।। প্রথম পরিচ্ছেদ।।
রবিবার সকাল ছ’টায় বিমল প্রতিদিনকার অভ্যাসমত প্রাতঃভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। বিমলের বয়স পঁচিশের বেশি নয়। চোখে মুখে বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল ভাব, ঠোঁটের উপর সরু গোঁফের রেখা। তার বলিষ্ঠ গড়ন দেখে কেউই বলবে না যে সে আগাগোড়া কলকাতাতেই মানুষ। এর প্রধান কারণ অবশ্য ওই প্রাতঃভ্রমণ, যার কথা জানুয়ারী মাসের এই কনকনে শীতের সকালেও বিমল বিস্মৃত হয়নি।
নিউ আলিপুর যদিও খোলামেলা জায়গা নয়, তবুও এখানে ছোটোদের জন্য একটি ক্রীড়োদ্যান রয়েছে। সুতরাং বায়ুসেবনের উদ্দেশ্যে বিমল এই পার্কের দিকেই অগ্রসর হল। পার্কে ঢুকে নিজেকে চাঙ্গা করার জন্য এবার সে দৌড়তে আরম্ভ করল। হঠাৎ কী একটা জিনিসে হোঁচট খেয়ে বিমলকে আচমকা থেমে যেতে হল। মাটিতে বাদামী রঙের একটা মানিব্যাগ পড়ে রয়েছে। অদম্য কৌতূহলের সঙ্গে বিমল সেটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ভেতরের কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগল।
এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার। আজ প্রায় একবছর হল বিমল স্বনামধন্য গোয়েন্দা হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। সে অবশ্য কোনও পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ‘অপরাধ তদন্ত বিভাগ’ দ্বারা নিযুক্ত নয়। শখের গোয়েন্দা হিসেবেই সে কাজ করে। বহু রহস্যের জাল বিমল ছিন্ন করেছে, আর তাই সাধারণ কলকাতাবাসীর কাছে তার নাম আদৌ অপরিচিত নয়।
সাতটা নাগাদ বাড়ি ফিরে এসে প্রাতরাশ সেরে বিমল আবার মানিব্যাগটা নিয়ে টেবিলে বসল। ভেতরে রয়েছে মালিকের আইডেন্টিটি কার্ড, একটা ক্যাশমেমো, কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট থেকে দেওয়া মাসিক মাইনে-সম্বন্ধীয় দু’টি দলিল আর ছোটোবড়ো নানা কাগজপত্র। এর প্রত্যেকটি মনোযোগের সঙ্গে নিরীক্ষণ করল বিমল।
প্রথমেই আইডেন্টিটি কার্ড। তাতে ব্যাগের মালিকের ফটো আর তার নীচেই বড়ো বড়ো হরফে লেখা নাম – নিমাইসাধন সান্যাল। ক্যাশমেমোটি গড়িয়াহাটের স্টাইলো দোকানের, আর অন্যান্য কাগজগুলো দেখে বিমল নিঃসন্দেহ হতে পারল যে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের C.M.E. বিভাগই হল নিমাইবাবুর চাকুরীকেন্দ্র। এছাড়া রিপন লেনের জনৈক ডাক্তার বিবেক ভট্টাচার্যের দু’টি প্রেসক্রিপশনও বিমলের নজর এড়াল না।
কিছুক্ষণ পরে বিমল স্থির করল পুলিসের হাতে ব্যাগটা পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। লালবাজার থানার ইন্সপেক্টর পলাশ ঘোষ প্রায়ই বিমলের বাড়িতে গল্পগুজব করতে আসেন, নানা তদন্তের ব্যাপারেও তিনি তাকে সাহায্য করেন। আজও বিমল ফোন করার ঘন্টাখানেকের মধ্যে তিনি তরুণ গোয়েন্দার বাড়ি এসে উপস্থিত হলেন।
“কী ব্যাপার বিমল, আজ এত সকালে হঠাৎ কী দরকার পড়ল?” একগাল হেসে প্রশ্ন করলেন পলাশবাবু।
উত্তর দেওয়ার আগে বিমল ভদ্রলোককে আরামকেদারায় বসতে বলল। তারপর চাকর গোবিন্দকে দু’কাপ চা করতে বলে বাক্যালাপ আরম্ভ করল।
“না, তেমন কিছু না ইন্সপেক্টর ঘোষ। তবে রবিবার আপনার নিশ্চয়ই সময়ের অভাব নেই। একটু গল্প করতে ক্ষতি কী? আর তাছাড়া এই মানিব্যাগটা আপনার হাতে তুলে দিতে চাই।”
“কই, দেখি।” পলাশবাবু হাত বাড়ালেন। তারপর পার্সটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রশ্ন করলেন, “তা, কী জানতে পারলে এটা দেখে?”
“বেশি কিছু না।” বলল বিমল। “এটুকুই উদ্ধার করতে পারলাম যে নিমাইসাধনবাবু কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে কাজ করেন, মাসিক বেতন তিনহাজার টাকা, হিসেবী লোক, তাঁর একটি কালো ও একটি নীল ডটপেন আর একটি ফাউণ্টেন পেন আছে। কালো কলমটি তিনি সচরাচর পকেটে নিয়ে ঘোরেন। কয়েকটা মিষ্টি তুলুন, পলাশবাবু।”
গোবিন্দ এরই মধ্যে এসে চা-মিষ্টি রেখে গেছে। “বাকি সবই তো বুঝলাম, কিন্তু ওই কলমের ব্যাপারটা…” চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন পলাশবাবু।
“খুবই সোজা। কাগজপত্র দেখেই বোঝা যায় ভদ্রলোকের তিনরকমের তিনটি কলম ছিল, যা দিয়ে তিনি হিসেব করতেন। ওর মধ্যে দু’একটি কাগজে কালো কলমটির কালি পড়েছে। আগেই বলেছি যে এটি ডটপেন, আর একমাত্র পকেটে রাখলেই এর থেকে কালি ঝরার সম্ভাবনা থাকে।”
“বেশ বলেছ। কিন্তু এসব কি খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে তোমার মনে হয়?”
“না। তবে এ ব্যাপারে খটকা লাগছে যে কোথাও, এমনকি আইডেন্টিটি কার্ডেও ভদ্রলোক নিজের ঠিকানা লিখে রাখেননি। এছাড়া দেখেছি যে ব্যাগে টাকাপয়সা নেই। সুতরাং, জিনিসটা চোরাই মাল হওয়া অসম্ভব নয়। অর্থাৎ, চোর ব্যাগটা থেকে টাকাকড়ি সরিয়ে সেটা পার্কে ফেলে দিয়েছে।”
“হুঁ, ঠিক বলেছ। যাক গে, নিমাইবাবুর ঠিকানা পাওয়া কঠিন হবে না। তাঁর কর্মস্থলে হানা দিলেই সেটা জানা যাবে। আরেকটা কথা, আইডেণ্টিটি কার্ডের এই ফটোটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। এর আগে যদি ইনি পুলিসের দৃষ্টি আর্কষণ করে থাকেন তাহলে আশ্চর্য হব না। তবে হ্যাঁ, ভদ্রলোকের নাম এর আগে কখনও শুনিনি।”
পলাশবাবু এবার উঠে পড়লেন। দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর বিমল আপন মনেই চিন্তা করতে লাগল। এতে হয়তো চিন্তা করার কিছুই নেই। সামান্য মানিব্যাগ হারানোর কেসও এটা হতে পারে। সবকিছুতেই রহস্য থাকার কোনো কারণ নেই। আর তাই যদি হয় তাহলে ব্যাপারটা মন থেকে মুছে ফেলাই সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা। কিন্তু এও ঠিক যে ব্যাগের মালিক যদি পুলিশের নজর এড়াতে চান তাহলে তিনি নিশ্চয়ই তাঁর ঠিকানা যেখানে সেখানে লিখে রাখবেন না।
। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।।
শুক্রবার বিকেলের দিকে বিমলের ফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলতেই ওদিকে পলাশবাবুর কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হয়।
“হ্যালো বিমল, নিমাইবাবুর ঠিকানা পাওয়া গেছে।”
“এতদিন পরে! একটা সামান্য কাজ সম্পন্ন করতে আপনাদের কেন এত সময় লাগে তা বোধগম্য হয় না।”
“শোনোই না ব্যাপারখানা। নিমাইবাবুর ঠিকানা কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের দপ্তর থেকেই পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটার সাহায্য না নেওয়াই মনস্থ করলাম। মঙ্গলবারের খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন ছেপে দিয়েছি। কিন্তু আজও ব্যাগের সন্ধানে কেউ আসেনি।”
“আসবে বলে মনেও হয় না। আচ্ছা, ঠিকানাটা বলুন তো, লিখে নিই।” বিমল গিয়ে খাতা পেন্সিল নিয়ে এল।
“বলছি, শোনো। ৩৪ রাসবিহারী এভিনিউ, কলকাতা – ৭০০০২৯। বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছাকাছি।”
“বেশ, তাহলে আজ রাখছি।”
ফোন রেখে বিমল বেরোবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিল। তার একটা কারণ এই যে নিমাইসাধন সান্যালের ঠিকানা লিখে রাখার সময় খাতায় টুকে রাখা ডাক্তার বিবেক ভট্টাচার্যের ঠিকানাও তার চোখে পড়ে গেছে। এই দু’টি জায়গায় অনুসন্ধান করা দরকার।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বিমল লালবাজার থানায় চলে গেল, আর সেখানে পলাশবাবুর কাছ থেকে মানিব্যাগটি সংগ্রহ করে নিল। তারপর সেখান থেকে রিপন লেন পৌঁছতে লাগল পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
ডাক্তার ভট্টাচার্যের ডাক্তারখানায় প্রবেশ করে বিমল দেখল যে চেয়ারে উপবিষ্ট বৃদ্ধ ডাক্তারবাবু ছাড়া ঘরে অন্য কোনও ব্যক্তি নেই। বিবেকবাবুর বয়স পঞ্চান্নের কাছাকাছি। মাথায় চকচকে টাক, গোঁফদাড়ি কামানো। বিমলের দিকে তিনি সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।
বিমল নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “ডাক্তার ভট্টাচার্য, আপনার কাছে আসতে হয়েছে একটা বিশেষ কাজে। আশা করি আপনি এই ব্যক্তির সন্ধান আমাকে দিতে পারবেন।” বিমল নিমাইসাধনবাবুর আইডেন্টিটি কার্ড এগিয়ে দিল। “ইনি ন’বছর আগে আপনার ডিসপেনসারিতে এসেছিলেন। অন্তত এঁর কাছে পাওয়া দু’টি প্রেসক্রিপশন তো তাই বলে।”
“না, এ নামে তো আমি কাউকে চিনি না। আমি এই রিপন লেনে আছি কুড়ি বছর ধরে। আমার অধিকাংশ পেশেন্টই হল আমার পাড়ার প্রতিবেশী। আর এ অঞ্চলের সবাই প্রায় আমার জানা। কিন্তু মিস্টার সান্যালের হদিস আমি আপনাকে দিতে পারব না। তবে হ্যাঁ, ফটোটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। হয়তো ইনি বাইরে থেকে এসেছিলেন। কিন্তু বাইরে থেকেও তো বড়ো একটা কেউ আসে না।”
“তাহলে আজ উঠি। অশেষ ধন্যবাদ। খুব বিরক্ত করলাম আপনাকে।”
ডাক্তার বিবেক ভট্টাচার্যের ডিসপেনসারি থেকে বেরিয়ে বিমল ভাবতে লাগল। ডাক্তার ভট্টাচার্যের ডাক্তারখানায় বাইরে থেকে বিশেষ কারোর সমাগম হয় না। আর মিঃ সান্যাল থাকেন বালিগঞ্জে। তার মানে কি এই যে নিমাইবাবু এককালে রিপন লেনেই থাকতেন? কিন্তু তাহলে তো বিবেকবাবুর তাকে চেনার কথা। কারণ, সেখানে তিনি কুড়ি বছর যাবৎ প্র্যাক্টিস করছেন। অথচ তিনি বললেন যে এঁর সঙ্গে পরিচিত নন। অবশ্য ফটোটা দেখে হয়তো কিছুটা চিনতে পেরেছেন।
বিমল পকেট থেকে সেই মানিব্যাগটা বের করে হাঁটতে হাঁটতেই সেটা থেকে প্রেসক্রিপশনগুলো বের করল। আশ্চর্য ব্যাপার! কোনওটিতেই রুগীর নাম লেখা নেই। সুতরাং প্রেসক্রিপশনগুলো নিমাইসাধনবাবুর সম্পত্তি কি না তা জানা গেল না। যাই হোক, সন্দেহজনক ব্যাপার আর নিমাইসাধন সান্যাল সন্দেহজনক ব্যক্তি।
ট্রামে করে গড়িয়াহাট পৌঁছে সেখানে চৌত্রিশ নম্বর বাড়ি খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগল না বিমলের। বেশ বড়ো তিনতলা বাড়ি, চারতলায় ছাত। নতুন আমলের বাড়ি, সাত আট বছরের বেশি পুরনো হবে না। বাইরের নীলরঙ এখনও চটে যায়নি। দরজায় গিয়ে কড়া নাড়তে একজন মধ্যবয়স্ক চাকর এসে খুলে দিল। বিমল যে খোদ মালিকের সঙ্গে দেখা করতে চায় সেটা জেনে সে ভেতরে গেল। তারপর এসে বলল যে বৈঠকখানায় ডাক পড়েছে।
বৈঠকখানায় ঢুকে বিমল দেখল যে ঘরটি ছোটো অথচ ছিমছাম। ঘরে বাহারের জিনিসপত্র বেশি নেই। শুধু একটা বইয়ের আলমারি আর টেবিলের চারপাশে দু’টো আরামকেদারা আর দু’টো সোফা। এরই একটিতে গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছেন নিমাইসাধন সান্যাল। ফটোর সঙ্গে চেহারার পার্থক্য অনেকখানিই। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, রোগা ফর্সা চেহারা। দাড়িগোঁফ নেই। ভদ্রলোক কালো ফুলপ্যান্ট আর সাদা শার্টের উপর হলুদ গলাবন্ধ সোয়েটার পরে আছেন। মাথায় পশমের টুপি। বিমলই কথা আরম্ভ করল।
“নমস্কার, আমি আসছি একটা কাজে।” বিমল পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টেবিলের উপর রাখল। “এই মানিব্যাগটা বোধহয় আপনারই?”
নিমাইবাবু সোজা হয়ে বসে জিনিসটা হাতে তুলে নিলেন। “এটা? হ্যাঁ, এটা তো আমার বলেই মনে হচ্ছে। এই মানিব্যাগটা আমার হারিয়ে যায় দিন দশ-পনেরো আগে। সেদিন রাতে নিউ আলিপুরে বন্ধুর বাড়ি থেকে যখন ফিরছিলাম তখনই হয়তো ওটা পকেট থেকে পড়ে যায়। কিন্তু আপনার কাছে ওটা এল কী করে? আর আপনিই বা কে?”
“আমার নাম বিমল সাহা। আমি একজন শখের গোয়েন্দা। আমিই আপনার এই ব্যাগটি নিউ আলিপুর পার্কে খুঁজে পাই। খবরের কাগজে এটার একটা বিজ্ঞাপনও বেরোয় মঙ্গলবার। কিন্তু আপনি যখন এলেন না তখন ঠিক করলাম যে নিজেই গিয়ে ফেরত দিয়ে আসব।”
“আচ্ছা, কোন সংবাদপত্র বলুন তো?”
“স্টেটস্ম্যান।”
“না, ওটা রাখি না। আপনি চা খাবেন?”
“না না। আমি এক্ষুনি উঠব। আচ্ছা, এই বাড়িটাতে কি আপনিই থাকেন?”
“না, আমি একা মানুষ, এত বড়ো বাড়ি নিয়ে কী করব? আর তাছাড়া আমি তো বেশিরভাগ সময়েই থাকি বাড়ির বাইরে। এই কিছুক্ষণ আগেই ফিরলাম। কিন্তু বাড়িটা ভাড়া দিতেও ইচ্ছা করে না। তাই ওপরের দু’টো তলায় আমি পেয়িং গেস্ট রেখেছি। সব মিলিয়ে পাঁচজন। আর নীচের তলায় থাকি আমি আর আমার দুই ভাই শংকর ও অনিমেষ।”
“তাহলে আজ আসি। খুব ভালো লাগল।”
ঘর থেকে প্রস্থান করার মুখে বিমল দেখল যে আলমারির উপর স্তূপ করে রাখা কাগজপত্রের মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা স্টেটস্ম্যান খবরের কাগজ। সেদিন বাড়ি ফিরতে রাত সাড়ে সাতটা হয়ে গেল বিমলের। ভেতরে ঢুকেই সে টেলিফোন ডিরেক্টরি ঘাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই সন্ধানে সফল হল সে। নিমাইসাধন সান্যালের ফোন নম্বর ২৫-৭৩৪১। রিসিভার তুলে ডায়াল করতে লাগল বিমল। একটু পরেই সে ওদিক থেকে নিমাইবাবুর গলা পেল।
“হ্যালো।”
“হ্যালো। আমি হোটেল শ্রীনিবাস থেকে কথা বলছি।” বিমল নিজের গলাটাকে ঘড়ঘড়ে মোটা করে নিয়েছে।
“কেন, কী দরকার?”
“আজ্ঞে, শুনেছি আপনার ওখানে পেয়িং গেস্ট থাকে। তা আমি আসছি লখনৌ থেকে। দামী কোনও হোটেলে উঠিনি কারণ, অনেকদিন থাকব। আর এখানে ব্যবস্থা ভালো নয়। তা আপনার বাড়িতে কি ঘর ফাঁকা আছে?”
খানিক ইতস্ততর পর জবার এল, “তিনতলায় একটা ঘর আছে। আচ্ছা, আপনি কাল সকাল আটটায় এখানে চলে আসুন। পরে এলে হয়তো পাবেন না। অফিসের কাজ।”
“বেশ, তাহলে কাল আটটা।” বিমল রিসিভার রেখে দিল।
।।তৃতীয় পরিচ্ছেদ।।
শনিবার সকালবেলা ২৪/২৯ ট্রামে করে রওনা হল বালিগঞ্জের উদ্দেশ্যে। আজ তাকে দেখে ইন্সপেক্টর পলাশ ঘোষও চিনতে পারতেন কি না সন্দেহ। তার ছদ্মবেশ পুরোপুরি নিখুঁত বললেও খুব ভালো বলা হবে না। তার সরু গোঁফের উপর মোটা একটা গোঁফ লাগিয়ে নিয়েছে। এছাড়া আছে চাপদাড়ি আর ঝাঁকড়া চুল। এসবই হল পেয়িং গেস্ট হিসেবে কয়েকদিন থাকার প্রস্তুতি।
বিমল সঙ্গে নিয়েছে একটা সুটকেস যার মধ্যে রয়েছে কাপড়জামা, দাড়ি কামানো আর দাঁত মাজার সরঞ্জাম। এছাড়া আছে কয়েকটি বই, একটি টর্চ, একটি ম্যাগনিফাইং গ্লাস আর সযত্নে রক্ষিত একটি চকচকে রিভলভার।
পৌনে আটটার সময় ট্রাম বিমলকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিল। ৩৪ নম্বর বাড়ির দরজার দিকে অগ্রসর হতেই সে হঠাৎ একজনের সঙ্গে ধাক্কা খেল। একটি তেইশ চব্বিশ বছরের যুবক বেরিয়ে আসছে বাড়ি থেকে। বিমলকে গ্রাহ্যই না করে সে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। বিমল অনুমান করল যে এ একজন পেয়িং গেস্ট। সকালে কাজে বেরোচ্ছে।
দরজা খোলাই ছিল। বিমল ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে আবার সেই চাকর এল আর তারপর আগমন হল মনিবের। আজও সেই বৈঠকখানা। বিমলকে দেখে নিমাইবাবুর চোখ কপালে উঠে গেল। গরুগম্ভীর গলার সঙ্গে মানানসই চেহারা বটে।
“মিঃ সান্যাল, আমি অমিয়নাথ বোস।” সেই একই গলায় বিমল বলল। “কাল রাতে আপনাকে একটা ফোন করেছিলাম।”
“ও, আপনি! তা বেশ তো। আপনি থাকতে চান তো অনায়াসে ক’দিন এখানে কাটিয়ে দিতে পারেন। তা ক’দিনের জন্য এসেছেন?”
“আজ্ঞে, সে কিছু ঠিক নেই।”
“তাহলে আপনি বরং এইবেলা ঘরটা দেখে আসুন। রমেশ একে তিনতলার খালি ঘরটাতে নিয়ে যাও তো।”
চাকর রমেশের সঙ্গে বিমল বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এল। একটি প্রশস্ত ডাইনিং রুমের একপাশে রয়েছে ওপরে যাবার সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশে একটি প্যাসেজ। এছাড়া আছে বৈঠকখানা ও আরও দু’টি ঘরের দরজা।
সিঁড়ি দিয়ে দু’জন উপরে উঠে গেল। একতলার মতো তিনতলাতেও রয়েছে একটা লম্বা প্যাসেজ। প্যাসেজ না বলে বারান্দা বলাই ভালো। এই বারান্দার একদিকে রেলিং আর অপর প্রান্তে পরপর চারটে ঘরের দরজা। চতুর্থ ঘরটি স্নানাগার।
তৃতীয় দরজাটিতে তালা দেওয়া ছিল। রমেশ চাবি বের করে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। বিমল তাকে অনুসরণ করতে দ্বিধা করল না। ঘরটি নিতান্ত সংকীর্ণ নয়। দক্ষিণদিকে দু’টো বড়ো জানালা আর এরই মধ্যে সূর্যের আলো এসে পড়ছে। ঘরের একপাশে বিছানা; তাতে লেপ তোষক ও বালিশ সবই রয়েছে। অন্যদিকে জামাকাপড় রাখার আলনা ও পড়ার টেবিল চেয়ার। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বিমল দেখল যে বাড়ির পেছনেই বড়ো মাঠ। আরও ওদিকে দেখা যাচ্ছে রেললাইন আর তার সংলগ্ন বস্তি অঞ্চল। দৃশ্য যে সব মিলিয়ে খুব সুন্দর তা নিশ্চয়ই নয়। তবে ঘরটা নিঃসন্দেহে বড়ো আর খোলামেলা।
“ঘর মনঃপূত হয়েছে?” বিমল একতলার বৈঠকখানায় ফিরে আসার পর প্রশ্ন করলেন নিমাইবাবু।
“তা হয়েছে। কিন্তু ভাড়াটা কত?”
“দিনপ্রতি পঞ্চাশ টাকা। আপনি বোধহয় এখানেই খাবেন। ব্রেকফাস্ট সকাল সতটায়, লাঞ্চ সাড়ে বারোটায় আর ডিনার আটটা থেকে ন’টার মধ্যে। যাঁরা সকালেই কাজে বেরিয়ে যান তাঁদের জন্য রমেশ টিফিন করে দেয়।”
“ঠিক আছে। তাহলে এখন বরং সোজা ঘরে চলে যাই।”
“স্বচ্ছন্দে। একটা কথা কী জানেন অমিয়বাবু, এখানে আমরা সবই থাকি একটি বৃহৎ পরিবারের মতো। এখন আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে। ফিরে এসে ডিনারের সময় অন্যান্য সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।”
বিমল ওপরে উঠে গেল আবার। যাওয়ার সময় ডাইনিং রুমের সংলগ্ন অন্য দু’টি ঘরের মধ্যে উঁকি দিল। দুটিরই দরজা খোলা। একটি ঘর খালি, অন্যটিতে বসে কাজ করছেন একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। ইনি সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাই।
ওপরে নিজের ঘরে ঢুকে বিমল স্যুটকেসটা মাটির উপর রাখল। তারপর সেটা থেকে একটা বই বের করে চেয়ার বসে পড়তে আরম্ভ করল। এটা গোয়েন্দা গল্প। কিন্তু বইয়ের পাতার মধ্যে কতক্ষণ ডুবে থাকা যায়! কিছুক্ষণ পরই বিমল তাই বইটি সশব্দে বন্ধ করে টেবিলের উপর রেখে দিল।
বিমল ভেবে দেখল যে এই অপরিচিত নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে তাকে এ বাড়িতে চলাফেরা করতে হবে। সে যে এখন বিমল সাহা নয়, অমিয়নাথ বোসের ছদ্মনাম এবং ছদ্মবেশ ধারণ করেছে একথা একমুহুর্তের জন্য ভুললেও চলবে না। একই সঙ্গে যে উদ্দেশ্য নিয়ে সে এখানে এসেছে সে উদ্দেশ্য সফল করার প্রচেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে। সে এসেছে নিমাইবাবু সম্বন্ধে আরও কিছু খবর সংগ্রহ করতে। আর তাই আজ দুপুরে যখন বাড়ি ফাঁকা থাকবে তখন মালিকের ঘরে একটু চোরা অনুসন্ধান চালাতে হবে।
কিন্তু তার আগে আর একটা করণীয় আছে, সে যে কেন চাকর গোবিন্দকে পাঁচদিনের ছুটি দিয়ে নিউ আলিপুরের বাড়ি তালাবন্ধ করে রেখে একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত স্থানে চলে এসেছে আর কোথায় এসেছে এ খবর কমপক্ষে বাইরের একজন লোককে জানাতে ক্ষতি কী? এই ভেবে বিমল কিছুক্ষণ পরে নিজের ঘরে তালা দিয়ে চৌত্রিশ নম্বর রাসবিহারী এভিনিউ থেকে বেরিয়ে এল।
বেলা দশটার সময় বিমল লালবাজার থানার গোয়েন্দা পুলিশ বিভাগে গিয়ে উপস্থিত হল। তার আগে অবশ্য সে একটি নির্জন গলিতে ঢুকে গোঁফ, দাড়ি আর ঝাঁকড়া চুল খুলে নিয়েছ। আজ শনিবার। তাই পলাশবাবু বিশেষ ব্যস্ত ছিলেন না। বিমলকে কাজের ঘরে প্রবেশ করতে দেখেই পলাশবাবু উঠে দাঁড়ালেন।
“একি! বিমল তুমি?”
