রাশিয়ান গল্প

সোনার পাহাড়- বাংলা ভাষান্তরঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

bnibdeshirussian (Small)

অনেক কাল আগে এক দূরের দেশে ছিল এক বেনের ছেলে। বেণে মানে জানো তো? তারা হল ব্যবসায়ী। জাহাজে চেপে দূর দূর দেশে ব্যাবসা করতে যায়। তা সে ছেলের বাবা মারা গিয়েছিল এমনি এক দূরদেশে ব্যাবসা করতে গিয়ে।

জমা টাকাপয়সা সব শেষ হলে একদিন বেণের ছেলে দেখল, ঘরে আর খাবার নেই। তখন সে করল কি, একটা কোদাল হাতে নিয়ে শহরের বাজারে কাজ খুঁজতে গেল।

সেখানে তো অনেক লোক কোদাল, কুড়ুল এইসব নিয়ে কাজ খুঁজতে এসেছে। তাদের সঙ্গে মিলে অপেক্ষায় রইল বেণের ছেলে। এমন সময় হল কি, ঝমঝমিয়ে জুড়িগাড়ি চালিয়ে হাজির হল একটা লোক। তার গাড়ির চাকা সোনায় মোড়া, আসনে হিরেমুক্তো ঝিলিক দিচ্ছে। ঘোড়ার সাজে সাত রাজার ধন সেলাই করা। কিন্তু মজা হল, তাকে আসতে দেখেই হঠাৎ কাজ খোঁজারু সমস্ত লোকজন বাজার ছেড়ে একেবারে উধাও। সেখানে তখন একা দাঁড়িয়ে রইল সেই ছেলে।

জুড়িগাড়ি তার পাশে এসে থামল। গাড়ি থেকে উঁকি দিয়ে সেই লোকটা জিজ্ঞেস করল, “কী হে ছোকরা, কাজ খুঁজছ বুঝি? তা আমার সঙ্গে কাজ করতে যাবে?”

“যাবো তো বটেই,” ঘাড় নাড়ল বেণের ছেলে, “সেইজন্যেই তো এসেছি। কিন্তু বলি মজুরি দেবে কত?”

“কত চাস?”

“উম্‌ম্‌- দিনে একশো রুবল হলেই কোনমতে চলে যাবে,” বেণের ছেলে জবাব দিল।

“বড্ডো বেশি খাঁই দেখছি তোর?” লোকটা গম্ভীর গলায় বলল।

“তা একটু বেশি বইকি,” জবাব দিল বেনের ছেলে,” কিন্তু তোমায় দেখেই বাজার যে খালি হয়ে গেল। আমি নইলে কাজের লোক আর তুমি পাচ্ছো কোথা?”

খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল লোকটা। তারপর একগাল হেসে বলল, “ঠিক হ্যায়। কাল সূর্য ওঠার সময় জাহাজঘাটায় চলে আয়। আমি অপেক্ষা করব তোর জন্য।”

পরদিন সক্কালসক্কাল জাহাজঘাটায় কোদাল নিয়ে পৌঁছে বেণের ছেলে দেখে জলে ভাসছে একটা বেজায় সুন্দর সোনালী রঙের জাহাজ। তার ডেকের ওপর দাঁড়িয়েছিল আগের দিনের সেই লোকটা। বেণের ছেলেকে দেখে সে একগাল হেসে বলে, “এসেছিস? আয়, আয়, কাজে যাই চল।”

জাহাজ তো ভেসে চলল অকূল দরিয়ায়। একমাস, দুমাস তিনমাস ভেসে চলবার পর সে এসে ভিড়ল একটা দ্বীপের গায়ে। দ্বীপের ভেতরে একটা জায়গায় হলদে আগুন জ্বলছে যেন দাউদাউ করে। সেইদিকে দেখে বেণের ছেলে জিজ্ঞাসা করল, “ও কীসের আগুন?”

লোকটা হেসে বলল, “আগুন নয়। ও আমার সোনার প্রাসাদ। রোদে ঝলমল করছে।

তারপর তো তারা জাহাজ থেকে নেমে লোকটার বাড়িতে গেল। সেখানে দেয়াল, মেঝে, আসবাবপত্র সব সোনার, কিন্তু তাদের সব্বার চেয়ে সুন্দর হল লোকটার মেয়ে। তার সোনার মতন গায়ের রঙ, অন্ধকারের মতন একঢাল চুল আর লাল টুকটুকে ঠোঁট। আর তেমনই মিষ্টি স্বভাব তার।

বাড়ি পৌঁছে লোকটা বলল, “কাজকর্ম কাল হবে। আজ এসো সবাই মিলে আমরা ফূর্তি করি।” তারপর তো শুরু হল খানাপিনা গানবাজনার পালা। আনন্দফূর্তি চলছে এমন সময় বেণের ছেলে দেখে লোকটার মেয়ে তাকে ইশারা করে ডাকছে। কাছে যেতে সে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল তার নিজের ঘরে। তারপর বলল, “তুমি খুব ভালো ছেলে। তবে সামনে তোমার অনেক লড়াই আছে। এইটে সঙ্গে রাখো, বিপদ এলে কাজে দেবে।”

এই বলে সে ছেলের হাতে তুলে দিলো একটুকরো চকমকি পাথর আর একটা লোহার পাত। আর বলল, “বিপদে পড়লে লোহার পাতে চকমকি ঘষে দিও, সব বিপদ কেটে যাবে।”

বেণের ছেলে সেই চকমকি আর লোহা নিয়ে লুকিয়ে রাখল তার আংরাখার নীচে গোপন এক থলের ভেতর।

পরদিন সকালে ঝকমকে রোদ উঠলে লোকটা বেনের ছেলেকে নিয়ে ফের জাহাজে উঠল। বলল, “চল এবারে কাজ করতে যাই।”

অমনি জাহাজ ছুটল পাল উঁচিয়ে জল কেটে। চলতে চলতে চলতে তিন মাস তিনদিন পরে তারা এসে উঠল এক দ্বীপে। তার মাঝখানটায় উঠে গেছে আকাশ ছোঁয়া একটা সোনারঙের পাহাড়।তার খাড়াই দেয়াল দেখলে ভয় লাগে। লোকটা বেণের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠতে উঠতে মেঘের ওপরে চলে গেল। তবু পাহাড়ের চুড়ো মিলল না। পাহাড় হয়ে উঠল আরো খাড়াই। তখন তারা হামাগুড়ি দিয়ে চড়াই বাইতে লাগল। তবু পাহাড়ের চুড়ো মেলে না। সেইখানে পাহাড় একটা থামের মতন খাড়া উঠে গেছে ওপরদিকে। তার গা বেয়ে ওঠা মানুষের সাধ্য নয়।

তখন একটা চ্যাটালো পাথর দেখে তার ওপর বসে লোকটা বলল, “তেষ্টা পেয়েছে নাকি রে?”

বেণের ছেলে ঘাড় কাত করে বলল, “হ্যাঁ তো।”

“বেশ তাহলে আয়, একটু মিঠে শরবত খেয়ে নে দেখি!”

ছেলে তো সোনার পাত্রে ঢালা চমৎকার শরবত এক চুমুকে খেয়ে নিল। এদিকে হয়েছে কি, লোকটা সেই শরবতের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছিল ঘুম বিষ। যেই না শরবত খাওয়া অমনি বেণের ছেলে ঘুমে ঢলে পড়ল। লোকটা তখন করল কি, সঙ্গে আনা ঘোড়াদুটোর একখানাকে মেরে তার পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করে দিয়ে বেণের ছেলেকে কোদাল সহ তার মধ্যে ভরে পেট সেলাই করে দিল আবার। রক্তের গন্ধ পেয়ে তখন আকাশ কালো করে উড়ে এসছে একঝাঁক লোহার ঠোঁটওয়ালা পাখি। যেমন তাগড়া তাদের চেহারা তেমনই কটকটে তাদের গলার আওয়াজ। মরে পড়ে থাকা ঘোড়াটাকে সবাই মিলে ঠোঁটে ঝুলিয়ে নিয়ে তারা উড়ে গেল পাহাড়ের একেবারে চুড়োয়। তারপর ঠোঁট ডুবিয়ে তার মাংস খেতে শুরু করল।

খানিক বাদে ঘোড়া খাওয়া শেষ হতে ছেলের ঘুম ভাঙল। হাঁচোড়পাচোড় করে  ঘোড়ার পেট থেকে কোদাল হাতে বেরিয়ে এসে সে দেখে পাহাড়ের মাথায় সোনা, শুধু সোনা।

তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে নীচে থেকে লোকটা বলে, “এইবার কাজ শুরু করে দে। মাটি কেটে সোনা তোল আর নীচে ফেল।”

বেণের ছেলে তো সোনা কাটতে লাগল। এক দুই তিন করে একে একে বিশ বস্তা সোনা নীচে ফেলে দিল সে। তখন লোকটা সোনার বস্তাগুলো অন্য ঘোড়াটার পিঠে চাপিয়ে নীচের দিকে রওনা দিল।

“আর আমার কী হবে?” ওপর থেকে হেঁকে বলল বেণের ছেলে।

“তোর আবার কী হবে? ওইখানে পড়ে শুকিয়ে মর! এখন অবধি নিরানব্বইটা লোক ওইখানে পড়ে মরেছে। তোকে নিয়ে একশোজন হবে। এ পাহাড় থেকে কেউ জ্যান্ত নামতে পারেনি আজ অবধি।” এই বলে লোকটা ঘোড়া আর সোনা নিয়ে চলে গেল।

বেণের ছেলে তো মহাদুঃখে পাহাড়ের মাথাতেই বসে রইল। সূর্য অস্ত গিয়ে রাত এল। হু হু করে হাওয়া বইতে লাগল। লোহার ঠোঁটওয়ালা পাখিগুলো তার মাথার ওপরে চক্কর কাটতে লাগল। তারা জানে এ ছেলে শিগগিরই পাহাড়ের মাথায় পড়ে মরবে। তখন তাদের ভোজ হবে।

তখন হঠাৎ বেণের ছেলের মনে পড়ে গেল লোকটার মেয়ের দেয়া উপহারের কথা। তাড়াতাড়ি পোশাকের ভেতর থেকে লোহা আর চকমকি বের করে এনে জোরে জোরে ঠুকল সে। অমনি তার থেকে একঝাঁক আগুনের ফুলকি বের হয়ে এসে তাই থেকে তৈরি হল একজন বিরাট মানুষ। মানুষ তার সামনে মাথা নিচু করে বলল, “হুকুম করুন।”

তাই শুনে বেণের ছেলে তাড়াতাড়ি খানিক সোনা তার পোশাকের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে বলল, “আমায় শিগগির এইখান থেকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে চল।”

বিরাট মানুষ তক্ষুনি তাকে কোলে করে নিয়ে সাবধানে পাহাড় থেকে নেমে এক ছুটে তাকে সমুদ্রের ধারে বসিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। সমুদ্র দিয়ে তখন ভেসে যাচ্ছিল একটা জাহাজ। বেণের ছেলেকে দেখে তারা এগিয়ে এসে নোঙর করে তাকে জাহাজে তুলে নিল। তারপর অনেকদিন সমুদ্রে ভেসে ভেসে শেষমেস সে তার দেশে ফিরে এল।

************

দেশে ফিরে সোনাটোনা বেচে বেণের ছেলে দিব্যি আছে। কিন্তু তার খালি মনে পড়ে সেই সোনার প্রাসাদের মেয়ের কথা। ভালোবেসে সে মেয়ে তার প্রাণ বাঁচিয়েছিল যে! অবশেষে একদিন সে ঠিক করল দুষ্টু লোকটাকে সাজা দিয়ে সেই মেয়েটাকে বিয়ে করে আনতে যাবে সে।

অনেক ভেবেচিন্তে সে এক বোতল তুরান দেশের সুরা জোগাড় করে তার মধ্যে খানিক ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে পোশাকের মধ্যে বোতলটা লুকিয়ে নিল। তারপর লম্বা লম্বা চুলদাড়ি গজিয়ে গরিব মানুষ সেজে একটা কোদাল নিয়ে বাজারের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল।

খানিক বাদে ফের ঝমঝমিয়ে জুড়িগাড়ি চালিয়ে হাজির সেই লোকটা। বাজারের সব লোকজন তাকে আসতে দেখেই পালিয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে আছে একলা ছদ্মবেশী বেণের ছেলে। লোকটা তাকে চিনতেই পারল না। কাছে এসে বলে, “কাজ করবি নাকি?”

“করব। তবে মাইনে লাগবে দিনে দুশো রুবল,” বেণের ছেলে জবাব দিল।

“বাপ রে! তোর মাইনে দেখি বড্ডো বেশি?”

“দিলে দাও, নইলে অন্য লোক দেখ গে যাও। পাবে কোথায় অন্য লোক তুমি? সবাই তো তোমায় আসতে দেখেই পালিয়ে গেছে,” বেণের ছেলে জবাব দিল।

লোকটা খানিক ভেবেচিন্তে বলে্‌, “চল তবে আমার সঙ্গে জাহাজঘাটায়।”

জাহাজঘাটায় এসে ফের তারা লোকটার সেই সোনার জাহাজে চড়ে ভেসে গেল গভীর সমুদ্রে। তারপর একদিন জাহাজ গিয়ে সেই সোনার প্রাসাদে পৌঁছোল। রাত্তিরে অনেক খাওয়াদাওয়া ফূর্তি হল, আর তার পরদিন তারা গিয়ে চড়ল সেই সোনার পাহাড়ে।

তার মাঝবরাবর উঠে লোকটা ফের বলে,”তেষ্টা পেয়েছে নাকি?”

বেণের ছেলে বলে, “তা তো পেয়েছে। আমার কাছে এক বোতল তুরান দেশের দারুণ সুরা আছে। চাও তো তোমায় খানিক দিতে পারি।”

শুনে লোকটার চোখ লোভে চিকমিক করে উঠল। বলে, “কই দে দেখি! আগে সেইটে খাই, তারপর দুজন মিলে আমার শরবতটাও খাব।”

বেণের ছেলে তখন পোশাকের মধ্যে থেকে আগে থেকে লুকিয়ে নিয়ে আসা ঘুমপাড়ানি বিষ মেশানো তুরান দেশের সুরা বের করে লোকটাকে খাওয়াল। লোকটার কোন সন্দেহই হল না।

খানিক বাদে যেই না লোকটা ঘুমিয়ে পড়েছে অমনি সঙ্গে আনা দুটো ঘোড়াগুলোর  একখানাকে মেরে ফেলে তার পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করে লোকটাকে একটা কোদালসহ ভরে দিল তার ভেতরে।

তারপর উড়ে এল লোহার ঠোঁটওয়ালা পাখির দল। মরা ঘোড়াকে ঠোঁটে তুলে উড়ে গেল পাহাড়ের চুড়োয়। সেইখানে বসে ঘোড়া খাওয়া শেষ করতে লোকটা ঘোড়ার পেট থেকে বেরিয়ে এসে দেখে সে পাহাড়চুড়োয় আটকা পড়েছে। নীচে থেকে বেণের ছেলে হেঁকে বলল, “আমায় চিনতে পারোনি তুমি। আমি সেই ছেলেটা যাকে তুমি পাহাড়চূড়োয় একশো নম্বর মরা মানুষ হবার জন্যে ফেলে রেখে গিয়েছিলে। আমি জানি কেমন করে ওখান থেকে নামতে হয়।”

“আমায় বলে দে না!” লোকটা মিনতি করে বলল।

“আগে কোদাল দিয়ে পাথর খুঁড়ে চল্লিশ বস্তা সোনা ফেলো নীচে, তারপর বলছি তোমায়,” জবাব দিল বেণের ছেলে।

লোকটা আর কী করে! কোদাল দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে বস্তা বস্তা সোনা ফেলতে শুরু করল নীচে। চল্লিশ বস্তা সোনা হতেই বেণের ছেলে সেই সোনা সঙ্গে আনা ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে বলল, “বদমাশ লোক, তুই নিরানব্বইটা লোককে এইভাবে মেরেছিস। এইবার তুই হবি লোহাপাখিদের একশো নম্বর খাবার।”

এই বলে লোকটার কান্নাকাটিতে মোটে কান না দিয়ে সে ঘোড়া ছুটিয়ে নেমে গেল পাহাড় থেকে। তারপর লোকটার জাহাজে চেপে ফিরে গেল তার সোনার প্রাসাদে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল সেই সোনার মেয়ে। তাকে বিয়ে করে নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে সে সুখেশান্তিতে ঘর করতে লাগল। আর দুষ্টু লোকটার হাড়গুলো পড়ে রইল সেই সোনার পাহাড়ের চুড়োয়। কেউ আর কোনদিন তার খোঁজ পেল না।

পোলেভয়-এর রাশিয়ান স্কাজকি থেকে নিসবেত বাইন এর ইংরিজি অনুবাদ অবলম্বনে।

 জয়ঢাকের সব গল্প একত্রে এই লিংকে