দীপালি দেবনাথের আগের লেখা পারাচিনারের স্মৃতি
বেহাগ
দীপালি দেবনাথ
সুকুমার রায় তাঁর বিখ্যাত ‘আবোল-তাবোল’এ বলেছেন ‘বেহাগ সুরে গাইবে কেবল রাধে কৃষ্ণ রাধে’। রাগ বিহাগ, বাংলা ভাষায় বেহাগ । শুধু বিহাগ কেন বেশির ভাগ রাগই , বোধ হয় সব রাগেরই বন্দিশ অর্থাৎ যাতে চার পংক্তির রচনায় রাগের মূল রূপকে বন্দি করা হয়, রাধা-কৃষ্ণ কে কেন্দ্র করে ঘোরে । মোটমাট শৃঙ্গার রস সব চাইতে পছন্দ রচনাকারদের ও বাগ্যেয়কারদের। ধ্রুপদের বিষয় হল মূলত ভগবত্ প্রেম। সেই সব রচনার মধ্যে আছে নিরাকার ব্রহ্ম, শিব পার্বতীর বর্ণনা, প্রকৃতি, কখনও রাজা-মহারাজা কে ভগবত জ্ঞানে স্তুতি। ধামারের বিষয় হলো দোল খেলা বা হোলি খেলা ,তাতে রাধা কৃষ্ণ গোপিকাদের তো আসতেই হবে ।
যাক সে কথা, আমি ভাবছি একটি মিষ্টি সুন্দর রাগ বিহাগকে নিয়ে। সবই শুদ্ধ স্বর, আবার ওঠার সময়ে সিঁড়ি টপকিয়ে পাঁচ ধাপেই শেষ করে অর্থাৎ ‘আরোহণে ‘ পাঁচটা স্বর ব্যবহার হয় আর ‘অবরোহণে’ সাতটা ধাপই অর্থাৎ সাত স্বরই ব্যাবহার করতে হয়। বিধি-নিষেধ তো কিছু আছেই; যেমন ‘ষড়জ’ এবং ‘পঞ্চম’ অর্থাৎ ছোট্ট করে সা ও পা ছাড়া অন্য একটি স্বরে ও ঘুরে ফিরে বিশ্রাম নেবার জায়গা অর্থাৎ ‘বাদী’ স্বর ‘গান্ধার’ যার ডাক নাম ‘গা’ আর তারপরেই আসে সম্বাদী স্বর ‘নিষাদ’ বা ‘নিখাদ’, ডাকনাম ‘নি’ ।
আরও আছে যাকে বলা হয় ‘বিবাদী’ স্বর। বলছি। শিল্পী সুর তুলছেন ‘ সা—-গ ম গ ,গ ম প ধ – গ ম গ –,গ ম প ন সা (তার সপ্তকের সা) নি ধা পা –গম গ– ইত্যাদি । সুরে ভাসতে ভাসতে দেখলেন একটা কুঠুরীর দরজায় সামান্য ফাঁক, তীব্র ‘মধ্যমের’ ঘরের। তীব্র ‘মা’ মাথা টা বার করেই ‘ পা’ কে ছুঁয়েই পালিয়ে গেল। শিল্পী দেখলেন এ তো বেশ মজা! রাগের মধুরতা তো বেড়ে গেল, তাহলে তাই হোক। তাই এই স্বরের নাম ‘ বিবাদী’।
শুরু হল –গ ম পা নি (সা) নি ধ পা (ম)পা -গ ম গ , গ রেসা –। রে র সঙ্গে সাক্ষাত মাত্র বিদায় নেবার তাড়া । রঞ্জয়তী ইতি রাগম। তবে ‘বিহাগে’ তীব্র মধ্যমের প্রয়োগ কিঞ্চিৎ অর্বাচীন। রবীন্দ্রসঙ্গীত বা অতুলপ্রসাদের অনেক গান বিহাগড়া রাগের ওপর, এ-গুলোয় অনেক ক্ষেত্রে বিহাগ ব্যবহার হয়েছে কোমল নিষাদের ছোঁয়া লাগিয়ে কিন্তু তীব্র মধ্যমকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডের ‘ক্রমিক পুস্তক মালিকা’ তে উনি একটি লক্ষণ গীত (যে রচনায় রাগের লক্ষণ সমুহ বলা হয়) লিখেছেন —
‘शुद्ध सुरन को मेल करे गुनि गावत राग बिहाग
औडब समपुरन कर मानत उपजत नित अनुराग ।
वादी गान्धार करे सुर सहचर ताको देत निषाद
रात समय नित दूजे प्रहर में गावत सब बड़े भाग ‘।।
দোরের বাইরে দাঁড়িয়ে তীব্র মধ্যম কিন্তু দুষ্টুমির মুচকি হাসি হাসছে, ‘যাবে কোথায়? আমি আছি না!”
