উদয়ারুণ রায়ের আগের গল্পগুলো– রতনলাল কবিরাজ স্বপ্নের কাতুকুতু ফুল ও পরীর গল্প
ছোটো ছোটো মুরগিগুলো দু’টুকরো করে কাটা। ছ’টা মুরগির বারো টুকরো। গলা বাদ, পেটের নাড়িভুঁড়ি বাদ। জহর মুরগির টুকরোগুলোকে ভালো করে ধুয়ে নুন-হলুদ মাখাচ্ছিল। মেলা ভালো চললে মালিক-ম্যানেজারদের খাওয়াদাওয়ার ধুম লেগে যায়। সকাল-বিকাল মাংস-মাছ দেদার। এই একটু আগে ব্রেকফাস্ট হল, ভাত আর নানান শীতের সব্জি দিয়ে জ্যান্ত ছোটো ট্যাংরামাছের ঝোল।
মেলা বসেছে ত্রিপুরার কুমারঘাট নামে এক জায়গায়। এখানে ত্রিপুরার মানুষ তিনবেলা ভাত খায়। সকাল, দুপুর ও রাতে। তিনবেলা তাদের ভাত চাই। জহরও ত্রিপুরার ছেলে। ওর বাড়ি খোয়াই। জহরেরও তিনবেলা ভাত চাই।
জহর এই আনন্দমেলা কোম্পানিতে আছে সাতবছর। ওর কোম্পানির নাম ডি.কে.এন্টারপ্রাইজ। ডি.কে. অর্থাৎ, দিলীপ কুমার। কোম্পানীর মালিকের নাম। জহর মালিকের খাস ছেলে। সাতবছর আগে বারো-তেরো বছর বয়সে জহর এই মেলা কোম্পানিতে এসে ঢোকে। সেসময় মেলা চলছিল সোনামুড়া বলে ত্রিপুরার এক জায়গায়। সোনামুড়া জায়গাটা বাংলাদেশের একদম বর্ডারে। ওপারে বাংলাদেশের কুমিল্লা। সোনামুড়া থেকে কুমিল্লা রেলস্টেশনের ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা যায়। সোনামুড়ায় রেলপথ নেই। কুমিল্লায় আছে। কুমিল্লার ক্ষীরতোয়ার খুব নাম। অমৃতের মতো খেতে। এই সোনামুড়াতে প্রথম এসে ঢোকে সে এই মেলা কোম্পানিতে। সেই শুরু মেলা জীবন। পনেরো-বিশদিন অন্তর অন্তর জায়গা বদল। এক-দু’মাস বাদে বাদে রাজ্য বদল। এই সাতবছরে জহর ভারতবর্ষের কত রাজ্য দেখল। ত্রিপুরা তো ওর নিজের রাজ্য। ত্রিপুরা বাদেও ও দেখল অসম, মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল আর উত্তরবঙ্গ। নিজের রাজ্য বাদেও ছ-ছ’টা দেশ দেখেছে জহর। প্রত্যেকটা রাজ্যই খুব সুন্দর। পাহাড়, মেঘ আর সবুজের মাখামাখি সবদেশে। দেশ দেখার জন্য জহর ঘর ছেড়েছিল। কিন্তু এসব রাজ্যে গিয়ে ওদের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে ওর খালি মায়ের কোলের কথা মনে হয়েছে। মায়ের কোল যেমন নিশ্চিন্ত, স্নেহমাখা, শীতলতা মাখা – এই রাজ্যগুলোও ঠিক সেরকম। সবুজ পাহাড়, কালো মেঘভরা আকাশ আর ক্ষেতভরা সবুজ ফসল। রুক্ষতা নেই কোনওখানে।
জহর এই মেলা কোম্পানির খিদমতগার। মালিকদের ফাইফরমাস খাটা আর ওদের স্পেশাল রান্নাগুলো করে দেওয়া ওর কাজ। নির্দিষ্ট কোনও ডিউটি নেই ওর। মালিকরা পাঁচভাই। বড়োভাই বাদে চারভাই মেলাতে থাকে। দিলীপ কুমার মেজোভাই। সেই এই কোম্পানির সর্বেসর্বা। অন্য ভাইরা তার অ্যাসিস্ট্যান্ট। এছাড়াও ম্যানেজার আছে দুইজন। এই ছয়জনের সব অর্ডার মানতে হয় জহরকে। এছাড়া আছে ক্যাশিয়ারদাদা। ক্যাশিয়ারদাদার তাঁবুতেই থাকে জহর। জহরকেও মাঝেমাঝে ক্যাশিয়ারদাদা বাথরুমে বা টয়লেটে গেলে ক্যাশবাক্স পাহারা দিতে হয়। জহরকে সবাই বিশ্বাস করে। ক্যাশিয়ারদাদা খুব ভালোও বাসে। বড়োমালিক অর্থাৎ দিলীপ কুমারও ওকে খুব ভালোবাসে।
একবার এক মজার ঘটনা ঘটেছিল। সে কথা মনে পড়লে এখনও হাসি পায় জহরের। তখন জহর সবে মেলায় ঢুকেছে। তিন কি চারমাস হবে। সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মেলা শুরু হয়ে গেছে। মাঠে লোক ভর্তি। নাগরদোলনা ঘুরছে। এক তাঁবুতে ডিস্কো-ড্যান্স হচ্ছে। তার মাইক বাজছে তারস্বরে। আর একদিকে টয়-ট্রেন চলছে। নৌকো চলছে। সারি দিয়ে দোকান। কোনওটা কসমেটিকসের, কোনওটা জামাকাপড়ের। কোনওটা বা খেলনার। ব্যাগের দোকানও আছে। এমন কি সংখ্যায় কম হলেও জুতোর দোকান আছে তিন-চারটে। এছাড়া লাকি-ড্র, সবান রিং, বন্দুক শুটিং এসব তো আছেই। এককথায় জমজমাট মেলা চলছে। জহর যথারীতি ক্যাশিয়ারদাদার তাঁবুতে আছে। চলতি ভাষায় তাঁবুকে বলা হয় রাউটি। ক্যাশিয়ারদাদার রাউটি পাহারা দিচ্ছিল সে। ক্যাশিয়ারদাদা গৌরাঙ্গ তখন ক্যাশবাক্স খুলে ক্যাশ গুনছে। সে ওকে বলেছে, “রাউটির পর্দা ফেলে দে। আর তুই একটা টুল নিয়ে বাইরে বোস। কাউকে রাউটির ভিতরে ঢুকতে দিবি না, আমি যতক্ষণ না বলছি। এমন কি ম্যানেজারদেরও নয়। একমাত্র মালিকরা ছাড়া।”
জহর তখনও বড়োমালিক দিলীপ কুমারকে দেখেনি। শুনেছে বড়োমালিক নিজের বাড়ি কলকাতায় গেছে। মালিকের অন্য ভাইদের চেনে সে। জহর ক্যাশিয়ারদাদার কথায় ঘাড় নেড়ে রাউটির পর্দা ফেলে টুল নিয়ে বাইরে গিয়ে বসেছে চৌকিদারি করতে। এই তাঁবুতে সে ঢুকতে দেবে না কাউকে। যতক্ষণ না ক্যাশিয়ার গৌরাঙ্গদাদার অনুমতি মিলছে। এদিকে মেলা চলছে জমজমাট। মেলার মাঠে ভিড় থিকথিক করছে। একবার একজন ম্যানেজার শম্ভু দাস এসে ক্যাশিয়ার-রাউটিতে ঢুকে যাচ্ছিল হন হন করে। জহর রুখে দাঁড়াল। টুল ছেড়ে উঠে পথ আটকাল শম্ভু দাসের। বলল, “এখন এই রাউটিতে ঢোকা মানা আছে।”
শম্ভু দাস থমকে গেল। তারপর অবজ্ঞার গলায় বলল, “ছাড়, পথ ছাড়। পোঙটামি করিস না। কাম আছে কইয়াই তো ঢুকুম।”
জহর আরও দৃঢ় গলায় দুই হাত দু’দিকে ছড়িয়ে ম্যানেজার শম্ভু দাসকে গাদি খেলার ভঙ্গিতে পথ আটকে বলল, “আমার উপর অর্ডার নাই। তুমি ভিতরে যাইতে পারবা না।”
জহরের গলার স্বর আর শরীরের দৃঢ়তা দেখে শম্ভু দাস আর ওকে ঘাঁটাল না। ক্যাশিয়ার-রাউটিতে না ঢুকে আবার মেলার দিকে চলে গেল।
এর কিছুক্ষণ পর আবার একজন এল মেলার ভিড় টপকে। জহর দেখল, লোকটার বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা। ছাই রঙের সাফারি স্যুট পরা। হাতে একটা দামি সুটকেস। পায়ে দামি জুতো। ডানহাতের আঙুলে চার-চারটে সোনার আংটি। জহর মনে মনে ভাবল, এই কি বড়োমালিক?
লোকটা গটমট করে এসে ক্যাশ-রাউটিতে ঢুকতে যাচ্ছিল। জহর একবার ভাবল, নিশ্চয়ই এই লোকটা বড়োমালিক হবে। কিন্তু না জেনে সে রাউটিতে ঢুকতে দেবে কীভাবে? সেই আগের কায়দায় পথ আটকাল লোকটার। ম্যানেজারের মতো লোকটাও পথ আটকানোয় থমকে দাঁড়াল। জহর বলল, “এখন রাউটিতে ঢোকা মানা আছে।”
লোকটা থমকে গেলেও জহরের মতো বাচ্চাছেলের বলার ধরনে ওর দু’হাত মেলে পথ আগলে দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে হেসে ফেলল। তারপর মিষ্টি গলায় জিজ্ঞাসা করল, “ভিতরে কে আছে রাউটিতে? কী হচ্ছে যে ঢোকা বারণ?”
