এসো গান শুনি
[এই দেশের বহুত্বের স্বর বহুধাবিস্তৃত। নানা ভাষা, ধর্ম, আচারের বে-নি-আ-স-হ-ক-লা’র মতো এই দেশের সঙ্গীতের বহতা ইতিহাসের ধারাও নানা বাঁকে বাঁকে নিজেকে পুনরাবিষ্কার করেছে। জয়ঢাকের এই প্রবন্ধমালায় আমরা সেই বিরাট শ্রুতির ধারার কয়েকজন পুরোধার জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত বয়ান করব]
প্রথম পর্ব
পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে
ঠাকুর পরিবারের বড়ো তরফ মানে পাথুরিয়াঘাটা অংশের এক কৃতী পুরুষ ছিলেন সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৪০-১৯১৪)। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের দুই ধারার সঙ্গীতেই তাঁর ছিল গভীর পান্ডিত্য আর অনেক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি এই বিষয়ে। ১৯০৭ সালে মহারাষ্ট্র থেকে এক আইনজ্ঞ কলকাতায় আসেন তাঁর সঙ্গে সঙ্গীত বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। এই মানুষটা মাতৃভাষা মারাঠী ছাড়াও হিন্দি, গুজরাটি, তামিল আর সংস্কৃত ভাষায় ছিলেন সুপণ্ডিত। এছাড়া কর্মসূত্রে ইংরেজি তো জানতেই হত সেই সময়। কলকাতায় আসার আগে তিনি বাংলা ভাষাটাকেও খুব ভালো করে রপ্ত করেছিলেন একটা বিশেষ কারণে। সেকালের প্রখ্যাত সঙ্গীত বিশারদ কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘গীতসূত্রসার’ (প্রথম প্রকাশ ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে) ছিল ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের এক আকর গ্রন্থ। কেবলমাত্র এই বইটাকে পাঠ আর অধ্যয়ণের জন্যই তাঁর এই ভাষাশিক্ষা। এই ধরণের গভীর অনুসন্ধিৎসা সব দেশে সব কালেই বিরল। শুধুমাত্র বাংলা না, ওই মানুষটা ভারতের অন্যান্য বেশ কিছু প্রদেশের ভাষাও শিখেছিলেন এই একটামাত্র কারণে মানে ওইসব ভাষায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিছু প্রামাণ্য গ্রন্থ গভীরভাবে অধ্যয়ন করার জন্য। সঙ্গীতের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এই মহান মানুষটার নাম হল পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে (১৮৬০ – ১৯৩৬) আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রচার, প্রসার এবং অনেক অজানা রাগ আর শ্রুতির ধারাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রামান্য বয়ানে রেখে যাওয়ার পেছনে যার অবদান কোন বিশেষণেই বাঁধা যাবে না।
ছোটবেলা থেকেই চিরাচরিত পড়াশোনার পাশাপাশি সঙ্গীত বিষয়ে তাঁর এই প্রবল অনুসন্ধিৎসা লক্ষ করা যায়। সঙ্গীত শিক্ষার জন্য তিনি অসংখ্য গুরুর কাছে গিয়েছিলেন এবং তাঁদের গান্ডা বাঁধা শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন। ১৮৮৪ সালে এফ.এ. পাশ করার পর সে-সময়ের বোম্বে শহরের কাছে ‘গায়ন উত্তেজন মণ্ডলী’ নামে এক প্রসিদ্ধ সঙ্গীত শিক্ষা কেন্দ্রের সদস্য হয়ে যান ভাতখন্ডেজি। পাশাপাশি রাওজীবুয়া বেলবাগকার নামে এক বিখ্যাত ধ্রুপদীয়ার কাছে শুরু হয় ধ্রুপদ শিক্ষা। প্রায় একই সাথে মহম্মদ হোসেন এবং বিলায়ত হোসেনের কাছে চলছিল খেয়াল চর্চা।
এছাড়া সেতার এবং বীণা বাজানোতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর দক্ষতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছোয় যে ‘গায়ন উত্তেজন মণ্ডলী’র পরিচালনার ভার তাঁকেই দেয়া হয়। ইতিমধ্যে ১৮৯০ সালে আইন পরীক্ষায় পাশ করে এক দক্ষ আইনজীবী হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন মহারাষ্ট্রে। কিন্তু সঙ্গীতই ছিল তাঁর প্রথম ভালোবাসা। সঙ্গীতের জন্য অনেক সময় তিনি নিজের আইনব্যাবসা ফেলে ছুটে যেতেন কোনো পণ্ডিত বা ওস্তাদের বাড়ি অজানা বন্দিশের খোঁজে।
