।২৭।
“রাম রাম মীরসাহেব,” আমায় দেখেই হাত জোর করে বলল সাহুকার।
আমি উত্তরে প্রতিনমস্কার করে বললাম, “রাম রাম। আপনি যে এই দীন সেবকের সঙ্গে চলবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তাতে সেবক ধন্য হয়ে গেছে। আপনার কথা শুনতে বড়ো ভালো লেগেছে আমার কাল।”
ফের একসাথে পথ চলা শুরু হল আমাদের। দলের লোকজনেরা সাহুকারের লোকজনকে ঘিরে তাদের জায়গাগুলো এরইমধ্যে ঠিকঠাক করে নিয়েছে। এই সময়টা আমাদের ঠগিদের একটা বিচিত্র উত্তেজনা হয় মনে। দয়া, মায়া, ভয় কোনটাই নয়, শুধু একটাই চিন্তা মাথায় থাকে–কাজটা ভালো করে করে ফেলতে হবে। ততদিনে আমি পাকা ঠগি হয়ে উঠলেও কোন বড়ো কাজ করবার আগে এই যে উত্তেজনা হওয়া সেটা আমার তখনো যায় নি। বুকের ভেতরটা একটু দুপদুপ করছিলো আমার। সাহুকারের রসিকতাগুলোর জবাব ঠিকঠাক দিয়ে উঠতে পারছিলাম না। খানিক বাদে সাহুকার দেখি সেটা নজর করেছে। তাড়াতাড়ি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে আমি ফের তার কথাবার্তার দিকে মনোযোগ দিলাম। ভেবেচিন্তে একটা চুটকিলা বলতে ভুঁড়ি কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে সাহুকার বলে,“এইবারে আপনি স্বাভাবিক হয়েছেন মীরসাহেব। এতক্ষণ কী হয়েছিলো বলুন তো আপনার? মুখটা গোমড়া করে ছিলেন। কথাবার্তাও কানে নিচ্ছিলেন না বিশেষ!”
বললাম,“ঠিকই ধরেছেন শেঠজি। মনটা ভালো নেই। বাড়ির কথা মনে পড়ছিলো সকাল থেকে–”
“সে তো আমারও পড়ে মীরসাহেব। পথ চলা বড়ো ঝামেলার কাজ। এই তো দেখুন না,একমাস হল সাগর থেকে রওনা দেবো তো জ্যোতিষীব্যাটা ছাড়বে না। আজ কুযোগ,কাল দিন ভালো নয় এই করে করে কাটিয়ে দিচ্ছিল। শেষে এবারে একেবারে জোর করেই বেরিয়ে পড়েছি। কদ্দিন আর বসে থাকব! এখন নারায়ণ করুন,ঠগি,ডাকাত,চোরের হাত থেকে বেঁচে ভালোয় ভালোয় ঘরে পৌঁছোলে বাঁচি। গত বছরদুয়েক ধরে এ রাস্তায় প্রায়ই লোকজন হারিয়ে যাচ্ছে বলে শুনেছি।”
“আমারও সেই একই প্রার্থনা শেঠজি। আমার পেশাই তলোয়ারবাজি। বেঁচেবর্তে ঘরে ফেরা আমার পক্ষে আপনার চেয়েও বড়ো ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু এই ঠগি না কী বলছিলেন,এরা আবার কী? নাম শুনিনি তো কখনো?”
“আমিও খুব ভালোভাবে জানিনা মীরসাহেব। তবে যা শুনেছি তাতে করে মনে হয় এরা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায় আর নিরীহ লোকজনকে রাস্তায় পেলে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে। অনেকে বলে রাস্তায় এদের দলের সুন্দরী মেয়েরা বসে থাকে লোকজনকে ফাঁদে ফেলবার জন্য। তবে আমাদের কোন ভয় নেই,কী বলেন? সঙ্গে এত লোকজন আছে যে খারাপ লোক কাছে ঘেঁষতে ভয় পাবে।”
আমি মনে মনে হাসছিলাম। গত দু’বছরে এই এলাকায় যত লোক হারিয়ে গেছে তার পেছনে গনেশ জমাদারের হাত কাজ করছে সেটা আমার জানাই ছিল। মুখে অবশ্য ফুর্তির ভাব ফুটিয়ে বললাম,“ভয় পাবেন না। ওসব একলা-দোকলা লোক দেখে মেরেধরে চলে যায়। আমাদের সঙ্গে লাগতে এসে দেখুক একবার,ইনশাল্লা,কিমা বানিয়ে ছেড়ে দেব। আগেও দু’একবার পথে চোরডাকাতের মুখোমুখি হয়েছি আমি। দেখেছি একবার তলোয়ার খুললে সব শেয়ালের মত পালিয়ে যায়।” বলতেবলতেই হঠাৎ সামনের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম,“আরে,আমাদের দলের লোক মনে হচ্ছে? এইখানে কোত্থেকে এল?”
