ঈশ্বরের বাসা
অভীক মুখোপাধ্যায়
বহু বছর পরে আজ অনল নিজের স্কুলে এসেছে। এখান থেকেই মাধ্যমিক দিয়েছিল। স্কুলে ঢোকার আগেই মনে পড়ে গিয়েছিল অশোকদার দোকানের কথা। আর দোকান দেখতেই মনে পড়ল কত স্মৃতি। অশোকদার দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল অনল। ও যখন স্কুলে পড়ত, তখনই অশোকদা ষাট পেরিয়ে গিয়েছিল। দাদা বলে ডাকলে কী হবে, বয়সে বাবার থেকেও বড় অশোকদা। সে-ও তো প্রায় সতেরো – আঠেরো বছর আগের কথা। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে, অশোকদা চোখে আবছা দেখে। অনল একা আসেনি। সঙ্গে আছে পুপুন, ওর পাঁচ বছরের ছেলে। অশোকদার দোকানটা অনলের ছোটবেলায় বিস্ময়ের জগত ছিল। কী না মিলত! কারেন্ট নুন, সাঁকী পাঁপড়, লাল – কালো আমচূর, মাছ লজেন্স, মাঞ্জা সুতো, চাঁদিয়াল ঘুড়ি, ক্যাম্বিস বল, গুডবয় খাতা, পাখির খাওয়ার জন্য সমুদ্রের ফেনা, অ্যাকোরিয়ামের মাছে জন্য কেঁচো মায় লক্কা পায়রাও। কিন্তু আজ আর দোকানে সেগুলোর কোনওটাই দেখতে পেল না অনল। পুপুনের চোখেও ধরা পড়ল না বাবার কাছে শোনা গল্পগুলো। সামনে সাজানো ছিল ক’টা কাচের বয়াম। তার কোনওটার সিকিটাক ভরা ছিল ঝুড়িভাজায়, কোনওটার আধাআধি ভরতি ছিল কেক দিয়ে। অশোকদা চিনতে পারল না অনলকে। পুপুন সমানে অশোকদাকে জিজ্ঞাসা করছিল এটা কী, ওটা কী। তারপর একটা খালি বয়াম দেখিয়ে বলল, এতে কী আছে? উত্তর দিতে দিতে বিরক্ত হচ্ছিল অশোকদা। বয়সের ভার একটা সময়ে সরল প্রশ্নকেও জটিল করে তোলে বোধ হয়। একটু কড়া ভাবেই উত্তর দিল অশোকদা, ওতে ভগবান আছে। রাখ, রাখ, নামিয়ে রাখ! জবাব শুনে পুপুন অনলের দিকে তাকাল। অনলও চমকে গিয়েছে। ও বলল, আচ্ছা অশোকদা, ঈশ্বর তো সব জায়গায় আছেন। তুমি শুধু খালি বয়ামটার কথাই বললে কেন? দ্যাখো বাবা, সব ক’টা বয়ামেই কিছু না কিছু আছে, তাই সেগুলোর নাম বলেছি। ওটায় কিছু নেই বলে ভগবান আছে বলে দিলাম। আর এমনিতেও ভগবান তো আর কোনও জিনিস নয়। একটা ভাবের নামই ভগবান। একটু থেমে পুপুনের দুগাল ধরে আদর করে অশোকদা বলল — এমন বিচ্ছুকে ভগবান ছাড়া আর কার নাম বলে শান্ত করব?
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস