মূল কাহিনিঃ আর্থার কোনান ডয়েল-এর ডে প্রোফান্ডিস।ভাষান্তরঃ অমিত দেবনাথ
সমুদ্রের জলে লুকিয়ে আছে বহু রহস্য,আশ্চর্য দৃশ্য,শব্দ আর বিপদ। সে কারণেই সমুদ্র সম্বন্ধে মানুষের কৌতুহল এবং রোমাঞ্চ সুবিদিত।বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান রাজপথও ঐ সমুদ্রের জল । ব্রিটিশ সম্রাজ্যের সীমান্ত প্রসারিত হয়েছে চতুর্দিকে। বহু প্রাণের বিনিময়ে,অবশ্যই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রসদ হিসেবে বহু তরুণ প্রাণ চলে গেছে পেশোয়ারে,আম্বালায়,কোর্তিতে,পিয়ারসন দুর্গে,তাদের সমাধির স্মৃতি ফলক গুলোই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ করছে।
জল যখন সারা বিশ্বের সঙ্গে ব্রিটেনের যোগসূত্র স্থাপন করে,তখনই আমাদের মনে নানারকম রোমাঞ্চকর কল্পনার সৃষ্টি হয়।যখনই কারো প্রিয়জন সমুদ্রযাত্রা করে,পাহাড়ে পাহাড়িয়াদের বুলেটের নাগালে ঘোরাফেরা করে,জলাভূমিতে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়,যেখানে মৃত্যু আসে চকিতে,নিঃশব্দে তখনই আমাদের মন শঙ্কিত হয়ে ওঠে,নানারকম উদ্ভট কল্পনার জন্ম হয়,যেখানে মা দেখে ছেলে মৃত্যশয্যায়। শোকের প্রথম ধাক্কাটা কাটানোর আগেই আসল খবর চলে আসে এবং দেখা যায় হাজার হাজার মাইল দূরের কোন এক ঘটনার সঙ্গে সামান্য সাদৃশ্য ছাড়া এর সঙ্গে আর কোন মিলই নেই। আমি অন্তত একটি ঘটনার কথা বলতে পারি,ঘটনা পরম্পরায় যা অলৌকিক বলে মনে হলেও যার পেছনে প্রকৃতিক সমস্ত নিয়মই কাজ করেছিল।
সিংহল দ্বীপের কফি রপ্তানিকারক সংস্থা হাডসন অ্যান্ড ভ্যানাসিটার্ট এর তরুণ পার্টনার ছিল জন ভ্যানসিটার্ট। ডাচ রক্ত শরীরে থাকলেও চললেবলনে খাঁটি ইংরেজ। বহু বছর ধরে আমি লণ্ডনে তার এজেন্ট ছিলাম। ১৮৭২ সালে সে যখন লন্ডনে আসে মাসতিনেকের ছুটি কাটাতে,তখন সে আমাকে বলে ইংল্যাণ্ডের শহর আর গ্রামের সঙ্গে পরিচয় করাতে। তাকে গোটা সাতেক চিঠি লিখে দিলাম যেগুলো নিয়ে সে আমার অফিস ছাড়ে এবং পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন চিরকুট পেতে লাগলাম যাতে বোঝা গেল যে আমার বন্ধুবান্ধবরা তাকে বেশ পছন্দই করেছে। তারপর খবর এল হিয়ারফোর্ড লসন বংশের এমিলি লসনের সঙ্গে তার বেশ জমে উঠেছে এবং গুজব টুজবের পালা চুকিয়ে শেষ পর্যন্ত পাকা খবর এল যে তারা বিয়ে করেছে। এদিকে তার ছুটিও ফুরিয়ে আসছিল। কাজের জায়গায় ফিরতে হবে। তারা কলম্বোয় ফিরবে কোম্পানির নিজস্ব একহাজার টনের ছোট পালতোলা জাহাজে এবং তাদের মধুচন্দ্রিমাটাও হবে সেখানেই।