জহর বিজ্ঞের মতো গলা করে বলল, “তা আপনেরে কমু ক্যান? আপনেরে আমি কি চিনি? শুধু এইটুকু শুইন্যা রাখেন, ক্যাশিয়ারদাদা কওয়া না পর্যন্ত ওই রাউটিতে কেউ ঢুকব না।”
জহরের কথা শুনে আবার হেসে ফেলল লোকটা। হাসতে হাসতে ওর গাল টিপে দিয়ে বলল, “যা, তোর ক্যাশিয়ারদাদাকে গিয়ে বল, দিলীপ কুমার এসেছে। তার রাউটিতে ঢোকার পারমিশন আছে কি না জেনে আয়।”
দিলীপ কুমার নামটা শুনে জহর জিভ কেটে এক স্যালুট বড়োমালিককে। নীচু স্বরে বলেছে, “অপরাধ নিবেন না, বাবু। আমি আপনেরে চিনি না তো, তাই আটকাইছি। গৌরাঙ্গদা আমারে এই ডিউটি দিছে।”
উত্তরে দিলীপ কুমার বলছে, “ঠিক করেছিস, আটকেছিস। ডিউটিতে ফাঁকি দিসনি বলে খুশি আমি।”
সেই থেকেই দিলীপ কুমারের প্রিয় ছেলে জহর। জহর সৎ বৈষ্ণব পরিবারের ছেলে। বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। জহরের বাবা চাষি। খোয়াইয়ে ওদের চার-পাঁচ বিঘা ধানজমি। সেই জমির চাষের উপরেই ওদের সংসার চলে। জহররা তিনবোন একভাই। জহর সবার ছোটো। ওর বয়স যখন বারো বছর তখন ক্লাস সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষায় ও অঙ্কে পেল পাঁচ আর ইংরাজিতে দশ। দুটো বিষয়েই ফেল। রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে বাবার হাতে সে খুব মার খেল। বাবা ভীষণ মারল ওকে। সেই যে জহর পড়া ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হল আর বাড়িমুখো হল না সে। এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে সে এই মেলা কোম্পানিতে এসে জুটল। এখানে এসে আটকে গেল সে। আর বাড়ি ফেরা হল না। মেলা কোম্পানির সঙ্গে সে এ-মাঠ ও-মাঠ, এ-রাজ্য ও-রাজ্য, এদেশে সেদেশ ঘুরে বেড়াতে লাগল। কত মানুষ দেখল সে, কত নদী দেখল, কত পাহাড় দেখল। কত ভাষা জানল। কিছুটা শিখলও। সে বাংলা বাদেও ত্রিপুরার আদিবাসীদের ভাষা জানে। কিছুটা অসমীয়া ভাষা বলতে পারে। একটু একটু মণিপুরিও জানে সে। অরুণাচল আর মিজো ভাষাটা সে এখনও রপ্ত করতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু সেখানে সে আধো বাংলা, আধো হিন্দি বলে চালিয়ে নিয়েছে। মণিপুর আর অসম ওর ভীষণ ভালো লেগেছে। বিশেষ করে আপার আসাম। পাহাড়ি টিলায় ঘেরা চা-বাগানে ভরা আসাম। বছরের বেশিরভাগ দিন মেঘ-বর্ষায় ভেজা। চারদিক গাঢ় সবুজ। একটা ঠান্ডা ভেজা ভেজা ভাব। আসামের নদীনালাও খুব আপন মনে হয় জহরের। ওদের দেশ ত্রিপুরা তুলনায় কিছুটা রুক্ষ। সবুজ আছে, তবে অসমের মতো গাঢ় নয়। বাড়িগুলোর ঢঙ অনেকটা ওদের দেশের মতোই। সিমেন্টের মেঝে আর বাঁশ-বেড়া দেওয়া দেওয়াল, টিনের চাল। প্রতি বাড়িতেই মাটির উঠোন, তুলসীমঞ্চ। গাছগাছালিতে ভর্তি। জহরের দেশে খুব কাঁঠাল হয়। লিচু, আমও হয়, তবে কাঁঠাল প্রচুর হয়। আনারসও হয় অনেক। আসামে এত কাঁঠাল হয় না। ত্রিপুরার গরিবরা তিনমাস কাঁঠাল খেয়ে বাঁচে।
জহরের মেলা ছেড়ে না যাওয়ার আর একটা কারণ, মেলায় একটা ছোটোখাটো চিড়িয়াখানা আছে। সেই চিড়িয়াখানায় কী নেই। একটা চিতা বাঘ আছে, তার নাম রানি। একটা সিংহ আছে। তবে সেটা কানা। এক চোখে দেখতে পায় না। তবুও তার নাম রাজা। বনের রাজা তো! সিংহটা বুড়ো হয়ে গেছে। আর আছে দুটো হায়না। স্বামী-স্ত্রী। সারাদিন তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে আবার ভাবও খুব দু’জনের। একটা কুমীর আছে। চুপ করে সারাদিন শুয়ে থাকে যেন দেহে কোনও প্রাণ নেই। কিন্তু যেই ওকে খেতে দেওয়া হবে, তখন ওর খুব দাপাদাপি। সাঁড়াশি করে যেই ওর মুখের সামনে মাছ বা মাংস ধরা হবে ওমনি ও ঘুম ভেঙে কপ কপ করে খেতে থাকবে। এছাড়াও যখন বৃষ্টি হবে খুব, ঘন ঘন মেঘ ডাকবে, তখন কুমীরমশাইকে দেখে কে? কী তার তেজ! চৌবাচ্চা তোলপাড় করে ল্যাজের বাড়ি মারবে ছলাৎ ছলাৎ। চৌবাচ্চার মধ্যে একবার এদিকে ঘুরবে আবার ওদিকে। মুখটাকে এমন হাঁ করে থাকবে যে দেখলেই বুক ধুকপুক করবে।
ক্যাশিয়ারের রাউটিটা চিড়িয়াখানার পেছনে হয়। ইচ্ছে করেই হয়। কারণ চিড়িয়াখানায় পশুদের মলমূত্রের একটা বোঁটকা দুর্গন্ধ থাকে। শত পরিষ্কার করে ফিনাইল ছড়ালেও সে গন্ধ যায় না। দর্শকরা জন্তু দেখা বাদে ওই চিড়িয়াখানার দিকে অহেতুক আসে না ওই দুর্গন্ধের জন্য। সেই কারণে ক্যাশিয়ারের রাউটিটা চিড়িয়াখানার পেছনে করা হয় যাতে চট করে মানুষজন ওই তাঁবুতে না ঢোকে। কারণ, মেলার সব টাকাপয়সাই ক্যাশিয়ারের রাউটিতে থাকে। চিড়িয়াখানার পেছনে হলেও ক্যাশিয়ারের রাউটিটা ঝকঝকে পরিষ্কার। রাউটিতে দুটো খাট পাতা। দুটোই লোহার খাট। একটা সিঙ্গল আর একটা ডবল-বেডের খাট। সিঙ্গল খাটটায় জহর শোয় আর ডবল খাটটায় ক্যাশিয়ার গৌরাঙ্গদাদা শোয়, সঙ্গে মালিকের ভাইদের যেকোনও একজন। বড়োমালিক এলে সেও শোয় গৌরাঙ্গদাদার পাশে। তখন বড়োমালিকের ভাইরা অন্য রাউটিতে শুতে যায়। রাউটিটা বেশ বড়ো। দুটো খাট পড়েও অনেক জায়গা। সেই জায়গায় ডবল খাটের মাথার দিকে একটা টেবিল ও চেয়ার পাতা। টেবিলের উপর মোটা কাঠের ক্যাশবাক্স। ইয়া পেল্লাই এক তালা তার গায়ে। তার চাবি সবসময় ক্যাশিয়ারদাদার পকেটে। খাটের পায়ের দিকে বেশি জায়গা। ওখানেই মালিক-ম্যানেজারদের স্পেশাল রান্না হয়। সেই রান্না জহর করে। তিনবেলা রান্না। জহর আগে রান্না জানত না। বড়োমালিকের কাছ থেকে সব রান্না শিখেছে। বড়োমালিক খুব ভালো রান্না জানে। সে যখনই মেলার মাঠে থাকে তখনই নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ায় ওদের। জহর তখন বড়োমালিকের হেল্পার। এইভাবে সে রান্না শিখেছে। এখন সে পাক্কা রাঁধুনি।
একবার কী হল, তখন মেলা চলছে অসমের বরপেটায়। জুন মাস হবে। আগের দিন রাত থেকে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির চোটে রাত আটটায় মেলা বন্ধ হয়ে গেছে। সারারাত বৃষ্টি, সঙ্গে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম ডাক। ভোররাতে জহরের বাথরুম পেয়েছে। সে উঠে বাথরুম করার পর হঠাৎ তার মনে হল, দেখি চিড়িয়াখানার জন্তুগুলো কেমন আছে এই বর্ষায়। মাঠের বর্ষার জল থৈ থৈ করছে। চিড়িয়াখানায়ও জল ঢুকেছে। তবে জন্তুদের খাঁচাগুলো মাটি থেকে বেশ উঁচুতে রাখা হয়। প্রায় তিন ফুট উঁচুতে। যাতে এরকম জল হলে খাঁচাগুলোতে জল না ওঠে। একমাত্র কুমীরের চৌবাচ্চাটা মাটির লেভেলে কাটা। চারদিক সামান্য উঁচু করে দেওয়া হয়।
