গল্প-পয়লা মক্কেল-হারুন অল গুপ্ত-শীত ২০২২

হারুন অল গুপ্তের আগের গল্প –মন্ত্র, গোবরবাবুর আমসত্ত্ব

Golpoharu83

তার আসল নাম ছিল নিত্যগোপাল পাল। দশ বছর ধরে ডিম-মুরগি, গুল-কয়লা এমনকি মুলিবাঁশের বেড়া ইত্যাদি ব্যাবসায় এবং হাতদেখা, তন্ত্রসাধনা, রাজনীতি ইত্যাদি নানাবিধ শিল্পকর্মে অক্লান্ত পরিশ্রম করে, একেবারে কেটে না গিয়ে কারনিকহীন ঘুড়ির মতো যখন লাট খাচ্ছিল, সেই সময় এক ঝড়বৃষ্টির রাতে বিদ্যুতের মুহুর্মুহু ঝলকানি দেখতে দেখতে অমনিই বিদ্যুৎঝলকের মতো নিত্যগোপালের মাথায় আচমকা এসে পড়েছিল সেই নতুন আইডিয়া—গোয়েন্দাগিরি করলে কেমন হয়!

যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ।

কিন্তু নাম যে নিত্যগোপাল। এ-নামে হাত দেখা যায়, পুরুতগিরি করা যায়, তাই বলে গোয়েন্দার নাম হবে ‘নেত্য’!

গোঁফ না থাকলেও ‘বাঘা’ হতে দোষ কী! তাই শেষমেশ সোজা নিত্য ম্যাজিস্ট্রেটের দরবারে গিয়ে উঠল।

ম্যাজিস্ট্রেট সারাদিন বহু নাম বদল করেছেন। বলতে গেলে কাঁড়ি কাঁড়ি। সবার দিকে তাকিয়ে দেখারও ফুরসত হয় না ওঁর। এবার কিন্তু দেখলেন। তাকিয়ে তাকিয়ে, তারিয়ে তারিয়ে, অনেকক্ষণ ধরে। একরত্তি এই মহামানুষ নিত্যগোপাল, নতুন নাম নিচ্ছেন পরাক্রম সিঙ্গি। ঝোলা গোঁফ নাচিয়ে এফিডেবিটে সই করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যাপারখানা কী?”

পরাক্রম ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ধরা দামি সুদৃশ্য কলমটার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল। বলল, “ওই তো স্যার, পুরোনো নামটা পছন্দ হচ্ছিল না, মানে, প্রাইভেট ব্যাপার আর কী!”

“না না, কোর্টে কোনও প্রাইভেট-ট্রাইভেট নেই—সবটাই পাবলিক। বলতে হবে।”

চাপাচাপি করে যখন শুনলেন নিত্যগোপাল গোয়েন্দা হবে, তাঁর আকাশ কাঁপানো হাসির দমকায় ছাদের টিকটিকিটা টুপ করে খসে পড়ল নিত্যগোপালের মাথায়। হাসিটা অপমানকর, ক্ষুব্ধ হওয়ার মতোই। কিন্তু নিত্য খুশি হল। বুঝল, তার ভবিষ্যৎ সুপ্রসন্ন, মাথায় টিকটিকি পতন—পসার না জমে যায় না।

***

পরাক্রম সিঙ্গির নাম কে না জানে! রোজ খবরের কাগজের যেখানে জ্যোতিষীদের সারি সারি ছবি থাকে, সেই পাতায় নিয়মিত একজন গোয়েন্দার মুখ উদ্ভাসিত হয়। বড়ো বুদ্ধি করে বিজ্ঞাপনের জায়গাটা পছন্দ করেছে পরাক্রম। গোয়েন্দার শত্রুরা যাতে চিনে ফেলতে না পারে, সেজন্য চুল-গোঁফ-দাড়িতে সন্ন্যাসী বেশে বেশ জবরদস্ত একখানা ছবি তুলিয়েছে। এতে খামোখা কিছু রোজগারও হয়ে যাচ্ছে।            কারণ, মাঝে-মধ্যেই কিছু উদ্ভ্রান্ত লোক হাত দেখাতে চলে আসে তার কাছে। পরচুলা পর-দাড়ি পরে দেখেও দেয় পরাক্রম।

