বিদেশী গল্প ইংরিজি গল্প -নয় মাইল হাঁটা-হ্যারি কেমেলম্যান-অনুবাদ অমিত দেবনাথ-বর্ষা ২০১৬

bideshinoymile01 (Medium)গুড গভর্নমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ডিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমি এক্কেবারে একটা গাধা বনে গেলাম,আর তাই নিয়ে ব্লু মুনে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে নিকি ওয়েল্ট আমায় যা খ্যাপালো যে কী বলব! আমি যে বক্তৃতাটা তৈরি করে নিয়ে গেছিলাম,সেটা পড়লেই হত,তা না করে আমার আগের বক্তা,যিনি কাউন্টি অ্যাটর্নি অফিসে আছেন,তাঁর বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়েই গন্ডগোলটা পাকালাম। তাঁর বক্তব্য থেকে আমি নিজস্ব কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম,ব্যস,পরের চান্সেই সেগুলোর সবকটা খন্ডন করল লোকটা,আর আমার সততা নিয়েই টানাটানি পড়ে গেল।

রাজনীতিতে আমি একেবারে নতুন,কয়েকমাস হল ল স্কুল ফ্যাকাল্টি ছেড়ে কাউন্টি অ্যাটর্নির রিফর্ম পার্টির প্রার্থী হয়েছি। আমি অবশ্য পরে সামলানোর চেষ্টা করেছিলাম,কিন্তু নিকোলাস ওয়েল্ট,যে তার প্রগাঢ় জ্ঞানগম্যি কখনোই ফলানোর চেষ্টা করে না (ও ইংরাজি সাহিত্যের স্নোডন প্রফেসর),সে আরো গলা চড়িয়ে ব্যাপারটা থামিয়ে দিল,যেন এগুলো কোন ব্যাপারই না। এমন সুরে বলল,যেন ও ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারের কোন ছাত্রের একটা পেপারের পরীক্ষা একটু পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে।

যদিও ও আমার থেকে বছর দুই তিনের বড়ো,বয়স চল্লিশের কোঠা পেরোনোর মুখে,আমার সঙ্গে এমনভাবে কথাবার্তা বলে,যেন কোন নির্বোধ ছাত্রকে শিক্ষক রামধমক দিচ্ছে। আর আমাকে,পক্ককেশ,মুখে ভাঁজ পড়া নিকির থেকে অনেক কমবয়সি লাগে বলেই বোধহয় সেগুলো মেনে নিতে হয়।

 “ওগুলো কিন্তু নিখুঁত সিদ্ধান্ত ছিল,” আমি বললাম।

 “শোন খোকা,সে বলল,” যদিও মানবজীবন সিদ্ধান্ত ছাড়া অচল,তবুও বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই ভুলে ভরা। আর আইনি পেশায় এই ভুলের শতকরা হার একটু বেশিই,কারণ এখানে সত্যটা প্রকাশ করার ইচ্ছে যতটা থাকে,তার থেকে অনেক বেশি থাকে সত্যটা চাপা দেওয়ার ইচ্ছে।”

আমি আমার বিলটা তুলে উঠে পড়লাম, “আমার মনে হয় তুমি কোর্টে ক্রস এগজামিনের কথা বলছ। কিন্তু সেখানে বিবাদি পক্ষের উকিল থাকে,যুক্তিহীন সিদ্ধান্ত হলে বাধা দেওয়ার জন্য।”

“আরে যুক্তির কথা কে বলছে?” সে বলে উঠল, “কোন সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত হয়েও ভুল হতে পারে।”

আমরা দাঁড়িয়েছিলাম ক্যাশিয়ারের বুথের সামনে। আমার বিল মেটানো হয়ে গেছিল, কিন্তু নিকির তখনও হয়নি।সে পকেট থেকে বার করেছিল একখানা পুরোন আমলের মানিব্যাগ,সেখান থেকে একটা একটা করে কয়েন বার করে আনছিল,রাখছিল কাউন্টারের ওপর তার বিলের পাশে,মিলিয়ে দেখছিল কয়েন দিয়েই পুরো পয়সা মেটানো যায় কিনা। শেষ পর্যন্ত একটা শ্বাস ফেলে সে কয়েনগুলো আবার ঢুকিয়ে দিল মানিব্যাগে,তার বদলে বের করে আনল একখানা নোট,এগিয়ে দিল ক্যাশিয়ারের দিকে।