সিংহলে কফিচাষের সে এক স্বর্ণযুগ ছিল।একটি মাত্র মরশুমে এক মারাত্মক ছত্রাকের আক্রমণে কফিচাষের পুরো ব্যাবসা ধ্বসে গিয়ে সেটা একটা গোটা জাতিকে হতাশায় ডুবিয়ে দিয়েছিল। তবে এটাও ঠিক যে একটি ব্যাবসা মার খেলেও অন্য আরেকটি চাষের সে জায়গাটা নিতে দেরি হয়নি। সিংহলে চা-শিল্প গর্ব করে বলার মতই বিষয়।ওয়াটারলু যুদ্ধের সেই সিংহের প্রতীকের মতই বিষয়।সেই সিংহের প্রতীকের মতই সিংহলের চা-শিল্পও মানুষের সাহস ও চ্যালেঞ্জ নেওয়ার পরিচয়।
তবে সেই ‘৭২ সালে আকাশে কোণে কোন দূর্যোগের মেঘ ঘনিয়ে আসেনি এবং ব্যবসায়ীরাও এই শিল্পের সম্বন্ধে যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন। ভ্যানসিটার্ট লন্ডনে ফিরল, সঙ্গে তার সুন্দরী তরুণী স্ত্রী। আমার সঙ্গে পরিচয় তাদের সঙ্গে ডিনার সারলাম আর এটাও ঠিক হল যে আমি তাদের সঙ্গেই ইস্টার্ন স্টার জাহাজে চেপে সিংহল যাব। জাহাজ ছাড়বে সামনের সোমবার।
রোববার বিকেলে আবার আমার সঙ্গে দেখা হল ভ্যানসিটার্টের। রাত্তিরে নটা নাগাদ সে আমার ঘরে এল কেমন উদভ্রান্তের মত। করমর্দনের সময় দেখলাম হাতটা খরখরে আর গরম। “অ্যাটকিনসন”,বলল সে,“একটু লেবুর রস খাওয়াতে পারবে? গলা শুকিয়ে গেছে এমন যে খালি খালি লেবুর রস খেয়েও আশ মিটিছে না।”
আমি বেয়ারাকে ডেকে লেবুর রসের অর্ডার দিয়ে বললাম,“কী ব্যাপার? তোমার মুখ লালচে হয়ে গেছে। তোমাকে তো এরকম লাগে না! কিছু হয়েছে নাকি?”
“হয়েছে মানে,মুখ শুকিয়ে গেছে,কোমর ব্যথা করছে আর কোন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। লন্ডনে এসেই এই কান্ডটা হল মনে হয়। এমনকি এখানকার দূষিত হাওয়ায় শ্বাস নিতেও অসুবিধে হচ্ছে,” দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল সে, মনে হল সত্যিই ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
“সমুদ্রের হাওয়া খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“ঠিক বলেছ। কোন ডাক্তারের দরকার নেই। কাল সকালে সমুদ্দুরে গিয়ে পড়তে পারলেই আমি ফিট হয়ে যাব।আর দ্বিতীয় কোন রাস্তা নেই।একগ্লাস লেবুর রস খেয়ে দুহাত মুঠো করে আঙুলের গাঁটগুলো জোড়া করে কোমরের কাছটায় রাখল সে, বলল,“এবার একটু আরাম লাগছে।”
তারপর আমার দিকে ভাসাভাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তোমার সাহায্য চাই,অ্যাটকিনসন,আমার কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে।”
“কী ব্যাপার?”