কিন্তু গোয়েন্দা পরাক্রমের কাছে কেউ আর আসে না।

দুর্বল মন আর ফাঁপরে পড়া মানুষজনের সহজেই চোখে পড়বে ভেবে এমন বিজ্ঞাপন দেওয়া। কিন্তু চারটা বৃথাই যাচ্ছে। গাঁয়ে জমিজিরেত, চাষ-আবাদ কিছু আছে। একা মানুষ। ভালোই চলে। তাই বলে পরাক্রম সিঙ্গি এতটুকুতে হারিয়ে যাবে! ফড়িংয়ের জীবন পেয়ে কোনও আহ্লাদ আছে নাকি!

পরাক্রমের বসার ঘরে একটা ছোট্ট টি-টেবিল। সামনে সোফা। সোফাখানা এমনভাবে রাখা যে বসলেই নজরে পড়বে উলটোদিকের ধবধবে সাদা দেওয়ালের মধ্যে লাল টুকটুকে দুটো লেটার বক্স। একটার উপরে রাশিচক্র-সমেত হাত। অন্যটার উপরে ধোঁয়া বেরোনো রিভলভারের ছবি। আর আছে দক্ষিণা। রিভলভারের নীচে লেখা ‘পাঁচশত টাকা মাত্র’, আর হাতের নীচে ‘একশত এক টাকা’। পাশে একটা বোর্ডে নিয়মাবলি লেখা। যা থেকে মক্কেলরা অ্যাডভান্সের ইঙ্গিতটা সহজে বুঝতে পেরে নিজ নিজ প্রয়োজনমতো বাক্সে প্রথমেই দক্ষিণাটা সেঁধিয়ে দিতে পারে।

দেওয়ালের ও-পাশে আরেকটা ঘর। সেখানে টুলের উপর শিকারি বেড়ালের মতো ওত পেতে বসে থাকে পরাক্রম। বাক্স দুটি এমন কায়দার যে, দক্ষিণা সটান চলে আসে তার হাতে।

কিন্তু হাত দেখে দেখেই বেদম হয়ে যাচ্ছিল পরাক্রম। একবছর হয়ে গেল, মক্কেল কেউ কেউ কদাচিৎ আসে। কিন্তু ওই একশো এক টাকা। পরাক্রম গোয়েন্দার খোঁজে কেউ আর আসে না। ভেবেছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারবে। কিন্তু এ যে কাকের কারবারি হয়ে উঠছে সে। তার সূক্ষ্ম বুদ্ধির পরিচয় দেখে চমৎকৃত হবে এমন কাকাতুয়া কোথায়? ‘আসলে রাশিচক্রটাই যত নষ্টের গোড়া!’ এইসব সাতপাঁচ ভেবে পরাক্রম ঠিক করল হাতদেখার দক্ষিণা বাক্সটা খুলে নেওয়া দরকার।

সেই রাতটা মন দিয়ে ঘুমিয়ে, পরের দিন সকালে উঠে যখন বাক্সটার উৎপাটনে সবে হাত লাগিয়েছে পরাক্রম, অমনি কড়া নড়ল দরজায়। ‘এই সাতসকালে আবার কে এল!’ ভাবল পরাক্রম। তবে একবার কড়া নাড়লেই কখনও শশব্যস্ত হয়ে দরজা খোলে না সে, বরং ধীরেসুস্থে দ্বিতীয় বারের অপেক্ষায় থাকে।

আজও তাই হল। দ্বিতীয় বারের পর দরজা খুলেই যাঁকে দেখল তাঁর মাথায় বাবরি চুল, পাট করা নিখুঁত সিঁথি আর গোঁফজোড়া সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো দু-ধারে ঝুলছে। বয়স পঞ্চাশের উপরেই মনে হয়। পরনে সাদা ফুল শার্ট আর নীল প্যান্ট। জামার বোতামের ফাঁক দিয়ে গেঞ্জি বেরিয়ে গেছে বলে বোঝা যাচ্ছে তেজ আছে ওঁর ভুঁড়ির। দু-হাতে সোনা-রুপো-তামা-লোহা-কাঁসা ইত্যাদি মিলিয়ে মোট সাতখানা আংটি।

