সবুজ ফিতে দিয়ে বাঁধা। বেশি বড়ো নয়। এক হাতেই ধরা যাবে। সম্ভবত গানের আন্টি ফেলে গেছে। কী লেখা আছে বইটায়? এভাবে সবুজ ফিতে দিয়েই বা বাঁধা আছে কেন? মিনু বইটা হাতে তুলে নিল। হয়তো বইয়ের লেখাগুলো পড়লে কিছু জানা যাবে। প্লুটোকে কোলে নিয়ে সে নিচে নেমে এল। কেমন যেন থম মেরে আছে প্লুটো। একমনে কী যেন ভাবছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আবার শ্যামলীর মায়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। বইটার উপর প্লুটোকে চেপে ধরে কোনওরকমে আড়াল করল মিনু।

“এক্ষুনি চলে যাচ্ছিস যে! বোস না।”

“পরে আসব, এখন বসলে বাবা পিটবে।”

শ্যামলীর মা এবার এগিয়ে এসে তার মাথায় একটা হাত রাখলেন, “শুনলাম, তোর নাকি গান শেখার ইচ্ছা?”

মিনু আকাশ থেকে পড়ল, “কে বলেছে?”

“ওমা, তোর বাবাই বলল কালকে। আজ গানের আন্টিও বললেন, বেশ মিষ্টি গলা তোর।”

“আমি গান শিখব না।” মিনু জোর গলায় কথাটা বলে ঝড়ের মতো দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল।

বড়দিনটা এ পাড়ায় বেশ বড়ো করে হয়। একটা ছোটোখাটো চার্চ আছে। সেটাকে ইস্টার ট্রি দিয়ে নতুন করে সাজানো হয়। সকাল থেকে হালকা সুরে ক্যারল বাজতে থাকে। পাড়ারই দু’একজন বুড়ো সান্টাক্লজ সেজে বাচ্চাদের সাথে হাত মেলায়। মিনুর এই সমস্ত মন্দ লাগে না। শুধু একটাই আফসোস, কলকাতায় বরফ পড়ে না। বহুবার সে ইংরাজি সিনেমায় দেখেছে ক্রিসমাস এলেই সেখানকার রাস্তা বরফে সাদা হয়ে যায়। বাড়ির মাথাও ঢেকে যায় বরফে। অথচ এখানে তেমনটা হয় না। সকালবেলা সে ছাদে দাঁড়িয়েছিল। চতুর্দিকটা কুয়াশায় ঢেকে আছে। দূরে গির্জার ঘণ্টাটা টুং টুং করে বাজছে। সামনের কোনও বাড়ি থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছে। ‘জিঙ্গল বেল, জিঙ্গল বেল, জিঙ্গল অল দ্য ওয়ে।’ মিনুও মনে মনে সুর করে গাইতে লাগল গানটা। বরফে ঢাকা পাহাড় মহানন্দে পাড়ি দিচ্ছে সান্টাক্লজ, কুকুরে টানা গাড়িতে চড়ে। শীতকালটা খুব ব্যস্ত থাকে সে। এতগুলো বাচ্চাকে উপহার পৌঁছে দিতে হবে। মিনু অবশ্য আজ অবধি কিছু পায়নি। কাল রাতেও মাথার কাছে একটা লম্বা মোজা ঝুলিয়ে শুয়েছিল। সকালে উঠে দেখেছে সেটা ফাঁকা। তারপর থেকে মনটা খারাপ হয় গেছে। মনখারাপ হলেই সে ছাদে চলে আসে। প্লুটোটা অবশ্য আসেনি, সে ব্যাটা জুতোর বাক্সে শুয়ে শীতের আমেজ মেখে ঘুম দিচ্ছে। পাশের বাড়ির দিকে তাকিয়েই শ্যামলীর কথা মনে পড়ল। তার সাথে সেই ডাইরিটার কথাও। ছাদেই সিমেন্টের বেঞ্চের তলায় লুকিয়ে রেখেছে সেটা। এই ক’দিন খুলে দেখতে সাহস হয়নি। বইটা যে হারিয়েছে সেটা নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝে গেছে দিদিমণি। যদি খুঁজতে আসে? পড়া হয়ে গেলে কি সেটা আবার ফিরিয়ে দেওয়া উচিত? সেদিন জানালার ফুটো দিয়ে যা দেখেছিল সেটা এখনও বিশ্বাস হয় না মিনুর। হয়তো চোখে ভুল দেখেছিল। না হলে শ্যামলীর নখগুলো অত বড়ো হয়ে গেল কী করে? নাকটাই বা…