“আমার স্ত্রীর মা অসুস্থ,তার করেছিল।ওকে যেতে বলেছে।আমি যেতে পারিনি, হাজারটা ঝঞ্ঝাট চারিদিকে। বউ একাই গেছে। এখন ব্যাপার হল,আমি আরেকটা তার পেলাম যে ও কাল আসছে না, তবে বুধবার ফলমাউথ থেকে জাহাজ ধরবে। আমরা তো ওখান দিয়েই যাব,যদিও ব্যাপারটা সোজা নয়,আর অ্যাটকিনসন,তুমি তো জান যে কোন মানুষ রহস্যে বিশ্বাস না করলেই অভিশাপ কুড়োয়। হ্যাঁ,অভিশাপ।” সে সামনে ঝুঁকে প্রায় কান্নার মত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
সেই সময়েই,প্রথমবার আমার মনে হল,এটা বোধহয় অতিরিক্ত ব্র্যান্ডি খাওয়ার ফল। অতিরিক্ত ব্র্যান্ডি খেলে মানুষ এরকম অসংলগ্ন বকে,হাত খরখরে হয়ে যায়,চোখ চকচক করে,মুখ লালচে হয়ে যায়। এরকম একটা ভাল ছেলে শেষ অবধি নেশায় খপ্পরে পড়েছে দেখে খারাপ লাগল।
“তোমার একটু শোয়া দরকার,”আমি একটু কড়া গলাতেই বললাম।
সে চোখের এমন একটা ভঙ্গি করল যেন প্রাণপণে চেষ্টা করছে ঘুম থেকে জেগে ওঠার।
“শোব,শোব,” বলল সে, “একটু আগে আমার একটু ঘোর ঘোর লাগছিল বটে, তবে এখন ঠিক আছি।কী যেন বলছিলাম? ও হ্যাঁ,আমার বউ।হ্যাঁ,সে জাহাজ ধরবে ফলমাউথে।এখন,আমি তো ওখানে যাব জলপথে,না হলে আমার শরীর সারবে না। পরিষ্কার সমুদ্রের বাতাস পেলেই আমি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠব।তাই বলছিলাম তুমি রেলপথে ফলমাউথ যাও,কারণ যদি ওখানে জাহাজ পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়,তাহলে তুমি অন্তত আমার বউয়ের কাছে থাকতে পারবে।আমি ওকে তার করে দিচ্ছি যে তুমি রয়্যাল হোটেলে থাকবে।ওর সঙ্গে ওর বোন থাকবে।”
“আমার কোন অসুবিধে নেই”,আমি বললাম,“সত্যি বলতে কি,আমি রেলেই যাব ভাবছিলাম।কারণ কলম্বো যাওয়া পর্যন্ত বাকি সময়টা তো সমুদ্রেই থাকব।আমারও মনে হয়,তোমার একটা চেঞ্জ দরকার।আর,আমি যদি তুমি হতাম,তাহলে এক্ষুণি ঘুমোতে যেতাম।”
“হ্যাঁ,হ্যাঁ,যাব।আজ সারারাত ঘুমোব।জান তো-” তার চোখের দৃষ্টি আবার সেই রকম ঘোলাটে হয়ে এল, “গত বেশ কয়েকটা রাত ঘুমোতে পারিনি।একটু ঝামেলা ছিলাম থিয়োললজ -কী বলে-থিয়োললজিক্যাল- দুত্তোর,” বেশ চেষ্টা করে বলল সে, “ভগবানের চিন্তায়।ভাবছিলাম,ইশ্বর কেন আমাদের সৃষ্টি করলেন,কেন তিনি আমাদের মাথা ঝিমঝিম করান,কেন আমাদের পিঠে ব্যথা দেন।আজ রাতটা বোধহয় ভাল থাকব,” চেয়ারের পাশটা ধরে সে কোনওক্রমে উঠে দাঁড়াল।
“শোন ভ্যানসিটার্ট,” আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে বললাম,“আমি বরং এখানে যাহোক করে তোমার শোবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।তোমার শরীর ঠিক নেই। তোমার নেশা হয়ে গেছে।”
“নেশা!” সে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকাল।
“হ্যাঁ,নেশা।তোমার কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে গেছে দেখছো না?”