“আমাকে দশ কি বারোটা শব্দের একটা লাইন বল,”সে বলল,“আমি সেটা থেকেই তোমাকে এমন যুক্তিশৃঙ্খল দেখাবো,যেটা তুমি লাইনটা বলার সময় ভাবতেও পারনি।”

অন্যান্য খদ্দেররা আসছিল,তাই আমি ভাবলাম নিকির কাজ যতক্ষণ শেষ না হয়,আমি বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করি। আমার বেশ মজা লাগছিল এই ভেবে যে ও বোধহয় ভাবছে,ও এরপর যা বোঝাবে,আমি তাই বুঝতে বাধ্য থাকব।   

বাইরে বেরিয়ে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে আমি বললাম, “নয় মাইল হাঁটা মোটেই ঠাট্টার ব্যাপার নয়,বিশেষ করে বৃষ্টির মধ্যে।”

“সে তো বটেই,” সে সায় দিল অন্যমনস্কভাবে,তারপরই থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকাল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে, “এসব কী আবোলতাবোল বকছ হে?”

“কেন,একটা লাইন বললাম,এগারোটা শব্দের,” আমি আরেকবার বললাম লাইনটা,প্রত্যেকটা শব্দ গুনতে গুনতে।

“কী করছ?”

“কেন,তুমিই তো বললে দশ বারোটা শব্দের একটা লাইন বলতে-”

“ওঃ,তাই তো,”আমার দিকে সে সন্দেহের চোখে তাকাল।”কোত্থেকে পেলে এটা?”

 “এমনিই মাথায় চলে এল।এবার তোমার সিদ্ধান্ত বল।”

 “সত্যি বলছ?”ওর নীল চোখে চকচক করছে মজার আভাস, “সত্যিই জানতে চাও?”

বাঃ! প্রথমে নিজেই বলল,আর এখন বলছে জানতে চাই কিনা! রেগে গেলাম।

“বলবে তো বল,নাহলে চুপ কর,” আমি বললাম।

“ঠিক হ্যায়,” বলল সে,“অত রাগ করার কিছু নেই। চল,এবার দেখা যাক বাক্যটা কী। নয় মাইল হাঁটা মোটেই ঠাট্টার ব্যাপার নয়,বিশেষ করে বৃষ্টির মধ্যে। বেশ।”

“দশটা শব্দের বেশি আছে কিন্তু,” আমি বললাম।

“ভালো কথা,” ওর কথা শুনে মনে হল ও মনে মনে চিন্তা করা শুরু করে দিয়েছে, “প্রথম সিদ্ধান্ত,বক্তা বেশ কষ্ট পেয়েছে।”

 “মেনে নিলাম,” আমি বললাম, “যদিও এটাকে সেভাবে সিদ্ধান্ত বলা যায় না।এতখানি হাঁটলে তো কষ্ট হবেই।”

অধৈর্যভাবে মাথা নাড়ল সে, “পরের সিদ্ধান্ত, বৃষ্টি হয়েছে কিনা পরিষ্কার নয়,না হলে সে বলত ‘বৃষ্টির মধ্যে নয় মাইল হাঁটা মোটেই ঠাট্টার ব্যাপার নয়।’ সে তা না বলে বলেছে বিশেষ করে বৃষ্টির মধ্যে,যেন বিশেষ করে কথাটা সে একটু ভেবে বলেছে।”

“মেনে নিলাম,” আমি বললাম, “যদিও এটা বোঝাই যাচ্ছিল।”

“মাথা পরিষ্কার থাকলে না বোঝার কিছু নেই,” নিকি বলল বাঁকাসুরে।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। দেখাই যাক না ও আর কতটা তালগোল পাকাতে পারে।

 “পরের সিদ্ধান্ত, বক্তা খেলাধুলো বা দৌড়ঝাঁপে পারদর্শী নয়।”

“যেমন?”

“ঐ যে-বিশেষ করে কথাটা, “সে বলল, “বক্তা একথা বলেনি যে বৃষ্টির মধ্যে নয় মাইল হাঁটা ঠাট্টার ব্যাপার নয়,বরং বলতে চেয়েছে যে হাঁটাটা-মানে ঐ দূরত্বে হাঁটাটা ঠাট্টার ব্যাপার নয়। এখন দেখ,নয় মাইল এমন কিছু বিশাল দূরত্ব নয়। নয় হোলের গলফেও এর চেয়ে অনেক বেশি হাঁটতে হয়,আর গলফ বয়স্কদেরই খেলা,” আমার দিকে চোখ টেরিয়ে তাকিয়ে কথাটা বলল সে। আমি গলফ খেলি কিনা!