মিনু ধীরে ধীরে সিমেন্টের বেঞ্চটার দিকে এগিয়ে গেল। শীতকাল বলে বৃষ্টিতে ভেজার ভয় নেই। অবশ্য কুয়াশা জমে খানিকটা ভিজে থাকতে পারে। সাবধানে বেঞ্চের তলায় হাত ঢুকিয়ে বইটা টেনে বের করল মিনু। ফিতেটা আগের মতোই বাঁধা আছে। তার মানে এখনও কেউ খুঁজে পায়নি সেটা। আর একবার সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিক দেখে নিল। কেউ দেখছে না তো? তারপর মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে দু’পায়ের ফাঁকে বইটা রেখে উপরের শক্ত কাঠের মতো পাতাটা খুলল। ভেতরের পাতাগুলো ভীষণ পুরনো আর হলদে। ধরলেই মনে হয় ভেঙে যাবে। সে খুব সাবধানে পাতা উল্টাতে লাগল। একটা জায়গায় ছক কাটা আছে। মিনু গুনে দেখল মোট ঊনত্রিশটা ঘর কাটা আছে। তার সবক’টাতেই নাম লেখা, শুধু শেষের ঘরটা ছাড়া। কাদের নাম এগুলো? পাতাটা উল্টাতে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা নাম চোখে পড়তেই সে আটকে গেল। শেষের ফাঁকা ঘরের ঠিক উপরে লেখা আছে – শ্যামলী গুহ। মিনু বই থেকে মুখ তুলে ভাবার চেষ্টা করল। এতগুলো নাম একসাথে লেখা হয়ছে কেন? এদের নিয়ে কী করতে চায় গানের আন্টি? সে আবার পাতা উল্টালো। জায়গায় জায়গায় কীসব যেন লেখা আছে। তার খানিক ইংরাজিতে, সেগুলো ঠিক করে পড়তে পারল না। ইংরাজিটা তার এখনও সেভাবে সড়গড় হয়নি। কষ্ট করে যেটুকু পড়া গেল তার মধ্যে একটা শব্দ বেশ কয়েকবার আছে – ‘আমদুসিয়াস’। এরকম বিদঘুটে নাম মিনু আগে শোনেনি।

বইটায় ইংরাজি ছাড়াও অন্য ভাষাতেও কিছু লেখা আছে। সেগুলো মিনু বুঝতে পারল না। অনেকগুলো পাতা জুড়ে বড়ো বড়ো ছবি দিয়ে সুর লেখা আছে। এগুলোকে বলে স্বরলিপি। কীসের সুর এটা? এটাই কি তাহলে মাঝে মাঝে শুনতে পায় সে? কিন্তু সেটা বাজায় কে? বইটা হাতে নিয়ে মিনু উঠে পড়ল। ছাদের এই জায়গাটা খুব একটা নিরাপদ নয়। নামটা কয়েকবার মনের মধ্যে আউড়ে নিল। ‘আমদুসিয়াস’।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলে আগে পড়ে বাবার ঘর, তারপর মিনুর পড়ার ঘর। সেখান থেকে সিঁড়ি আবার নিচে নেমে গেছে। একতলায় ভাড়াটেরা থাকে। আজ মিনু নিচে নেমে আসতেই দেখল মহেন্দ্রকাকা গায়ে একটা শাল দিয়ে কোথায় বেরোচ্ছে। কেমন যেন হন্তদন্ত ভাব। তাকে দেখেই মিনু থমকে দাঁড়াল। ফ্রকের পকেটে ঢুকিয়ে নিল হাতের বইটা। এত সকালে পাড়ার লোক ঘুম থেকেই ওঠেনি। এরই মধ্যে এত তাড়াহুড়ো করে বেরোচ্ছে কোথায়? মিনুকে দেখেই মহেন্দ্র থমকে দাঁড়াল, “শুনেছিস, কী হয়ছে?”