দরজা খুলতেই ভদ্রলোক মিষ্টি হেসে বললেন, “নমস্কার! আমার নাম রামনাথ ভটচায।”

দু-হাতের আংটিগুলো প্রথমেই নজরে পড়েছিল পরাক্রমের। সে রুক্ষ স্বরে বলে উঠল, “মাফ করবেন, এখানে আজকাল হাত-টাত দেখা হয় না।”

“আরে রামোঃ! হাত কে দেখাতে এসেছে? হাত দেখাতে হলে জ্যোতিষ মহাসমুদ্র ধন্দধর মহারাজের কাছেই যাব। আমি গোয়েন্দাশ্রেষ্ঠ পরাক্রম সিঙ্গির কাছে এসেছি অন্য কারণে।”

“তবে এক্কেবারে ঠিক জায়গায় এসেছেন। মানে বলতে চাইছি আপনার নিশানা অভ্রান্ত।”

আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল পরাক্রম। গোয়েন্দাগিরির প্রথম মক্কেল নিজে পায়ে হেঁটে এসেছে! ওহ্, আজ সকালে যার মুখ দেখেছিল, সে একশো আটবার ধন্য। কিন্তু কার মুখ দেখেছিল? কার মুখ? মনে হয় ওই কেঁদো ইঁদুরটার মুখ দেখেছিল। তারই পাতা কলে ধরা পড়ে এখন দু-দিনের কারাদণ্ড ভোগ করছে বেচারা। ঠিক আছে, ওকে আগাম মুক্তি দেওয়ার আগে ভালো করে বাতাসা খাওয়াতে হবে। খুশিতে গলে গিয়ে পরাক্রম মনে মনে স্থির করে নিল।

“আমার এলেমটা দেখুন, কেমন এককথায় চিনে নিলাম আপনাকে!” নতুন মক্কেল ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন।

চিনে নেওয়ার কথায় গালে হাত পৌঁছে গেল পরাক্রমের। তাই তো! গালে দাড়ি নেই, মাথায় জটাজুট নেই, চিনল কী করে? শত্রুপক্ষের লোক নয়তো! মুখে বলল, “আশ্চর্য!”

“আরে আশ্চর্যের কী আছে? আমি রামনাথ ভটচায, ছাব্বিশ বছর ধরে প্রাচীন গোয়েন্দাগিরির পুথিপত্র ঘেঁটে আসছি, আর আপনাকে চিনব না? যতই জটাজাল বিস্তার করুন, আপনার বাঁ-গালের ওই তিলটাকে তো মুছে দিতে পারেননি ছবিতে!”

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল পরাক্রম।—“হ্যাঁ, আপনার চোখ আছে বলতে হবে।”

“না না, ও আর কী! ওসব ছেড়ে দিন, বরঞ্চ একটা জিনিস কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না, জানেন।” চিন্তান্বিত রামনাথ ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন।—“ভাবছি কোথাও একটা ভুল হয়েছে। আসলে তিলতত্ত্ব অনুযায়ী, গোয়েন্দাদের কিন্তু বাঁ-গালে তিল থাকা উচিত নয়।”

“কেন?”

“মানে, ওই তিলতত্ত্ব বলে, বাঁ-গালে তিল থাকা লোকজন একটু বোকা হয় কিনা! আসলে হ্যারল্ড জার্ডিনের  বিখ্যাত বই ‘কনফেশনস অফ মোলস’-এর তিনশো তিপ্পান্ন পাতায় ঠিক ওই কথাই লেখা আছে। তাই ভাবছিলাম…”

পরাক্রম লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। এ-হে-হে, ওই সার্ডিন না জার্ডিনের বিখ্যাত বইখানা পড়া হয়নি। পড়া থাকলে বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগে বাঁ-গালের তিলটাকে না-হয় ডান গালে বসিয়ে নেওয়া যেত। আজকাল তো প্লাস্টিক সার্জারি-টার্জারি কত কী হয়। নামই বদলে গেল যেখানে, একটা তিল আর কী এমন বড়ো ব্যাপার! তবু মক্কেলের সামনে অপ্রস্তুত হওয়া ঠিক নয় ভেবে উপন্যাসের হরেক ঝানু গোয়েন্দার মতো রহস্যময় হেসে মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, “আপনি প্রচুর বইপত্র পড়েন দেখছি।”

“প্রচুর, বিস্তর। শুনলে পাগল হয়ে যাবেন।”

“তবে আজ সকালে যদিও ঘুম থেকে উঠেছেন অনেকক্ষণ, কিন্তু কোনও বইপত্র পড়েননি।”

“বাহ্, এক্কেবারে ঠিক বলেছেন, অদ্ভুত! কীভাবে ধরলেন বলুন তো?”

“আপনার চুল দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যেরকম বাবরি চুল আর যেমন টানটান সিঁথে কেটেছেন, দেখলেই বোঝা যায় সকাল সকাল উঠে অনেকক্ষণ ধরে চুলের পরিচর্যা করেছেন।”

“নাইস! কী অবজারভেশন! সেজন্যই ভাবছিলাম, কোথাও একটা ভুল হয়েছে।”

“যাক, আপনার সমস্যাটা বলুন। তিল-টিল নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।”

এ-কথায় রামনাথ ভটচায তাঁর ঝুপো গোঁফজোড়া বাঁ-হাতে সরিয়ে দুটো গালই খুব আরাম করে চুলকে নিলেন। তারপর বললেন, “হয়েছে কী জানেন, আমার একটু গোয়েন্দাগিরির শখ আছে।”

“সে কি! তবে আমার কাছে কেন?”

“সেই কথাতেই আসছি। সেই ছেলে বয়েস থেকে ডিটেকটিভ হওয়ার শখ। তবে আপনার মতো ফিল্ডের কাজকর্ম আমার নয়। রাজ্যের গোয়েন্দা গল্প পড়ি আর বসে বসে ভাবি, ক্রাইমটা কীভাবে হলে গোয়েন্দাকে আরও বেশি প্যাঁচে পড়তে হত। কিংবা ধরুন, আমার ঘরে একটা জিনিস এখান থেকে সরে ওখানে গেল। সব্বাই বলল, ‘আমি সরাইনি’। তাহলে সরাল কে? তখন বসে বসে প্যাঁচ কষে ঠিক ধরে ফেললাম কালপ্রিটকে। অতি সহজ ব্যাপার।”

“ইন্টারেস্টিং! তারপর?”

“তারপর আবার কী? বুঝতে পারলেন কে সরাল? সমস্ত দেওয়া আছে, শুধু ঠিকঠাক প্যাঁচটা কষা চাই। বলতে পারবেন, কে সরাল?”

“ও তো দাদা আপনিই সলভ করে ফেলেছেন। আমি আর কী করব? কোনও হেজে যাওয়া সলভড ম্যাটারে আমার আগ্রহ নেই। আমি চাই ঝাল-ঝাল টক-টক, মানে একদম টগবগে তাজা রহস্য। হয়েছে নাকি তেমন কিছু?”

“হুম।” বলে চুপ করে বসে রইলেন রামনাথ ভটচায। তারপর বললেন, “আপনি ফেস স্টাডি জানেন? মানে, মানুষের মুখ দেখে তার ক্যারেক্টারিস্টিক্স আদ্যোপান্ত বলে যাওয়া?”

পরাক্রম সিঙ্গির যে বেদম বিরক্তি লাগছিল, সে আর বলার কথা নয়। কিন্তু সে ভাব প্রকাশ করলে পাছে পয়লা মক্কেল লক্ষ্মীর ঝুলি নিয়ে কেটে পড়ে, সেই ভয়ে মৃদু গলায় ঠোঁট উলটে বলল, “সে আর এমন কঠিন কাজ কী! আমি তো দেখলেই বলে দিতে পারি কোনটা চোর, কোনটা খুনে।”

