বইপড়া-ইকারাস-গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়- রিভিউ করলেন স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় -শরৎ২০২২

প্রকাশক : শিশু সাহিত্য সংসদ
আলোচক- স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় 
দাম : ১০০ টাকা
অর্ডার করতে --
http://samsadbook.com/product-details/icarus

bookreviewicarus

যারা কল্পবিজ্ঞানের গল্প পড়তে ভালোবাসে, তাদের এক অবশ্যপাঠ্য বই হল ইকারাস। আর যারা কল্পবিজ্ঞানের গল্পের রসাস্বাদন এখনও তেমনভাবে করে ওঠে নি, তাদেরও অবশ্যপাঠ্য ইকারাস, কারণ এই বইটা পড়লে তাদের মনে কল্পবিজ্ঞানের গল্প সম্পর্কে আগ্রহ জাগতে বাধ্য। ইকারাসকে অবশ্য গল্প না বলে একটি ছোট উপন্যাস অথবা উপন্যাসিকা বলাটাই সমীচীন। ইকারাসের কাহিনী শুরু থেকেই বেশ গতিশীল, আর তারপর যেমন যেমন ভাবে কাহিনী এগিয়েছে, প্রতি পদেই এর পর কি ঘটতে চলেছে তাই নিয়ে মনের মধ্যে একটা আকুতি থেকে যায়।

ইকারাসের কাহিনী শুরু হচ্ছে শ্রীহরিকোটা রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে। সেখানে সবাই ভীষণ উত্তেজিত কারণ মিশন সম্পাতি প্রথম বার এক গ্রহাণুর মাটি স্পর্শ করতে চলেছে, যার নাম ইকারাস। ভারতীয় বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক প্রসূত এই মহাকাশ মিশন পৃথিবীর মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত খুলতে চলেছে। ভারতীয় এবং বাঙালী মহাকাশ গবেষক চন্দ্রশেখর, জার্মান মহাকাশবিদ হেরম্যান ও ইসরোর মহাকাশযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রাক্তন পাইলট ওয়াসিম পাড়ি দিয়েছেন ইকারাস গ্রহাণুতে। হেরম্যান চৌম্বক এক মেরু কণা বা ম্যাগনেটিক মনোপোল নিয়ে উৎসাহী আর চন্দ্রশেখরের মতে সেই কণার বাস্তব অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে সূর্যের কাছাকাছি। অথচ সূর্যের অত কাছে সাধারণভাবে কোনও মানুষ বা যন্ত্র গেলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, পর্যবেক্ষণ তো অনেক দূরের কথা। চন্দ্রশেখরই এর সমাধান বাতলান, পৃথিবীর কাছাকাছি থাকা কোনও গ্রহাণু, যাদের নিয়ার আর্থ অ্যাস্টেরয়েড বলা হয়, তাদের মধ্যে কোনও একটাতে পর্যবেক্ষণের দূর নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রপাতি বসিয়ে দিলে, সে যখন সূর্যের খুব কাছ দিয়ে পরিক্রমণ করবে, তখন তার পর্যবেক্ষণ করা তথ্য বিশ্লেষণ করলেই তো কাজ হাসিল। চন্দ্রশেখরের গবেষণার মূল বিষয়ই এই নিয়ার আর্থ অ্যাস্টেরয়েডরা, তিনি অঙ্ক কষে এবং পর্যবেক্ষণ করে জানান যে ইকারাসই হল সেই গ্রহাণু যা কিছুকালের মধ্যেই সূর্যের কাছ দিয়ে যাবে, আর তার আরেক বৈশিষ্ট্য হল যে তার নিজের অক্ষের ওপর আবর্তনের যা বেগ তাতে সূর্যের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তার মাত্র একটা দিকই সূর্যের দিকে মুখ করে থাকবে, সেই জন্য অন্য দিকটাতে পর্যবেক্ষণের যন্ত্রপাতি বসিয়ে দিতে পারলে সে যন্ত্র পুড়েও যাবে না, আবার প্রয়োজনীয় তথ্যও সে যোগাতে পারবে।  এই হিসেব মত  চন্দ্রশেখর ও হেরম্যান যেখান যেখান থেকে যা যা অনুমতি ও অন্যান্য সহায়তা প্রয়োজন তা নিয়ে পাইলট ওয়াসিমের সঙ্গে সম্পাতি নামের মহাকাশযানে পাড়ি দেন ইকারাসের দিকে। কিন্তু সেখানে গিয়ে খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই তাঁরা আবিষ্কার করেন এমন কিছু গর্ত ও যন্ত্র যা প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি নয়! তাঁরা তো ইকারাসে পা রাখা প্রথম মানুষ! তাহলে সেখানে এমন কোন বুদ্ধিমান প্রাণী আগে পৌঁছে থাকতে পারে তাঁদের আগে যারা এসব তৈরি করেছে? এখান থেকেই শুরু হয় এক নতুন অনুসন্ধান, যা মিশন সম্পাতির মূল উদ্দেশ্যকেই বদলে দেয়। এর পরে কি কি ঘটতে থাকে তা বইটি পড়লে পাঠকরা অনেক বেশি উপভোগ করবেন এখানে ছোট করে শোনার চেয়ে।

