গল্প অচেনা শহর মো.শামীম মিয়া বর্ষা ২০১৭

  1. মোঃ শামীম মিয়ার আগের গল্প  শেষ চিঠি 

মো. শামীম মিয়া

বাবা ঢাকা শহরে গেছেন, আসবেন সাতদিন পর তা ছোট্ট ইতি জানত। তবুও মাকে বার বার জিজ্ঞাসা করে, “মা, বাবা ঢাকা থেকে কখন আসবে?”

মা ইতির মনের অবস্থা বুঝতে পারে, ইতির মনটা বেশ খারাপ। কেননা, বাবাই যে ইতির একমাত্র খেলার সাথী। ইতিও যেন বাবার কলিজার একটুকরো মাংস। অভাব-অনটনের সংসার। জীবন বাঁচানোর তাগিদে ছুটতে হয় শহরে। ঢাকা যাওয়ার সময় বাবা ইতিকে বলে গেছেন, “বাড়িতে আসার সময় তোমার জন্য অনেকগুলো খেলনা নিয়ে আসব।”

ইতিও ঝটপট বলে দিয়েছে, “মাটির হাঁড়ি-পাতিল আনবা। আমি ভাত-তরকারি রান্না করব, তুমি আর মা খাবে।”

বাবা ইতির কপালে একটা চুমা দিয়ে চলে গেলেন। রাত হলেই ইতি ছটফট করত, কান্না করত। সহজে ঘুমায় না, রোজ রাতে নতুন একটা গল্প বলতেই হবে। মা বেশি গল্প জানত না। যা জানত সব বলা শেষ। মা ইতিকে সান্ত্বনা দিত, “তোমার বাবা ঢাকা থেকে অনেক অনেক গল্প শিখে আসবে। বাবা না আসা পর্যন্ত শুধু ঘুমাও আর ঘুমাও।”

সাতদিন হয়ে গেছে। বাবা আসবে বলে ইতি এখনও কিছু মুখে দেয়নি। যাকে দেখা পায় তাকেই বলে, “আজ আমার বাবা আসবে। আমার জন্য অনেককিছু আনবে।”

ইতি বাবার পথ চেয়ে বাড়ির সামনে বড়ইগাছটার নিচে বসে আছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল বাবা আসছে না। ইতি দৌড়ে একবার মার কাছে যায়, আরেকবার গাছটার নিচে আসে। সন্ধ্যা হয়ে এল তবুও বাবার খোঁজ নেই। সন্ধ্যার ঝাপসা আলোতে দূরদূরান্তে দুইটা লোককে দেখা যাচ্ছে। ইতি দৌড় দেয় লোকদুটির দিকে। কাছে গিয়ে দেখে, হ্যাঁ, তার বাবা এবং এক চাচা আসছে। ইতি বাবার কাছে গিয়েই বাবাকে ঝাপটে ধরে আর বলে, “বাবা, তোমার জন্য সকাল থেকে ঐ বড়ইগাছটার নিচে বসে আছি তুমি আসবে বলে।”

বাবা ইতিকে কোলে নিয়েই চুমা খেতে লাগল। হঠাৎ চাচা বলল, “কী রে, কীভাবে আসলি? দেশের যে অবস্থা, তোর কোনও সমস্যা হয়নি তো?”

বাবা বলল, “অল্পের জন্য বেঁচে গেছি মিলিটারিদের হাত থেকে। ঢাকা শহরের করুণ অবস্থা। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের যেন সেখানেই সূচনা। একেকটা রাত যেন সেখানে ভয়াল কালরাত্রির মতো। পোড়া কাঠ আর লাশ, জননীর কান্না নিয়ে রক্তে রাঙা একেকদিনের নতুন সূর্য উঠছে।”

ইতি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, আর শুনছে বাবার কথাগুলো। চাচা বলল, “এখানেও তো কম নয়।”

বাড়ির কাছে আসা মাত্রই চাচা বাবাকে বলল, “পরে কথা হবে।” এই বলে তিনি চলে গেলেন।

আঙিনায় বাবা আসা মাত্রই ইতি বাবার কোল থেকে নেমেই চটের ব্যাগটা খুলতে থাকে আর বলে, “বাবা, আমার জন্য কী কী এনেছ?”

বাবা বলল, “তুমি যা যা চেয়েছ, আমি তাই এনেছি মা। ঘরে গিয়ে সব বের কর।”

ইতি মাথা নাড়িয়ে চলে যায় ঘরে। বাবা ইতির মা’র কাছে এসে বলে, “ইতির মা, দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা করছে বাঙালিদের। আমরা বাঙালিরাও পাকিস্তানিদের উচিত শিক্ষা দিবই।”

মা’র দু’চোখে তখন দু’ফোঁটা পানি টলমল করছিল। বাবা বলল, “ইতির মা, পাকিস্তানিরা আমাদের দেশকে তাদের আয়ত্তে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করছে। কিন্তু আমরা জনতা, ছাত্রসমাজ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলবই।

“ইতির মা, আমার বাবা বলত, মানুষের যতগুলো অনুভূতি আছে তার মধ্যে সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে ভালোবাসা। আর এই পৃথিবীতে যতগুলো ভালোবাসা আছে তার মধ্যে তীব্র ভালোবাসাটুকু হতে পারে শুধুমাত্র মাতৃভুমির জন্য। যারা কখনও নিজের মাতৃভূমির জন্য ভালোবাসাটুকু অনুভব করেনি তাদের মতো দুর্ভাগা আর কেঊ নেই। ইতির মা, আমি সৌভাগ্যবান হতাম যদি যুদ্ধে যেতে পারতাম।”

ইতির মা জানত বাবা এই কথাই বলবেন। মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি চাই তুমি যুদ্ধে যাও, দেশ-মাকে রক্ষা কর পাকিস্তানিদের হাত থেকে। রক্ষা কর দেশের লক্ষ লক্ষ মায়ের সম্মান।”

মা’র দু’চোখে দু’ফোঁটা জল চিকচিক করছিল। মা আরও বলল, “ইতির বাবা, আমার যদি উপযুক্ত একমাত্র সন্তান থাকত তাহলে আমি অনেক আগেই তাকে যুদ্ধে পাঠাতাম।”

বাবা বলল, “কীভাবে যুদ্ধে যাব জানি না। কার সাথে যাওয়া যায় বল তো ইতির মা?”

মা বলল, “রহমত নাকি যুদ্ধে যাবে। তুমি ওর সাথে কথা বল।”

বাবা ঘরে না গিয়ে গেলেন রহমতের বাড়ি। রহমত বাবার মুখে দেশপ্রেম ও অন্তরে দেশের জন্য ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হলেন। বললেন, “তুমি বাড়ি যাও। যেকোনও সময় আমরা যুদ্ধে যাব।”

বাবা মাথা নাড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে।”

এই বলে বাবা এলেন বাড়িতে। অনেক রাত হয়েছে। বাবা ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই দেখেন ইতি চুপটি করে বসে আছে বাবার অপেক্ষায়। বাবা বলল, “মা, তুমি ঘুমাওনি এখনও?”

ইতি বলল, “বাহ্‌ রে, তোমার মুখে গল্প না শুনে কি আমি ঘুমিয়েছি কখনও?”

বাবা ইতির কপালে চুমা দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, তাহলে গল্প শোন। আজ তোমাকে নতুন একটা গল্প বলব। গল্পের নাম, অচেনা শহর। সেখানে তারাই যেতে পারে যাদেরকে সৃষ্টির্কতা পছন্দ করে। তবে একদিন সেই দেশের বাসিন্দা আমরা সবাই হব। যারা এই পৃথিবীতে ভালো কাজ করবে তারা সেখানে বিশাল বাড়িতে থাকবে, কোনওকিছুর অভাব থাকবে না।”

ইতি মনোযোগ সহকারে শুনছে বাবার কথা। বাবা বলল, “শহরটার চারদিক থাকবে ফুলে ফলে ভরা। যার যা মন চাইবে তাই পাবে। পরির মতো উড়তেও পারবে। সেই শহরে সবাই যখন যে যেথায় যেতে চাইবে সেথায় যেতে পারবে।”

মা পাশের রুম থেকে বলল, “ইতির বাবা, খেতে এস। সারাদিন তো কিছুই খাওনি। ইতিকেও নিয়ে এস।”

বাবা মা’র কথার উত্তর দেওয়ার আগেই শুরু হল ঠাস ঠাস গুলির শব্দ। মা দৌড়ে এলেন এ ঘরে। এসে ইতিকে বুকে জড়িয়ে নিলেন আর বললেন, “ইতির বাবা, গ্রামে হয়তো মিলিটারি ঢুকে পড়েছে। ঘরের আলোটা নিভে দাও যাতে ওরা মনে করে এখানে কোনও মানুষ থাকে না।”

বাবা তাই করলেন। প্রায় দশ মিনিট পর দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে। ইতির মা ইতিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আছে। বাবা হাতে নিলেন ইয়াব্বড়ো একটা লাঠি। বাবা রাগী কন্ঠে বললেন, “কে?”

উত্তর এল মৃতকন্ঠে, “আমি রহমত, দরজা খোল।”

বাবা দরজা খুলে দিলেন। রহমত ঘরে ঢুকে নিজেই দরজা বন্ধ করে বললেন, “আমাদেরকে এখনই যেতে হবে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানিরা।”

বাবা অনেক আগেই ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। বাবা করুণ মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মা দু’চোখের পানি মুছে বলল, “কিছু খেয়ে যাও। সারাটাদিন মুখে কিছুই দাওনি।”

বাবা কিছু বলার আগেই রহমত বললেন, “ভাবী, আমাদের সাথীরা বটতলায় অপেক্ষা করছে। গ্রামের পশ্চিমে গোলাগুলি হচ্ছে। আমাদের এখন যেতেই হবে।”

বাবা আর কোনও কথা না বাড়িয়ে তার গায়ের চাদরটা নিলেন। দেখলেন, ইতি ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগেই। বাবা ইতির কপালে একটা চুমা দিয়ে কাঁদা কন্ঠে বললেন, “ইতির মা, ইতিকে দেখে রেখো।”

মা কথা বলা মাত্রই কেঁদে উঠতেন, তাই মাথা নাড়িয়ে বললেন ঠিক আছে। নিজের কষ্ট বুকে রেখে শুধু মা বললেন, “নিজের প্রতি খেয়াল রেখো।”

বাবা আর রহমত চলে গেল যুদ্ধের উদ্দেশ্যে। মা ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে নীরবে কাঁদছে। এদিকে ইতি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে ভাসছে।

ইতি স্বপ্নে এসেছে সেই অচেনা শহরে। ঐ যে দূরদূরান্তে পরির মতো ডানাসহ বাবাকে দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে রহমত চাচাও আছে। ইতি দৌড়ে যায় সেখানে। বাবা, বাবা বলে ডাকছে। বাবা কেন যেন শুনছে না। রহমত চাচা, চাচা বলে ডাকলেও শুনছে না। ইতি বাবা এবং চাচাকে ধরতে চায়, কিন্তু ধরতে পারে না। বাবা আর রহমতচাচা এই ফুলের গাছ থেকে অন্য ফুলের গাছে যাচ্ছে। সবাই মিলেমিশে উড়ে বেড়াচ্ছে। কারও সাথে কারও ঝগড়া নেই। আমাদের দেশের মতো নেই গোলাগুলি। সবার মুখেই হাসি। ইতি ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে এবং বাবার সাথীদের বলে, “আমার বাবাকে একটু ডেকে দাও না! কেউ কি আমার কথা শুনতে পারছ না?” হঠাৎ বাবা চোখের আড়ালে চলে গেল। ইতি বাবাকে আর খুঁজে পেল না।

হঠাৎ ইতি ঘুমের মধ্যে চিৎকার দিয়ে উঠল, “বাবা, আমায় ছেড়ে যেও না বাবা।”

মা পাশের রুম থেকে দৌড়ে এসে বলল, “কী হয়েছে, মা?”

ইতি চোখ মেলে দেখল অনেক আগেই সকাল হয়েছে। ইতি মাকে অচেনা শহরের কথা বলল। মা চোখে পানি আর রাখতে পারল না। কেননা, মা তো বুঝেছে বাবা অচেনা শহর বলতে কোন শহরের কথা বুঝিয়েছে। মা বুঝে গেছেন তার স্বামী হয়তো শহীদ হয়েছে, যদি ইতির স্বপ্ন সত্য হয়। দিনের পর দিন চলে যায়, বাবা আর ফিরে আসে না। ইতি আর মা সেই বড়ইগাছের নিচে বসে থাকে বাবার আশায়, বাবা আসবে বলে।

একদিন এই দেশটা স্বাধীন হল। সবাই লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে আনন্দ-মিছিল করছে। ইতি মাকে হাতের ইশারায় বলল, দেখ মা, ঐ দেখ। লাল-সবুজ পতাকার মধ্যে বাবাকে দেখা যাচ্ছে। বাবা হাসছে। মা বাকশূন্য অবস্থায় লাল-সবুজ পতাকার দিকে পাথর চোখে তাকিয়ে আছেন। তার চোখে ঝরনার মতো পানি ঝরছেই।

গ্রাফিক্স : তন্ময়

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s