জহর ভিজে ভিজে ঢুকল চিড়িয়াখানায়। চিড়িয়াখানার টিনের চালে বৃষ্টির অবিরাম ঝমঝম শব্দ। চিড়িয়াখানায় সারারাত দুটো বড়ো আলো জ্বলে। সেই আলোতে জহর দেখল, ভয়ংকর বৃষ্টিতে প্রত্যেক খাঁচার জন্তুগুলো গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ছটফটে চিতারানি খাঁচার এক কোনায় চুপচাপ। সিংহবুড়ো এই বৃষ্টিতে ভীষণ ক্ষুদ্ধ। সে খাঁচার শেষপ্রান্তে মুখ গুঁজে শুয়ে। হায়নাদুটোও শান্ত। মোটা আজগর সাপটা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে। হঠাৎ তার নজর গেল কুমীরের চৌবাচ্চার দিকে। নেই তো চৌবাচ্চায় কুমীরটা! চৌবাচ্চার চারদিকে মানুষ সমান লোহার ফেন্সিং। সামনে এগিয়ে গেল জহর। না, চৌবাচ্চায় নেই তো কুমিরটা। তবে বেরিয়ে গেল ফেন্সিং টপকে? সর্বনাশ! মাঠে চলে গেলে এই বর্ষায় ওকে ধরে ওর চৌবাচ্চায় নিয়ে আসা ভীষণ বিপদের। অন্য রাউটিগুলোতে সবাই বর্ষার আমেজে ঘুমে কাদা। কুমীরটা যদি কাউকে অ্যাটাক করে? কুমীর তো মানুষখেকো! ভয়ে শিউরে উঠল ও। এখন কী হবে? হঠাৎ ওর ঘাড়ের কাছে ফোঁস করে একটা শব্দ হল। জহর চমকে দু’পা পিছিয়ে গেল ফেন্সিং থেকে, আর সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেল, সে ফেন্সিংয়ের যেখানে ছিল তার ডানপাশে আধঝোলা হয়ে ঝুলে আছে কুমীরটা। চেষ্টা করছে ফেন্সিং টপকাতে। আর সামান্য দেরি হলেই বাইরে বেরিয়ে আসবে কুমীরটা। কী করবে জহর? সে চিৎকার করে ডাকল চিড়িয়াখানার ইনচার্জ নারায়ণ সাউকে। চল্লিশ বছরের সুঠাম চেহারার নারায়ণ সাউ। বিহারি এই কোম্পানিতে চিড়িয়াখানা যবে থেকে, নারায়ণ তবে থেকে। প্রত্যেকটা পশু ওর গায়ের গন্ধ চেনে। সিংহের খাঁচায় খাবার দিতে একমাত্র ঢোকে সে। চিমটে দিয়ে নয় হাতে করে কুমীরকে সে মাছ খাওয়ায়। অজগরটাকে দুই কাঁধে নিয়ে চিড়িয়াখানার টিকিট কাউন্টারে বসে থাকে দর্শক টানার জন্য। মাঝে মাঝে হায়নার গলায় শেকল বেঁধে কাউন্টারের উপর নিয়ে আসে টিকিট বিক্রির সময়। চিতাবাঘ রানির মাথায় হাত বোলায় নারায়ণ।
জহরের চিৎকারে ঘুম ভেঙে উঠে এল নারায়ণ। তারপর কুমীরটাকে ওই অবস্থায় একটা মোটা বাঁশ নিয়ে এসে এক ধাক্কায় বাঁশ দিয়ে উল্টে দিল। ফেন্সিংয়ের ভেতর চৌবাচ্চার ধারে ছিটকে পড়ল কুমীরটা। তারপর সুট করে নেমে গেল চৌবাচ্চার জলে। তখনও জহরের শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে।
এরকম আর একবার হয়েছিল, সেবার মণিপুরের ইম্ফলের মেলায়। পনেরোদিনের মেলা শেষ। এবার মেলা মণিপুর ছেড়ে আসমে নেমে যাবে। মেলা দু’দিন আগে শেষ হয়েছে। সেদিন ফুল পাঞ্জাব ট্রাক এসেছে দশটা। মেলার জিনিসপত্র এক একটা ট্রাকে তোলা হচ্ছে। কোনও ট্রাকে উঠছে নাগরদোলনা, ইংরেজিতে থাকে বলে জায়েন্ট হুইল। কোনও ট্রাকে উঠছে ব্রেক ডান্সের সামগ্রী। কোনও ট্রাকে টয়-ট্রেন আর নৌকো। একটা ট্রাকে ডিস্কো ডান্সের সবকিছু। চিড়িয়াখানার খাঁচাগুলো ওঠে দু-দুটো ট্রাকে। মাত্র আট-দশটা খাঁচা, কিন্তু খাঁচাগুলো এত বড়ো বড়ো যে দুটো ফুল পাঞ্জাব ট্রাক লেগে যায়।