“বাহ্, বাহ্! আপনার সঙ্গে মিলছে ভালো। আমিও একটু আধটু পারি। তারপর বুঝলেন, ক’দিন আগে ওই নিয়ে ডগলাস লারউডের একটা বিখ্যাত বই পড়েছিলাম, ‘গো ওয়েন্ট গন’। ওহ্! এখনও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। কী আশ্চর্য পর্যবেক্ষণ ভদ্রলোকের! সারাটি জীবন ওই নিয়ে কাটিয়েছিলেন। শেষের দিকে অবশ্য খুন হয়েছিলেন নিজেরই পরিচিত লোকের হাতে।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটাকেই বলে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। ওরকম হয়। ভদ্রলোক ওই ফেস স্টাডি নিয়ে কাটাতে গিয়ে পরিচিত ঘনিষ্ঠদের দিকে বিশেষ নজর দিতেন না। অর্থাৎ, আপনার ওই লারউড অত্যন্ত অহংকারী মানুষ ছিলেন। অনেকেই সহ্য করতে পারত না। কিন্তু ওই বইয়ের সঙ্গে আপনার এখানে আসার সম্পর্কটা কী?”

“সম্পর্কটা হল, আটকে গেছি।”

“আটকে গেছেন!”

“হ্যাঁ, একটা বন্দুকে এসে—কিছুতেই আর কূলকিনারা পাচ্ছি না।”

“বন্দুক!” নড়েচড়ে বসল পরাক্রম সিঙ্গি। এইবার মনে হচ্ছে মক্কেল আসল কথাটা পাড়বে।

কিন্তু রামনাথ ভটচায হাই তুলে বললেন, “বন্দুক ঠিক বলা যায় না, আসলে গুলি। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে, গুলিও নয়, শুধু একটা তারিখ। ওই তারিখটাই মিলছে না, বুঝলেন!”

এবার বিরক্ত হল পরাক্রম। বলল, “ধুস! তারিখ কি সবসময় মেলে নাকি! এই ধরুন আমি যবে জন্মেছিলাম আর আমার ইস্কুলে যে জন্মতারিখ লেখা আছে সেটা অন্তত তিন বছরের ফাঁক। তার ওপর, এই যে প্রায় তিরিশ বছর ধরে শুনে আসছি পৃথিবীর বয়স চারশো কোটি বছর, চারশো কোটি তিরিশ হল না কখনও—সেটা কি ঠিক? এরকম উদাহরণ তো শয়ে শয়ে পাবেন। ওরকম একটু আধটু হয়, রামনাথবাবু।”

“না না, বুঝছেন না।” হাঁ হাঁ করে ওঠেন রামনাথ ভটচায।—“ওই তারিখটা মিলে গেলে একটা গুরুত্বপূর্ণ রহস্যের পাঠোদ্ধার তো হবেই, উলটে একটা বিশাল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও হয়ে যেতে পারে। আপনি বিষয়টা নিয়ে ভাবুন।”

পরাক্রম সিঙ্গির মাথায় সব জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। অধৈর্য হয়ে বলল, “কী নিয়ে ভাবব? আপনি তো রহস্যটাই বলছেন না। খালি ধানাইপানাই করছেন।”

এ-কথায় কপাল কুঁচকে গেল রমানাথ ভটচাযের। গম্ভীর গলায় বললেন, “লবস্টার টর্টয়েজের নাম শুনেছেন?”

গোয়েন্দাদের বহু কিছু জানা থাকতে হয়। সুতরাং আন্দাজেই পরাক্রম বলল, “মনে হচ্ছে শুনেছি, সেই আমেরিকা না…”

“ঠিক ধরেছেন।” এবার উচ্ছ্বসিত রামনাথবাবু। বললেন, “ভদ্রলোক একজন আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট। ‘ককেশাস ক্যামেরুন’ নামে একটা বই লিখে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন।”

“আবার বই!” স্বগতোক্তি করল পরাক্রম।

“হ্যাঁ, বই! কী লেখা ছিল জানেন? লেখা ছিল ডগলাস লারউডের মৃত্যুর সাতাশশোতম দিনে ছ’টা শেয়াল এক রাত্তিরের মধ্যে কবর খুঁড়ে তাঁর মৃতদেহ বার করে ফেলেছিল। সাংঘাতিক ব্যাপার!”

“সাতাশশো!” মনে মনে দ্রুত হিসেব কষল পরাক্রম। মানে, সাত বছরেরও বেশি সময়! বলল, “দাঁড়ান দাঁড়ান, সাতাশশো দিন বাদে মৃতদেহ না হাড়গোড়, কী পেয়েছিল শেয়ালরা?”