“শোন অ্যাটকিনসন,গত দু’দিন ধরে আমি একটি ফোঁটাও খাইনি।এটা নেশার ব্যাপার নয়।এটা যে কী কে জানে! তোমার যদিও মনে হচ্ছে এটা নেশা।” সে আমার হাত ধরে তার কপালে ছুঁইয়ে দিল।
“আরিব্বাস!” আমি বলে উঠলাম।
হাত ছুঁইয়ে মনে হল তার চামড়া জুড়ে একটা মখমলের মত আস্তরণ পড়েছে,যাতে ছোট ছোট গুঁড়ি গুঁড়ি দানা ভারতি। মসৃণ মনে হলেও আঙুল দিলে বোঝা যাচ্ছে এগুলো খসখসে।
“ও কিছু না,” আমার চমকানো মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল,“ঘামাচি হয়েছে।বিচ্ছিরি ঘামাচি।”
“কক্ষনো এগুলো ঘামাচি নয়।”
“নিশ্চয় ঘামাচি।লন্ডনের এই দূষিত হাওয়াতেই এগুলো হয়েছে। কাছাকাছি এক সার্জেন আছে।তাকে একটু দেখিয়ে নিলে কালকেই সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি এখন যাই।”
“না,তুমি যাবে না,” তাকে একটা চেয়ারে ঠেলে বসিয়ে দিয়ে বললাম,“এটা মজার ব্যাপার নয়।তুমি এখান থেকে কোত্থাও যাবে না।আগে একজন ডাক্তার তোমাকে দেখুক। এখন চুপ করে ওখানে বসে থাকো।”
মাথায় টুপিটা চাপিয়ে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কাছাকাছি এক ডাক্তার থাকেন।তাঁকে ডেকে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকে দেখলাম ঘর ফাঁকা,ভ্যানসিটার্ট নেই। বেল বাজাতে বেয়ারা এসে বলল যে আমি বেরোন মাত্র ভদ্রলোক তাকে দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি ডাকিয়ে তাতে উঠে চলে গেছেন। ভদ্রলোক গাড়োয়ানকে ডকের দিকে চালাতে বলেছেন।
“ভদ্রলোককে কি অসুস্থ লাগছিল?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“অসুস্থ!”বেয়ারা হেসে ফেলল, “সারাক্ষণ বিকট চেঁচিয়ে গান করছিলেন,স্যার।”
যদিও বেয়ারার কাছ থেকে এত চমৎকার তথ্য পেয়েও আমি স্বস্তি পেলাম না,তবে আমার মনে হল ও সোজা ইস্টার্ন স্টারে গিয়ে পৌঁছেছে। জাহাজে একজন ডাক্তার থাকবেই।কাজেই এ ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। তবে সারাক্ষণই আমার মনে হচ্ছিল ওর সাংঘাতিক তেষ্টার কথা,উত্তপ্ত হাতের কথা,ঘোলাটে চোখ,অসংলগ্ন কথাবার্তা আর ওর কপালের দানাগুলোর কথা।এসব ভাবতে ভাবতেই শুতে গেলাম।
