অনুবাদঃমহাশ্বেতা
অবশেষে আমি একদিন তার বাড়িতে গেলাম। সেদিনটা ছিল ক্রিসমাসের ঠিক আগে। আমার জাহাজ তখন বন্দরে আর আমার তিন সপ্তাহ ছুটি। বাম্বল আশপাশে ছিল না। আর আমি একটু ঠাট্টা করেই জিজ্ঞেস করলাম কুকুরটা অবশেষে মারাই গেছে বুঝি?
“হ্যাঁ,” প্র্যাট উত্তর দিল। অতটুকু বলাতেই তার গলার স্বরটা খুব অদ্ভুত ঠেকল আমার। কয়েক মুহূর্ত পর সে আবার বলল, “ওটাকে মেরেই ফেলেছি। আর সহ্য করতে পারছিলাম না।” আমি তাকে প্রশ্ন করলাম সে ঠিক কোন জিনিসটা আর সহ্য করতে পারছিল না। তবে উত্তরটা আমি জানতাম।
“আরে, কুকুরটার একটা বাজে অভ্যেস হয়েছিল। খালি গিয়ে ওই…মানে তার পুরোন চেয়ারটায় গিয়ে বসত আর আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকত।” এই বলে লিউক যেন একটু কেঁপে উঠল। “কিন্তু বিশ্বাস কর, কষ্ট পেয়ে মরেনি বেচারা বাম্বল,” সে প্রবল গতিতে বলে যেতে লাগল, যেন আমায় বোঝাতে চেয়ে যে সে নিষ্ঠুর নয়, “আমি ওর জলে কিছুটা ডায়োনাইন মিশিয়ে দিয়েছিলাম, তাতে ও নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল আর তারপর আস্তে আস্তে ক্লোরোফর্ম দিয়ে…ও কিন্তু এর কিছুই টের পায়নি, স্বপ্ন দেখতে দেখতেও নয়। এরপর থেকেই সব বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে।”
সে যে ঠিক কী বলতে চাইছিল তা আমি বুঝতে পারছিলাম না, কারণ তার মুখের থেকে কথাগুলো যেন জোর করে ঠেলে বেরিয়ে আসছিল। কিন্তু আজ আমি সব বুঝি। ও বলতে চেয়েছিল যে কুকুরটা যাওয়ার পর থেকে আওয়াজটা আর ও অত ঘনঘন শুনতে পেত না। হয়ত ও ভেবেছিল যে আওয়াজটা আসলে বাম্বলরই চাঁদ দেখে চিৎকার, যদিও আওয়াজটা সেই ধরনের ছিল না। অবশ্য লিউক সে কথা না জানলেও এখন তা আমি জানি। তাছাড়া একটা আওয়াজেরই তো ব্যাপার। আওয়াজ তো আর কারুর কোন ক্ষতি করে না। কিন্তু কল্পনাশক্তিটা লিউকের আমার চেয়ে ঢের বেশি ছিল।
হ্যাঁ, জায়গাটায় যা ঘটে চলেছিল তা ব্যাখ্যার বাইরে। কিন্তু যদি আমার সামনে এরকম কিছু হত তাহলে আমি সেটাকে ভূতের নেত্য বলতাম, কিন্তু কখনোই শুধু শুধু ধরে নিতাম না যে জিনিসটা আমাকে মারতে চাইছে। লিউক সারাদিন খালি তাইই ভাবত। আমি সবকিছুর ব্যাখ্যা করতে পারিনা, আপনিও পারেন নি।
আসলে যে একবার সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছে সে কখনোই হলফ করে বলতে পারবে না যে দুনিয়ায় সব ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারে। আগে আমরা জলোচ্ছাস কেন হয় তার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারতাম না, মনে আছে? এখন আমরা বলি সমুদ্রের তলায় ভূমিকম্প হলেই নাকি জলোচ্ছাস হয়। আর আরও পাঁচ গন্ডা থিয়োরি লিখি। তার মধ্যে হয়তো কোনোটাই ভুল নয়। কিন্তু তা তখনই কাজ করবে যখন আমরা সত্যি সত্যি জানতে পারব এই ভূমিকম্পটা আসলে কী। একবার আমাকে এরকম একটা জলোচ্ছাসের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমি বসেছিলাম, হঠাৎ করেই আমার টেবিলের ওপর থেকে কালির দোয়াতটা সোজা গিয়ে আছড়ে পড়ল আমার কেবিনের ছাতে। ক্যাপ্টেন লেকির সাথেও একই জিনিস ঘটেছিল, আমার মনে হয় আপনি তা পড়েছেন, তার ওই “রিঙ্কেলস”-এ। বাহ, ভাল, ভাল। এবার যদি এরকম একটা জিনিস ডাঙায় কোথাও, বা ধরুন এই ঘরটাতেই ঘটত, কোন ভিতুর ডিম ভূত-প্রেত, ম্যাজিক কী না কী টেনে আনত এর ব্যাখ্যা করতে। কিন্তু যেটা শুধু একটা ‘বিস্ময়কর ঘটনা’ বলেই ছেড়ে দেওয়া যায়, সেটাকে নিয়ে এত গণ্ডগোল কেন? এই আমার মত, মশায়।
তাছাড়া, লিউক যে তার স্ত্রীকে খুন করেছে, তারও তো কোন প্রমাণ নেই। আপনি বলেই বলছি, অন্য কেউ হলে আমি তো এরকম একটা কথা ইঙ্গিতও করতাম না। শুধু এই যে আমার লিউককে ওই খুন করার কায়দাটার কথা বলার কয়েকদিনের মধ্যে বেশ কাকতালীয় ভাবেই মিসেস প্র্যাটকে বিছানায় মৃত পাওয়া যায়। আরে দুনিয়ায় কত মহিলাই তো ওভাবে মারা গেছে, শুধু কি ও একা? পাশের প্যারিশ থেকে লিউক এক ডাক্তারকেও ডেকে এনেছিল, আর সেই ডাক্তার আর সে, দুজন মিলে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছিল যে মিসেস প্র্যাট হার্টের কী একটা দোষে মারা গেছেন। এরকম তো হরবখত হয়।
অবশ্য কাছেই একটা হাতাও ছিল। আমি কাউকে সে ব্যাপারে কিছু বলিনি। ওদের শোবার ঘরের আলমারিতে হাতাটাকে দেখেই তো আমি ভিরমি খেয়ে গেছিলাম। একেবারে নতুন ছিল জিনিসটা, লোহার ওপর টিনের পাতলা একটা পরত, দু-একবারের বেশি আগুনে দেওয়া হয়নি। একটুখানি গলানো সিসেও পেয়েছিলাম সেটার মধ্যে, নিচে আটকে ছিল। কিন্তু তাতে কিছুই প্রমাণ হয় না। আরে গ্রামের ডাক্তার জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই নিজের হাতে করে থাকে। তাছাড়া লিউকের সিসে গলানোর আরও তো হাজারখানা কারণ থাকতে পারে। সমুদ্রে মাছ ধরতে ভালবাসতো ও। হয়তো বঁড়শির ওজনের জন্য বা ঘড়ির জন্য ওর দরকার ছিল বস্তুটার।
সে যাই হোক, জিনিসটা পেয়ে আমার বড় অস্বস্তি হয়েছিল। হাতাটাকে আসলে একদম আমার সেই খুনের গল্পের মেশিনটার মত দেখতে ছিল। বুঝতেই তো পারছেন তা দেখে আমার মনের অবস্থা কীরকম দাঁড়াল। জিনিসটাকে একেবারে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। এখনও হয়তো আছে কোথাও সেটা, সমুদ্রের তলায়, স্পিট-এর মাইলখানেক দূরে। কখনো ডাঙায় ভেসেও এলে ক্ষতি নেই। ততদিনে সেটা আর চেনার অবস্থায় থাকবে না।
লিউক নিশ্চয়ই ওটাকে গ্রাম থেকেই কয়েকবছর আগে কিনেছিল। গ্রামে একটা লোক এখনও সেইরকম হাতা বেচে। রান্নার কাজে লাগে বোধহয়। সে যা হোক কোন কৌতুহলী কাজের মেয়ের হাতে যদি সিসেসুদ্ধ সেটা একবার পড়ে যেত, তাহলে আর দেখতে হত না। সে হয়তো প্লাম্বারের ছেলের বউ সেই অন্য মেয়েটাকে গল্পটা শোনাত গিয়ে, সে আবার আমায় ডিনারের সময় সে গল্পটা বলতে শুনেছিল। তার হয়তো মনেও ছিল গোটা ব্যাপারটা।
বুঝতে পারছেন তো গোটা ব্যাপারটা? লিউক প্র্যাট অনেকদিন আগেই ইহলোক ত্যাগ করেছে আর এখন তার সেই বউ-এর পাশের কবরেই রয়েছে সে। কবরের ফলক অনুসারে সে একজন ভাল লোক, কর্তব্যপরায়ণ, সৎ ও খাটিয়ে লোক। আমি আর পুরোন কথা বলে মৃত মানুষটার স্মৃতিটাকে নোংরা করতে চাইনা। স্বামী, স্ত্রী, ছেলে –তিন জনের কেউই আর বেঁচে নেই। আর এমনিতেও লিউকের মৃত্যুর সময় যথেষ্ট ঝামেলা হয়েছিল।
কেমন ঝামেলা? ওর মৃতদেহটাকে সমুদ্রের ধারে পাওয়া গেছিল এক সকালে। আর যথারীতি করোনারকে দিয়ে একটা তদন্ত করানো হয়েছিল গোটা ব্যাপারটাকে নিয়ে। ওর গলার চারধারে অদ্ভুত কয়েকটা দাগ পাওয়া গেছিল। কিন্তু জিনিসপত্র কিছু চুরি বা ছিনতাই হয়নি। শেষমেস আন্দাজ করা হয়েছিল যে “রাক্ষুসে কোন মানুষ বা কুকুরের হাতে বা কামড়ে” মৃত্যু হয় প্র্যাটের। অর্ধেক জুরি ভেবেছিল যে একটা বড় কুকুর প্রথমে ওকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে ওর শ্বাসনালী কামড়ে ধরেছিল, কারণ ওর ঘাড় মটকায়নি। ও যে কখন বেরিয়েছিল, কোথায় যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিল তা কেউ জানতো না। সমুদ্রের ধারে দেওয়ালের গায়ে যেখানে জোয়ারের জলের দাগ, ঠিক সেখানে পড়েছিল। হাতের নিচে ছিল তার স্ত্রীর পুরোন একটা টুপির বাক্স, ঢাকনা খোলা। বাক্সটাতে ও একটা খুলি নিয়ে যাচ্ছিল—আরে ডাক্তাররা এসব করে থাকে কখনও-সখনও। খোলা বাক্স থেকে গড়িয়ে গিয়ে খুলিটা ওর মাথার কাছে পড়ে ছিল। আশ্চর্য রকমের সুন্দরও ছিল সেটা। ছোট্ট, চমৎকার আকৃতির, ও খুব সাদা, আর তাতে মুক্তোর মত নিখুঁত দাঁত। দাঁত বলতে খালি ওপরের সারিটার কথাই বলছি। নিচের চোয়ালটার কোন চিহ্ন ছিল না। অন্তত প্রথম যখন দেখি তখন ছিল না।
হ্যাঁ, এখানে এসে জিনিসটা দেখেছিলাম আমি। জিনিসটা না, খুব সাদা আর চকচকে ছিল, যেন পালিশ করা। ওটাকে কাচের শোকেসে করে সাজিয়ে রাখবার মত করে রেখে দিয়েছিল কেউ। জিনিসটা কোত্থেকে এসেছিল, বা সেটা নিয়ে কীই বা করা হবে, তা কেউ জানত না। তাই বোধহয় ওরা সেটাকে আবার সেই বাক্সে ভরে রেখে বাড়ির সবচেয়ে ভাল শোবার ঘরের আলমারির একটা তাকে তুলে রেখেছিল বস্তুটাকে। আমি বাড়িতে থাকতে এলে আমাকে ওরা সেটাকে দেখিয়েও দিয়েছিল। খালি একটা জিনিসেরই কেউ কোন ব্যাখ্যা করতে পারেনি। খুলিটা বালির ঢাল বেয়ে নিচে সমুদ্রের দিকে গড়িয়ে যাওয়ার বদলে লিউকের মাথার কাছে উঠল কী করে? তখন আমার ব্যাপারটা সেরকম অদ্ভুত লাগেনি, মশায়। কিন্তু পরে অনেক ভেবেছি এই নিয়ে। ঢালটা বড়ই খাড়া। কালকে আপনাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে না হয় দেখিয়ে দেব, যদি আপনি চান। পরে সেখানে পাথর দিয়ে আমি একটা স্তম্ভমতন বানিয়ে রেখেছি।
এরপর আগামী সংখ্যায়