জহর নিজের রাউটিতে বসে মালিকদের রান্নার জোগাড় করছিল। বড়োমালিক আছে। বড়োমালিক থাকলে জহরকে রান্না করতে হয় না। বড়োমালিক নিজেই রান্না করে। জহরের স্পষ্ট মনে আছে, সেদিনের মেনু ছিল ভাত, ডাল, ফুলকপির তরকারি আর হাঁসের ডিমের কষা। দুপুরের খাওয়ার পর ওদের রাউটি ভাঙা হবে। তারপর এক সঙ্গে দশটা ট্রাক সার বেঁধে রওনা দেবে অসমের দিকে। জহর ক্যাশিয়ার রাউটি যে ট্রাকে ওঠে সেই ট্রাকে ওঠে মাথায় চেপে যায়। ক্যাশিয়ার গৌরাঙ্গদা যায় ড্রাইভার কেবিনে। বড়োমালিক প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে যায়। সঙ্গে যায় এক ম্যানেজার, মালিকের দু-একজন ভাই আর গাড়ির ডিকিতে যায় ক্যাশবাক্সটা।
জহর ফুলকপি, আলু এসব কেটে ভালো করে ধুচ্ছিল। মণিপুরের ফুলকপির খুব স্বাদ। হাঁসের ডিমেরও স্বাদ খুব। দেশি হাঁসের ডিম। স্টোভে ডিম সেদ্ধ হচ্ছে। বড়োমালিক গৌরাঙ্গদার সঙ্গে বসে টাকাপয়সার হিসেব করছে। হঠাৎ হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। চিড়িয়াখানার একটা স্টাফ দৌড়ে এসে বড়োমালিককে বলল, “দাদা, রানি খাঁচার থিকা ছুইট্যা গেছে।”
ছেলেটার কথা শুনে দিলীপ কুমার চমকে উঠল। মুখে বলল, “সর্বনাশ!”
একটা লুঙ্গি পরে খালি গায়ে বসে ছিল দিলীপ কুমার। সেই অবস্থায় ছুটে বেরিয়ে গেল রাউটি থেকে। পেছন পেছন গৌরাঙ্গদাও ছুটল। জহরও ওদের ফলো করল।
রানি মানে চিতাবাঘ। খাঁচা থেকে বেরিয়ে গেছে। মেলার মাঠের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে সে। খাঁচা থেকে বেরিয়ে একটু ঘাবড়েও গেছে। ওর পেছন পেছন দৌড়চ্ছে চিড়িয়াখানার ইনচার্জ নারায়ণদা। নারায়ণদার ভয়ডর নেই। জন্তুরা ওর গায়ের গন্ধ চেনে, ভালোও বাসে। কিন্তু রানি এতটাই ঘাবড়ে গেছে যে সে নারায়ণদার কথা শুনছে না। উলটে মাঝে মাঝে নারায়ণদার দিকে দাঁত বার করে খেঁকিয়ে উঠছে। চিড়িয়াখানার অন্য স্টাফরা ভয়ে সামনে যাচ্ছে না। জহর শুনেছে, বেশ কিছু বছর আগে একটা নাগাবুড়োর থেকে এই চিতাবাঘটা কিনেছিল বড়োমালিক। তখন রানি বেড়ালছানার মতো ছিল। বড়োমালিক ওকে নিজের বিছানায় নিয়ে শুতো। ফিডিং বোতলে দুধ খাওয়াত। এসব গল্প জহর শুনেছে গৌরাঙ্গদার কাছে। তখন এক বিছানায় গৌরাঙ্গদা, বড়োমালিক আর রানি শুতো। এর জন্য বড়োমালিক আর গৌরাঙ্গদা যখন রানির খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে, “রানি, আয়, আয়,” বলে ডাকে তখন রানি খাঁচার সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। বড়োমালিক বা গৌরাঙ্গদা রানির মাথায়, গলায় হাত বুলিয়ে দেয়। রানি চুপ করে আদর খায়।
দিলীপ কুমার নারায়ণ রানিকে সামলাতে পারছে না দেখে লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই রানির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর চিৎকার করে বলতে লাগল, “রানি, ডোন্ট গো, প্লিজ কাম হিয়ার। আমার কাছে এস রানি, দুষ্টুমি করে না। কাম হিয়ার।”
দিলীপ কুমার দু-তিনবার বলার পরেই রানি দৌড়ে এল বড়োমালিকের দিকে। কাছে এসে পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দুই পায়ে দিলীপ কুমারের পেটে আঁচড়াতে লাগল আহ্লাদে। খাঁচা থেকে বেরিয়ে গিয়ে আচেনা জগতে এসে সে হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে এদিক ওদিক দৌড়চ্ছিল। এবার নিজের লোকের স্বর শুনে কাছে এসে ভয় ভুলে মালিককে আদর করতে লাগল। দিলীপ কুমারও ওকে শান্ত করবার জন্য রানির মাথায়, গলায় হাত বোলাতে লাগল। এদিকে চিতাবাঘের আদর কি সহজ ব্যাপার! ওর দু’হাতের নখের আঁচড়ে দিলীপ কুমারের পেট দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করল। তবুও বড়োমালিকের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। ওর মাথায় ও গলায় আদর করে যেতেই লাগল। কিছুক্ষণ পরে রানি শান্ত হলে নারায়ণদা এসে ওকে কোলে নিয়ে খাঁচায় পুরে দিল। খাঁচায় পুরে না দেওয়া পর্যন্ত বড়োমালিক রানির সঙ্গে সঙ্গে গেল খাঁচা অবধি। রানিকে খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে তবে শান্তি। বড়োমালিককে এরপর ডাক্তার দেখাতে হয়েছিল। ইঞ্জেকশন নিতে হয়েছিল। তবুও বড়োমালিক হাসতে হাসতে বলেছিল, “রানি এখনও আমাকে মানে। আমার কথায় ঠিক শান্ত হল তো! নইলে কী বিপদই না হত! ও তো ওর বস নারায়ণকে পাত্তাই দিচ্ছিল না। একবার মাঠ ছেড়ে লোকালয়ে চলে গেলে কী যে হত ভাবতেই গা শিউরে উঠছে।”
জহর সেদিন বড়োমালিকের চোখের কোনায় জল দেখেছিল। রানিকে বড়ো ভালোবাসে মালিক।
মুরগির টুকরোগুলোকে ধুতে ধুতে জহর এসবই ভাবছিল। মুরগির রোস্ট বানাতে হবে। মালিকদের অর্ডার। জহর ভাবে, মুরগি সবাই খায়। মুরগি ওরা রান্না করে খায়। জ্যান্ত মুরগি অনেক সময় রানির খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয় নারায়ণদা। বুড়ো সিংহটাকেও দেয় মাঝে মাঝে। তবে সিংহটার এক-দুটো মুরগিতে পোষায় না। ওকে দিনে চার-পাঁচ কেজি গরুর মাংস দিতে হয়। দুটো হায়নাকেও তাই। মুরগি অজগর সাপটাকেও দেওয়া হয়। রানির আর অজগরের মুরগি খাওয়ার স্টাইল দু’জনের দু’রকম। রানির খাওয়ার ধরনটা খুব মজার। ও জ্যান্ত মুরগিটাকে নিয়ে প্রথম খেলতে থাকে। খেলতে খেলতে মুরগিটার গায়ের বেশিরভাগ পালক ঝরিয়ে দেয়। তারপর গলার কাছে কামড় দিয়ে ধরে প্রথমে রক্ত খায়। পরে ধীরে ধীরে পুরো পালক ছাড়িয়ে ভেতরের মাংসটা শুধু খায়।
অজগরের খাবার ধরনটা আবার অন্যরকম। অজগরের খাঁচায় জ্যান্ত মুরগি ঢুকিয়ে দিলেও ওর খিদে না পেলে ও খায় না। ও কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে। জহর দেখেছে, পাঁচ-সাতদিন মুরগিটা অজগরের খাঁচায় খেলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সাপটা খাচ্ছে না। যেদিন খিদে পাবে, সেদিন সে খাবে। বড়ো হাঁ করে ধীরে ধীরে গিলে নেবে মুরগিটাকে। তারপর মুরগিটা অজগর সাপটার যে অংশ দিয়ে যাবে সেই অংশটা ফুলে উঠবে। বোঝা যাবে মুরগিটা যাচ্ছে ওর দেহের ভেতর দিয়ে।