“মেনে নিলাম,” আমি বললাম,“তবে এখানে আরো কতগুলো সম্ভাবনা আছে। বক্তা হয়ত কোন জঙ্গল-যোদ্ধা,সে ক্ষেত্রে নয় মাইল হাঁটা পরিশ্রমসাধ্য তো বটেই,সে বৃষ্টি হোক বা না হোক।”

“বটেই তো,”ব্যঙ্গের সুরে বলল নিকি, “হয়তো বক্তার একটা পা নেই। হয়তো সে একজন গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট,হয়তো সে একখানা লিস্ট বানাচ্ছে কোন কোন জিনিস মজার নয় তা নিয়ে।যত্ত সব! শোন হে,আমাকে পুরোটা বলার আগে আরো কয়েকটা জিনিস বুঝে নিতে হবে।”

“মানে?” আমি বললাম সন্দিগ্ধ হয়ে।

 “মনে রাখবে,আমি এই বাক্যটা শুরু করেছি শূন্য থেকে। আমি জানি না কে এটা বলেছে বা এর পেছনের ঘটনাটা কী। সাধারণত কোনও কথার পেছনে একটা ঘটনা থাকে।”

 “তা অবশ্য ঠিক। কী কী ব্যাপার তুমি বুঝতে চাইছো?”

“একটা জিনিস,বক্তার উদ্দেশ্য খারাপ নয়।বক্তা সত্যি সত্যিই ঐ দূরত্বটা হেঁটেছে এবং সেটা কোন বাজি জেতার উদ্দেশ্যে নয়।”

“বেশ।”

“আর আমি এটাও বলব যে হাঁটাহাঁটির জায়গাটা কাছাকাছির মধ্যেই।”

“তুমি বলতে চাও জায়গাটা এই ফেয়ারফিল্ডেই?”

 “তা নয়। আমি বলতে চাইছি জায়গাটা এখানকারই কোথাও।”

 “মেনে নিলাম।”

“তাহলে তুমি যদি আমার ধারণাগুলো মেনেই নাও,তাহলে আমার শেষ সিদ্ধান্তটাও মেনে নাও,বক্তা অ্যাথলেট নয় বা সে দৌড়ঝাঁপ করে না।”

“ঠিক আছে,তারপর?”

 “আমার পরের সিদ্ধান্ত হল, হাঁটা হয়েছিল গভীর রাতে অথবা খুব সকালে-ধর মাঝরাত আর সকাল পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে।”

“এটা তুমি বুঝছ কীভাবে?”আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“দূরত্বটা ভাবো-নয় মাইল। আমরা এমন জায়গায় আছি যেখানকার জনসংখ্যা বেশ ভালোই। যে কোন একটা রাস্তা ধরলে দেখবে নয় মাইলের মধ্যে কোন না কোন জনবসতি পেয়ে যাবে। হ্যাডলি পাঁচ মাইলের মধ্যে,হ্যাডলিফলস সাড়ে সাত মাইল,গোরটন এগারো,ইস্ট গোরটন আবার আট মাইল আর তুমি গোরটন যাওয়ার আগেই ইস্ট গোরটনে পৌঁছবে। গোরটনে ট্রেনে যাওয়া যায়,বাকিগুলো বাসে। সবকটা রাস্তা-মানে হাইওয়েই ভাল। তাহলে বুঝতেই পারছো-নয় মাইলের হাঁটা একমাত্র গভীর রাতেই সম্ভব,যখন বাস সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। আর অত রাত্রে হাইওয়েতে চলাচল করা কোন গাড়ি চট করে কাউকে তুলতে চায় না।”

“হয়তো ও কাউকে দেখা দিতে চাইছে না,” আমি বললাম।

নিকি আমার দিকে করুণার চোখে তাকিয়ে হাসল, “তুমি বলছ,বক্তা রাস্তা দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটবে,অথচ তাকে লোকে খেয়াল করবে না,তাহলে কোথায় খেয়াল করবে,বাসে-যেখানে বেশিরভাগ লোক কাগজ পড়তে ব্যস্ত থাকে?”