আজ কিন্তু তীব্র মধ্যমের প্রয়োগ সর্বজনমান্য । বিবাদি হয়ে অবশ্য। শুদ্ধস্বর গুলো থেকে সরে গিয়ে চারটে কোমল স্বর আর একটা তীব্র স্বরের জন্ম তাই এদেরকে বিকৃত স্বরও বলা হয়। কেন এই নামকরণ আমার জানা নেই। বিদ্বানের দেওয়া নাম এবং সর্বজনস্বীকৃত। বেসুর বা অ-সুর তো নয়! বরং সাত সুরকে আরো মহিমান্বিত করে সুরময় করে তুলেছে।
রাগগুলোকে আবার ‘ঠাট’ বদ্ধ মানে গোত্রে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। মহামতি পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে দশটি পরিবারে গোষ্ঠিবদ্ধ করেছেন। যথা–
বিলাবল ~সব শুদ্ধ স্বর,
খামাজ~ একটি কোমল স্বর, শুদ্ধ নি কে সরিয়ে কোমল নি,
কাফি~ দুটি কোমল স্বর , গা এবং নি ,শ
আসাবরী~ তিনটি কোমল স্বর, গা ,ধৈবত অর্থাৎ ধা এবং নি,
ভৈরবী~ স্বরগ্রামে চারটি কোমল স্বরের অবস্থান চারটেই লাগে ; ঋষভ অর্থাৎ রে ,গা , ধা ,এবং নি ।
ভৈরব~ রে এবং ধা কোমল বাকি সব শুদ্ধ স্বর অর্থাৎ দুটি স্বর মোলায়েম ও বাকি স্বর ঠাট নামের ধ্বজা ধরে রয়েছে ।
কল্যাণ~ কেবল একটি স্বর শুদ্ধ নয় ,তীব্র মধ্যম (চড়া মা ) । এর স্বরও নামের প্রতি শ্রদ্ধাবান ।
মারবা~ এর রে কোমল আর তীব্র মা কিন্তু ষড়জ অর্থাৎ সা সহজে ধরা-ছোঁয়া দেয় না । একেবারেই “যে কেবল পালিয়ে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায় ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে।” ধৈবত বলবান।
পূর্বী~ এর ধা আবার নরম, মোলায়েম অর্থাৎ কোমল, রে কোমল মধ্যম তীব্র আবার শুদ্ধ নি-এর বার বার আনাগোনা ।
তোড়ি~ রে গা ও ধা কোমল তার সঙ্গে তীব্র মা ।
আবার সেই বিহাগ রাগেই ফিরে আসি। এই অতি মিষ্টি রাগ বিহাগ বিলাবল ঠাটের ঘরে পড়ে তাকে ধনী করেছে । সঙ্গে তার যৌতুক এসেছে আরো কত রাগ। অবরোহণে সোজাসুজি নয় একটু রসিকতা করে কোমল নিষাদ লাগিয়ে একটু চলন বাঁকা করে ষড়জে ফিরে আসা।
গা মা পা গামাগা –, গা মা–গামা গা—গামাপাধা—মা পা –গামাগা–গামাপাধা (নি কোমল ) ধাপা গা মা গা, গারেসা ।
অর্থাৎ ফিরে এসে দলবল নিয়ে কোমল নি-এর সঙ্গে দেখা করে আসা। ফেরার সময়ে আলতো করে রে কে ভালোবেসে ছুঁয়ে আসা।
রাগ ‘বিহাগড়া’ নামের সখীর এই রঙ্গ। আবার স্মরণে আসায় চট করে কোমল গান্ধারের সঙ্গে দেখা করা, সেই সখী, তাকে আদরের নাম দেওয়া হয় রাগ ‘খোখর’ ; কী সব রগড়! আহা। কত রাগ! ‘পটবিহাগ’ আছে কাছাকাছি। আবার কখনও বা ‘মারু’ কে ‘নট’ কে ডাক দেয় বা আর কাউকে, যুগলে রঙ্গ করার জন্যে।
‘মারুবিহাগ’, ‘নটবিহাগ’। বলে শেষ করা যায় না। কখনও অন্য পরিবার থেকে রাগ ‘নন্দ’ এসেই ‘বিহাগড়া’ ‘পটবিহাগ’ ‘খোখর’দের সঙ্গে দেখা করেই চলে যায়। মানে সম প্রাকৃতিক রাগের ‘ আবির্ভাব’ আর ‘তিরোভাব ‘ হয়। আমি শুধু দু’কান ভরে শুনি আর মনের রং তুলি দিয়ে মনের আঙিনায় আলপনা দিয়ে ভরার ইচ্ছেয় থাকি। কিন্তু পারি কী ?
‘এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে ‘