পরদিন এগারোটা নাগাদ আমি ডকে গেলাম,কিন্তু ইস্টার্ন স্টার ততক্ষণে ছেড়ে দিয়ে প্রায় গ্রেভসেন্ড-এ পৌঁছে গেছে।ট্রেনে করে গ্রেভসেন্ড-এ গিয়েও তাকে ধরতে পারলাম না,শুধু দেখলাম জাহাজের মাস্তুলটা,আর চিমনি থেকে ছাড়া ধোঁয়ার কুণ্ডলী। তার মানে ফলমাউথে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমার বন্ধুর আর কোন খবরই পাওয়া যাবে না।অফিসে ফিরে দেখলাম একটা টেলিগ্রাম এসেছে মিসেস ভ্যানসিটার্টের কাছ থেকে। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন।পরের দিন সন্ধেয় আমি ফলমাউথের রয়্যাল হোটেলে গেলাম,যেখানে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ইস্টার্ন স্টারের জন্য। দশদিনের মধ্যেও ইস্টার্ন স্টারের কোন খবর পেলাম না।
সেই দশদিনের কথা আমি বোধহয় কখনো ভুলতে পারবো না।যেদিন ইস্টার্ন স্টার টেমস থেকে রওনা দেয়,সেই দিনই পুবদিক থেকে বয়ে আসে এক মারাত্মক ঝোড়ো হাওয়া এবং পরের এক সপ্তাহ ধরে তার শান্ত হওয়ার কোন লক্ষণই দেখা যায় না।দক্ষিণ উপকূলে এরকম ভয়ংকর ঝড়ের কথা এর আগে কখনো শোনা যায় নি। আমাদের হোটেলের জানালা থেকে ঝাপসা হয়ে দেখা যাচ্ছিল সমুদ্রের ঢেউয়ের দল অর্ধচন্দ্রাকৃতিভাবে তীরে ভেঙে পড়ছে। ঝড়ের দাপট এতটাই ছিল যে ঢেউ ফুলতে পর্যন্ত পারছিলনা।ঢেউয়ের চূড়াগুলো ভেঙে গিয়ে আছড়ে পড়ছিল তীরে।মেঘ, ঝড়,সমুদ্র সব যেন পশ্চিমের দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল,আর সেখানে,এই ভয়াবহ আবহাওয়ায় দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন আমি অপেক্ষা করছিলাম,যেখানে আমার সঙ্গী এক ফ্যাকাশে,মৌন মহিলা যিনি আতঙ্কভরা চোখে,কপাল জানলার কাচে ঠেকিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ধূসর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতেন,যদি কোন জাহাজের দেখা পাওয়া যায়।কিছু না বললেও তাঁর সারা মুখে ছড়িয়ে থাকত ভয়।
পাঁচ দিনের দিন আমি এক পুরোন নাবিককে ধরলাম।ভেবেছিলাম একটু আড়ালে কথা বলব,কিন্তু চোখে পড়ে গেল মিসেস ভ্যানসিটার্টের,আর যে মুহুর্তে চোখে পড়ে গেল,তিনি ব্যাকুল মুখে আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন।
“লন্ডন থেকে সাতদিন আগে বেরিয়েছে,” বলল সেই নাবিক, “ঝড়ই তো হচ্ছে পাঁচদিন ধরে।এই ঝড়ে তো চ্যানেলে কিছু থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। তিনটে জিনিস হতে পারে। ঐ জাহাজ হয়তো ফ্রান্সের দিকের কোন বন্দরে ভিড়ছে।সেটার সম্ভাবনাই বেশি।”
“কিন্তু-কিন্তু উনি তো জানেন,আমরা এখানে।তাহলে কি উনি টেলিগ্রাম করতেন না?”
“হ্যাঁ,তা করতেন।তাহলে,হয়তো উনি আসছেন,হয়তো উনি এখন মাডেইরার কাছাকাছি চলে এসেছেন। আপনি অপেক্ষা করতে পারেন,ম্যাডাম।”
“আর না হলে? আপনি বললেন যে আরেকটা সম্ভাবনা আছে?”