“কী হয়ছে?”

“তোর বন্ধু শ্যামলী আছে না…”

“হ্যাঁ, কী হয়ছে তার?” অজান্তেই মিনুর বুক কেঁপে উঠল।

“তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না।”

“পাওয়া যাচ্ছে না!” মিনু খুব একটা অবাক হল না। এমনটা যে হবে তা সে আগেই আশঙ্কা করেছিল। বরঞ্চ অন্য একটা প্রশ্ন ঘুরছে তার মাথায়। সে মহেন্দ্রর হাতটা ধরে সেটাই করে বসল, “আচ্ছা মহেন্দ্রকাকা, আমদুসিয়াস কে?”

একটা বছর দশেকের বাচ্ছা মেয়ের মুখে প্রশ্নটা শুনে একটু হাসল মহেন্দ্র। তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলল, “গ্রীক নাম মনে হচ্ছে। এখনই মনে পড়ছে না, বই দেখতে হবে।”

“তো দেখ।” মিনু নির্বিকার মুখে বলল।

“এখনই?”

“তবে নয় তো কী?”

মহেন্দ্রর তাড়া ছিল। সে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। এই মেয়েটা বড্ড জেদি। যেটা বলেছে সেটা না করিয়ে ছাড়বে না।

“আচ্ছা চল, দেখছি।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহেন্দ্র ভেতরে ঢুকে এল। মিনু এল তার পেছন পেছন। তারপর তার প্রিয় দুলন্ত ঘোড়াটার পিঠে বসে দোল খেতে লাগল।

মিনিট দশেক বইয়ের পাহাড় ঘাঁটল মহেন্দ্র। ল্যাপটপ খুলে কী যেন টাইপ করে ঘনঘন মাথা নাড়াতে লাগল। তারপর মুখ তুলে সটান মিনুর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “হঠাৎ নামটা জানলি কোত্থেকে?”

“আগে বল তুমি।”

“কী বলব?”

“ওমা! এতক্ষণ কী দেখলে তবে?”

“ও হ্যাঁ, আমদুসিয়াস বটে। যেমনটা ভেবেছিলাম, গ্রীক নাম। তবে মানুষ নয়, সাক্ষাৎ অপদেবতা।”

“অপদেবতা কী?” মিনু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল।

“মানে খানিকটা মানুষের মতোই আবার ঠিক মানুষও নয়। খারাপ কিছু, রাক্ষস বলতে পারিস।”

“আমদুসিয়াস রাক্ষস?” মিনু কেমন যেন ঘাবড়ে গেছে।

“ঠিক রাক্ষস নয়, রাজা, কিং আমদুসিয়াস।”

এবার মিনু অধৈর্য হয়ে উঠল, “ধুর, কী যে বল ছাতা, বুঝি না। ঠিক করে বলবে?”

মহেন্দ্র বই বন্ধ করে তার দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, “সব বলব। আগে বল তুই এসব জানলি কী করে? এসব তোদের স্কুলের বইতে থাকার তো কথা নয়।”

মিনু ভেবে দেখল মহেন্দ্রকাকাকে এসব সব কথা খুলে না বললে আমদুসিয়াস সম্পর্কে কিছুই জানা যাবে না। তার মনে বলছে সেটা না জানতে পারলে শ্যামলীকে ফিরে পাবার আশাও নেই। অগত্যা সে ব্যাজার মুখে পকেট থেকে বইটা বের করে মহেন্দ্রর দিকে এগিয়ে দিল। প্রায় আধঘণ্টা ধরে তার প্রতিটা পাতা উল্টে দেখল মহেন্দ্র। ধীরে ধীরে তার মুখ লাল হয়ে উঠল। অস্বাভাবিকরকম কাঁপতে লাগল হাতদু’টো। এই শীতেও কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম পড়তে লাগল। কোনওরকমে মুখ তুলে মিনুকে একবার দেখেই বিছানা থেকে উঠে পড়ল সে। ঘরের দরজাটা বন্ধ করে আবার ফিরে এল বিছানার কাছে। তারপর ফিসফিসে গলায় জিজ্ঞেস করল, “বইটা কে দিয়েছে তোকে?”