একটু থমকালেন রামনাথ ভটচায।—“কতদিন বললাম, সাতাশশো?” বলে পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বার করে পাতা উলটেই জিভ কাটলেন—“মাপ করবেন, সাতাশশো নয়, সাতাশ দিন।”

“শেয়ালের হানা আর সাতাশ দিন।” এই প্রথম ডায়েরিতে রহস্যের নোট রাখল পরাক্রম।

“তো দেহটা বাইরে এনে শেয়ালেরা প্রায় গোটাটাই খেয়ে ফেলল, শুধু মাথাটা বাদে।” রামনাথ থামলেন।

“কেন, কেন? মাথাটা ছেড়ে দিল কেন?” পরাক্রম ঈষৎ উত্তেজিত।

“আসলে, মাথাটা খাওয়ার আগেই যে শেয়ালগুলো পটল তুলল।”

“কীভাবে? পাহারাদারের গুলি খেয়ে?”

“না মশাই, তখন ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডা, পাহারাদার কোথায়? ওরা বিষ খেয়ে মরল।”

“ডেডবডি খেল, তারপর বিষ খেল… শেয়ালদের এরকম গণ আত্মহত্যার কথা তো শুনিনি কখনও, কিছু কিছু পাখিরা আত্মহত্যা করে শুনেছি।” সুযোগ পেয়ে জ্ঞান ফলাল পরাক্রম।

“না না, সে-সব নয়। ডগলাস লারউডের শরীরে বিষ ছিল, ওর পরিচিতরাই বিষ খাইয়ে মেরেছিল কিনা! তাতেই শেয়ালগুলো কাত।”

“আহা রে!” স্বগতোক্তি করল পরাক্রম।

“সে ঠিক, কিন্তু অন্য একটা রহস্য দানা পাকাল এর থেকে।” রামনাথ একটু কেশে নিলেন।

“রহস্য তো মিটেই গেল, আবার রহস্য পেলেন কোথায়?”

“ওই যে মাথাটা, ওটা নিয়ে তো বলিনি এখনও, ওটাই তো আসল! একটু চা পেলে ভালো হত।”

রাস্তার ও-পারে চায়ের দোকান। অগত্যা পরাক্রম বাইরে বেরিয়ে হাঁক মেরে দু-কাপ চা আর দুটো লেড়ো বিস্কুটের অর্ডার দিল। মনে মনে ভাবল তার গোয়েন্দাগিরির অ্যাডভান্সের সঙ্গে এই চা-বিস্কুটের দামটাও ধরে নিতে হবে।

ঘরের মধ্যে বই বলতে পঞ্চানন ঘোষালের অপরাধ বিজ্ঞানের এক খণ্ড। পরাক্রম কোনোদিন খুলেও দেখেনি বইখানা। গোয়েন্দার চেম্বারে এমন এক-আধটা রাখতে হয় বলেই রাখা। চায়ের অর্ডার দিয়ে ফিরে এসে দেখল, রামনাথ ভটচায বইখানার পাতা ওলটাচ্ছেন। পরাক্রমের চোখে চোখ পড়তেই বললেন, “ডিলিশাস বই বুঝলেন! অপরাধীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে প্রচুর জ্ঞান লাভ করেছি এর থেকে। বাকি খণ্ডগুলো কিনে নেবেন।”

চা এসে গেছিল। চুমুক দিতে দিতে রামনাথ বললেন, “হ্যাঁ, যা বলছিলাম, ওই মাথাটা ঘিরেই জমল রহস্য। সকালবেলায় পুলিশ এসে মাথা আর হাড়গোড় সব তুলতে গিয়ে দেখল মাথার পেছনে খুলিতে একটা ফুটো। আর যায় কোথা! ঝাঁপিয়ে পড়ল গোয়েন্দারা। মাথার ভেতরে পাওয়া গেল একটা ছোট্ট বুলেট। অথচ পুরোনো পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, ডগলাস লারউডের মৃত্যু ঘটেছে বিষক্রিয়ায়। শরীরে অন্য কোনও ক্ষতচিহ্ন ছিল না।”

“হু, এটা একটা রহস্য বটে। গুলিটা এল কী করে?”