“বলেছিলাম নাকি? না না ম্যাডাম,আমি এই দুটোর কথাই বলেছিলাম। হয়ত ওই জাহাজটা ঝড়ের ধাক্কায় আটলান্টিকের গভীরে চলে গেছে।তবে এখন আবহাওয়া ভাল হচ্ছে তো,আপনারা এইবারে খবর পেয়ে যাবেন। চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। কাল সকালেই দেখবেন আকাশ পরিস্কার হয়ে গেছে।”
বৃদ্ধ নাবিকের অনুমানই সত্যি হল। পরের দিনটা অনেক শান্ত আর ঝকঝকে,শুধু আকাশের পশ্চিমদিকে ছেঁড়া ছেঁড়া নিচু মেঘ আগের দিনগুলোর ভয়াবহ আবহাওয়ার কথা জানান দিচ্ছিল।কিন্তু জাহাজের কোন খবর এল না।আরো তিনটে দুঃসহ দিন কাটল।তিনদিনের দিন একটা লোক হোটেলে এল একটা চিঠি নিয়ে।সেটা দেখেই আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। চিঠিটা এসেছে ইস্টার্ন স্টারের ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে। প্রথম লাইনটা পড়েই আমি চিঠিটা ঢেকে ফেলেছিলাম হাত দিয়ে,কিন্তু তার আগেই মিসেস ভ্যানসিটার্ট হাত দিয়ে আমার হাতটা সরিয়ে দিয়েছেন, “আমি দেখেছি,” তিনি বললেন শান্ত,ঠান্ডা গলায়,“আমি পুরোটাই পড়তে চাই।”
চিঠিতে লেখা আছে-
প্রিয় মহাশয়,
মিঃ ভ্যানসিটার্ট গুরুতর অসুস্থ। তাঁর গুটিবসন্ত হয়েছে।তিনি কিছু বলার মত অবস্থায় নেই। আমরা ঝড়ের ধাক্কায় অনেক দূর চলে এসেছি।সম্ভবত আমরা এখন ফানকাল থেকে তিনশো মাইল দূরে আছি।তাই মনে হচ্ছে যে আমাদের এখন ফানকালে গিয়ে মিঃ ভ্যানসিটার্টকে হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার।আপনি না আসা পর্যন্ত আমরা সেখানে অপেক্ষা করব।আমি যতদূর জানি,ফলমাউথ থেকে একটা স্টিমার ছাড়বে কয়েকদিনের মধ্যেই ফানকালে আসার জন্য।এই চিঠিটা ফলমাউথের মারিয়ন স্টিমারে পাঠানো হচ্ছে,পত্রবাহককে পাঁচ পাউন্ড দিতে হবে।
আপনার বিশ্বস্ত
জে এন ও হাইনস
সদ্য স্কুল পাশ করা এত কমবয়সী মানুষ হয়েও স্নায়ুর ওপর আশ্চর্য দখল দেখলাম মহিলার। এতবড়ো একটা খবর পেয়েও তিনি শক্তসমর্থ পুরুষের মতই শান্ত রইলেন।কিচ্ছু বললেন না,শুধু ঠোঁটদুটো শক্ত করে চেপে মাথাটা ওড়নায় ঢেকে নিলেন।
“আমি বেরোচ্ছেন নাকি?” আমি বললাম।
“হ্যাঁ।”
“আমি যাব?”
“না,আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।”
“ডাক্তারের কাছে?”
“হ্যাঁ,গুটি বসন্তের রোগীকে কিভাবে পরিচর্যা করতে হয়,সেটা জানতে যাচ্ছি।”
সারা বিকেলটা তিনি ব্যস্ত রইলেন।পরদিন সকালে রোজ অফ শ্যারন নামের একটা ছোট পালতোলা জাহাজে চড়ে আমরা চললাম মাডেইরার দিকে।হাওয়া দিচ্ছিল ঘন্টায় দশ নট গতিতে।প্রথম পাঁচদিন জাহাজ চলল চমৎকার,এবং আমরা যখন দ্বীপের কাছাকাছি চলে গেছি তখন ষষ্ঠ দিনের মাথায় হাওয়া একদম পড়ে গেল এবং আমাদের যাত্রাও গেল বন্ধ হয়ে। আমরা আর এক ফুটও এগোতে পারলাম না।
