বিদেশী গল্প-রাশিয়ান-দুখপুঁটুলির গল্প-নিসবেট বেইন-অনুবাদ-দেবজ্যোতি-বর্ষা ২০১৬

bideshirussian (Medium)এক গ্রামে থাকত দুই ভাই। একজন বড়োলোক। তার ভাগ্য বেজায় ভালো। ধুলোমুঠি ধরলে সোনামুঠি হয়ে যায় তার। অন্যজন গরিব। তার মত দুর্ভাগা দুটি নেই দুনিয়ায়।

বড়োলোক ভাই কিছুদিনের মধ্যেই অনেক টাকাপয়সা জমিয়ে শহরে উঠে গেল। সেখানে তার বেজায় বড়ো প্রাসাদ, বিরাট ব্যাবসাপত্র। ওদিকে গরিব ভাই গরিব হতে হতে এমন দশা যে বাড়িতে তার ছেলেমেয়ের মুখে জোগাবার জন্য রুটিটুকুও জোটে না। বাচ্চারা তার খাবারের জন্য কেঁদে কেঁদে ভিক্ষে করে। একদিন গরিব ভাই নিরুপায় হয়ে বড়োলোক ভাইয়ের কাছে গিয়ে হাত পেতে দাঁড়াল, “আমায় একটু সাহায্য করবি দাদা?”

“কেন করব না? আমার তো অনেক আছে। আমার এখানে এ সপ্তাহটা কাজ কর, আমি তোকে সাহায্য করব।” বড়োভাই জবাব দিল।

“একশোবার,” বলে ছোটোভাই তক্ষুণি কাজে লেগে পড়ল।  বাড়ির উঠোন ঝাঁট দিল, ঘোড়াদের দলাইমলাইকরল, চুলোর জন্য কাঠ চিরে দিল।

সপ্তাহ শেষ হতে বড়োভাই তাকে দিল একটা ফুটোপয়সা আর একটুকরো রুটি।

“যা দিলি তাই সই। তোকে ধন্যবাদ,” বলে ছোটোভাই সেই নিয়ে বাড়িমুখো রওনা হবে তখন হঠাৎ বড়োভাইয়ের বিবেক দংশন হল একটু। ছোটোভাইকে ডেকে সে বলল, “এমনভাবে চলে যাস না। কাল আমার জন্মদিন। ভালো করে খেয়েদেয়ে তারপর যাস।”

রয়ে গেল ছোটোভাই। কিন্তু জন্মদিনের ভোজে এত গণ্যমান্য লোকের ভিড় হল যে তাদের খাতিরদারি করতে করতে বড়োভাই বিলকুল ভুলেই গেল ছোটোভাইয়ের কথা। তারপর ভোজ শেষ হয়ে গেল। গণ্যমান্য অতিথিরা সবাই হাসতে হাসতে , গান গাইতে গাইতে বাড়ি চলে গেল। ছোটোভাইয়ের খাওয়া জুটল না।

গরিব ভাই খিদে নিয়েই নিজের বাড়ির পথ ধরল। যেতে যেতে সে ভাবল, আমিও গান গাইতে গাইতে যাই। তাহলে লোকে ভাববে দাদা আমাকেও যত্ন করে খাইয়েছে। এই ভেবে ছোটোভাই তো গান ধরেছে। আর ধরেই বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে থেমে গেছে সে। কারণ ঠিক তার পেছনে কে যেন সরু গলায় গান ধরেছে তার সঙ্গে।সে থামতে গলাটাও থেমে গেছে। ফের যেই সে গান ধরেছে, পেছন থেকেও গুণগুণিয়ে উঠেছে সেই গলা।

“কে রে আমাকে ভ্যাঙাচ্ছিস? সামনে আয় দেখি,” হেঁকে উঠল ছোটোভাই। সঙ্গেসঙ্গেই একটা রাক্ষস এসে দাঁড়াল তার সামনে। বেচারার চেহারা ভারী দুর্বল। চামড়া হলদে হয়ে কুঁচকে গেছে তার। গায়ে ছেঁড়া জামাকাপড়। হাতেপায়ে ন্যাকড়া জড়ানো। মরোমরো দশা তার।

গরিব ভাই তো দেখে বেজায় ভয় পেয়েছে। কোনমতে সে রাক্ষসকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কে হে?”

“আমি হলাম গোর-গোরিনসকো, মানে দুখপুঁটুলি” রাক্ষস বলল, “তোকে দেখে আমার মনে ভারী দয়া হয়েছে। আমি তোকে গান গাইতে সাহায্য করব।”

“বেশ। তাহলে চল গোরে,” বলল গরিব ভাই। তার ভয়টয় চলে গেছে তখন, “চল আমরা হাতে হাত ধরে দুনিয়াটা ঘুরি। নিজের ভাই যখন দাগা দিল, তখন তুইই সই।”

“চল মালিক। আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না।” গোরে জবাব দিল।

“তা, যাব কীসে?”

“তুমি কীসে যাবে আমি তা জানি না কিন্তু আমি যাব তোমার কাঁধে চেপে,” এই বলে রাক্ষস এক লাফে গিয়ে গরিব ভাইয়ের কাঁধে চেপে বসেছে। গরিব ভাই আর কী করে? টালমাটাল পায়ে সেই দুঃখের বোঝাটাকে টানতে টানতে সে চলল। তার কাঁধে বসে রাক্ষস মনের আনন্দে গান ধরল আর একটা ছোটো লাঠি দিয়ে তার পিঠে দমাদম মারতে মারতে তাল দিতে লাগল। বলে, “তা মালিক, আমার পছন্দের একখানা গান তোমায় শেখাব নাকি? শোনো তবে গাই—

“আমি হলাম দুখপুঁটুলি সকল দুখের সেরা

গায়ে আমার ময়লা কাপড় এদিকওদিক ছেঁড়া

(আমার) সঙ্গে যদি থাকলে গো

(দুঃখু )সাথে রাখলে গো

যদি সঙ্গে না রয় পয়সাকড়ি

জলদি আনো জোগাড় করি

দুখের দিনে একটা কড়ি

নাহয় সাথে রাখলে গো?

কেমন গান বলো মালিক? তাছাড়া তোমার সঙ্গে দেখছি পয়সা একখানা আছে। খানিক রুটিও আছে। তবে আর চিন্তা কী? চলো ঘুরতে বের হই দুজনে মিলে।”

এই বলে তারা দুজন এদিকসেদিক ঘুরতে ঘুরতে, খাওয়াদাওয়া করতে করতে অবশেষে একদিন গরিব ভাইয়ের  ঘরে গিয়ে পৌঁছাল। ঘরে তো গরিব ভাইয়ের বউছেলেমেয়ে তখন না খেতে পেয়ে বসে বসে কাঁদছে। সে রাত্তির তো কাটল কোনমতে। পরদিন রাক্ষস গরিব ভাইকে ডেকে বলে, “খানা লাও।”

“পয়সা নেই যে একটাও। খানা আনব কী দিয়ে?” গরিব ভাই জবাব দিল।

“কেন কাল গানের মধ্যে বললাম না, না থাকলে জোগাড় করে আনবি? যা, তোর লাঙল, স্লেজ সব বাঁধা দিয়ে পয়সা নিয়ে আয়।”

গরিব ভাই আর কী করে? দুখের পুঁটুলি তখন তার কাঁধে এমন চেপে বসেছে যে নিঃশ্বাস নেয়া দায়। তাড়াতাড়ি সে তার কথামতন কাজ করে সব বেচেবুচে দিয়ে সেই পয়সায় তার রাক্ষসকে সঙ্গে নিয়ে সারাটাদিন দোকানে দোকানে খেয়ে আর মজা করে ঘুরে বেড়াল। দিনের শেষে দেখা গেল দুখপুঁটুলির দুঃখ আরো বেড়ে গেছে। গরিব ভাইয়ের কাঁধে বসে বসে সে তাকে লাঠিপেটা করে আর বলে, “ওরে, এবারে তুই নিজেকে বেচে দে। তারপর চল সেই পয়সা নিয়ে খানাপিনা হবে।”

গরিব  ভাই বুঝল এইবারে একেবারে সর্বনাশ হতে চলছে তার। তখন সে বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, “বুড়োমানুষদের কাছে শুনেছি এইখানে একজায়গায় মাটির অনেক তলায় সাত রাজার ধন পোঁতা আছে। কিন্তু সে এমন ভারী পাথরের নীচে পোঁতা যে আমি একলা তাকে তুলতে পারব না। বুঝলে কিনা দুখপুঁটুলি, সেই সাত রাজার ধন যদি আমরা খুঁড়ে তুলতে পারতাম তাহলে, কত যে খানাপিনা হত তার ইয়ত্তা নেই।”

শুনে দুখপুঁটুলি তো বেজায় খুশ। দুনিয়ায় সে পারে না হেন কাজ নেই। বলে, “চল দেখি কোথায় তোর সাত রাজার ধন চাপা দেয়া পাথর!”

এদিকওদিক ঘুরে গরিব ভাই দুখপুঁটুলিকে নিয়ে এল এক বিরাট পাথরের সামনে। দশটা জোয়ান মিলে তাকে একচুল নড়াতে পারে না। দুখপুঁটুলি হাসতে হাসতে তাকে এক টানে তুলে ফেলতেই—কী আশ্চর্য!! সত্যিই তার নীচে দেখা গেল একটা সিন্দুক। তার ভেতরে অন্ধকারে চকমক করছে কী একটা যেন।

“শিগগির ওর মধ্যে ঢুকে ধনরত্নগুলো তুলে আন রে দুখপুঁটুলি,” বলে উঠল গরিব ভাই। শুনেই তো রাক্ষস গিয়ে ঢুকেছে সিন্দুকের ভেতর। আর ভেতর থেকে চিৎকার করে বলছে, “মালিক দেখ এসে। এখানে দুনিয়ার সেরা ধনরত্ন জমা রয়েছে গো। কুড়ি ঘড়া মোহর!!”

বলতেবলতেই সে একখানা ঘড়া তুলে গরিব ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। গরিব ভাই ঘড়াটা কাঁখে নিয়েই অন্য হাতে ধরে রাখা পাথরটাকে দিয়েছে ছেড়ে। সেটা গিয়ে ফের সিন্দুকের মুখে পড়তে ওপর থেকে সে হেঁকে বলল, “এইবারে তুই বাকি সোনা নিয়ে পচে মর।”

এই বলে সোনার ঘড়া নিয়ে সে রওনা দিল বাড়ির দিকে। বাড়ি ফিরে ঘরদোর সেই পয়সায় সারিয়েসুরিয়ে অনেক গরুভেড়া কিনে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সে নতুন করে ব্যাবসা শুরু করে দিল। এক বছ্রের মধ্যে তার কুঁড়েঘরের জায়গায় উঠল বিরাট কাঠের প্রাসাদ।

এইবার একদিন সে শহরে গিয়ে তার বড়োলোক ভাইকে নেমন্তন্ন করল তার বাড়িতে খাবার জন্য।

“আমায় নেমন্তন্ন করছিস তুই? বলি ভেবেছিসটা কী রে?” বড় ভাই টিটকিরি দিয়ে উঠল, “এই তো কদিন আগে পেটে ভাত ছিল না, পরবার কাপড় ছিল না।”

“আহা একবার এসেই দ্যাখো না দাদা,” গরিব ভাই জবাব দিল, “আমার অবস্থা তোমার চেয়ে মোটেই খারাপ নয় এখন।”

পরদিন গরিব ভাইয়ের বাড়ি খেতে গিয়ে বড়োলোক ভাইয়ের তো চোখ কপালে উঠেছে। বলে, “কোত্থেকে এতকিছু করলি রে তুই ভাই?”

গরিব ভাই তখন সব খুলে বলল তার দাদাকে। শুনে বড়োলোক দাদা মনে মনে ভাবল, “ছোটোটা একটা বোকা। নইলে উনিশ ঘড়া মোহর ছেড়ে এক ঘড়া নিয়ে সুখে থাকে? এইবারে আমি গিয়ে বাকি মোহরগুলো নেব। দুখপুঁটুলিটাকেও ছেড়ে দেব যাতে বোকাটাকে ফের তাড়া করতে পারে।”

এই ভেবে বড়োভাই চলল সেই পাথরের কাছে। অনেক কসরত করে যেই না সে পাথরটাকে একটুখানি সরিয়েছে অমনি তার ফাঁক দিয়ে সিন্দুকের মুখ দেখা দিয়েছে। বড়োভাই যেই সেখানে উঁকি মেরেছে কী আছে দেখতে, আর সেই ফাঁকে তার ভেতরে আটকা দুখপুঁটুলি  বেরিয়ে এসে অমনি চেপে বসেছে তার কাঁধে, আর কানে কানে চিৎকার করে বলেছে, “বদমাশ, পাজি, আমাকে ঠকিয়ে গর্তে ফেলা হয়েছে? আমায় আটকে রাখা হয়েছে? দেখি এইবার তুই কেমন করে পালাস। আর কোনদিন তোকে ছাড়বে না তোর দুখপুঁটুলি।”

বড়োভাই যত বলে, “ওরে আমি সে নই, সে অন্য লোক,”  রাক্ষস তত গর্জায়, “দেখতে তো একইরকম। ভাবছিস মিথ্যে বলে আমায় ঠকাবি? আমি তোকে আর ছাড়ছি না।”

বড়োভাই কী আর করে? কাঁধে করে দুখের পুঁটুলিকে সে বয়ে নিয়ে গেল তার বাড়িতে। তার ধনরত্ন সব জলে গেল, সে এখন দুখপুঁটুলির সঙ্গে পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়ায়। ছোটোভাই অবশ্য এখন সুখেই আছে।

নিসবেট বেইনের ইংরিজি অনুবাদ থেকে

বাংলা ভাষান্তর-দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য