ভারতীয় সঙ্গীতে ভাতখন্ডেজির অবদান সম্বন্ধে বিচার করার আগে একটা প্রসঙ্গ বলে নেয়া উচিৎ। প্রাচীন এবং মধ্য যুগে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের যে ধারা ছিল তাঁর প্রকৃত রূপ নিয়ে নানা ধন্দ আছে পণ্ডিতদের মধ্যে। ভারতীয় সঙ্গীত শ্রুতি নির্ভর মানে স্বরের সূক্ষ্মতম ভগ্নাংশেও লুকিয়ে আছে তার পরিচয়। যেমন উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত অনুযায়ী ষড়জ বা সা চার শ্রুতির, ঋষভ বা রে তিন শ্রুতির ইত্যাদি। দক্ষিণ বা কর্নাটকী সঙ্গীতে আবার আছে মেল পদ্ধতি যার পঞ্জীকরণ আরো সূক্ষ্ম। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে গত দু-তিনশ বছরে ভারতীয় সঙ্গীতের কিছু মূলগত পরিবর্তনের জন্য সেই প্রাচীন যুগের সঙ্গীত বিষয়ক প্রামাণ্য বইগুলোতে লেখা বিভিন্ন রাগের স্বর বা শ্রুতির অবস্থানকে ধরতে পারা খুব মুস্কিল বা প্রায় অসম্ভব ছিল। ভরত মুনির লেখা ‘নাট্যশাস্ত্র’ এর মতো সুপ্রাচীন বা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শার্ঙদেবের লেখা ‘সঙ্গীত রত্নাকর’ এমন কিছু আকর গ্রন্থ।
ঊনবিংশ শতাব্দীতেই বোঝা যাচ্ছিল যে এইসব বইতে লেখা স্বরের অবস্থানকে অনেক সময়ই ধরতে পারা যাচ্ছে না। বিদেশী মিশনারিদের প্রভাবে ভারতীয় মূল স্কেল (যা ছিল রাগ কাফি নির্ভর) পাশ্চাত্যের মতো টেম্পার্ড স্কেলে (রাগ বিলাবল অনুসারে – যার সব স্বর এখনকার পদ্ধতি অনুসারে শুদ্ধ) পরিবর্তন হয় গত দু-তিনশ বছরে। খেয়ালের জন্মও প্রায় একই সময়ে (অনেকের মতে মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ রঙ্গিলার শাসনকালে)। এই পরিবর্তনের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই কোন কোন রাগের আগের চেহারাটাকে ধরতে পারা যাচ্ছিল না সেই সময়।
এছাড়া বিভিন্ন ঘরানায় রাগের শ্রুতির বেশ কিছু সূক্ষ্ম বা স্থূল পার্থক্য দেখা যায় যার ফলে সাধারন সঙ্গীত শিক্ষার্থীর কাছে কোন রাগ আয়ত্ত করার ক্ষেত্রে একটা বড়ো বাধা দেখা দিচ্ছিল। আর একটা কথা বলে নেয়া ভালো যে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকেই থেকেই চিরাচরিতভাবে গুরুর কাছে সঙ্গীত শিক্ষার পাশাপাশি সঙ্গীত শিক্ষার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছিল যেখানে অনেক বেশি সংখ্যায় শিক্ষার্থীরা শিখতে পারত। ভাতখন্ডেজি সারা ভারতে অনেক গুণী সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে আলাপ আলোচনা করে অসংখ্য প্রামাণ্য গ্রন্থ গভীরভাবে পড়ে কতগুলো মূল সিদ্ধান্তে আসেন একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর কাছে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের মূল চেহারাটা যথাযোগ্য প্রামাণ্যভাবে তুলে ধরার জন্য।
১৯০৯ সালে সংস্কৃতে ‘লক্ষণগীত’ আর ‘অভিনবরাগমঞ্জরী’ নামে দুটো বই লিখে তাঁর সিদ্ধান্তগুলো প্রাঞ্জলভাবে প্রকাশ করার কাজ শুরু করেন তিনি। এই বইগুলোতে প্রথম ঠাটভিত্তিক রাগের প্রকারভেদ আর আর তাদের সময় বিধি বর্ণনা করা শুরু হয়। পরের বছর মানে ১৯১০ সালে ‘লক্ষণগীত’ বইয়ের একটা বিস্তৃত টীকা হিসেবে মারাঠীতে ‘হিন্দুস্থানী সঙ্গীত পদ্ধতি’র প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়। এই বই ভাতখন্ডেজিকে সারা ভারতে বিরাট প্রসিদ্ধি দেয়।
১৯১৫ সাল থেকে নিখিল ভারত সঙ্গীত সম্মেলন শুরু হয় বরোদায়। ভাতখন্ডেজিই ছিলেন তার মূল উদ্যোক্তা। এর প্রভাবে সারা ভারতের বিভিন্ন শহরে নানা সঙ্গীত সম্মেলনের চল শুরু হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যার অন্যতম উদ্যোক্তা আর বিচারক ছিলেন তিনি। এর মধ্যে দিল্লি, বেনারস লখনউ এইসব জায়গায় হওয়া সঙ্গীত সম্মেলন ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর উদ্যোগে বরোদা, গোয়ালিয়র ইত্যাদি রাজ্যে সঙ্গীত বিদ্যালয় স্থাপিত হয় স্থানীয় রাজা বা নবাবের পৃষ্ঠপোষকতায়। এর সাথে সাথেই চলছিল ‘হিন্দুস্থানী সঙ্গীত পদ্ধতি’র বাকি খন্ডগুলো প্রকাশের কাজ।
১৯৩২ সালে এই বইয়ের শেষ (ষষ্ঠ) খন্ড প্রকাশিত হয়। প্রায় দু’হাজারের মতো খেয়াল আর ছশোর বেশি ধ্রুপদের সমন্বয়ে এই বই অনাগত সব সঙ্গীত শিক্ষার্থী আর সঙ্গীত পিপাসুর জন্য এক উজ্জ্বল দিকচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে তার পর থেকে।
[ভাতখন্ডে বর্ণিত পদ্ধতির এক সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের জন্য নিচের ভিডিওটা দেখ]
১৯২৬ সালে লখনউয়ের নবাব হামিদ আলি খাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় লখনউ ম্যারিস কলেজের প্রতিষ্ঠা হয় যা কিছুদিনের মধ্যেই সারা ভারতে অন্যতম সঙ্গীতশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ভাতখন্ডেজিই ছিলেন এর প্রথম অধ্যক্ষ।
সেই সময় এই কাজে তাঁর এক অন্যতম সুহৃদ ছিলেন কবি অতুলপ্রসাদ সেন যিনি নিজে লখনউ হাইকোর্টের এক প্রধান আইনজীবি হওয়ার পাশাপাশি সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ছিলেন গভীরভাবে উৎসাহী। এই ম্যারিস কলেজ পরে ভাতখন্ডে সঙ্গীত বিদ্যাপীঠ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, পরবর্তীকালে বিখ্যাত অভিনেতা পাহাড়ি স্যান্যাল এই গুণীজনেরা ছিলেন এই কলেজের প্রথম দিককার ছাত্র। এই সময়ই রামপুর স্টেটের নবাবের সাথে ভাতখন্ডেজির বন্ধুত্বের ফলে নবাবের গুরু সেনিয়া ঘরানার বিখ্যাত ওস্তাদ উজির খান এবং ছম্মন খানের কাছ থেকে অসংখ্য ধ্রুপদ শিক্ষা করেছিলেন তিনি আর তাঁর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যে এইসব গানের প্রামাণ্য স্বরলিপি তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছিলেন।
রক্তচাপ আর অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও সত্তরের পরেও তিনি বয়সকে তুড়ি মেরে সঙ্গীত বিষয়ে অনেক গবেষণা আর অধ্যয়নে কাজে মগ্ন হয়েছিলেন। তবে অত্যধিক পরিশ্রমে তাঁর শরীর আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছিল। ১৯৩৩ সালে এক ভয়ঙ্কর পক্ষাঘাতের ফলে তাঁর জীবনীশক্তি অনেকটা ক্ষীণ হয়ে আসে। শেষে ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬ সালে বোম্বে শহরে দিনের শেষে এক চির ঘুমের দেশে চলে যান ভাতখন্ডেজি।
ঘোমটা পরা ওই ছায়ার ওপারে দেবতারাও হয়তো ছিলেন এই সুরের সাধকের জন্য অধীর অপেক্ষায়। ভারতীয় সঙ্গীতের সারস্বত সাধনায় তাঁর অবদান বিশেষ করে ঠাটের ওপর ভিত্তি করে রাগের জাতিবিচার তাঁকে ভারতীয় সঙ্গীতের মহাসমুদ্রে এক পথ দেখানো বাতিঘর হিসেবে এক স্থায়ী অমরত্বের স্থান দিয়ে গেছে।
[ভাতখণ্ডেজির প্রিয় শিষ্য এবং তাঁর বর্ণিত পদ্ধতির অন্যতম প্রতিনিধি পন্ডিত শ্রীকৃষ্ণ নারায়ণ রতনজনকরের কন্ঠে কানাড়া অঙ্গের রাগের বিস্তৃত ব্যাখ্যা শোনার জন্য নিচের ভিডিও ক্লিপটা দেখ ]
চলবে
গ্রাফিক্স্- ইন্দ্রশেখর