“আমি পেয়েছি।”

“কোথা থেকে?”

“বলব না, তুমি আমাকে এখনও বলনি আমদুসিয়াস কে।”

মহেন্দ্র মাথা তুলে বলল, “সব বললে তুই বুঝবি না।”

মিনু উঠে পড়ল। বইটা ছোঁ মেরে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে বলল, “আচ্ছা আমি চলি। তুমি কোথায় যাচ্ছিলে, যেতে পার।”

“আচ্ছা শোন, আয় বস এখানে।”

মিনু আবার আগের মতো ঘোড়ার উপর বসে পড়ল। মহেন্দ্র খোলা জানলার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলে চলল, “গ্রীক পুরাণের কথা। বহু শতাব্দী আগে কোনও এক রাজার আমলে এক বিখ্যাত সুরকার ছিল আমদুসিয়াস। দেশ বিদেশে তার সুর এত বিখ্যাত ছিল যে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে লোকে তার বাজনা শুনতে আসত। মৃত মানুষও নাকি সেই বাজনা শুনে নড়ে উঠত। ফলে হল কী, আস্তে আস্তে চারদিকে খবর ছড়িয়ে গেল যে সে মরা মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারে। কিছু লোক তাকে দেবতা ভেবে পুজো করতে লাগল। কেউ কেউ আবার তাকে শয়তান বলে রাজার কাছে অভিযোগ করতে লাগল। এদিকে রাজা দেখল যে আমদুসিয়াস এত জনপ্রিয় হয়ে পড়েছে যে লোকে আর রাজাকে মান্য করছে না। আমদুসিয়াস মানুষ হোক বা শয়তান, সে যে অসীম শক্তির অধিকারি সেটা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে। ফলে বিপদ বুঝে রাজা আমদিসিয়াসকে খতম করার হুকুম দিলেন। সে যুগে গ্রীকদেশে শয়তান অভিযোগে গলা কেটে নেওয়াটাই ছিল বিধি। তো রাজার খতমওয়ালা যখন আমদুসিয়াসের গলা কাটতে এল তখন সে সবে একটা একশিংওয়ালা প্রাণী ইউনিকর্নের হাড় থেকে কিছু একটা বাজনা বানাবে বলে সেটাকে কেটে দু’টুকরো করেছে। এমন সময় পিছন থেকে খতমওয়ালা তলোয়ার চালাল। আমদুসিয়াসের মাথাটা কেটে পড়ল সামনে। অথচ তার হাতদু’টো তখনও সচল ছিল। সেই হাত দিয়ে সে নিজের মাথার বদলের ওই একশিঙেরই মাথাটাই তুলে বসিয়ে নিল নিজের মাথায়। তার হাড় দিয়ে বানাল এক আশ্চর্য বাজনা, দেখতে অনেকটা বাঁশির মত। কিন্তু ভয়ঙ্কর শক্তি ধরে তাতে। সেই বাজনার সুর যে শোনে তাকেই নিজের দলে টেনে নিতে পারে আমদুসিয়াস। তারপর থেকে সে হয়ে উঠল শয়তান। হয়ে উঠল নরকের রাজা। প্রতিমুহূর্তে নরকে ভয়ঙ্কর আর পৈশাচিক সব বাজনা বাজে। তাতে নেতৃত্ব দেয় আমদুসিয়াস। শোনা যায়, অনেক সময় ঝড় উঠলেও নাকি তার সেই মারণবাঁশীর আওয়াজ শোনা যায়।”

কথাগুলো শুনতে শুনতে মিনু হাঁ হয়ে গেছিল। বেশ কিছুক্ষণ সে কিছু বলল না। তারপর হঠাৎ একটা ব্যাপার মাথায় আসতেই বইটার উপর ঝুঁকে পড়ল। সেই ছক কাটা পাতাটা বের করে মহেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, “এখানে এই নামগুলো লেখা আছে কেন?”

“ক’টা নাম আছে গুনে দেখ।”

“ঊনত্রিশটা, শেষটা খালি।”

“নরকে ঊনত্রিশটা দেশের দায়িত্ব ছিল আমদুসিয়াসের উপর। সেই ঊনত্রিশটা দেশের আবার আলাদা আলাদা রাজা ছিল। তাদের সবার নেতা ছিল আমদুসিয়াস। সে তাদের সুর শেখাত। আস্তে আস্তে তারাও ভয়ানক সব শয়তান হয়ে উঠত। এবার বল তো, কোথা থেকে পেয়েছিস বইটা।”

মিনু এতক্ষণে বুঝেছে আর কিছু চেপে রাখা উচিত হবে না। সমস্ত ব্যাপারটা তার ধারণারও বাইরে। একটা চিন্তা শুধু থেকে থেকে হানা দিচ্ছে, শেষ ঘরটা ফাঁকা কেন? কার নাম বসবে ওখানে? সে নিজেও বেশ কয়েকবার শুনতে পেয়েছে সুরটা। সেদিন যা দেখেছে সেগুলো তাহলে চোখের ভুল নয়। সত্যিই শ্যামলী পালটে গেছে। আর তার গানের আন্টি? সেই কি তবে সাক্ষাৎ শয়তান আমদুসিয়াস? সুরটা শুনতে পাওয়ার কথা অবশ্য মহেন্দ্রকে বলল না সে। বইটাও আর ফেরত নিল না। মিনু ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে মহেন্দ্র তার হাত চেপে ধরল, “শোন, এসব সত্যি না, পুরাণের গল্প। তাও একা একা কোথাও যাস না। কয়েকটা দিন কাটুক, তারপর। বুঝলি?”

মিনু মাথা নেড়ে দিল। তার মন বলছে শ্যামলীকে আর পাওয়া যাবে না। ছকের শেষ ফাঁকা ঘরটা ভাবিয়ে তুলেছে তাকে। কী নাম লেখা হবে সেখানে? মৃন্ময়ী মিত্র? শয়তান আমদুসিয়াস কি শেষ পর্যন্ত তাকেও নরকে ধরে নিয়ে যাবে? তাই যদি হয় তাহলে শেষপর্যন্ত লড়াই করবে মিনু। কিন্তু কী দিয়ে করবে? তার গায়ে তো জোরও নেই, হাতে অস্ত্রও নেই। হঠাৎ খেয়াল হল, পায়ের কাছে ভিজে কিছুর স্পর্শ লাগছে। মিনু উবু হয়ে বসে প্লুটোর গলায় হাত বুলিয়ে দিল, “তুই লড়াই করবি তো আমার সাথে?”

প্লুটো মহানন্দে আদর খেতে খেতে বেড়ালভাষায় জানিয়ে দিল, “আসুক না ব্যাটাচ্ছেলে আমদুসিয়াস। বেড়ালের আঁচড় কাকে বলে আমিও দেখিয়ে দেব।”

অন্যবার বড়দিনের সন্ধ্যায় পাড়াটাকে প্রায় চেনাই যায় না। এবার সব কেমন যেন মিইয়ে পড়েছে। পাড়ারই একটা মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারোর উৎসবে মন নেই। পাশের বাড়ি থেকে সারাদিন কান্নার আওয়াজ আসছে। সন্ধে হতে মিনুর আর ভালো লাগল না। ধীরে ধীরে সে বাইরে বেরিয়ে এল। গোটা রাস্তাটা রঙবেরঙের আলোয় ভরে আছে। অথচ লোকজন বেশি চোখে পড়ছে না। পুকুর পেরিয়ে বড়ো রাস্তার ওপারে একদল লোক দলবেঁধে চার্চের দিকে চলেছে। ঝলমলে পোশাক পড়েছে সবাই। মিনুর একবার চার্চ থেকে ঘুরে আসতে ইচ্ছা করল। সারি সারি বেঞ্চের উপর বসে প্রার্থনা করে সবাই। ফাদার ধবধবে আলখাল্লা পরে পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে বাইবেলের গল্প পড়ে শোনান। কখনও গান হয়। বাকি সময় চুপচাপ। এসব মিনুর বেশ ভালো লাগে। কখনও কখনও সে নিজেও একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ক্রস থেকে ঝুলন্ত যীশুর দিকে। আজও তার চার্চে যেতে ইচ্ছা হল। আগের বছর সব বাচ্চারা মিলে গেছিল। এবার শ্যামলী নেই, বাকিরাও আসেনি। এবার সে একা।

মিনু ধীর পায়ে চার্চের দিকে এগিয়ে গেল। গায়ের নীলচে সোয়েটারটা দিয়ে ভালো করে কান মাথা ঢেকে নিল। চার্চের গা জুড়ে একটা বড়োসড়ো কবরস্থান আছে। একে ইংরাজিতে বলে গ্রেভ ইয়ার্ড, চার্চের লাগোয়া কবরস্থান। সেটা শেষ হতে খানিকটা ঝোপঝাড়, বাঁশগাছের জঙ্গল। অন্যদিন হলে সন্ধেবেলা এখানে আসার অনুমতি থাকে না। যদিও জঙ্গলটা ছোটো, তাও সাপখোপ থাকতেই পারে। বাঁশগাছের জঙ্গলটা এখনও অন্ধকার হয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে মিনুর কেমন যেন ভয় লাগল। হালকা হাওয়ায় বাঁশপাতাগুলো অল্পঅল্প দুলছে। সে ঢোঁক গিলল। প্লুটো এতক্ষণ একটু পিছনে হাঁটছিল। এবার সে পায়ের কাছে এগিয়ে এল। প্লুটো কাছে থাকলে মিনুর ভয় লাগে না। একটু দূরে ঢঙ ঢঙ করে চার্চের ঘণ্টা বাজছে। মিনু একবার পা চালিয়েও থেমে গেল। কীসের যেন একটা আওয়াজ আসছে। ভীষণ আস্তে কেউ যেন শিস দিচ্ছে। ব্যাপারটায় কান দিল না সে। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল চার্চের দিকে। মনের ভিতরে কেউ যেন বলতে লাগল জঙ্গলের দিকে তাকালেই এখন কাউকে দেখা যাবে, সামনের বাঁশগাছটার তলায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মিনুর হাত পা শিরশির করতে লাগল। ঘাড়ের কাছে কার যেন নিঃশ্বাস পড়ল! আর একটা পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে না? কিন্তু আর কেউ তো নেই। প্লুটোর গায়ের লোম এরকম খাড়া হয়ে উঠছে কেন? সেই ফিনফিনে বাঁশীর শব্দটা কি ধীরে ধীরে বাড়ছে?

“মিনু, এখানে কী করছিস?”

পেছন থেকে আচমকা ডাকটা শুনে মিনু দাঁড়িয়ে গেল। চেনা গলা। শ্যামলী, তার অনেকদিনের বন্ধু। কিন্তু সে তো হারিয়ে গেছিল। এখানে এল কী করে? কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও মিনু জিজ্ঞেস করল না। গির্জার দিকে একটা আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওখানে যাচ্ছি। কোথায় ছিলিস তুই?”

“এই তো এখানেই, দেখ এটা দেখ।”

মিনু দেখল শ্যামলী তার দিকে একটা ছোটো বাঁশের টুকরো এগিয়ে দিয়েছে। ভালো করে দেখে বুঝল টুকরোটার গায়ে কতগুলো ফুটো করা আছে, বাঁশ নয়। বাঁশি।

“কী হয় এতে?”

“ওমা, বাঁশি দিয়ে আবার কী হবে? বাজাবি?”

“না তুই বাজা, আমি চলি।”

মিনু তার দিকে পেছন ফিরে পা বাড়াল। পেছন থেকে শ্যামলীর বাঁশির শব্দ আসছে। আশ্চর্য! সে এত সুন্দর বাঁশি বাজাতে শিখল কবে? একটুও ভুল নেই। দমে একটুও ঘাটতি নেই। দক্ষ বাঁশিওয়ালার মতো একটানা বাজিয়ে চলেছে। মিনু খানিকদূর গিয়ে আর যেতে পারল না। মাথাটা কেমন যেন ব্যথা করছে। পাদু’টো চলতে চাইছে না। তার থেকেও আশ্চর্য ব্যাপার হল, মিনুর কাঁধ থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসতে চাইছে প্লুটো। তার শরীরটা যেন আগের থেকে বেশ খানিকটা ফুলে উঠেছে। নখগুলো থাবার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। একটা লাফ মেরে কোল থেকে নেমে সে পেছনদিকে এগিয়ে গেল। মিনু বুঝতে পারল, তার বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই।

কোনওরকমে সে মুখ পেছনদিকে ফেরাল। আর সাথে সাথে ভয়ে আর আতঙ্কে তার শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে এক মনে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে শ্যামলী। তার ঠিক পিছনেই কার যেন ছায়া পড়েছে। সে ছায়ার মাথাটা হরিণের মতো। শুধু দু’টোর বদলে একটা শিং। হাতে একটা সরু লাঠিকে ক্রমাগত ধীরে ধীরে নেড়ে চলেছে ছায়াটা। ঠিক যেভাবে মিউজিসিয়ানরা অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্ট করে। প্লুটো ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের দিকে। এখন আর তার হাবভাব আগের মতো হিংস্র নেই। সুরের মোহে যেন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সে। আস্তে আস্তে তার শরীরটা বড়ো হচ্ছে। মিনু মাটির উপর বসে পড়ল। চেষ্টা করেও সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।

শ্যামলীর কাছে পৌঁছে প্লুটো কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়াল। এতক্ষণে একটা নেকড়ের মতো বড়ো হয়ে উঠেছে সে। বাঁশির সুর এখন আরও ভয়ঙ্কর, আরও মোহময় হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে প্লুটো ঘুরে দাঁড়াল। কী বীভৎস মুখের দৃষ্টি, নীল শয়তানি মাখা কুতকুতে চোখ। মিনুর দিকে তাকিয়ে কয়েকবার জিভ বের করল প্লুটো। মিনুর মনে হল সেও সুরের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। ক্রমশ তার পাদু’টো সচল হল। এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল সেই বাঁশির দিকে। রাস্তায় ধারে কাছে কেউ নেই। দূরে পাড়ার সব আলোগুলো ঝাপসা হয়ে এসেছে। এইবার সেই ছায়ামূর্তির আঙুলগুলো একবারের জন্য থেমে গেল। তারপর হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল মিনুকে। কাছে, আরও কাছে এগিয়ে চলেছে সে। আর বেশি দেরি নেই। মিনুর ছোট্ট দশ বছরের শরীরটা খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হচ্ছে। কালই পরিষ্কার করে কাটা নখগুলো আরও ছুঁচলো হয়ে আসছে। এইবার ঝড় উঠবে… এইবার শনশন করে ঝড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

শ্যামলীর একদম সামনে এসে পড়েছিল মিনু। এমন সময় মনে হল শ্যামলীর বাঁশি ছাপিয়ে অন্য একটা কিছু শোনা যাচ্ছে। হ্যাঁ, অন্য একটা বাঁশি। একটা চেনা সুর। মিনুর মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা। তা সত্ত্বেও সে ভালো করে শোনার চেষ্টা করল। সুরটা তাদের পেছন থেকে আসছে। অর্থাৎ, মিনুর ঠিক পেছনে দাঁড়িয়েই কেউ বাজাচ্ছে সেটা। কিন্তু কে? এত চেনা সুর… অনেকক্ষণ শোনার পর মিনু বুঝল এই সুরটা সে আজই শুনেছে। ‘জিঙ্গল বেল, জিঙ্গল বেল, জিঙ্গল অল দ্য ওয়ে।’

সামনে অন্ধকার ছায়ামূর্তি অস্থির হয়ে উঠেছে। শ্যামলীও বাঁশি থামিয়ে একটানা তাকিয়ে আসছে মিনুর কাঁধের পাশ দিয়ে। কে বাজাচ্ছে বাঁশিটা? তাদের পাড়ার কেউ? মিনুও পেছন ফিরে তাকাল। একটা ছোটো ছয় চাকার গাড়ি, তার সামনে চারটে কুকুর বাঁধা। গাড়ির একদম উপরে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক। অন্ধকারেও বেশ বোঝা যায় তার লম্বা দাড়ি। বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সুর থামিয়ে সে একটানা তাকিয়ে আছে সামনে। কে এই লোকটা? ঝড়ের শব্দ ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে উঠছে। এতক্ষণে সেটা যেন আর্ত চিৎকারের মতো শোনাচ্ছে। একটু একটু করে কমে আসছে ঝড়টা। সেই সঙ্গে সঙ্গে মিনুর মাথার তীব্র যন্ত্রণাটাও।

মিনিট কয়েক মোহগ্রস্তের মতো সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে মিনু পেছন ফিরে তাকাল। ঝড়ের শব্দ মিলিয়ে আসার সাথে সাথে সেই ছায়ামূর্তিও যেন মুছে গেছে। রাস্তার উপর পড়ে আছে শ্যামলী। তার একটু দূরেই সেই বাঁশিটা। প্লুটো আবার আগের মতো ছোটো হয়ে গেছে। এতক্ষণ যেন অন্য জগতে ছিল সে। মিনুর দিকে তাকিয়ে হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিনু আবার সামনে ফিরে তাকাল। কুকুরে টানা গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা একবার তার দিকে হাত নাড়াল। মিনু সেদিকে খানিকটা এগিয়ে গেল। জানতেই হবে এ লোকটা কে। এই গভীর রাতে নির্জন রাস্তায় এই লোকটাই তাকে সাক্ষাৎ শয়তান আমদুসিয়াসের সুরের থেকে বাঁচিয়েছে। সেই সাথে শ্যামলীকেও। লোকটা কিন্তু এতক্ষণে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছে। সে মুখ দেখাতে চায় না।

“তুমি কে? দাঁড়াও, দাঁড়াও বলছি ওখানে।” কথাগুলো বলতে বলতে সে গাড়ির পিছনে দৌড় দিল। সেটা ধীরে ধীরে গতি নিচ্ছে। টুং টুং করে বেলের আওয়াজ আসছে। ঘরর ঘরর শব্দ করতে করতে সীমান্তের দিকে ছুটে গেল স্লেজটা। মিনুর ছোটো ছোটো পা তাদের সাথে পারবে কেন? একটু পরেই গাড়িসুদ্ধু লোকটা মিলিয়ে গেল। মিনু ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল রাস্তার উপরে। দূরের দিকে তাকিয়ে তার মুখ থেকে অস্পষ্ট কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এল, “বললে না তুমি কে…”

হঠাৎ তার ঘাড়ের কাছে কীসের যেন ঠাণ্ডা ছোঁয়া লাগল। মিনু সেখানে হাত দিতেই হাতটা ভিজে গেল। বরফ। কিন্তু এখানে বরফ এল কোথা থেকে? উপরে তাকাতেই সে অবাক হয়ে গেল। তার মাথার ঠিক উপরে আকাশ থেকে নেমে আসছে অসংখ্য কুচি কুচি বরফের টুকরো। স্নো ফল! কিন্তু কলকাতায় তো বরফ পড়ে না। মিনু অত কিছু ভাবল না। ঠাণ্ডা সাদা ধবধবে বরফ দু’হাতে মাখতে লাগল গায়ে।

একটু পরেই তার চোখ পড়ল শ্যামলীর দিকে। এখনও আগের মতোই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সে। একটু দূরেই সেই বাঁশিটা। এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলে নিল মিনু। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল চার্চের দিকে। অবাক বিস্ময়ে দু’বার ‘ম্যাও’ করে প্লুটোও পিছু নিল তার।

চার্চে ঢোকার ঠিক মুখেই বসে ছিল মিহির। গায়ে একটা ছেঁড়া ছেঁড়া সোয়েটার। রাজ্যের শুকনো কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালিয়েছে সে। দু’হাত কচলে আগুন পোহাচ্ছে। মিনু আর প্লুটো সেদিকে এগিয়ে গেল। তাকে দেখতে পেয়েই হাসল মিহির, “একা একা এতটা রাস্তা এলে দিদি! ভয় করে না?”

“এবার আর কেউ নেই তো।” মিনু একদৃষ্টে চেয়ে আছে আগুনের দিকে।

“বড্ড ঠাণ্ডা পড়েছে। বসো বসো, এই আগুনের ধারে বসো।” কথাগুলো বলে মিহির আবার আগের মতো হাত কচলাতে লাগল।

মিনু নিঃশব্দে হাতের বাঁশিটা ঢুকিয়ে দিল আগুনের ফাঁকে। লেলিহান শিখায় মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সেটা।

জয়ঢাকের গল্প ঘর