“হ্যাঁ,সেটা অবশ্য ঠিক,” আমি বললাম।

 “তাহলে এটা ভাব, বক্তা শহর থেকে কোথাও যাওয়ার বদলে কোন শহরের দিকেই যাচ্ছিল।”

“এটা হতে পারে,” আমি ঘাড় নাড়লাম। “ও কোনও শহরে থাকলে তো ওখান থেকেই

যানবাহনের ব্যবস্থা করতে পারত। তুমি তাই ভাবছো তো?”

“খানিকটা তাই,” নিকি বলল, “তবে আরেকটা কথা মাথায় রাখতে হবে-ওই দূরত্বটা। মনে রেখ,এটা নয় মাইল,আর নয় একটা নিখুঁত সংখ্যা।”

“বুঝলাম না।”

 আবার স্কুলমাস্টার সুলভ ভাবভঙ্গি ফুটে উঠল নিকির চোখে মুখে, “ধরা যাক,তুমি বললে “আমি মাইল দশেক হাঁটবো” বা “একশো মাইল গাড়ি চালাব”,তার মানে ধরে নিতে হবে তুমি আসলে আট থেকে দশ মাইলের মধ্যে যে কোন একটা দূরত্ব যাবে অথবা নব্বই থেকে একশো মাইলের মধ্যে যে কোন একটা দূরত্বে গাড়ি চালাবে। অন্য কথায়,দশ আর একশো হল গোটা সংখ্যা। তুমি ঠিকঠাক দশ মাইলও যেতে পারো,অথবা দশ মাইলের একটু এদিক ওদিক কোন দূরত্বও যেতে পারো। কিন্তু যখনই তুমি বলবে নয় মাইল,তখন আমার ধরে নেওয়ার অধিকার আছে যে সংখ্যাটা তুমি জেনেই বলছ। শহর থেকে কোনও জায়গার দূরত্ব আর কোনও জায়গা থেকে শহরের দূরত্ব থেকেও ব্যাপারটা বোঝা যায়। মানে ধর,তুমি শহরের কাউকে জিজ্ঞেস করলে ফার্মার ব্রাউনের বাড়িটা কদ্দুর,এখন সে যদি ফার্মার ব্রাউনকে চেনে,বলবে ‘এই তিন চার মাইল হবে।’ কিন্তু তুমি ফার্মার ব্রাউনকে যদি জিজ্ঞেস কর, ‘তোমার বাড়ি শহর থেকে কতদূর?’সে বলবে ‘তিন পূর্ণ ছয়ের দশ মাইল-কতবার স্পিডোমিটারে দেখেছি!’”

 “ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে না,” আমি বললাম।

“কিন্তু তুমিই তখন বললে যে সে যদি শহরে থাকে,তাহলে যানবাহনের ব্যবস্থা করে নেবে-”

“হ্যাঁ,তা অবশ্য ঠিক,” আমি বললাম, “ঠিক আছে,মেনে নিলাম। আর কিছু?”

 “এবার আসছি সেই কথায়,” বলল সে, “আমার পরের সিদ্ধান্ত, সে নির্দিষ্ট একটা গন্তব্যস্থলেই যাচ্ছে এবং তাকে সেখানে একটা নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে হবে। এবং সেটা একটা নির্দিষ্ট কারণে। এলেবেলে কোন ব্যাপার-যেমন গাড়ি খারাপ,বা বাড়িতে চোর এসেছিল-এসব নয়।”

“কিন্তু এক্ষেত্রে গাড়ি খারাপ হওয়াটাই তো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কারণ মনে হচ্ছে।শহর ছাড়ার সময়ই তো সে ঠিকঠাক দূরত্বটা দেখে নিতে পারছে।”

 নিকি ঘাড় নাড়ল,  “বৃষ্টির মধ্যে নয় মাইল হাঁটার চেয়ে সে বরং গাড়ির পেছনের সিটে শুয়ে ঘুমোবে,অথবা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে অন্য কোন গাড়ি দাঁড় করানোর চেষ্টা করবে। মনে রেখো,এটা নয় মাইল। হাঁটলে কতক্ষণ লাগবে?”

“চার ঘন্টা,” আমি বললাম।

সে ঘাড় নাড়ল, “বৃষ্টির কথা মাথায় রাখলে,তার কম নয়। আমরা একমত যে ঘটনাটা গভীর রাতের অথবা খুব সকালের। ধরা যাক গাড়ি খারাপ হয়েছে রাত একটায়। তাহলে গন্তব্যস্থলে যেতে তার পাঁচটা বাজবে। তখন ভোর। রাস্তায় গাড়ি চলাচল শুরু হয়ে গেছে। বাস চলাচল শুরু হয় তার সামান্য পরেই। বস্তুতপক্ষে,ফেয়ারফিল্ডে প্রথম বাসগুলো ছাড়ে সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই। তাছাড়া,ওর যদি সাহায্যই দরকার হয়,তাহলে ও শহর অবধি হেঁটে যাবে না-যাবে কাছাকাছি টেলিফোন বুথে। তার মানে,ওর নির্দিষ্ট কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে,সেটা শহরেই এবং সেটা সাড়ে পাঁচটার আগেই।”

“তাহলে সে কেন সেখানে আগে গিয়ে অপেক্ষা করবে না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সে লাস্ট বাসটা ধরল,একটার মধ্যে ওখানে চলে গেল,আর অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় অবধি অপেক্ষা করল? তার বদলে সে বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে নয় মাইল হাঁটবে কেন,যেখানে তুমি বলছ সে অ্যাথলেট নয়?”

আমরা মিউনিসিপাল বিল্ডিঙে চলে গেছিলাম,এখানেই আমার অফিস। সাধারণত আমাদের মধ্যে কোন তর্কাতর্কি ব্লু মুন থেকে শুরু হয়ে এখানে এসে শেষ হয়। কিন্তু নিকির বিবরণটায় বেশ আগ্রহ বোধ করছিলাম,তাই নিকিকে বললাম ও আমার অফিসে কিছুক্ষণের জন্য আসুক।

ভেতরে গিয়ে বসার পর আমি বললাম,”নিকি,সে কি আগে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারত না?”

“পারত,কিন্তু সে যখন সেটা করেনি,তখন আমরা ধরে নেব হয় সে লাস্ট বাস চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে,অথবা সে দেরি করেছে কোন সংকেতের জন্য-ধরা যাক সেটা কোনও টেলিফোন কল।”

 “তাহলে তোমার কথা অনুযায়ী মাঝরাত আর ভোর সাড়ে-পাঁচটার মধ্যে তার কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল-”

“আরো ভালভাবে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যায়। মনে রাখতে হবে,দূরত্বটা অতিক্রম করতে তার চার ঘন্টা লেগেছে। লাস্ট বাস আসে রাত সাড়ে বারোটায়। সে যদি বাসটা না ধরে,কিন্তু ওই সময়েই রওনা দেয়,তাহলে সে গন্তব্যস্থলে সাড়ে চারটের আগে পৌঁছতে পারবে না। অন্যদিকে,সে যদি সকালের প্রথম বাসটা ধরতে চায়,তাহলে তাকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ওখানে পৌঁছতে হবে। তার মানে তার অ্যাপয়েন্টমেন্টটা হল সাড়ে চারটে থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে।”

“তুমি বলতে চাইছ যদি তার অ্যপয়েন্টমেন্ট সাড়ে চারটের আগে হয়,তাহলে সে রাত্তিরের শেষ বাসটা ধরবে,আর সাড়ে পাঁচটার পরে হলে সকালের প্রথম বাসটা?”

“একদম ঠিক। আরেকটা জিনিস, যদি সে কোন সংকেত বা টেলিফোনের জন্য অপেক্ষা করে,তাহলে এটা রাত একটার আগেই আসবে।”

তার মানে,”আমি বললাম,”যদি তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে পাঁচটার সময়,আর যেতে চার ঘন্টা লাগে,তবে ওকে রওনা হতে হবে একটার সময়।”

নিকি ঘাড় নেড়ে চুপ করে কী যেন ভাবতে লাগল। আমি কথা বলে ওর চিন্তায় আর ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলাম না। দেয়ালে এই এলাকার একটা ম্যাপ ঝোলানো ছিল,কাছে গিয়ে দেখতে লাগলাম সেটা।

“নিকি,তুমি ঠিক বলেছ,” ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, “ফেয়ারফিল্ডের কাছাকাছি এমন কোন শহর নেই,যেটা নয় মাইলেরও বেশি দূরত্বের। আশেপাশে অনেকগুলো ছোটো শহর আছে,ফেয়ারফিল্ড ঠিক সেগুলোর মাঝখানে।”

নিকি এসে ম্যাপ দেখতে শুরু করল, “বুঝতেই পারছ,ও ফেয়ারফিল্ডে যেতে চাইছে না,যেতে চাইছে অন্য কোন ছোট শহরে। ধরা যাক হ্যাডলি।”

“হ্যাডলি? হ্যাডলিতে কেউ ভোর পাঁচটায় যেতে চাইবে কেন?”

 “কারণ ওয়াশিংটনের ট্রেনটা ঠিক ওই সময়েই ওখানে জল নিতে দাঁড়ায়।”

“তাই তো,” আমি বললাম, “ঘুম ভেঙে গেলে আমি ঐ ট্রেনটার আওয়াজ শুনেছি বটে। ওটা আসার মিনিটখানেক কি মিনিটদুয়েক পরেই মেথডিস্ট চার্চের ঘন্টায় পাঁচটা বাজে।” আমি ডেস্কে গিয়ে টাইমটেবিলটা দেখলাম, “ওটা ওয়াশিংটন থেকে ছাড়ে রাত বারোটা সাতচল্লিশে আর বস্টনে ঢোকে সকাল আটটায়।”

নিকি তখনও ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে একটা পেনসিল নিয়ে দূরত্ব মাপামাপি করছে।

“হ্যাডলি থেকে ঠিক নয় মাইল দূরত্বে হচ্ছে ওল্ড সামটার সরাইখানা,” বলল সে।

“ওল্ড সামটার সরাইখানা,” আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল ওই কথাটারই প্রতিধ্বনি, “যাচ্চলে! তাহলে তো পুরোটাই গুলিয়ে গেল। যে কোন শহরের মতই ওখান থেকেও তো সহজেই যানবাহনের ব্যবস্থা করা যায়।”

মাথা নাড়ল নিকি, “গাড়ি যেখানে থাকে,গেট পেরিয়ে সেখানে যেতে গেলে তোমাকে অ্যাটেনডেন্টের মুখোমুখি হতে হবে। বেখাপ্পা সময়ে কেউ গাড়ি ভাড়া নিলে অ্যাটেনডেন্ট নির্ঘাত তাকে মনে রাখবে। এটা তো আর বিরাট কোন জায়গা নয়! লোকটা হোটেলের কোনও ঘরে অপেক্ষা করতে পারে,যতক্ষণ না সে ওয়াশিংটন থেকে কোন খবর পায় যে ঐ ট্রেনেই কেউ আসছে-কোচ আর বার্থ নম্বর সমেত। সে তখন চুপচাপ হোটেল থেকে বেরিয়ে হ্যাডলির পথে হাঁটা ধরতে পারে।”

আমি সম্মোহিতের মত তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

“ট্রেন যখন জল নিচ্ছে,সেই সময় টুক করে ট্রেনে উঠে পড়া কি খুব কঠিন,যখন সে কোচ নম্বর,বার্থ নম্বর-সবই জানে?”

আমি অশুভ কিছু আশঙ্কা করছিলাম। বললাম, “নিকি,এক্ষুনি বস্টনে একটা লং ডিসট্যান্স কল করতে হবে। যদিও ব্যাপারটা পাগলামির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে,তবুও!”

 নিকির চোখদুটো চকচক করে উঠল,জিভ দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে সে বলল, “কর।”

*******

bideshinoymile02 (Medium)খানিক বাদে টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে বললাম, “নিকি,এটা সম্ভবত ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমাপতন। গত রাতের বারোটা সাতচল্লিশের ওয়াশিংটনের ট্রেনে একজন তার বার্থেই খুন হয়েছে। ঘন্টাতিনেক আগেই খুনটা হয়েছে,যেটা হ্যাডলির ক্ষেত্রে একদম মিলে যাচ্ছে।”

“আমি এইরকমই একটা কিছু ভাবছিলাম,” নিকি বলল, “তবে তোমার একটু ভুল হয়েছে,এটা কাকতালীয় নয়। হতেই পারে না। তুমি কথাটা কোথায় শুনেছিলে?”

“এটা এমনি একটা কথা।এমনিই এসেছিল মাথার মধ্যে।”

“অসম্ভব।এটা সাধারণ কোন কথা নয় যে এমনিই মাথায় চলে আসবে।তুমি যদি কাউকে দশবারোটা শব্দের কোন লাইন বলতে বল,দেখবে সে সাধারণ কোন কিছু বলবে,যেমন, “আমি দুধ খেতে পছন্দ করি,কারণ এটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল।” কিন্তু তুমি যেটা আমাকে বললে,সেটা নির্দিষ্ট কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।”

“কিন্তু আমি বলছি,আমি আজ সকালে কারো সঙ্গে কথা বলিনি। আর ব্লু মুনে তোমার সঙ্গে আমি একাই ছিলাম।”

“আমি যখন বিল মেটাচ্ছিলাম,তখন কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে ছিলে না। ওই সময়ে তুমি কি বাইরে কারো সঙ্গে দেখা করেছ?”