“হ্যাঁ পলাশবাবু, আমিই।”
“তা, কীভাবে সাহায্য করতে পারি বল।”
“আজ এখানে এসেছি।” বিমল সংক্ষেপে সব ঘটনার বিবরণ দিল।
“না, আমার মনে হয় তুমি নিছক সময় নষ্ট করছ। নিমাইবাবু হয়তো নিজের কথা বাইরে প্রকাশ করতে চান না। তা কত লোকের তো কত অদ্ভুত খেয়াল থাকেই। এটা কিন্তু আমার বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয় না।”
“আমার মন থেকে কিন্তু খটকাটা দূর হয়নি পলাশবাবু। আর যদি বা নিমাইবাবু নির্দোষ হন তাহলেও তো নিজের পরিচয় গোপন করে নতুন জায়গায় ক’দিন থাকতে অসুবিধা নেই। আপনার কাছে এলাম ঘটনাটা জানাতে। ফোন নম্বরটাও রাখুন, ২৬-৭৩৪১।”
বারোটা নাগাদ বিমল তার নতুন বাসস্থানে প্রত্যাগমন করল। পেয়িং গেস্ট বাড়িতে থাকে বলেই হয়তো নিমাইসাধন সান্যাল একটি সাহেবি কায়দার প্রচলন করেছেন। তাই বিমল স্নান সেরে আসার অল্পক্ষণ পরই কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে বারোটায় লাঞ্চের ঘণ্টা শুনতে পেল।
নীচে পৌঁছে দেখল ডাইনিং রুম খালি। তবে টেবিলের উপর চারটি থালাবাটি সাজানো রয়েছে। বিমল গিয়ে একটি চেয়ার দখল করে বসল। কিছুক্ষণ পরেই অন্য তিনজন ভোজনার্থীর সমাগম হল। এদের মধ্যে একজনকে বিমল চিনতে পারল। এঁকেই সে সকালে একতলার ঘরটাতে দেখেছিল।
রমেশ ভাত, ডাল আর লাউয়ের তরকারি নিয়ে এল। খাওয়া শুরু হওয়ার পর সেই ভদ্রলোক বললেন, “বোধহয় আপনিই অমিয়নাথবাবু। আপনার কথা দাদা আমাকে বলছিলেন।”
“ও। আপনার দুই দাদাই বোধহয় আজ বাইরে।” বিমল বলল।
ভদ্রলোক হাল্কা হাসলেন। “দাদা আমার একজনই, নিমাইদা। আমরা তিনভাই। আমার নাম অনিমেষ সান্যাল। ছোটোভাই শঙ্কর আমার চেয়ে আট বছরের ছোটো। ভালো কথা, আপনাকে এই দু’জনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি আসানসোলে থাকেন, মিঃ পরেশ তালুকদার। এসেছেন ব্যবসার কাজে। আর এই ভদ্রলোক মিঃ অরুণ বণিক। ইনি জলপাইগুড়ির রিটায়ার্ড অধ্যাপক। কলকাতায় বেড়াতে এসেছেন।”
ইতিমধ্যে রমেশ এসে ফুলকপি ও রুইমাছের ঝোল পরিবেশন করে গেছে। শেষপর্ব চাটনি আর দই।
বিমল অনিমেষবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনার দাদার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল। অভিজ্ঞ ব্যক্তি।”
“তা ঠিক। দাদার আশ্চর্য চরিত্র। জীবনে কত কী করল তার কোনও ঠিক নেই। এককালে গাড়িচালক ছিল। তারপর সেক্রেটারী। আর এখন কলকাতা পোর্ট কমিশনার। জীবনে চড়াই উৎরাই গেছে অনেক। কতবার আর্থিক সহযোগিতা করতে চেয়েছি, কিন্তু আমার কাছ থেকে একটা কানাকাড়িও নেননি। যা উন্নতি করেছেন সবই নিজের প্রচেষ্টা আর ঐকান্তিক শ্রমের সাহায্যে। এই বাড়ি সেই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল।”
“আর আপনি ও শঙ্করবাবু?”
“আমার জীবনে তেমন কোনও বৈচিত্র্য নেই। আমি একটি ক্রিশ্চান স্কুলের শিক্ষক। এখনও ক্রিসমাসের ছুটি শেষ হয়নি। আর শঙ্করের কথা ছেড়ে দিন। চাকরিবাকরি করে না, পাওয়ারও বিশেষ সম্ভাবনা নেই। বাড়ি থেকে বেরোয় সকাল সাতটায়, ফেরে রাত ন’টায়। বুঝতেই পারছেন।”
অরুণ বণিক মশাই আগেই খাওয়া সেরে উঠে গেছেন। এখন বাকি তিনজন উঠে পড়লেন। বিমলও অপেক্ষা না করে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে সে কাজ শুরু করবে।
ঘরে গিয়ে সামান্য বিশ্রাম আর চিন্তার পর বিমলের মনে হল যে এইবার বাড়িতে একটা শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। এটাই নিমাইবাবুর ঘরে যাবার পক্ষে উপযুক্ত সময়। পা থেকে চটি খুলে সে সিঁড়ি দিয়ে আস্তে নীচে নেমে গেল। একতলায় এখন সব মিলিয়ে তিনটি ঘর খালি। এর মধ্যে একটি বৈঠকখানা। অপর দু’টি নিশ্চয়ই নিমাইবাবু ও শঙ্করবাবুর ঘর। ডানদিকের অর্থাৎ বৈঠকখানার পার্শ্ববর্তী ঘরটিতে সন্তর্পণে প্রবেশ করল বিমল। প্রথমেই তার চোখে পড়ল একটি বৃহৎ আলমারির উপর রাখা নিমাইসাধনবাবুর ফটোগ্রাফ। ঠিক ঘরেই এসেছে সে। এছাড়া আরও রয়েছে বিছানা টেবিল চেয়ার আর বুকশেলফ। শেলফটির প্রথম দু’টি স্তরে সাজানো আছে বই। নীচের তাকে নানাপ্রকার ফাইল আর কাগজপত্র।
এই শেলফটির দিকেই এগিয়ে গেল বিমল। ওপরের ফাইলটা খুলে ভেতরের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে আরম্ভ করল সে। বিমল হয়তো আশা করছিল যে ওর মধ্যে একটা ডায়েরি থাকবে। আর ডায়েরি এসব ব্যাপারে খুব কার্যকরী। কিন্তু এ আশা তাকে শেষপর্যন্ত ত্যাগ করতে হল। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ তার চোখ পড়ল একটা প্লাস্টিকে মোড়া কাগজের ওপর। তাতে লেখা, পরিবর্তন ১। ৩৫৭০ ২। ৭৭৭৩ ৩। ১৫৯৭৭। তারপর অপরিবর্তিত। বিমল এই কাগজের রহস্যের মীমাংসা করতে পারল না। তাই নিজের পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করে সেখানে সে কথা, সংখ্যা আর চিহ্নগুলো টুকতে আরম্ভ করল।
অকস্মাৎ পেছন থেকে কাশির আওয়াজ পেল বিমল। গোয়েন্দাগিরি করে তার মাথা আর স্নায়ু প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আশ্চর্য ঠাণ্ডা থাকে। তাই এখন ধরা পড়ে গিয়ে প্রথমে কিছুটা অপ্রতিভ হলেও চকিতে সেটা সামলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। পেছনে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে চাকর রমেশ।
বিমল হাসল। বলল, “কী ভাই রমেশ, আমাকে অনুসরণ করছিলে? আসলে বৈঠকখানায় ঢুকতে গিয়ে ভুল করে এ ঘরটাতে ঢুকে পড়েছি।”
বিমল ভাবল, হয়তো রমেশ এবার জিজ্ঞাসা করবে যে ভুলই যদি হয়ে থাকে তাহলে সেটা সংশোধন করতে কতক্ষণ লাগে। এটা বৈঠকখানা না নিমাইসাধন সান্যালের ঘর তা ভাববার জন্য কাগজপত্র ঘাঁটার কী প্রয়োজন!
কিন্তু রমেশের ভাবলেশহীন মুখে কোনও পরিবর্তন দেখা দিল না। এমনকি বিমল যখন তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তখনও সে একটি কথাও উচ্চারণ করল না। রমেশ স্বল্পভাষী কিন্তু কর্মপটু। এক্ষেত্রে সে এই রহস্যজনক আগন্তুক ওরফে অমিয়নাথ বোস আর তার আচরণ সম্বন্ধে কী ধারণা করল তার লেশমাত্র আভাস বিমল পেল না।
।।চতুর্থ পরিচ্ছেদ।।
রাতে ডিনার টেবিলে বাড়ির সকলেই উপস্থিত ছিলেন। এমনকি ছোটোভাই শঙ্করও। নিমাইসাধনবাবু আগেই বলেছিলেন সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন। এবার তিনি শুরু করলেন।
“আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। মিঃ সুরেন দাস। কলেজে আমার সহপাঠী ছিলেন। এখন রাউরকেল্লায় ওকালতি করেন। কলকাতায় একটা মামলার কাজে এসেছেন। এঁর নাম ছবি বর্মণ। ইনি থাকেন দূর্গাপুরে। কলকাতায় এসেছেন একটা বাড়ি তৈরির কাজে। এ হল আমার ছোটোভাই শঙ্কর।”
শঙ্করের বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ বছর, লম্বা স্বাস্থ্যবান শরীর। শঙ্করের পাশে বসে আছে বিমলের পূর্বপরিচিত সেই যুবক যার সঙ্গে সকালে সে ধাক্কা খেয়েছিল। নিমাইবাবু বললেন যে এর নাম অবিনাশ মিত্র, শঙ্করের বন্ধু। টেবিলে উপস্থিত বাকিরা হলেন পরেশ তালুকদার, অনিমেষ সান্যাল আর অরুণ বণিক। বিমলের মনে হল যে শঙ্কর আর তার বন্ধুর উপর নিমাইবাবুর মনোভাব কিছুটা অপ্রসন্ন।
“আচ্ছা মিঃ সান্যাল,” নিমাইবাবুকে উদ্দেশ্য করে বিমল বলল, “রিপন লেনের ডাক্তার বিবেক ভট্টাচার্যের আপনি নিশ্চয়ই পরিচিত?”
“কই, না তো। রিপন লেনেও আমি কোনওদিন যাইনি। কেন বলুন তো?”
“ডাক্তার ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেকদিনের। উনি কী একটা প্রসঙ্গে আপনার নাম উল্লেখ করেন। তারপর আপনি যে বাড়িতে পেয়িং গেস্ট রাখেন সেটা ওনার কাছ থেকেই শুনি।”
বিমল এবার নিমাইবাবুর গলায় একটা কড়া সুর লক্ষ করল। “দেখুন অমিয়বাবু, যতজন লোক আমাকে জানে তাদের সবাইকে আমি নাও জানতে পারি।”
“সে তো বটেই। আরেকটা কথা। অনিমেষবাবু বলছিলেন যে আপনার জীবনের উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে, অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন আপনি।”
খাওয়া শেষ হয়ে এসেছে। নিমাইবাবু উঠে পড়লেন। বললেন, “সে অনেক কথা। পরে একদিন হবে।”
সেদিন বিমল অনেক রাত পর্যন্ত চিন্তামগ্ন হয়ে থাকল। আজ নিমাইসাধন সান্যালের আরেকটা মিথ্যা কথা ধরা পড়েছে। কাজকে তরান্বিত করতে তাকেও যে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়নি তা নয়। কিন্তু নিমাইবাবু কেন অস্বীকার করলেন যে তিনি বিবেক ভট্টাচার্যকে চেনেন? বিমল যখন তাঁর জীবন নিয়ে আলোচনা করতে উদ্যত হয়েছিল তখনই বা তিনি উঠে গেলেন কেন? শোওয়ার আগে বিমল স্যুটকেস খুলে একটা জিনিসের অভাব লক্ষ করল। তার রিভলভারটি অদৃশ্য হয়ে গেছে।
পরদিন সকাল সাতটায় বিমল প্রাতরাশ করার জন্য নীচে নামল। আজ টেবিলে উপস্থিত ছিলেন সবসুদ্ধ পাঁচজন। বিমল, নিমাইবাবু, অনিমেষবাবু, সুরেনদাস আর শঙ্করের বন্ধু অবিনাশ মিত্র। অনিমেষবাবু বললেন যে শঙ্কর সকালেই কাজে বেরিয়েছেন আর অন্য তিনজন পেয়িং গেস্ট ঘরেই ব্রেকফাস্ট খান।
টেবিলের ওপর রাখা ছিল চা, টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ। নিমাইবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে কী একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কপালের রগ টিপে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। অনিমেষবাবু ছুটে গেলেন।
“কী হয়েছে, কী হয়েছে দাদা?”
মৃদুস্বরে ও ধীরে ধীরে নিমাইবাবু বললেন, “বুঝতে পারছি না অনিমেষ। গা গোলাচ্ছে, টাল সামলাতে পারছি না। পাপ মানেই মৃত্যু।”
বলতে বলতেই নিমাইবাবুর শরীর একদিকে কাত হয়ে ঢলে পড়ল। বিমল উঠে গিয়ে ভদ্রলোকের নাড়ি টিপল। হৃৎস্পন্দন থেমে গেছে। শরীরে আর প্রাণের সাড়া নেই। তবু সে অনিমেষবাবুকে বলল, “চলুন, নিমাইবাবুকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শোওয়াই।”
দু’জনে মিলে নিথর ও নিস্পন্দ দেহটাকে ধরে নিয়ে গেলেন। অনিমেষবাবু কেমন যেন বিহ্বল হয়ে রয়েছেন। এতক্ষণে হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছেন যে তাঁর দাদা মারা গেছেন। আর সেটাই বোধহয় তার বাকরোধ করেছে। কিন্তু এইমুহুর্তে মৌনাবলম্বন করলে চলবে কী করে? বিমল অনিমেষবাবুকে জিজ্ঞাসা করল, “বাড়িতে অসুখবিসুখ করলে আপনারা কোন ডাক্তারকে দেখান?”
উত্তর দিতে কিছুক্ষণ দেরি হল। “ডাক্তারখানার ফোন নম্বর ২৬-২১১৪।”
বৈঠকখানায় গিয়ে বিমল পরপর দু’টি ফোন করল। একটি ডাক্তার অমর খান্নাকে ও অন্যটি ইন্সপেক্টর পলাশ ঘোষকে। ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখল যে এ ঘরটা এখন খালি। নিমাইবাবু যে কাপ থেকে চা পান করেছিলেন সেটা সে এককোণায় ঢাকা দিয়ে রেখে দিল। তারপর এগিয়ে গেল নিমাইবাবুর ঘরের দিকে যেখান থেকে অনিমেষবাবুর উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর ভেসে আসছে।
“দাদার ব্লাডপ্রেসার খুব বেশি ছিল। অনেকদিন থেকে বলছি যে এ ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু…” অনিমেষবাবুর গলা ধরে এল।
এইসময় বিমল প্রবেশ করল। “না অনিমেষবাবু, আপনার দাদার হার্ট অ্যাটাক হয়নি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে বিষ খাইয়ে তাঁকে খুন করা হয়েছে। আর বিষ মিশ্রিত ছিল তাঁর পানীয় চায়ের সঙ্গে। এ সন্দেহ আমার মনে বদ্ধমূল হয়েছে বলেই আমি লালবাজারের ইন্সপেক্টর পলাশ ঘোষকে ডেকেছি। যেকোনও মুহুর্তে তিনি এসে পড়বেন।”
“কিন্তু আপনি?” অস্ফুট গলায় বললেন অনিমেষবাবু।
বিমল একটানে ছদ্মবেশ খুলে ফেলল। “আমি শখের গোয়েন্দা বিমল সাহা। তদন্তের শেষে প্রকাশ করব কেন এখানে এসেছিলাম।”
কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার খান্না এসে উপস্থিত হলেন। ইনি বিমলকে দেখে বললেন, “আপনি তো গোয়েন্দা বিমল সাহা। আপনার নাম শুনেছি। খবরের কাগজে ছবিও দেখেছি।”
বিছানার উপর শায়িত নিমাইসাধন সান্যালের শরীর পরীক্ষা করে বললেন, “নাহ্, ভদ্রলোক আর ইহলোকে নেই। কীভাবে মারা গেছেন পোস্টমর্টেম না করে বোঝা যাবে না।”
কিছুক্ষণের মধ্যে পলাশবাবুও এসে গেলেন। দশটার মধ্যে মৃতদেহ পোস্টমর্টেমের জন্য চলে গেল। নিমাইবাবুর খাওয়া চায়ের কাপটিও বিমল পাঠিয়ে দিল পরীক্ষাগারে পরীক্ষার জন্য।
।।পঞ্চম পরিচ্ছেদ।।
ময়না তদন্তের ফলাফল বেরোতে বেশিদিন লাগল না। দুই একদিনের মধ্যেই খবর এল যে বিমলের সন্দেহ সম্পূর্ণ নির্ভুল। নিমাইসাধন সান্যাল মারা গেছেন আর্সেনিক বিষ খেয়ে। কিন্তু কফিতে বিষের চিহ্নমাত্র আবিষ্কৃত হয়নি।
মঙ্গলবার দুপুরে বিমল খাটে বসে ভাবছিল। সে বিবেচনা করে দেখল যে এখন তাকে দু’টি রহস্যের সমাধান করতে হবে। প্রথমত, আততায়ীকে বের করা আর দ্বিতীয়ত, চায়ে কেন বিষ নেই সেটা জানা। আবার দ্বিতীয়টির পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমটিকে বিচার করতে হবে। খুন করছে নিশ্চয়ই বাড়িরই একজন বাসিন্দা। অর্থাৎ, সম্ভাব্য অপরাধীদের তালিকায় আটজনের নাম লেখা যেতে পারে – অনিমেষ সান্যাল, শঙ্কর সান্যাল, অবিনাশ মিত্র, পরেশ তালুকদার, অরুণ বণিক, সুরেন দাস, ছবি বর্মণ ও চাকর রমেশ। এর মধ্যে আবার পাঁচজন খাওয়ার টেবিলে উপস্থিত ছিলেন না। অবশ্য রমেশ টেবিলে উপস্থিত না থাকলেও চা প্রস্তুত করেছিল ও টেবিলে কাপগুলিকে সাজিয়ে দিয়েছিল। সে কি আগেই জানত নিমাইবাবু কোন চেয়ারে বসবেন? যে চারজনকে বিমল নীচে নেমে টেবিলে জমায়েত দেখেছিল তাঁরাই বা কে কখন এসে পৌঁছেছিলেন? রমেশ কি খালি টেবিলেই কাপ সাজিয়েছিল? তবে একটা কথা ঠিক, টেবিলে যে চারজন আসেননি তাঁদের কাছে খুন করার সুযোগ কমই ছিল।
যাই হোক, বিমল স্থির করল যে প্রত্যেককেই স্বতন্ত্রভাবে জেরা করবে ও সে কাজ সেইদিনই রাতে শুরু করবে। পরে যে চায়ে বিষ পাওয়া যায়নি তার কারণও অনুসন্ধান করতে হবে। অর্থাৎ, পরবর্তীকালে কাপ সরিয়ে ফেলার সুযোগ ছিল কি না সেটাও জানতে হবে।
নোটবই আর পেন্সিল নিয়ে বিমল প্রথমেই ঢুকল পাশের ঘরে অর্থাৎ পরেশ তালুকদারের ঘরে। এঁর সম্বন্ধে প্রাথমিক বর্ণনা হল, বয়স চল্লিশ থেকে বেয়াল্লিশ, বেঁটে মানুষ, শরীর কিছু স্থূল ও ঠোঁটের উপর বেশ তাগড়াই একটা গোঁফ। বিমল সরাসরি বলল, “মিঃ তালুকদার, আপনি হয়ত জানেন যে আমি একজন শখের গোয়েন্দা। সুতরাং আপনাকে নিমাইসাধন সান্যালের মৃত্যু সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন করব। প্রথমে আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি যে আপনি রবিবার সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে সাতটার মধ্যে কী করছিলেন?”
তালুকদার মশাই কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন, “দেখুন মিঃ সাহা, আমি নিতান্ত নিরীহ মানুষ। কোনদিন কারোর কোনও অনিষ্ট করিনি। পরশু সকালে উঠতে উঠতে সাতটা হয়ে যায়। বাথরুমে গিয়ে দাঁত মেজে আবার ঘরে ফিরে আসি। আমি ঘরেই খাবার দিতে বলে গিয়েছিলাম রমেশকে। এসে দেখি দিয়ে গেছে। আহারাদি সম্পন্ন হতে তো সাড়ে সাতটা বেজে গিয়েছিল।”
“আচ্ছা, আপনার সঙ্গে নিমাইবাবুর পরিচয় ক’দিনের?”
“আমি কলকাতায় আসলে সাধারণত হাজরা রোডে অমূল্য হোটেলে উঠি। গড়িয়াহাটে আমার একটি জামাকাপড়ের দোকান আছে, তালুকদার টেক্সটাইলস। জামা কিনতে মিঃ সান্যাল একদিন আমার দোকানে আসেন। এই সূত্রেই পরিচয়। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরদিনই অমূল্য হোটেল ছেড়ে এখানে চলে আসি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে মিঃ সান্যালের সঙ্গে আমার পরিচয় দশদিনের বেশি নয়।”
“আচ্ছা, আপনি তো থাকেন আসানসোলে। সেখানেও কি আপনার কোনও দোকান আছে?”
“আছে বৈকি। তালুকদার টেক্সটাইলসেরই একটি শাখা রয়েছে আসানসোলে।”
“আপনি বছরে ক’বার কলকাতায় আসেন?”
“তা চার পাঁচবার তো আসতেই হয়।”
“তাহলে উঠি, ধন্যবাদ।”
তিনতলার শেষ ঘরটিতে থাকেন ছবি বর্মণ। বিমল এঁর ঘরেই এবার প্রবেশ করল। কাজের কথায় চলে আসতে দেরি করল না। বিমলের প্রশ্নের উত্তরে মিঃ বর্মণ বললেন যে খুনের সময় তিনি ঘরে বসেই প্রাতরাশ সারছিলেন। ঘর থেকে তিনি ওই সময় একবারও পা বাড়াননি।
“আপনার জীবিকা উপার্জনের উপায়টি কী?” জিজ্ঞাসা করল বিমল।
“আমি দূর্গাপুরে একটি আয়রন অ্যান্ড স্টীল কারখানার অ্যাকাউন্টেন্ট।”
এখানে বলা দরকার যে ছবি বর্মণের বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি। মুখের গড়ন দৃঢ়। এখনও সেখানে বয়সের ছাপ পড়েনি।
“মিঃ বর্মণ, আপনি তো কলকাতায় এসেছেন একটি বাড়ি তৈরির কাজে। তাই না?”
“হ্যাঁ মিঃ সাহা, বেহালায় তিন বছর আগে চার কাঠা জমি কিনি। সেখানেই এখন বাড়ি তৈরি হচ্ছে।”
“এবার আমার শেষ প্রশ্ন মিঃ বর্মণ। কীভাবে এবং কখন আপনি মিঃ স্যানালের সাক্ষাৎ পান?”
“দেখুন, কলকাতার মতো স্থানে কেউ যদি বাড়িতে পেয়িং গেস্ট রাখেন তাহলে সে খবর রটতে বেশি সময় লাগে না। তবে এখন আমার সঠিক মনে নেই কার কাছ থেকে আমি প্রথম এ বিষয়ে জানতে পারি।”
খাওয়ার পর রাত ন’টায় বিমল দোতলার অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য নীচে গেল।
প্রথমেই ডানদিকে পড়ল অরুণ বণিকের ঘর। অরুণবাবু ঘরেই বিছানার উপর বসেছিলেন। বয়স পঞ্চাশের উপর কিন্তু মাথায় টাক পড়েনি। টিকালো নাক, কাঁচাপাকা চুল আর রয়েছে একটি কাঁচাপাকা প্রজাপতি মার্কা গোঁফ। ইনি তো পরেশবাবু আর হরিবাবুর মতোই হত্যার সময় ঘরে বসে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছিলেন।
“মিঃ বণিক, আপনি জলপাইগুড়ির কোথায় অধ্যাপনা করতেন এবং ক’বছর হল রিটায়ার করেছেন?” প্রশ্ন করল বিমল।
“মিঃ সাহা, আমি জলপাইগুড়ি মেডিকেল ইন্সটিটিউশনের ফিজিক্সের অধ্যাপক ছিলাম। তিন বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছি অধ্যাপনা থেকে। এখন মাসে হাজার টাকা পেনশন পাই।”
“কলকাতায় কি আপনি প্রায়ই বেড়াতে আসেন?”
“না, তা আসি না। কলকাতায় আমার কোনও আত্মীয়পরিজনও থাকে না। তবে এবার ভাবলাম যে কলকাতা শহরটা একবার ঘুরে আসি। শীতকালেই তো লোকে এখানে বেড়াতে আসে। বইমেলা, সার্কাস, চিড়িয়াখানা আরও কত বিচিত্র দর্শনীয় স্থান আছে।”
“আপনার বুঝি থিয়েটারের দিকে ঝোঁক আছে?”
বিমলের চোখ চলে গেছে শেলফের উপর রাখা কতকগুলি বইয়ের উপর।
“আপনি ঠিকই ধরেছেন। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক নাটক নির্দেশনা আর পরিচালনার কাজ করেছি জলপাইগুড়িতে। মঞ্চে অভিনয় জিনিসটির উপযুক্ত বিকাশ কিন্তু ঘটছে না।”
অরুণ বণিকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিমল প্রবেশ করল মিঃ সুরেন দাসের ঘরে। ঘরটি প্রশস্ত। তাতে রয়েছে চেয়ার, টেবিল, খাট, আলনা আর শেলফ। চেয়ারে বসে মনোযোগের সঙ্গে লিখছিলেন মিঃ দাস। বিমল ঢুকতেই উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলেন।
“আপনার উপর হয়তো উপদ্রব করছি মিঃ দাস, কিন্তু গোয়েন্দা হিসাবে কয়েকটি প্রশ্ন করতেই হবে।” বিনীত গলায় বলল বিমল।
“স্বচ্ছন্দে করতে পারেন।”
সুরেন দাসের বয়স নিমাইসাধন সান্যালের মতোই। চওড়া কপাল, গোঁফদাড়ি নেই। মাঝারি উচ্চতা ও ফরসা রঙ।
“আপনি যখন রবিবার সকালে ব্রেকফাস্ট খেতে একতলায় যান তখন টেবিলে কে কে উপস্থিত ছিলেন?”
“টেবিলে বসেছিলেন শুধু নিমাইসাধন।”
“রমেশ কি টেবিলে চা দিয়ে গিয়েছিল?”
“হ্যাঁ, চারটে চায়ের কাপ তো দেখলাম টেবিলে।”
“আপনি তো অনেকদিন পর্যন্ত মিঃ সান্যালের সতীর্থ ছিলেন। ওঁর স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে কিছু আলোকপাত করতে পারেন?”
“এক স্কুলে পড়লেও নিমাইসধানের আমার সঙ্গে বা অন্য কোনও ছাত্রের সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল না। কোনওদিনই খুব একটা মিশুকে ছিল না। কথাও স্বভাবতই কম বলত।”
“আপনি বুঝি রাউরকেল্লায় ওকালতি করেন?”
“হ্যাঁ, ওখানকার হাইকোর্টে।”
“এখানে যে মামলার ব্যাপারে এসেছেন, সেটা সম্বন্ধে জানতে পারি?”
“নিশ্চয়ই। খুনের মামলা। খুনটা হয় ন’বছর আগে। আর খুনের দিনই দেখা যায় যে পঞ্চাশ হাজার টাকা ভদ্রলোকের আলমারি থেকে অপহৃত। সন্দেহ পড়ে বাড়ির চাকরের উপর যে কি না ওই দিনই চম্পট দেয়। সে বলে যে সেইদিনই নাকি তার দেশে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একথা কারোর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। আমি এই চাকরের স্বপক্ষেই ওকালতি করছি।”
এবার বিমল গেল সর্বশেষ পেয়িং গেস্ট অবিনাশ মিত্রের ঘরে। অবিনাশ বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কী ভাবছিল। বিমল আসামাত্র চমকে উঠে বসল। তাকে বিচলিত দেখে বিমল বলল, “ভয় নেই অবিনাশবাবু, আমি শুধু আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করব।”
অবিনাশ চুপ করে থাকল। বিমল বলে চলল, “আপনি আজ সকালে খাবার টেবিলে গিয়ে সেখানে কাদের দেখেন?”
“আমি আর মিঃ অনিমেষ সান্যাল প্রায় একই সঙ্গে খেতে ঢুকি। টেবিলে তখন মিঃ সান্যাল আর মিঃ দাস বসেছিলেন।”
“দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনি কি কোনও পেশা নির্বাচন করেছেন?”
“এক জায়গায় শর্টহ্যান্ড টাইপ রাইটিংয়ের তালিম নিচ্ছি।”
“কোথায়?”
“রাসেল স্ট্রীটে।”
“শঙ্করবাবুর সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব কত দিনের?”
“শঙ্করকে আমি প্রথম দেখি দু’বছর আগে। সেই থেকেই আমরা বন্ধু।”
“আচ্ছা, আপনি পেয়িং গেস্ট হিসেবে এখানে ক’দিন আগে এসেছিলেন?”
“তা, মাসখানেক হবে। শঙ্করই ব্যবস্থা করে দেয়।”
“একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি কিছু মনে করবেন না। আপনার প্রতি নিমাইবাবুর ব্যবহার কেমন ছিল?”
“মোটেই ভালো না। গত সপ্তাহ ধরে তিনি ঘরভাড়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছিলেন। তিনবার কথা কাটাকাটি হয়েছে।”
বিমল আর এখানে দেরি করল না। সে সোজা চলে গেল নীচে অনিমেষ সান্যালের ঘরে। ভেতরে প্রবেশ করে দেখে যে অনিমেষবাবু একমনে বই পড়ে যাচ্ছেন।
“বেশীক্ষণ আপনাকে বিরক্ত করব না অনিমেষবাবু,” বিমল বলল। “বুঝতেই পারছি, বড়োভাইয়ের মৃত্যুতে আপনার মন ভারাক্রান্ত।”
“না না, আপনি ইচ্ছামতো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারেন।”
“সেদিন খেতে খেতে আপনি আপনার দাদার বিচিত্র চরিত্র সম্বন্ধে বলছিলেন। আজ একই ব্যাপারে একটু বিশদভাবে বলুন।”
“নিমাইদার থেকে আমি চার বছরে ছোটো। আমরা কলেজে ফার্স্ট ইয়ার পর্যন্ত একই সঙ্গে প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স এবং পরে সিটি কলেজে পড়ি। কিন্তু দাদার মন কোনওদিনই পড়াশুনায় বসেনি। তিনি কলেজে ওই একবছর পড়েই এ বিষয়ে ইস্তফা দেন। কিছুদিন অবধি তিনি গাড়িচালক হিসাবে কাজ করেন, তাও সামান্য মজুরিতে। এই সময়ই আমাদের বাবা মারা যান ও দাদা ড্রাইভারি ছেড়ে সেক্রেটারির চাকরি নেন। এই সময়টা তিনভাই পৈতৃক বাড়িতেই থাকতাম। তারপর আজ থেকে আট বছর আগে দাদা এই বাড়িটি কেনেন ও সেইসঙ্গে ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্টে চাকরি নেন।”
“আচ্ছা, আপনার দাদার শরীরের অবস্থা কেমন ছিল?”
“সেদিন বলছিলাম যে দাদা হাই ব্লাডপ্রেসারের রুগী ছিলেন। ডাক্তার ওঁকে চিনি খাওয়া কমাতে বলেছিলেন। একটি করে ভিটামিন ক্যাপসুল রোজ সকালে খাবার আগে খেতেন।”
“দাদার খুনের ব্যাপারে আপনার কাকে সন্দেহ হয়?”
“মাপ করবেন বিমলবাবু। এ সম্বন্ধে আমি কোনও কথা বলতে পারব না।”
“চাকর রমেশ কি পুরনো আর বিশ্বাসী?”
“বিশ্বাসী কি না জানি না, তবে খুব একটা পুরনো নয়। ও এসেছে দু’বছর আগে।”
“আজ তাহলে আসি অনিমেষবাবু, অনেক রাত হয়ে গেল।”
সবশেষে বিমল গেল রমেশের ঘরে। রমেশ শোয় একতলায়, রান্নাঘর আর বাথরুমের পাশেই একটি ছোটো খুপরিতে। কড়া নাড়তে সে দরজা খুলে দিল।
“আমি গোয়েন্দা বিমল সাহা”, বিমল বলল।
“তোমাকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব রমেশ। রবিবার যখন তুমি চা পরিবেশন কর তখন কি কেউ টেবিলে ছিল?”
“না।”
“তুমি চা দেওয়ার পর নিমাইসাধনবাবু এসেছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা, তুমি যে তিনজনকে সেদিন ঘরে ব্রেকফাস্ট দাও, তাদের মধ্যে কে কে তখন ঘরে ছিলেন ও কে কে ছিলেন না?”
“পরেশবাবু ব্যতীত অন্য দু’জন ভদ্রলোককে আমি ঘরেই দেখি।”
“আচ্ছা রমেশ, তুমি নিমাইসাধন সান্যাল সম্বন্ধে কতটুকু জান?”
“জানি যে উনি কৃপণ লোক ছিলেন।”
“আর কিছু?”
“না।”
“কোনও তথ্য গোপন করছ না?”
“হয়তো।”
বিমল হাল ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরে এল। রমেশের কাছ থেকে খুব বেশি সাহায্য পাবার আশা করেনি সে, পেলেও না।
।।ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।।
সেদিন রাতে কিছুতেই বিমলের ঘুম আসছিল না। শঙ্কর ছাড়া বাড়ির সকলের সঙ্গেই আজ সে কথা বলেছে। অনেক কিছু জানতেও পেরেছে সন্দেহ নেই। এবার তার কর্তব্য হচ্ছে এই তথ্যগুলো ভালো করে পরীক্ষা করে খুনী কে তা সঠিকভাবে নির্বাচন করা। বিমল ভেবে দেখেছিল যে শঙ্করকে প্রশ্ন করে আর বিশেষ কিছু লাভ হবে না। শঙ্কর খুনের সময় বাড়িতেই ছিল না। আর কোথায় ছিল সেটা অপ্রাসঙ্গিক।
রাত প্রায় বারোটা হয়ে এল। রাতের শেষ ট্রেনের বাঁশি নিকটবর্তী বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে ভেসে এল। তারপর সব নিস্তদ্ধ। বিমল কিন্তু কিছুতেই ঘুমোতে পারল না। ভাবল বই পড়বে। তাই সে হাত বাড়াল বেড সুইচের দিকে। আলো জ্বলল না। লোডশেডিং হয়েছে।
হঠাৎ বিমলের চোখ চলে গেল কাঁচের জানালার দিকে। যেটা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটা একটা কালোছায়া ছাড়া আর কিছুই না। বিমল নিঃশব্দে খাট থেকে নেমে একপাশে সরে গেল। সেখান থেকেই সে লক্ষ করে চলল রাতের এই রহস্যময় আগন্তুকের কার্যকলাপ।
ছায়ামূর্তিটি প্রথমে সামনের দিকে একটা হাত বাড়াল। দু’হাতেই তার রয়েছে নীলরঙের দস্তানা। ডানহাতটি সে চালিয়ে দিল কাঁচের মধ্যে দিয়ে। সশব্দে কাঁচ মাটিতে ভেঙে পড়ল। কাঁচ ভাঙার শব্দেও ঘরেও মধ্যে কেউ সাড়াশব্দ করল না দেখে কিছুটা আশ্চর্য সে নিশ্চয়ই হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে নিজের কাজ চালিয়ে গেল। ভাঙা জানালার মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে নীচের ছিটকিনিটা খুলল। তারপর আস্তে আস্তে জানালাও খুলে গেল। চোর এবার বাঁহাতটা সামনে আনল। এ হাতে রয়েছ একটা চকচকে রিভলভার। তার বাঁটে একটা সাদা কাগজ জড়ানো রয়েছে।
চোর ঘরের মধ্যে রিভলভার ছোঁড়া মাত্র নিষ্ক্রিয় বিমল এখন সক্রিয় হয়ে উঠল। এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে উঠে বালিশের পাশে রাখা টর্চটা হাতে তুলে নিল। তারপর সেটার জোরালো আলো সে ফেলল সোজা চোরের মুখের উপর। কিন্তু এ কী! চোরের মুখ কালো কালো কাগজের মুখোশে ঢাকা। তারপরই চকিতে মধ্যে ছায়ামূর্তিটি অদৃশ্য হল। পলকের জন্য বিমল শুধু দেখল এক বলশালী ব্যক্তির অন্তর্ধান। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মাটিতে পড়ে থাকা রিভলভারটা সে দেখতে পেল। এটা নিঃসন্দেহে বিমলের নিজেরই সম্পত্তি। রিভলভারের বাঁটে যে সাদা কাগজ জড়ানো ছিল তাতে লেখা একটিমাত্র কথা, ‘সাবধান’।
বিমল ভেবে দেখল যে আজ রাতের আগন্তুকই যদি ইতিপূর্বে রিভলভার চুরি করে থাকে তবে সে এ বাড়িরই বাসিন্দা। এই কারণেই তাকে কালো মুখোশ পরতে হয়েছে।
বিমল শুয়ে পড়ল। আজ রাতে আর কিছু করা যাবে না। পরদিন সকালে এর একটা বিহিত করতে হবে। কিছুক্ষণ পরেই সে অঘোরে ঘুমে আচ্ছন্ন হল।
বুধবার সকাল। বিমলের উঠতে একটু বেলা হয়েছে। কিন্তু আজ তার মন, মাথা সব পরিষ্কার। হয়ত সেইজন্যই খাওয়ার সময় একটা আশ্চর্য জিনিস সে আজ আবিষ্কার করল। তাই তো, এই খুনের ব্যাপারটা সে তো কখনও এইদিক থেকে ভেবে দেখেনি!
চায়ে বিষ পাওয়া যায়নি অথচ বিষ খেয়েই মারা গেছেন নিমাইসাধন স্যানাল। তবে কি মাঝখানে কাপ বদল করা হয়েছিল? নিমাইবাবু মারা যাওয়ার পর বিমল আর অনিমেষবাবু মিলে মৃতদেহটিকে ভেতরের ঘরে নিয়ে যায়। এই সুযোগে কি খুনী নিমাইবাবুর কাপটি নিয়ে তার পরিবর্তে সেখানে নিজের কাপটি রেখে দিয়েছিল? কিন্তু টেবিলে উপস্থিত অন্যান্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে সেটা করার উপায় ছিল না। তার মানে কি এই নয় যে সেদিন হত্যাকারী সকলের পরে খাওয়ার ঘর থেকে প্রস্থান করেছিল?
হ্যাঁ, এ সবই অনুমান মাত্র। আর এগুলোর সত্যতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হতে এখন একটাই পন্থা অবলম্বন করতে হবে। সেটা হল কাপের হাতলের ওপর আঙুলের ছাপ পরীক্ষা। বিমল আর অপেক্ষা করল না। খাওয়া শেষ হওয়া মাত্র সে বৈঠকখানায় চলে গেল আর সেখান থেকে পলাশবাবুর ফোন নম্বর ডায়াল করল।
“হ্যালো, পলাশবাবু?”
“কে, বিমল বলছ?”
“হ্যাঁ। আচ্ছা, যে চায়ের কাপটি নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল সেটা কি এখনও ওখানেই আছে?”
“তা আছে বোধহয়। কিন্তু ওটাতে তো বিষ পাওয়া যায়নি।”
“তা হোক। ওটার হাতলের উপর ফিঙ্গার প্রিন্টগুলো পরীক্ষা করতে বলে দেবেন।”
“বেশ, কিন্তু কেন বল তো?”
“এটাও বুঝতে পারলেন না? কার আঙুলের ছাপ তা জানার জন্য,” বলে বিমল চট করে রিসিভার রেখে দিল। ফিরে এসে দেখে তার ঘরে জানালার কাঁচের যে অংশ ভেঙে গিয়েছিল সেখানে একটা সাদা কাগজ আটকানো। সকালে খাওয়ার সময় বিমল চোরের ব্যাপারটা অনিমেষবাবুকে জানিয়েছিল। তিনিই নিশ্চয় রমেশকে দিয়ে এই কাজটি করিয়েছেন।
খাতা পেন্সিল নিয়ে এবার বিমল বসে গেল সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের একটি তালিকা প্রস্তুত করতে।
১। অনিমেষ সান্যাল। হত্যার সময় টেবিলে ছিলেন, খুনের সুযোগ ছিল। দাদার উইলে সম্পত্তির তিন-চতুর্থাংশ ও বালিগঞ্জের এই বাড়ির অধিকারী হয়েছেন, খুনের মোটিভ ছিল। তিনতলায় পাইপ বেয়ে ওঠার ক্ষমতা না থাকাই সম্ভব।
২। শঙ্কর সান্যাল। ইনি খুনের সময় বাড়ির বাইরে ছিলেন। খুনের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। নিমাইসাধন সান্যাল সম্ভবত এঁকে পছন্দ করতেন না। কারণ, শঙ্কর চকরি না করে সময় ও টাকা দুইয়েরই অপব্যয় করেন। উইলেও তাকে মাত্র এক-চতুর্থাংশ অংশীদার করা হয়েছে। খুনের মোটিভ ছিল। ওই এক-চতুর্থাংশও নিতান্ত কম নয় এবং আক্রোশের বসেও খুন করা সম্ভব ছিল। বয়স সাতাশ। গত রাত্রের চোর হওয়ার সামর্থ ছিল।
৩। পরেশ তালুকদার। খুনের সময় টেবিলে উপস্থিত ছিলেন না। অতএব খুন করার সুযোগ কম ছিল। রমেশের কথা, ওই সময় এঁকে ঘরেও পায়নি। মোটিভ জানা যায় না। পাইপ বেয়ে ওঠার ক্ষমতা আছে কি না সন্দেহ। বয়স চল্লিশের কোঠায়।
৪। ছবি বর্মণ। খুনের সময় নিজের ঘরেই ছিলেন। কাজেই সুযোগের অভাব। মোটিভও অনুপস্থিত।
৫। অরুণ বণিক। হত্যার সময় নিজের ঘরে আহার করছিলেন। সুতরাং খুনের সুযোগ ছিল না। খুনের কারণ সম্বন্ধেও কিছু জানা নেই। বয়স পঞ্চাশের উপর। কাল রাতের চোর হওয়া প্রায় অসম্ভব।
৬। সুরেন দাস। খুনের সুযোগ ছিল। খুনের কারণও থাকা সম্ভব। নিমাইবাবুর সঙ্গে অনেকদিনের পরিচয়। মধ্যবয়স্ক হওয়ায় পাইপ বেয়ে ওঠা কঠিন।
৭। অবিনাশ মিত্র। খুনের সময় সকলের সঙ্গে নীচের ঘরে খাবার খাচ্ছিলেন ও খুনের সুযোগ ছিল। খুনের সম্ভাব্য কারণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু শঙ্কর কি দাদার হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করার কাজে এঁকে নিয়োগ করেছিলেন? সেইজন্যই কি তিনি অবিনাশকে এখানে এনেছিলেন? অল্প বয়স, অনায়াসে পাইপ বেয়ে উঠতে পারবেন।
৮। চাকর রমেশ। খুনের সুযোগ এরই সবচেয়ে বেশি ছিল। কারণ ছিল বলে জানা নেই। সুস্থ ও সবল শরীর। অর্থাৎ, কাল রাতে ঘরে অনধিকার প্রবেশের অপরাধে অভিযুক্ত করা চলে।
সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তালিকা শেষ করে বিমল ঠিক করল যে এবার সে বাইরের বাগানে যাবে। কাল রাতে যে চোর এসেছিল সে তো ওখান থেকেই পাইপ বেয়ে ওঠে। সম্ভবত সে কোনও সূত্র রেখে গেছে।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ডানদিকের সরু প্যাসেজটায় ঢুকল বিমল। রান্নাঘর ও বাথরুমের পাশেই রয়েছে বাগানে যাওয়ার রাস্তা। বাগানটি সুন্দর, সারি সারি টবে আছে নানাপ্রকার বিচিত্র রঙিন ফুল। চারদিক সবুজ ঘাসে ভরা। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পায়ে হাঁটা পথ। এই পথ ধরেই বিমল বাড়ির পিছনে চলে গেল। এখান থেকে ওপরের দু’টো তলার প্রায় প্রত্যেকটি ঘরেই জানালা দেখা যায়। আর সব জানালার উপরেই রয়েছে কার্নিশ। বিমলের ঘরের ঠিক পাশে, বাথরুম পর্যন্ত চলে গেছে একটা পাইপ। বাগানটির অন্যদিকে আছে লম্বা শিকের পাঁচিল। তারই মধ্যে বাইরে যাবার ছোটো গেট। এটা এখন খোলা রয়েছে। কিন্তু রাতে সম্ভবত তালাবন্ধ থাকে। বিমল পাইপের গোড়ার দিকে এগিয়ে গেল। এখন শীতকাল। মাটি খটখটে শুকনো। তাই বিমল পায়ের ছাপ দেখার আশা করেনি। একি! ঘাসের উপর রয়েছে কেডসের আবছা চিহ্ন! ওই জায়গায় চারপাশ খুঁটিয়ে দেখে আরও কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টা করল বিমল। কিন্তু সে প্রয়াস বিফল হয়।
বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় বিমলের নজরে পড়ল বাগানের একপাশে রাখা একটা কাগজের স্তূপের ওপর। একেবারে ওপরেই রয়েছে খবরের কাগজের একটি পাতা। আর সেখানে একটি ফটোগ্রাফ। আশ্চর্য, এ যে বিমলেরই ছবি! একমাস আগে যুগান্তর পত্রিকায় বেরিয়েছিল। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হল এই যে ছবির ওপর আঁকা রয়েছে দাড়ি আর গোঁফ। ফলে চেহারাটা হয়ে গেছে অবিকল অমিয়নাথ বোসের মতোই।
যুগান্তরটা হাতে তুলে নিতেই দেখে কাগজের স্তূপের মধ্যে একটি আইডেন্টিটি কার্ড। নীচে নাম লেখা পি. সি. বিশ্বাস, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল, ডিভিশন-২, সেকশন-সি। আর্মির পোশাক পরিহিত এক যুবকের ফটো, বয়স কোনওক্রমেই পঁচিশের বেশি নয়। গোঁফ দাড়ি কামানো, মাথায় ঢেউ খেলানো কালো চুল। বিমল যুগান্তরের সঙ্গে এই আইডেন্টিটি কার্ডটিও হস্তগত করল। সর্বশেষ যে জিনিসটা সে সংগ্রহ করল সেটা হল ঘাসের ওপর পড়ে থাকা কিঞ্চিৎ গুঁড়ো পদার্থবিশেষ। একটুকরো কাগজ ছিঁড়ে সেটাতে গুঁড়োটুকু সে মুড়ে নিল। তারপর এগিয়ে গেল সদর দরজার অভিমুখে।
দুপুর ঠিক বারোটার সময় বিমলের একটা ফোন এল। পলাশবাবুরই ফোন। কাপের হাতলে দুইপ্রকার বিভিন্ন ফিঙ্গারপ্রিণ্ট পাওয়া গেছে।
দুপুরের খাওয়ার পর বিমল কাজে লেগে গেল। ইলেকশনের সময় বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ দিতে যে স্পিরিট ব্যবহৃত হয় বিমলও একশিশি অনুরূপ স্পিরিট পার্শবর্তী একটি মণিহারী দোকান থেকে কিনে আনল। এর দ্বারা বাড়ির প্রতিটি বাসিন্দার ফিঙ্গারপ্রিণ্ট সে জোগাড় করল একটি সাদা ফুলস্কেপ কাগজের মধ্যে। চাকর রমেশের আর তার নিজেরও টিপসই নিতে ভুলল না। টেবিলে ইন্সপেক্টর পলাশ ঘোষ এসে উপস্থিত হলেন। নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের ল্যাবরেটরিতে তিনিই কাগজটি নিয়ে গেলেন।
পরদিন সকালে পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়ে গেল। প্রথম ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিমলের। কিন্তু বাকি আটজনের কারোরই আঙ্গুলের ছাপের সঙ্গে দ্বিতীয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলেনি।
।।সপ্তম পরিচ্ছেদ।।
নিমাইসাধন খুন হন রবিবার। তারপর তিনদিন কেটে গেছে। আজ বৃহস্পতিবার। একটু আগেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট সম্বন্ধে তার পূর্ব অনুমান সবই বিফল হয়েছে। এ সত্ত্বেও গতকাল সে যে মূল্যবান সূত্রগুলো আবিষ্কার করেছিল সেগুলো তাকে অনেকখানি অনুপ্রাণিত করেছে। সেগুলো সত্যিই কতদূর মূল্যবান আর খুনীই সেগুলোকে ঘটনাস্থলে রেখে গেছে কি না তা সে জানে না। কিন্তু এতদিনে সে যেন একটু আলোর আভাস দেখতে পেয়েছে। এখন কর্তব্য হবে আলোর উৎস কোথায় সেটাই সঠিক বের করা। প্রথমে একটি সূত্র ধরে যদি একটিমাত্র রহস্যের উদঘাটন করা যায় তবে আপনা থেকেই হয়তো বাকি সব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে।
সর্বপ্রথম কাজ হল কালকে পাওয়া গুঁড়ো পদার্থটি সম্বন্ধে ভাল করে জানা। কাল সে যখন পলাশবাবুকে ফিঙ্গারপ্রিন্টের কাগজটি দিয়েছিল তখন তার একথা মনে ছিল না। তাই আজ সকাল দশটায় সে নিজেই গিয়ে নীলরতন সরকার কলেজে গুঁড়োগুলো জমা দিয়ে এল।
নিজের ঘরে ঢুকে সে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে শুয়ে একমনে ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে বিমল নোটবই খুলল। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ সে দেখতে পেল সেই সাঙ্কেতিক লেখাটা যেটা সে খুনের আগেরদিন নিমাইবাবুর ফাইল থেকে টুকে রেখেছিল। অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে সাঙ্কেতিক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে হয়তো ওতে গুপ্ত কিছু নেই। তবু সে পাঠোদ্ধারের কাজে প্রবৃত্ত হল।
কিন্তু বেশীক্ষণ এ নিয়ে সে ভাবতে পারল না। একটা বুদ্ধির ঝিলিক তার মাথায় খেলে গেছে। এক লাফে বিছানা থেকে নেমে সে সোজা চলে গেল দোতলার মিঃ সুরেন দাসের ঘরে।
মিঃ দাস তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন, “আসুন আসুন মিঃ সাহা। বসুন। চা আনতে বলব?”
“না না। আমি এক্ষুনি উঠব। একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে এসেছি।”
“কী, বলুন?”
“আপনি যে খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়েছেন সেখানে হত ব্যক্তির নাম কী?”
“মিঃ অর্ধচন্দ্র বিশ্বাস। কলকাতার একটি বড়ো ফ্যাক্টরীর মালিক ছিলেন।”
“ধন্যবাদ। আসি।” বিমল উঠে পড়ল।
তারপর কী মনে করে সে একতলায় গেল। আজ আবার নিমাইসাধন সান্যালের ঘরে। এবারও অনুসন্ধান করতে। আজ ঘরের চেহারা অন্যরকম। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আর তা বোধহয় ঘরের মাঝখানে খাটটা না থাকার দরুণ। তবে অন্যান্য সব আসবাবপত্র মোটামুটি একইরকম আছে। শুধু আলমারীর মাথায় রাখা ভিটামিন ক্যাপসুলের শিশিটা সে প্রথমদিন দেখেনি।
আধঘন্টাটাক কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটির পর বিমল ফিরে এল দোতলায়। আজ বৃহস্পতিবার, দুপুরে বাড়িতে বিশেষ কেউ নেই। আছেন অনিমেষবাবু আর সুরেনবাবু। অন্য পেয়িং গেস্টদের ঘর খালি। একবার ঘুরে দেখলে হয় না? দোতলার ঘর তিনটির মধ্যে দু’টি এখন ফাঁকা। প্রথম সে অরুণ বণিকের ঘরে ঢুকল।
বেশ বড়ো ঘর। মাঝখানে খাট, ধবধবে সাদা চাদর পাতা। একপাশে রাখা কাচানো ও ইস্ত্রি করা জামা ও প্যান্ট। দেখে মনে হল যে এখানকার ধোপার কাজ খুব একটা খারাপ নয়। শুধু একটি সাদা প্যান্টে সবুজ দাগ লেগেছিল। এছাড়া ঘরে রয়েছে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো বইয়ের তাক। সেখানে স্তরে স্তরে সাজানো বই। ঘর দেখে বিমলের ধারণা হল যে অরুণবাবু লোকটি পরিচ্ছন্ন স্বভাবের এবং কাজ পাগলা।
এরপরে বিমল প্রবেশ করল অবিনাশ মিত্রের ঘরে। এই ঘরটি আকারে তো কম নয়ই আর আসবাবের অভাবে আরও অনেক বৃহদাকৃতি বলে ভ্রম হচ্ছে। এই ঘরে খাট ছাড়া রয়েছে টেবিল চেয়ার। টেবিলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বিমল দেখল যে এর ওপরের অংশটা খুব একটা মসৃণ নয়। বিমলের মনে হল যে কোনও একটা ভারি জিনিস টেবিলের উপর রাখা হয়েছিল। যেটা টেনে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঘষটানোর দাগ সুস্পষ্ট। এছাড়া টেবিলে আরও রয়েছে একটা ভাঙা মোমবাতির গোড়া। বাকি পুরো ঘরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বিমল আবিষ্কার করল একটি বহুদিনের পুরনো ছেঁড়া পোকায় খাওয়া বই। ওপরের লেখাটা কষ্টে পড়ল ‘New course in Pitmans Short Hand.’
বিকেলের দিকে বিমল একটু বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। বাড়ি থেকে বেরোনোর মুখে ধাক্কা খেল অবিনাশের সঙ্গে। এ বাড়িতে যেদিন পেয়িং গেস্ট হিসেবে এসেছিল সেদিনের পর আজ আবার। অবিনাশের হাতে একটি সুবৃহৎ বাক্স।
রাসবিহারী এভিনিউ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিমল অল্পক্ষণের মধ্যেই পৌঁছল গড়িয়াহাটের মোড়ে। চৌমাথা পেরিয়ে ডানদিকে ঘুরে সে গড়িয়াহাট রোড দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল। প্রশস্ত রাজপথ। উভয়পার্শ্বেই ফুটপাথে অজস্র দোকান। রাস্তার মাঝখানে ট্রামের লাইন। নিউমার্কেট সম্প্রতি আগুনে বিধ্বস্ত হয়েছে। তাই এই গড়িয়াহাট মার্কেটই আপাতত কলকাতার সেরা বাজার।
দু’দিকেই সমানভাবে নজর রেখে বিমল এগিয়ে চলল। যার অন্বেষণে সে বেরিয়েছিল সেই তালুকদার টেক্সটাইলস দোকানটিরও সন্ধান পেতে তার বেশি দেরি হল না। বেশ বড়ো দোকান। লোকজনের ভিড়ও কম না। ভেতরে ঢুকে সে একজন কর্মচারীর দিকে এগিয়ে গেল। কর্মচারী সে মুহুর্তে ব্যস্ত ছিল না। বিমলকে উদ্দেশ্য করে সে প্রশ্ন করল, “কী চাই বলুন?”
“দোকানের মালিকের সঙ্গে একটু কথা ছিল।”
“এ দোকানের ম্যানেজার তো কনক বসু।”
“আজ্ঞে না, আমি খোদ মালিকের কথা বলছি।”
“তেনার নামধাম আমি কিছুই জানি না। আপনি ম্যানেজার মিঃ বসুর কাছেই খোঁজ করুন। সেলস কাউন্টারে আছেন, উনিই সব বাতলে দেবেন।”
কর্মচারী ভদ্রলোক ক্রেতাদের দিকে এগিয়ে গেল। বিমল তার নির্দেশমতো কনকবাবুর কাছে গেল।
“আচ্ছা, এ দোকানের মালিকের নাম জানতে পারি, মিঃ বসু?” জিজ্ঞাসা করল সে।
“কে, পরেশ তালুকদার?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। উনি থাকেন কোথায়?”
“আসানসোলে। এখানে কালেভদ্রে আসেন। এ সময়ে একবার আসার কথা ছিল। এখনও এসে উঠতে পারেননি।”
বিমল বিদায় নিল। আজ আবার সে গেল রিপন লেনে ডাঃ বিবেক ভট্টাচার্যের সঙ্গে দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারের জন্য।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত আটটা হয়ে গেল। খাওয়ার আরও আধঘন্টা দেরি আছে। ততক্ষণ সে নিশ্চিন্তে একটু গবেষণা করতে চায়। হাত পা ধুয়ে ঘরে উঠে সে খাটে বসল। তারপর পাশের টেবিলে রাখা যুগান্তর কাগজটি তুলে নিল। এই খুনের রহস্য প্রায় উন্মোচিত হয়ে এসেছে। এখন এই সূত্রটি অনুসরণ করে কতদূর যাওয়া যায় দেখা যাক।
তার নিজের ছবি। অমিয়নাথের ছবিও বলা যেতে পারে। ছবির নীচে ছাপার অক্ষরে লেখা – ওপরে রয়েছে সখের গোয়েন্দা বিমল সাহার ফটো। সখের গোয়েন্দাগিরির কথা আজকাল কেবল গল্পেই পড়া যায়। কিন্তু অশোককান্তি ব্যানার্জির হত্যাকাণ্ড ও তার পলাতক আততায়ীর সনাক্তকরণ রূঢ় বাস্তবের ঘটনা। যে আশ্চর্য উপায়ে শ্রীবিমল সাহা এই অসাধ্যসাধন করেছেন তা আমাদের অভিনন্দনযোগ্য।
নিজের সম্বন্ধে প্রশংসার লেখা পড়তে অন্য সময়ে হয়তো বিমলের ভালোই লাগত। কিন্তু এখন সে ও নিয়ে অযথা মাথা ঘামাল না। তার নজর ছাপাটির দিকে। নীল ফেল্টপেন দিয়ে সেখানে আঁকা রয়েছে মোটা গোঁফ আর চাপদাড়ি। বোঝাই যাচ্ছে আঁকিয়ে বিমলের ছদ্মবেশটি অনেক আগেই ধরে ফেলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে এই নীল ফেল্টপেনের শিল্পীই কি তার রিভলভার অপহরণকারী? সে-ই কি খুনি? বিমল অনেক কিছুই তদন্তের ফলে জানতে পেরেছে বটে, কিন্তু এটা সম্বন্ধে এখনও সে অবগত হয়নি।
যুগান্তরটা ওল্টাতে সেই একই ফেল্টপেনের আঁকা একটা নকশাগোছের জিনিস তার চোখে পড়ল। পাতার একপাশে একটু সাদা জায়গায় এটি আঁকা।
বিমল আর ভাবতে পারল না। সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। এও কি সত্যি হতে পারে? নাকি এ স্বপ্ন? কিন্তু চোখের সামনে যা দেখেছে তা স্বপ্ন হবে কী করে? আবছাভাবে সে দেখছে তা স্বপ্ন হবে কী করে? আবছাভাবে সে দেখল যে এরই মধ্যে রমেশ ঘরে ঢুকে এসে একপাশে দাঁড়িয়েছে।
“আপনার ফোন এসেছে।” সেই একই গম্ভীর কন্ঠস্বরে বলল রমেশ। বিমল খাট থেকে নেমে চটি পরে নীচে নামল।
বৈঠকখানায় ঢুকে সে রিসিভার তুলে নিল। “আমি নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের ডাক্তার আশিস ধর। আপনার ওই গুঁড়োগুলো সম্বন্ধে…”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন।”
“ওগুলো আর কিছুই না, ভিটামিনের বড়ির মিহি গুঁড়ো মাত্র। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে না দেখেই বোঝা যায়। খবরটা আপনাকে দিতে দেরি হল বলে কিছু মনে করবেন না। আসলে এর আগে সময় হল না।”
“না না, ও ঠিক আছে। ধন্যবাদ। আজ রাখছি।”
ফোন রেখে বিমল ডাইনিং রুমে খেতে গেল। খাওয়ার সময় একটাও কথা বলল না সে। তারপর ঘরে গিয়ে খাতা খুলে অনেক রাত পর্যন্ত কী লিখল সেই জানে। এখন রাত। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে। বিমলের তীক্ষ্ণদৃষ্টি সেই সূচিভেদ্য আঁধারকে ভেদ করছে বটে, কিন্তু এখনও সে পুরোপুরি সবকিছু দেখতে পাচ্ছে না। আগামীকাল সকালেও কুয়াশা থাকবে। কেবল দুপুরের দিকেই সূর্যের আলোর দীপ্তি পৌঁছবে বিমলের কাছে।
।।অষ্টম পরিচ্ছেদ।।
শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটায় বিমলের ঘুম ভাঙল। আজ খুব দেরি হয়ে গেছে। কুয়াশা নেই। জানালা দিয়ে বয়ে আসছে সূর্যের উজ্জ্বল রশ্মি। রহস্যের জাল সরে গেছে। বিমলের মুখে তাই আজ আনন্দের হাসি।
সকলের প্রাতরাশ হয়ে গেছে। টেবিল খালি। তাই বৈঠকখানা যাওয়ার পথে রান্নাঘরে ঢুকে বিমল রমেশকে ঘরে খাবার দিতে বলে গেল। তারপর গিয়ে লালবাজার থানার ফোন নম্বর ডায়াল করল।
কিছুক্ষণ পরে ওদিক থেকে ভেসে এল পলাশ ঘোষের গলা, “কে, বিমল নাকি?”
“হ্যাঁ পলাশবাবু, আন্দাজে ঠিকই ধরেছেন। নিমাইসাধন সান্যালের খুন কে করেছিল, কীভাবে করেছিল এবং কেন করেছিল এসব আর আমার কাছে এখন অপরিষ্কার নেই।”
“সে কী! রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে? এ যে একেবারে অবিশ্বাস্য!”
“আপনাকে যে জন্য ফোন করলাম তা হল এই, আপনি আজ রাত আটটা নাগাদ এখানে চলে আসবেন। ওই সময়ের মধ্যে বাড়ির সব বাসিন্দাই কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে আসবেন আশা করা যায়। একটা সভা বসিয়ে সেখানেই আমি সবকিছু ঘোষণা করব। আমি চাই যে আপনিও সভাকক্ষে উপস্থিত থাকেন।”
সেদিন কাঁটায় কাঁটায় রাত আটটায় বৈঠকখানায় বৈঠক বসেছে। বিমল আগেই অনিমেষবাবুকে দিয়ে এর আয়োজন করিয়ে রেখেছিল। এখন ঘরে উপস্থিত আছে বাড়ির সব সদস্যই। আর এসেছেন ইন্সপেক্টর পলাশ ঘোষ। দরজার কাছে যারা সান্ত্রীর মতো পাহারা দিচ্ছে সেই দু’জন পুলিশের লোক, বিমল আর রমেশ দাঁড়িয়ে। অন্য সকলে উপবিষ্ট। অখন্ড নীরবতা ঘরের মধ্যে বিরাজ করছে। এই নৈঃশব্দ ভেদ করেই শোনা গেল বিমলের গলা। সে কথা আরম্ভ করে দিয়েছে।
“নিমাইসাধন সান্যালের আসল নাম আমি অত্যন্ত আকস্মিকভাবে দিন দশ বারো আগে জানতে পারি। নিউ আলিপুর পার্কে একটি মানিব্যাগ আবিষ্কার করি ও তার মধ্যে একটি আইডেন্টিটি কার্ড পাই।
“প্রথম থেকেই নিমাইবাবু আমার সন্দেহ উদ্রেক করেছিলেন। নিজের সম্বন্ধে যে তিনি প্রচার করে বেড়ান না আবার নিজের পূর্বজীবন গোপন রাখতে চান ও সর্বোপরি তিনি পুলিসের নজর এড়াতে চান, এই ধারণাগুলো আমার মনে বদ্ধমূল হয়। যেমন ধরা যায়, নিমাইবাবু ব্যাগের কোনও কাগজপত্রে নিজের ঠিকানা লিখে রাখেননি। এমনকি, খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের উত্তরে তিনি ব্যাগটি সংগ্রহ করতেও আসেননি। যার থেকে স্বতঃই মনে হয় যে তিনি লালবাজার থানায় যেতে অনিচ্ছুক। তিনি স্টেটসম্যান রাখেন না এই নিছক মিথ্যা কথাটিও বলার চেষ্টা করেছিলেন।
“এইসব কারণেই প্রথম আমি ছদ্মবেশে এখানে চলে আসি। এর পরদিনই অবশ্য নিমাইবাবু খুন হন। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে আসার আগে আমি তাঁর পূর্বজীবন সম্বন্ধে আলোচনা করে নিতে চাই। অনিমেষবাবু আমাকে বলেছিলেন যে তিনি বিভিন্ন সময়ে ড্রাইভার, সেক্রেটারী ও কলকাতা বন্দরে রক্ষা বিভাগের কর্মচারীর কাজ করেছেন। এবার দেখুন এই পুরনো ছেঁড়া কাগজের টুকরোটি। এটি নিমাইবাবুর ফাইলে ছিল এবং এতে দেখতে পাচ্ছি কতকগুলো সংখ্যা সাজানো রয়েছে। নিমাইবাবুর কর্মজীবনে পরিবর্তন হয়েছে ক’বার? পরিবর্তনের সংখ্যা এখানে দেখতে পাচ্ছি তিন। প্রথম দেখুন একটি সংখ্যা ৩৫৬৯। এটি বোঝাচ্ছে সন ও তারিখ। ১৯৬৯ সালের পঞ্চম মাস মে, তারিখ তেসরা মে। এইদিনই তিনি গাড়ি চালকের চাকরি পান। এই হল তাঁর কর্মজীবনের প্রথম পরিবর্তন। এরপর চাকরি বদল ৭।৭।৭৩ তারিখে, সেক্রেটারীর পদে নিয়োগ, ও তারপর ১০।১।৭৬ তারিখে আবার কোনও নতুন নিয়োগ। সেক্রেটারী হওয়ার আগে নিমাইবাবুর আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। অথচ আজ থেকে ঠিক ন’বছর আগে তিনি যখন চাকরি ছেড়ে দিলেন তখন হঠাৎ অগাধ সম্পত্তির অধিকারী হলেন ও সেই টাকা দিয়েই এই বিরাট বাড়িটি তৈরি করলেন।
“মারা যাওয়ার আগে নিমাইবাবুর শেষ কথা ছিল ‘পাপ মানেই মৃত্যু’। অনিমেষবাবু, আপনার প্রয়াত দাদার প্রতি আপনার শ্রদ্ধা বহুল পরিমাণে হ্রাস পাবে যদি আজ আপনি জানেন যে তিনি একটি অতি গুরুতর পাপ করেছিলেন। সে পাপ হল খুন। পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভে তিনি মিঃ অর্ধচন্দ্র বিশ্বাসকে খুন করেন। মিঃ দাস, আপনি এবার সহজেই আপনার মক্কেল সেই নির্দোষ চাকরটিকে বাঁচিয়ে দিতে পারবেন।”
সকলে নির্বাক। শুধু পলাশবাবু ধীর গলায় কথা বললেন। “এতক্ষণে মনে পড়ছে বিমল। রিপন লেনের মিঃ বিশ্বাসের খুনের তদন্ত করতে আমি সেখানে যাই। সেক্রেটারী নিমাইসাধনই ছিল বটে।”
“সে কথায় আসছি পলাশবাবু। তার আগে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই কাগজে অঙ্কিত এই তীরচিহ্নগুলোর দিকে। এই রেখাগুলো প্রথমদিকে নীচে থেকে উপরে নির্দেশ দিচ্ছে। অর্থাৎ, তিনি বোঝাতে চাইছেন কীভাবে তিনি নিজেকে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করে চলেছেন। জীবনের শেষ পরিবর্তনের ফলে তিনি আর্থিক সাচ্ছন্দ্য অনেকটাই বাড়াতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই নৃশংস কর্মের জন্য তিনি নিজের কাছে কি অনেক নীচে নেমে যাননি? এই দ্বন্দ্বই প্রকাশ পাচ্ছে এই প্রশ্নসূচক চিহ্নের মধ্যে দিয়ে।
“পলাশবাবু আর নিমাইবাবুর পূর্বপরিচিতি ডাক্তার বিবেক ভট্টাচার্য। এই দু’জনই তাঁর চেহারাটা ঠাওরাতে পেরেছিলেন। কিন্তু নামে চিনতে পারেননি। আসলে নাম আর চেহারা এই দু’টোই পালটে ফেলেছিলেন নিমাইসাধন সান্যাল। তাঁর প্রাক্তন নাম যে অসীম সান্যাল ছিল তা আমি ডাঃ ভট্টাচার্যের কাছ থেকেই জেনেছি। আর ন’বছর আগে নিমাইবাবু তাঁর গোঁফটি কামিয়ে ফেলেছিলেন।
“এই ফটোটা তো আপনার চেনা চেনা লাগছে। তাই না মিঃ বণিক?” চকিতের মধ্যে বিমলের গলার স্বর পালটে গেছে। সে এখন একদৃষ্টে চেয়ে আছে অরুণ বণিকের দিকে। তার হাতে বাগানে কুড়িয়ে পাওয়া আইডেন্টিটি কার্ডটা। উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই সে বলে বসল, “আমি যদি বলি যে এ ছবি আপনারই, এ আইডেন্টিটি কার্ড আপনারই সম্পত্তি আর আপনার প্রকৃত নাম পূর্ণচন্দ্র বিশ্বাস, তাহলে কি খুব ভুল বলা হবে? পলাশবাবু মিঃ বিশ্বাসের গোঁফ আর ওই প্লাস্টিসিনের বাড়তি নাকটুকু খুলে ফেলুন তো।”
অল্পক্ষণের মধ্যেই অরুণ বণিক পরিণত হলেন পি. সি. বিশ্বাসে। প্রতিবাদ করা দূরের কথা, তাঁর মুখ থেকে একটি বাণীও বেরোল না। মাথায় সযত্নে লাগানো পাকা চুলগুলো সত্যি যেন পাকতে আরম্ভ করেছে।
বিমল বলে চলল, “সেদিন আপনার ঘরে যখন যাই তখন দেখি যে একটা সাদা প্যান্টে সবুজ দাগ লেগে আছে। মিলিটারি পোশাক থেকেই তো ওই রঙ লাগে, তাই না? এটাও তো আপনারই কীর্তি। ঠিক তো?”
বিমল এবার হাতে তুলে নিয়েছে যুগান্তরের পাতাটি। “থিয়েটারের ব্যাপারে আপনার শখ আছে। আর যে লোক স্টেজে ছদ্মবেশ করায় সে তো চট করেই অন্যের ছদ্মবেশ ধরতে পারে। আবার নিজেও সে ছদ্মবেশ পরতে পারে। তাই না? আমার এবারের ছদ্মবেশ খুব যে পাকা হয়নি সেটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু তাতে কোনও অসুবিধা হয়নি।”
এতক্ষণে অনিমেষবাবু একটা কথা বললেন, “কিন্তু উনি খুনটা করলেন কীভাবে আর কী কারণে? রবিবার সকালে তো উনি ব্রেকফাস্ট টেবিলেও ছিলেন না।”
“সে কথা ঠিক। সেজন্যই আমার সন্দেহ প্রথমে ওনার ওপর পড়েনি। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে কী হয়েছে জানেন, চায়ে আদৌ বিষ মেশান হয়নি। মিঃ সান্যাল প্রতিদিন প্রাতরাশের আগে একটি করে ভিটামিন ক্যাপসুল খেতেন। শনিবার দুপুরে মিঃ বিশ্বাস ক্যাপসুলের শিশিটি মিঃ সান্যালের ঘর থেকে নিয়ে তার মধ্যেকার শেষ ক্যাপসুলটির, একটিই তখন বাকি ছিল – ভিটামিনগুঁড়ো ফেলে দিয়ে পরিবর্তে তার মধ্যে আর্সেনিক বিষ পুরে শিশিসমেত ক্যাপসুলটি যথাস্থানে রেখে দেন। শনিবার আমি নিমাইবাবুর ঘরে যাই। কিন্তু সেদিন ছিলেন মিঃ বিশ্বাস, অনিমেষবাবু ও রমেশ। অর্থাৎ, এই তিনজনের মধ্যে একজন ছিল হত্যাকারী।”
এইখানে একটু থামল বিমল। তারপর আবার সে কথা শুরু করল। “মিঃ বিশ্বাস, আপনি যে তুখোড় লোক তা মানতেই হবে। মঙ্গলবার রাতে আপনি আমার ঘরে অনধিকার প্রবেশ করেছিলেন। আমি ভাবতেও পারিনি যে সেটা আপনার পক্ষে আদৌ সম্ভবপর। কারণ, আপনি যে একজন পঞ্চাশ বছর বয়সের প্রৌঢ় ব্যক্তি! আপনার বয়স যে পঁচিশ তা জানব কী করে? অবশ্য কাগজে বাড়ির ছক এঁকে ছবি বর্মণের ওপর আপনি আমার সন্দেহকে আকৃষ্ট করতে চাইলেও সেই ছলনায় আমি ভুলিনি। আর অবিনাশবাবু, আপনার টেবিলে ভাঙা মোমবাতির ডাঁটি দেখে কিছুটা সন্দিগ্ধ হলেও রাত জেগে আপনি কী করছিলেন তা সহজেই বুঝতে পারি। কারণ, টেবিলে ছিল ভারি জিনিস সরানোর দাগ। অর্থাৎ, টাইপ রাইটিং ছাড়া অন্য কিছু হয়তো আপনি করেছিলেন না।
“এবার চলে আসি খুনের কারণ প্রসঙ্গে। এতক্ষণে হয়তো আপনারা ঠিকই অনুমান করতে পেরেছেন যে পি. সি. বিশ্বাস হলেন এ. সি. বিশ্বাসেরই উপযুক্ত পুত্র। পিতার হত্যার প্রতিশোধকল্পে আপনি হত্যাকারীকে নিজেই খুন করতে উদ্যত হয়েছিলেন। যা আমি ভালোভাবেই জানি। এজন্য আপনাকে আমি প্রশংসা করতে দ্বিধা করছি না।”
“কাপে আবিষ্কৃত দু’নম্বর ফিঙ্গারপ্রিন্টটা কার?” বলে উঠলেন পলাশবাবু। সংক্ষিপ্ত উত্তর পেলেন, “ওটা হত্যাকারীর নয় হত ব্যক্তির।”
খুনের অপরাধে অভিযুক্ত মিঃ পি. সি. বিশ্বাস এবার উঠে দাঁড়িয়েছেন, “আমি সগর্বে ঘোষণা করছি যে মিঃ সাহা এতক্ষণ যা বললেন সে সবই সম্পূর্ণ সত্য। বীরের মতো জীবন বিসর্জন দেওয়ার ইচ্ছা আমার ছেলেবেলা থেকেই ছিল ও সেজন্যই আমি আর্মিতে যোগদান করেছিলাম। আজ আমার জীবনের সেই মাহেন্দ্রমূহূর্ত এসে উপস্থিত হয়েছে। আমার বাবার নীচ হত্যাকারীকে নিজহাতে প্রাণদণ্ড দেওয়ার মধ্যেও যদি কোনও পাপ থেকে থাকে তবে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় মৃত্যু। আমি সানন্দে সেই মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছি।”
পলকের মধ্যেই পকেট থেকে ক্যাপসুল বের করে মুখে পুরলেন পূর্ণচন্দ্রবাবু ও অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁর দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
ছবিঃ মৌসুমী
(সম্পাদকীয় বক্তব্যঃ ১৩৯৩ সালের শারদীয় তরুণতীর্থ পত্রিকায় প্রকাশিত এ উপন্যাসের লেখক ছিল সদ্য টিন এজার এক তরুণ। তাঁর মা শ্রীমতী সুস্মিতা চক্রবর্তীর সৌজন্যে লেখাটি উদ্ধার করে পুণঃপ্রকাশিত হল। )