খানিক দূরে পথের পাশে বসে থাকা লোকটার কাছে গিয়ে পৌঁছোতে সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। লোকটা আমারই দলের একজন লুগাই। ভারি ভালো অভিনয়টা হচ্ছিল তার। দেখে মনে হচ্ছিল খুব ক্লান্ত। আমায় সেলাম করে সে বলল,“কাল পায়ে একটা বড়ো কাঁটা ফুটে গেছিলো। ব্যথা হচ্ছিল খুব। জোরে চলবার তো উপায় নেই,আর আপনি আমার জন্য দাঁড়াবেনও না। তাই কাল মাঝরাত থেকে উঠে হাঁটছি। কিন্তু আর পারছি না মীরসাহেব। একটা টাট্টু পেতাম যদি বড়ো ভালো হত।”
“বললাম,সে তুমি পাবে।আমার জিনিসপত্র বোঝাই টাট্টুটাকে খালি করিয়ে দিচ্ছি। সেটায় চড়ে চল। সন্ধেবেলায় গিয়ে একটা নাপিত ডেকে পা’টাও দেখিয়ে দেব’খন তোমার। তা তুমি কি একাই বেরিয়েছিলে নাকি সঙ্গে আরো কেউ ছিল?”
“ছিল কয়েকজন। আধক্রোশ দূরে একটা নদী আছে,তারা সেখানে এগিয়ে গিয়ে তারা মুখহাত ধুচ্ছে। সেখানেই আপনাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে তারা,আমায় এই খবরটা আপনাকে দিতে বলে গেছে।”
“ভালো খবর,” আমি মাথা নেড়ে বললাম,“কাছেই নদী আছে যখন তখন মুখেমাথায় একটু জল দিয়ে নেয়া যাবে। কী বলেন শেঠজি?”
“ঠিক। শুনে আনন্দ হল। আমারও গরমে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে মীরসাহেব। খিদেও পেয়েছে। সঙ্গে মিঠাই আছে কিছু। চলুন ভাগ করে খাওয়া যাবে। খালি পেটে ঘোরাঘুরি মোটেই ভালো কাজ নয়।”
কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা গিয়ে ছোট্ট নদীটার ধারে পৌঁছে গেলাম। সেখানে জলের ধারে আমার দলের কয়েকটা লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে খাওয়াদাওয়া সারছিল।
কাছে গিয়ে জল খেতে থাকা একজন বেলহাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ভিলা মাঞ্ঝে?(গর্ত তৈরি?)”
“মাঞ্ঝে,” জবাব দিল সে।
সাহুকার আমার কথা শুনে এসে বলে “কী জিজ্ঞাসা করছিলেন ওকে? জল খাবার জন্য মাজা ঘটি চাইছিলেন নাকি? আমার কাছে একটা আছে।”
“ধন্যবাদ শেঠজি,” আমি বললাম,“তার দরকার হবে না। আমার লোক বলছে সে একটা ঘটি আমার জন্য মেজেধুয়ে রেখে দিয়েছে।”
জলের কাছে এসে সবাই হাতমুখ ধুতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমার দলের লোকজন অবশ্য তার মধ্যেও নিজেরা সব ঠিকঠাক জায়গাতেই ছিল। সংকেত পেলেই যাতে লাফিয়ে পড়তে পারে। এর মধ্যে বেলহাটা আমায় এক লোটা জল এনে ধরে দিয়েছে। সেটা হাতে নিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ভিলটা কি অনেক দূরে করেছ?”
“না। ওই যে ঝোপটা দেখছেন ওর মধ্যে। ভালো জায়গা। ওখানে গতবার গনেশ জেমাদার একটা দারুণ বুনিজ নিকেশ করেছিল। কিন্তু আর দেরি করবেন না মীরসাহেব। সূর্য মাথার ওপরে উঠে গেছে। এ নালাটা এই এলাকায় অনেক ক্রোশের মধ্যে একমাত্র জল খাবার জায়গা। যে কোন সময় অন্য লোকজন চলে আসতে পারে কিন্তু।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি দাঁড়াও–”
বলতে বলতে আমি সাহুকারের কাছে এগিয়ে গেলাম। রাস্তায় মোতিরাম আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে,“ঝিরনি দিচ্ছেন না কেন মীরসাহেব?”
আমি জবাব দিলাম, “এই যে সাহুকারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েই ঝিরনি দিয়ে দেব।”
আমরা রামাসি ভাষায় কথা বলছিলাম। আমাদের ঠিক সামনে বসে সাহুকারের একটা লোক নদীর জলে দাঁত মাজছিলো। সে হঠাৎ একটা অচেনা ভাষায় কথা শুনে ঘুরে তাকালো একবার। তারপর ফের দাঁত মাজতে লেগে গেল। তার ঠিক পেছনে অলসভাবে গল্প করতে থাকা দলের অন্য দুটো লোক যে আর একটু বাদেই তাকে সেই পরিশ্রমের হাত থেকে চিরতরে রেহাই দিয়ে দেবে সে কথা সে তখনো ঘুণাক্ষরেও জানে না।
সাহুকার নদীর খানিকটা নিচের দিকে একা একা হাতমুখ ধুচ্ছিল। তার কাছে গিয়ে বললাম, “শেঠজি, এখানে এখানে এত ভিড়ে জল তো ঘুলিয়ে গেছে। ভাবছিলাম লোকজনের ভিড়টা পার হয়ে খানিক ওপরের দিকে গিয়ে স্নানটান করব। জল একটু পরিষ্কার মিলবে। একটা জায়গা দেখে এলাম সেখানে জলটা একটু গভীরও আছে। যাবেন নাকি?”
সে বলল, “চলুন দেখি।” এই বলে আমার সঙ্গে সঙ্গে এসে যেই না লোকজনের ভিড়ের মধ্যে ঢুকেছে সঙ্গে সঙ্গে আমি ঝিরনি দিয়ে দিলাম। আমার নিজের হাতের রুমালও তার কাজ সারল ভালোভাবেই। সাহুকার মাটি নেবার আগেই তার শেষ নিঃশ্বাস বের হয়ে গেল।
এই অবস্থায় দেরি করাটা ভালো কাজ নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে লোকের বুদ্ধিভ্রংশ হয়। আমারও সেদিন তাই হয়েছিল। কাজ সারবার পর শরীরটরীরগুলো ওইভাবে ফেলে রেখেই দলের লোকজন ফের হাত মুখ ধুতে লেগে গীল, কিন্তু আমি তাদের কিছু বললাম না। খানিক বাদে হঠাৎ খেয়াল হল দূরে দুজন লোক এদিকেই আসছে। কী আর করা,তাড়াতাড়ি মরাগুলোকে সোজা করে শুইয়ে তাদের গলা অবধি চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হল,যেন তারা বিশ্রাম নিচ্ছে। দলের বাকি লোকজনকেও বললাম তারা যেন এদের ঘিরে শুয়ে বসে থাকে যেন সবাই খুব ক্লান্ত। লোকদুটো কাছে এগিয়ে এলে দেখি তারা বেজায় গরিব। মেরে লাভ হবে না কোন। পীর খানকে সে কথা বলতে দেখি সে কিছুতেই তাতে রাজি নয়।
“ছেড়ে দেব? পাগল নাকি? আপনার কি মনে হয় মীরসাহেব এরা আমাদের সন্দেহ করেনি? মরামানুষের কাছে এলে যেকোন মানুষ টের পেয়ে যায় যে লোকটা মরা,সে আপনি তাদের যতই ঘুমোনো মানুষের মত করে সাজিয়ে রাখুন না কেন।”
পীর খানের কথায় যুক্তি ছিল। আমি নিমরাজি হয়ে গেলাম। তারপর এগিয়ে গিয়ে বললাম,“সালাম। এত সকাল-সকাল কোত্থেকে?”
তাদের মধ্যে একজন বলল,“আমাদের খুব তাড়া আছে সাহেব। তাই ভোর ভোর উঠে রাস্তায় নেমেছি। আমরা বরং এগোই।”
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, “একদম নড়বে না। আগে আমার কথার জবাব দাও। কাল রাতে যে গ্রামে থেকেছ সেখানে আর কতজন যাত্রী আছে?”
“আমরা ছাড়া আরো দুজন,” তারা ভয়ে ভয়ে জবাব দিল।
“দুজনের বেশি আর কেউ ছিল না তো? ঠিক জানো?”
“আ-আজ্ঞে হ্যাঁ। ওরা দুজন আর আমরা দুজন একইসঙ্গে জব্বলপুর থেকে আসছি। কাল রাতে আমরা একই বাড়িতে ছিলাম।”
“ওরা এখান থেকে কত দূরে আছে?”
“বেশি দূর নয়। এখুনি এসে পড়বে।”
“বেশ। এখন এখানে বস। ওরাও আগে এসে পৌঁছোক।”
হঠাৎ অন্য লোকটা রেগে গিয়ে বলে, “আমাদের আটকাবার আপনি কে? আমরা এবার যাবই–”
আমি ধমক দিয়ে বললাম,“নড়লে মরবি। এভাবে আমাদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছিস যখন তখন সাজা পেতে হবে না?”
“তোমরা চোরডাকাত নাকি? তাহলে আমাদের কাছে যা আছে কেড়ে নিয়ে আমাদের যেতে দাও।”
পীর খান এগিয়ে এসে বলে,“না হে,আমরা তার চেয়েও খারাপ লোক। এখন এখানে চুপ করে বোসো।”
শুনে প্রথমজন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অন্যজনকে বলে,“চোরডাকাতের চেয়েও ভয়ানক! ওরে বাবা,তাহলে এরা নিশ্চয় ঠগি রে!আজ আমাদের রক্ষা নেই। প্রথম থেকেই আমার ভয় হচ্ছিল। ওই-যে ওই দ্যাখ এরা মানুষ মেরেছে—ওই যে লাশগুলো পড়ে আছে রে–”
শুনে আমি বললাম,“হ্যাঁরে ব্যাটা দুর্ভাগা, ঠিকই ধরেছিস। তোরাও আর বেশিক্ষণ বাঁচবি না। সবই তোদের কপাল।”
নিরীহ, গোবেচারা এই গরিব মানুষগুলোকে মারতে হবে ভেবে আমার খারাপ লাগছিল সাহেব। কিন্তু উপায় কী? পীর খান ঠিকই ধরেছিল। মরাগুলোকে যতই ঘুমোনো মানুষ সাজিয়ে রাখিনা কেন,এদের চোখে ধুলো দেয়া যায়নি। সেটা অবশ্য সম্ভবও না। একটা মরামানুষ যেভাবে একতাল মাটির মত পড়ে থাকে তার সঙ্গে একটা নিঃশ্বাস নেয়া জ্যান্ত মানুষের ঘুমোনোর ভঙ্গী আলাদা হয়। যে কেউ একনজর দেখেই সেটা বলে দিতে পারে।
আমি সেখান থেকে ফিরে গিয়ে পীর খানকে বললাম,“যা করবার তাড়াতাড়ি করে ফেল। শুধু শুধু বেচারাদের কষ্ট বাড়িও না।”
০পীর খান দুজন লোক নিয়ে তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াতে বলতে তারা উঠে দাঁড়িয়ে বলির কোন বাধা না দিয়ে রুমালের দিকে গলা বাড়িয়ে দিল।
খানিক বাদে বাকি দুজন লোক এসে পৌঁছোল। একজন কমবয়েসি আর অন্যজন বুড়ো। আমি আর মোতিরাম তৈরি ছিলাম। মোতিরাম বুড়োটাকে ধরল। কমবয়েসি ছেলেটা আমার পাশ দিয়ে যাবার উপক্রম করতে আমাদের দলের একজন এসে তার হাতটা চেপে ধরল। সে যেই ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল,পেছন থেকে এসে আমি তার গলায় রুমালটা পরিয়ে দিলাম।
এরপর আর কোন সমস্যা রইল না। সব শরীরগুলোকে কবর দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম।
ক্রমশ
ছবিঃ মৌসুমী