কাজু-কিসমিস বাটা, সঙ্গে পেঁয়াজ-রসুন-আদাবাটা দিয়ে ভালো করে মুরগির টুকরোগুলোকে মাখতে মাখতে জহর ভাবছিল, আজই তার শেষদিন মেলায়। আজ দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর সে কিছুদিনের ছুটিতে বাড়ি যাবে। সাতবছরে সে একদিনও বাড়ি যায়নি। এই মেলাতেই থেকেছে। এ-মাঠ থেকে ও-মাঠ ঘুরে বেড়িয়েছে। কত মানুষ দেখেছে সে। কতরকমের মানুষ। তাদের কতরকম ভাষা। কতরকম আদব-কায়দা। কতরকম পোষাক-পরিচ্ছদ। জহরের বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করে না। পথকে সে ঘর বানিয়েছে। বড়োমালিক দিলীপ কুমার ওকে বলে, “তোর কোথাও যেতে হবে না। তুই আমাদের সঙ্গেই থাক। আমি তোকে বিয়ে দিয়ে ঘর বসিয়ে দেব। তুই আর একটু বড়ো হলে দেখবি আমি কী করি। তুই ম্যানেজার হবি এই কোম্পানির।”
জহর মাথা নিচু করে বলে, “বাবু, আমার কিচ্ছু লাগে না। আমি কিচ্ছু চাই না। ঘর চাই না, বউ চাই না। ম্যানেজার হওনও আমার লাগে না। আমি শুধু এই কোম্পানিতে থাকতে চাই। এই জন্তুজানোয়ারগুলির সঙ্গে থাকতে চাই। এই দুঃখী অসহায় মেলার মানুষগুলির লগে থাকতে চাই। মাঠে-ঘাটে ঘুরে এই পরিশ্রমের সঙ্গে লাইগ্যা থাকতে চাই। আমার বাড়ির সকলে বৈষ্ণব ছিল। আমার জাত গেছে। আমার বাড়ির কেউ মাছ-মাংস ছোঁয় না। কিন্তু আমি সব খাই। পানীয় জল পর্যন্ত আমাগো ঠিক নাই। পুকুরের জল আইন্যা তাতে ফিটকারি দিয়া নোংরা কাটাইয়া সেই জল খাই। কিন্তু এত কষ্টের ভিতরও একটা জিনিস বুঝি বাবু, আমি এই জহর ভারতের এই কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আছি। যারা দুই মুঠা খাওনের জইন্য মৃত্যুকূপে বাইক চালায়, যারা দুই মুঠা খাওনের জইন্য দিনের পর দিন ঘন্টার পর ঘন্টা হিন্দি-বাংলা গানের সঙ্গে নাচতে থাকে। যার এই ভারী ভারী লোহার খেলনাগুলি দুই মুঠা খাওনের জইন্য একবার জুড়ে আবার দিন পনেরো পর ভাঙে। আবার অন্য মাঠে গিয়ে জুড়ে। আমি ওগো সঙ্গে আছি। বাবু, বাবা-মা কইত রাধাকৃষ্ণ মাইনষের সঙ্গে থাকে। দুঃখীর সঙ্গে থাকে। আমিও তাই থাকি। এই মাঠে মাঠে ঘুরতে জন্তুজানোয়ারের সঙ্গে ঘুরতে আমি আরাম পাই। আমার মনে শান্তি হয়।”
জহরের কথা শুনে বড়োমালিক হেসে বলে, “কী রে, জহর? তুই তো দেশের নেতার মতো কথা বলছিস। আয়, আমার কাছে আয়, তোর পিঠ চাপড়ে দেই।”
জহরের চোখে তখন জল। সে বাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাবু ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “এটাই জীবন রে জহর, এটাই জীবন।”
বিকেল চারটে বাজতে বাজতে কুমারঘাটের মাঠে আনন্দমেলা জেগে ওঠে। মাইক বাজতে শুরু করে। নারায়ণদা ময়াল কাঁধে চিড়িয়াখানার কাউন্টারে গিয়ে বসে টিকিট বিক্রি করার জন্য। জায়েন্ট হুইল ঘুরতে শুরু করে। নৌকা দোলা খায়। টয়-ট্রেন চলে কু-ঝিক-ঝিক। মণিহারি দোকানগুলো একে একে পাল্লা তোলে দোকানের। মৃত্যুকূপ থেকে মোটর বাইকের শব্দ ওঠে ভট-ভট-ভট-ভট।
জহর পায়ে পায়ে মেলামাঠ ছাড়ে। বাড়ি ফিরছে সে। গ্রামের নাম খোয়াই। দু’দিন আগে খবর পেয়েছে সে, বাবা মৃত্যুশয্যায়। তিনি একমাত্র ছেলে জহরকে শেষ দেখা দেখতে চান। তাই জহর বাড়ি ফিরছে। পকেটে ওর সাতবছরের কামাই। সে বাড়ি ফিরছে কারণ, সে অসহায় বাবার পাশে থাকতে চায়। জহরের চোখে বানভাসি নোনা জল।
ছবিঃ মৌসুমী
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস একত্রে