সেদিন রাত দশটা নাগাদ,এমিলি ভ্যানসিটার্ট এবং আমি জাহাজের স্টারবোর্ডের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলাম,আমাদের পেছনে আলো দিচ্ছিল পূর্ণচন্দ্র। ঝকঝকে জলে পড়েছিল জাহাজের ছায়া,সেইসঙ্গে আমাদের দুজনেরও।
ছায়ার ওপর থেকে চাঁদের আলো পড়ে একটা আলোকিত পথ তৈরি করেছিল দিগন্তরেখা পর্যন্ত,জলের হালকা ঢেউয়ে নাচছিল সেটা।আমরা চারদিকের নিস্তব্ধতা, হাওয়ার সম্ভাবনা,আকাশের অবস্থা এই সব নিয়ে কথা বলছিলাম,আচমকা জলে একটা শব্দ হল,যেন স্যামন মাছে ঘাই মেরেছে,আর তারপর,পরিষ্কার আলোয় আমরা দেখতে পেলাম,জন ভ্যানসিটার্ট ভেসে উঠল জলের ভেতর থেকে,তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে।
ওকে যত পরিষ্কারভাবে দেখলাম,এত পরিষ্কার আমি জীবনে কোন কিছু দেখিনি। ঝকঝকে চাঁদের আলো পড়েছিল ওর শরীরে। তখন ও আমাদের থেকে বড়োজোর দু তিন বৈঠার তফাতে রয়েছে। শেষ যেমন দেখেছিলাম,ওর মুখ তার থেকেও ফোলা,মুখের বিভিন্ন জায়গায় কালো কালো ছোপ,চোখে খোলা,মুখ হাঁ করা,যেন কোনকিছুতে চরম বিস্মিত হয়েছে।ঘাড়ের কাছে সাদা মত কী একটা,একটা হাত কানের কাছে তোলা,আরেকটা হাত বুকের ওপর রাখা। আমি দেখলাম সে জলের থেকে লাফিয়ে বাতাসে ভেসে উঠল,আর সেই চরম নৈঃশব্দের ভেতর জলের ঢেউ এসে আঘাত করল জাহাজের দেয়ালে। তারপর আবার সে ডুবে গেল জলের ভেতর,আর ঠিক সেই সময় আমি শুনলাম একটা কড়কড় আওয়াজ,যেন শীতের রাত্রে আগুনে শুকনো ডালপালা দেওয়া হয়েছে। আবার যখন আমি তাকালাম,তখন সে মিলিয়ে গেছে,কিন্তু শান্ত সমুদ্রের ঐ জায়গাটাতে জলের আলোড়ন বুঝিয়ে দিচ্ছিল ওখানে সে এইমাত্র ছিল।আমি যে কতক্ষণ ওখানে ছিলাম,শিহরণ জাগানো শরীরে,একহাতে জাহাজের রোলিং ধরে,অন্যহাতে এক অচেতন মহিলাকে সামলে,তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।লোকে বলে আমার নাকি আবেগ বা উত্তেজনা নেই,কিন্তু সেদিন আমার হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। বেশ কয়েকবার ডেকে পা ঠুকে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম যে আমি ঠিক আছি না পাগল হয়ে গেছি। যখন আমি দাঁড়িয়ে আছি,কম্পিত কলেবরে, তখন চেতনা ফিরে এল মহিলার,হাঁ করে দম নিচ্ছিলেন তিনি,তারপর দুহাতে রেলিং-এ ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়লেন তিনি। চাঁদের আলোয় মনে হল,কয়েক মুহুর্তেই তাঁর বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে।
“আপনি ওকে দেখলেন?” অস্ফুট স্বরে বললেন তিনি।
“কিছু একটা দেখলাম।”
“এটা ও!এটা জন ছিল!ও মরে গেছে!”
আমি নিচু স্বরে সন্দেহ প্রকাশ করলাম।
“কোন সন্দেহ নেই।ও মারা গেছে!এখনই!” ফিস্ফিস্ করে বললেন তিনি,“মাডেইরার হাসপাতালে,আমি জানি।আমি এরকম ঘটনা অনেক পড়েছি।ও আমার কথা ভাবছিল। তাই ও আমায় দেখা দিল। ওঃ জন,জন ! হায়,জন !”