“না না, এটাও তেমন রহস্য নয়। তত্ত্বতালাশে জানা গেছে ভদ্রলোককে আগেও একবার হত্যার চেষ্টা হয়েছিল সেই উনিশশো চল্লিশ সালে। তখন তিনি হার্ভার্ডে পড়তেন। আততায়ী চিহ্নিত হয়নি, তবে গুলি করা হয়েছিল আর গুলিটা মস্তিষ্কের এমন জায়গায় আটকে গিয়েছিল, যে বের করে আনতে গেলে মৃত্যু হতে পারত। তা ওই বুলেট নিয়েই উনি কাটিয়ে দিলেন আরও সত্তর বছর। শুধু চোখে কম দেখতেন আর টক খেতে পারতেন না।”

এদিকে কিছুতেই আসল রহস্যটায় আসা যাচ্ছে না দেখে বিরক্ত পরাক্রম ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে লাগল।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে রামনাথ বললেন, “সরি, আপনার মনে হচ্ছে দেরি করিয়ে দিলাম। কোথাও যাওয়ার আছে বুঝি?”

“হ্যাঁ, অন্য একটা কেস নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি। সেখানেই যাব।”

“আর এক মিনিট! যা বলছিলাম, রহস্য হল বুলেট আর বুলেটের উপর খোদাই করা তারিখে। গুলি কালাশনিকভ রাইফেলের আর তার ওপর তারিখ খোদাই করা ছিল ০৮/১৯৩৫।”

পরাক্রমের চোয়াল ঝুলে গেছিল। সে কিছুই বোঝেনি আদতে। তাই দেখে তার ঊরুতে একটা মৃদু চাপড় মেরে রামনাথ ভটচায বললেন, “বুঝলেন তো গণ্ডগোলটা? আরে সে-সময় তো কালাশনিকভ রাইফেলের জন্মই হয়নি! কালাশনিকভ প্রথম তৈরি হয় ওই ঘটনার অন্তত এক যুগ পরে। তাহলে আপনি কী সিদ্ধান্তে আসবেন? আমার অবশ্য ধারণা, অমন রাইফেল আগেই তৈরি হয়েছিল রাশিয়ায় আর তাই দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের হাওয়া করে দিয়েছিল রাশিয়ানরা।”

রামনাথ ভট্টাচার্যের বিশ্লেষণী ক্ষমতায় অবাক হয়ে গিয়েছিল পরাক্রম। এ-কেসটাও প্রায় সলভ করে দিয়েছেন ভদ্রলোক। তবু দু-মিনিট ধরে বসে ‘আজ নিরামিষ, না ডিমের ঝোল—কোনটা রান্না করব’ ভাবতে ভাবতে বলল, “হুম। ইন্টারেস্টিং। কেসটা আমি নিলাম।”

“হ্যাঁ, আপনার মতো নামজাদা গোয়েন্দা কেসটা পেয়ে আনন্দিত হবে বলেই আসা। আর এটা আমার কেস নয়। ইন্টারপোল এর জন্য ওপেন টেন্ডার চেয়ে পাঠিয়েছে। লাখ লাখ টাকার মামলা। আমি কাল এসে সমস্ত রিলেটেড কাগজপত্র দিয়ে যাব। যাই হোক, দয়া করে আপনার ফিটা বলবেন।”

“আমি শুরুতে পাঁচশো নিই।” পরাক্রম বলল।

“আমি আপনাকে সাতশো অ্যাডভান্স করে যাচ্ছি।” বলে পকেট থেকে দুটো পাঁচশো টাকার নোট বের করলেন রামনাথ ভটচায। আর-একবার উঠে ঘরের ভেতর যেতে হল পরাক্রমকে। তারপর তিনশো টাকার চেঞ্জ হাতে ধরিয়ে জীবনের পয়লা মক্কেলকে নমস্কার জানিয়ে বিদায় দিলেন। মনে বড়ো ফুর্তি হল পরাক্রমের। এইবার সে তার মগজের তেজ দেখাবে। ইন্টারপোলের দৌলতে যখন তার নামডাক হবে প্রচুর, তখন রামনাথ ভটচাযকে সে মোটা মাইনেতে অ্যাসিস্ট্যান্ট রাখবে। আর তার চোখ ধাঁধানো অফিসের বাইরে বিশাল বোর্ড ঝুলবে—‘সিঙ্গি ইনভেস্টিগেশন’।