ইকারাসের কাহিনী বুনন অত্যন্ত মনোগ্রাহী, আর খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাঠকদের মনোযোগ ধরে রাখে। আজকের দিনে কল্পবিজ্ঞান হলেও ইকারাসে যে ধরণের মহাকাশ অভিযানের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা সম্ভব হতে হয়তো খুব বেশি দিন দেরি নেই। কল্পিত মহাকাশ অভিযান ছাড়াও ইকারাসে যে সব বিজ্ঞানের কথা আলোচনা করা হয়েছে তা গল্পের ছলে হলেও পদার্থবিদ্যা ও মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু জটিল তথ্য অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাবে পাঠকদের সামনে নিয়ে আসে। যেমন, যেভাবে লাগ্রাঞ্জ বিন্দুর ধারণাটি আলোচনা করা হয়েছে, বা চাঁদে অভিযানের সময়  জ্বালানি বাঁচাবার জন্য  ভর কম করতে চাঁদে নামার  আগে অতিরিক্ত ভরকে চাঁদের কক্ষপথে রেখে আসার সিদ্ধান্তের বিষয়টি এককথায় অসাধারণ। শুধু তাই নয়, মহাকাশ অভিযানের জন্য কি কি বিষয় বিশ্লেষণ করে দেখা হয়, অভিযানের আগে এবং অভিযান চলাকালীন কোনও সিদ্ধান্ত নিতে কি কি বিষয় ভাবা হয় ও কেন সেই সম্পর্কেও পাঠকদের একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয় ইকারাস পড়ে। গল্পের ছলে বিজ্ঞান শিখতে শিখতে চলার এক অপূর্ব অভিজ্ঞতার স্বাদ দেয় ইকারাস, কিন্তু সেই শেখা কখনই ভারি মনে হয় না। একই সঙ্গে জনগণের এক এক অংশের নতুন কিছু সম্ভাবনা দেখলেই অবৈজ্ঞানিকভাবে ভয় পাওয়া আর তাই নিয়ে জনমত তৈরি করা, মিডিয়ার ভূমিকা, বিভিন্ন রাষ্ট্রের ক্ষমতালিপ্সু চরিত্র যা পৃথিবীর সার্বিক কল্যাণের পথে প্রায়ই বাধা সৃষ্টি করে, আবারও সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে – এই বিষয়গুলো সম্পূর্ণ মজার ছলে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে।

সুতরাং ইকারাস সব বয়সের পাঠকের জন্যই এক অত্যন্ত আকর্ষণীয় বই, যা কল্পবিজ্ঞানের আঙ্গিকে লেখা হলেও আদতে এক বহুমাত্রিক সত্যকে সামনে নিয়ে আসে। বইয়ের শেষটিও বড় সুন্দর, প্রাণে নতুন আশার সঞ্চার করে। অত্যন্ত জটিল, গুরুগম্ভীর কিছু বিষয়কে সকলের বোঝার মত করে সরল ভাষায় ও শৈলীতে হাজির করে লেখক তাঁর অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণও বইটির বাকি আঙ্গিকগুলির সঙ্গে ভীষণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ যা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।

 বই পড়া সম্পূর্ণ লাইব্রেরি