আচমকা কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। আমি তাঁকে তাঁর কেবিনে রেখে এলাম। ওঁর এখন একা থাকা দরকার। সেই রাত্তিরে পূর্বদিক থেকে একটা হালকা হাওয়া বইতে শুরু করল এবং পরদিন বিকেলের দিকে লস ডেসার্টোস দ্বীপপুঞ্জ পেরিয়ে সূর্যাস্তের সময় ফানকালে নোঙর করলাম। ইস্টার্ন স্টার একটু দূরে ভেসে আছে,মাস্তুল থেকে উড়ছে কোয়ারান্টাইন পতাকা এবং জাতীয় পতাকা রয়েছে অর্ধনমিত।
“দেখছেন তো!” সঙ্গে সঙ্গেই বললেন মিসেস ভ্যানসিটার্ট। তাঁর চোখে এখন আর জল নেই। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কী হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের থেকে অনুমতি নিয়ে সেই রাত্রেই আমরা আমাদের জলযান ভেড়ালাম ইস্টার্ন স্টারের গায়ে।ক্যাপ্টেন হাইনস ডেকে দাঁড়িয়েছিলেন দুঃখিত মুখে এবং তিনি যখন কথা হাতড়াচ্ছেন,তার আগেই মিসেস ভ্যানসিটার্ট মুখ খুললেন, “আমি জানি আমার স্বামী মারা গেছেন,” তিনি বললেন,“তিনি গতকাল রাত দশটা নাগাদ হাসপাতালেই মারা গেছেন,তাই না?”
ক্যাপ্টেন অবাক,বিড়ম্বিত মুখে তাকালেন, “না,ম্যাডাম,তিনি মারা গেছেন আট দিন আগে,সমুদ্রে থাকতেই।আমরা ওখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করি- ইয়ে- সমুদ্রে ফেলে দিই।কারণ হাওয়া না থাকায় আমরা তখন আটকে গেছিলাম,কখন ডাঙায় আসব ঠিক ছিল না।”
এই হল জন ভ্যানসিটার্টের মৃত্যু সম্বন্ধীয় প্রধান ঘটনা এবং ওর স্ত্রী যেখানে ওকে দেখেছিলেন,তার অবস্থান ল্যাটিচিউড ৩৫ ডিগ্রি নর্থ এবং লঙ্গিচিউড ১৫ ডিগ্রি ওয়েস্ট। নানাভাবেই এ ঘটনার ব্যাখ্যা করা যায়। সে ভৌতিক দৃষ্টান্ত হিসেবেই হোক বা একেবারে আধুনিক থিয়োরি অনুযায়ী টেলিপ্যাথিই হোক। তবে ঘটনা প্রবাহ থেকে এটা বলতে পারি,আমরা জন ভ্যানসিটার্টের ভূত দেখিনি,বরং সেই রাত্রে স্বয়ং জন ভ্যানসিটার্টকেই চাঁদের আলোয় আটলান্টিকের অতল থেকে উঠে আসতে দেখেছিলাম। আমার বিশ্বাস,নিতান্ত ঘটনাচক্রেই- এমন ঘটনা আক্ষরিক অর্থেই কদাচিৎ ঘটে—আমাদের জাহাজ সেই বিশেষ জায়গায় গিয়ে নিবাত অবস্থায় পড়েছিল,যেখানে এক সপ্তাহ আগেই জনকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। জাহাজের ডাক্তারের মুখে শুনেছি,তার সঙ্গে যে ওজন বেঁধে দেওয়া হয়েছিল,সেটা খুব শক্ত করে বাঁধা ছিল না। সে কারণেই,হয়তো পরের সাতদিনে সেটা আলগা হয়ে গেছিল। তার ফলে সেটা যথেষ্ট গতিবেগ পেয়েই জলের ওপরে ভেসে উঠেছিল। এ ব্যাপারে আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা এটাই এবং যদি আপনারা জিজ্ঞাসা করেন তারপর দেহটার কী হল,আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেব দেই কড়কড় আওয়াজ আর আলোড়নটার কথা।হাঙরেরা জলের ওপরতল থেকেই খাবার সংগ্রহ করে এবং সমুদ্রের ঐ অংশে প্রচুর হাঙর দেখা যায়।