আমি মাথা নাড়লাম, “বাইরে তো আমি মিনিটখানেকেরও কম সময় একা ছিলাম,তারপরই তো তুমি চলে এলে। তুমি যখন টাকা বের করছিলে,তখন দুটো লোক ঢুকল,তার মধ্যে একজনের সঙ্গে আমার ধাক্কাও লাগল,তাই ভাবলাম আমি বরং বাইরে অপেক্ষা করি-”

“ওদের কি আগে দেখেছ?”

“কাদের?”

“যে দুটো লোক ভেতরে ঢুকল?” নিকির গলায় আবার উত্তেজনার সুর।

“না,মানে-নাঃ,ওদের কাউকেই আমি চিনি না।”

“ওরা কিছু বলছিল?”

“মনে হচ্ছে হ্যাঁ। হ্যাঁ,বলছিল। খুব গভীর কিছু আলোচনা করছিল নিজেদের মধ্যে,নাহলে ওরা আমায় খেয়াল করত আর আমি ধাক্কাও খেতাম না।”

 “খুব বেশি বাইরের লোক কিন্তু ব্লু মুনে আসে না,” সে মন্তব্য করল।

“তাহলে কি ওরাই নাকি?”আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম,”আমার মনে হচ্ছে ওদের আবার দেখলে চিনতে পারব।”

নিকির চোখ ছোট হয়ে এল। “সম্ভবত। দুজনকে থাকতে হবে-ওয়াশিংটনে একজন শিকারের পিছু নেবে,তার বার্থ নম্বরটা দেখবে,আরেকজন এখানে থাকবে,কাজটা শেষ করার জন্য। ওয়াশিংটনের লোকটা সম্ভবত পরে এখানে আসবে-যদি এটা চুরি হয়,তার সঙ্গে খুন,তাহলে লুঠের মাল ভাগাভাগির জন্য,আর যদি শুধুই খুন হয়,তাহলে সম্ভবত ওকে আসতে হবে পারিশ্রমিক মিটিয়ে দেওয়ার জন্য।”

আমি টেলিফোনের দিকে এগোলাম।

“আমরা ওখান থেকে বেরিয়েছি আধ ঘন্টাও হয়নি,” নিকি বলল, “ওরা সদ্য ওখানে গেছে,আর ব্লু মুনে খাবার দিতে দেরি হয়। যে লোকটা হ্যাডলি অবধি পুরো রাস্তাটা হেঁটেছে,সে নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত থাকবে,আর অন্যজন সম্ভবত ওয়াশিংটন থেকে সারারাত গাড়ি চালিয়ে এসেছে।”

“গ্রেফতার করতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে,” নির্দেশ দিয়ে আমি ফোনটা নামিয়ে রাখলাম।

 টেলিফোনটা বাজল অবশেষে। আমি শুনলাম,সেটা নামিয়ে রাখলাম,নিকির দিকে ফিরলাম।

“একজন রান্নাঘর দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল,কিন্তু উইন ওখানে একজনকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল,শেষ অবধি ধরে ফেলেছে ওকে।”

 “তাহলে একটা জিনিস প্রমাণ হয়,” নিকির মুখে বরফকঠিন শুকনো হাসি।

আমি মাথা নাড়লাম।

নিকি ঘড়ি দেখে চেঁচিয়ে উঠল,”দেখেছ! আমার আজ তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করার কথা,আর আমি কিনা তোমার সঙ্গে এখানে বকবক করে সময় নষ্ট করছি!”

আমি দরজার কাছে গিয়ে বললাম, “নিকি,তাহলে কী প্রমাণ হল?”

“প্রমাণ হল যে কতগুলো সিদ্ধান্তের পরম্পরা যুক্তিপুর্ণ হয়েও সত্য নাও হতে পারে,”সে বলল।

“ও।”

“হাসছ কেন?” সে বলল,তারপর সেও হেসে ফেলল।

 ছবিঃ মৌসুমী