এইসব ভাবতে ভাবতে পঞ্চানন ঘোষালের বইটা তাকে ওঠানোর জন্য হাতে নিতেই নজরে এল বই থেকে একটা কাগজ বেরিয়ে আছে। কৌতূহলী হয়ে কাগজটা বার করে দেখল একটা চিঠি। তাকেই লেখা।

মাননীয় পরাক্রম সিঙ্গিমশাই,

চিঠিটা আপনার এই ঘরে বসে লেখা নয়। রীতিমতন হিসেব কষে নিজের বাড়িতে বসে লেখা। আপনার নিশ্চয় মনে নেই, আমার সঙ্গে আপনার একবার কিছুক্ষণের জন্য আলাপ হয়েছিল। তখনই বুঝেছিলাম গোয়েন্দাগিরির কাজ আপনার নয়। আপনি বড়োজোর মোটা দাগের লোক ঠকানো বুদ্ধি ফাঁদতে পারেন। কাগজে জ্যোতিষীদের পাতায় আপনার নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেখে সেই ধারণা আরও দৃঢ় হল। তখনই মনে মনে দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল একটু। ভাবলাম দেখে আসি আপনি কেমন গোয়েন্দা হয়েছেন!

সবিনয়ে জানাই, আমার দেওয়া পাঁচশো টাকার দুটি নোটই জাল। কিন্তু এত নিখুঁত যে সাদা চোখে ধরা মুশকিল। আরেকটা কথা, এতক্ষণ যেসব গল্প আপনাকে শোনালাম, তা নিতান্তই আজগুবি এবং আমারই বানানো। ওই একটা ঝুঁকিই আমি নিয়েছিলাম। সেটা হল আমার অনুমানমতো আপনার অজ্ঞতার গভীরতা সম্পর্কে আমার ঘোর অনিশ্চয়তা। অবশ্য সেটা না খাটলে বিকল্প ভাবা ছিল একটা। আর-একটা চিঠিও তৈরি ছিল সেজন্য। ঢিলটা লেগে গেছে এ-যাত্রায়। কিছু নাম আপনি আমার গল্পে পেয়েছেন, তালগোল পাকানো যে নামগুলো, ক্রিকেটের কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজ সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা থাকলেই বুঝতে পারতেন।

আমি চাই, আমাকে খুঁজে বার করুন নিত্যগোপালবাবু। মাথাটা খাটালে ক্লুও পেয়ে যাবেন কিছু না কিছু। গোয়েন্দা হিসেবে আপনাকে এটাই আমার চ্যালেঞ্জ রইল। সে-ক্ষেত্রে আপনার টাকা আপনি ফেরত পেয়ে যাবেন, সঙ্গে পুরস্কারও।

ইতি

শুভাকাঙ্ক্ষী রামনাথ ভটচায

মাথায় চাঙর ভেঙে পড়ল যেন। তিনশো টাকা লসে সে মরে যাবে না অবশ্যই, কিন্তু এইভাবে তাকে ঘোল খাওয়াল লোকটা! ছিঃ ছিঃ! টি-টেবিলের উপর পড়ে থাকা আজকের কাগজের বিজ্ঞাপনেও জ্বলজ্বল করছে জটাজুটধারী পরাক্রম সিঙ্গি। মনে হল তার দিকেই তাকিয়ে যেন হ্যা হ্যা করে হাসছে।

দাঁতে দাঁত চেপে খবরের কাগজটা দলামোচড়া করে পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিল পরাক্রম। তারপর রামনাথ ভটচাযের চিঠিটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে থাকতে চোয়াল আরও শক্ত হল তার। অস্ফুটে বলল, “চ্যালেঞ্জটা নিলাম স্যার!”

ঘরের কোণ থেকে একটা টিকটিকি তিন বার ডেকে উঠল—‘ঠিক ঠিক ঠিক’।

অলঙ্করণ- শ্রীময়ী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে