গল্প টুসি শিশির বিশ্বাস শীত ২০১৮

শিশির বিশ্বাস-এর সমস্ত গল্প এই লিংকে

টুসি

 

শিশির বিশ্বাস

 

শিবুবাবুর সঙ্গে চিড়িয়াখানা দেখতে এসেই সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল বাচ্চুর। অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না। কলকাতায় বুলুমাসিদের বাড়িতে বেড়াতে এসে কদিনে শুকিয়ে থাকা মনটা চিড়িয়াখানা দেখতে এসেই হঠাৎ সেদিন খুব ভালো হয়ে গিয়েছিল ওর। ভালো হয়ে গিয়েছিল একরকম হঠাৎই চিড়িয়াখানার মস্ত জলাশয়টার দিকে চোখ পড়তে। গ্রামের মেয়ে বাচ্চু, তবু এমন দৃশ্য আগে ও কখনো দ্যাখেনি। বেণী দুলিয়ে খুশিতে নেচে উঠেছিল মেয়েটা। হাততালি দিয়ে বলেছিল, “দ্যাখো মামা, কত পাখি দ্যাখো!”

কিন্তু সেই মেয়েই কেন যে একটু বাদে বাড়িতে ফেরার জন্য অমন আকুল হয়ে উঠল, অনেক ভেবেও কোনো কূল করতে পারেননি শিবুমামা।

অথচ বাড়ি মানে সেই আমডাঙা। বাস আর ট্রেন মিলিয়ে পুরো একবেলার পথ। অতদূর থেকে ও যে কলকাতায় বেড়াতে আসতে পারবে কোনোদিন ভাবতেও পারেনি বাচ্চু। তবু সুযোগটা দিন কয়েক আগে এক রকম হঠাৎই এসে গিয়েছিল প্রায় একযুগ পর বুলুমাসি ওদের বাড়িতে বেড়াতে আসাতে। খুব হই চই হয়েছিল কদিন। ফেরার সময় বুলুমাসিই কথাটা পাড়লেন, স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা যখন হয়ে গেছে, তখন বাচ্চু সঙ্গে চলুক। দিন কয়েক কলকাতা থেকে বেড়িয়ে আসতে  পারবে।

বুলুমাসির কথা শুনে গোড়ায় মনটা নেচে উঠেছিল বাচ্চুর। কিন্তু তারপরই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল মা’র কথা ভেবে। ওকে ছাড়া থাকতে মা’র যে খুব কষ্ট হবে। বাচ্চু তক্ষুণি জানিয়ে দিয়েছিল-বুলুমাসির সঙ্গে ও কলকাতায় যাবে না। মা কিন্তু নিজেই জোর করলেন। ওর মনের কথা ঠিক বুঝে নিয়ে হেসে বললেন,  “পাগলি কোথাকার। মেয়ে কি চিরকাল মায়ের কাছে থাকে? কটা দিন আমি ঠিক কাটিয়ে দিতে পারব। তুই ঘুরে আয়। কত্ত বড় শহর কলকাতা। কোনোদিন তো যাসনি। ফিরে এসে আমায় গল্প শোনাবি।”

তো বড় শহরই বটে। বাড়িতে ফিরে গিয়ে মা’র কাছে কী গল্প করবে, গোড়ায় ক’দিন তা ভেবেই পায়নি বাচ্চু। আহিরীটোলার কাছে একটা বাই লেনে বুলুমাসিরা থাকেন। এঁদো সরু গলি, দিনদুপুরেও ভালো করে সূর্যের আলো ঢোকে না। আর দু’তলার যে ঘরদুটোয় বুলুমাসিরা থাকেন তার ভেতর তো দিনভর অন্ধকার। সামনের চিলতে ঝুলবারান্দা থেকেও আকাশের মুখ দেখা যায় না। দুদিনেই হাঁপিয়ে উঠেছিল বাচ্চু। ভাগ্যিস শিবুমামা হঠাৎ বুলুমাসিদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। নইলে বাচ্চু বোধ হয় দম বন্ধ হয়েই মরে যেত।

শিবুমামা ভবঘুরে মানুষ। লম্বা পাতলা চেহারা, চোখে চশমা। একমাথা লম্বা লম্বা চুল। কথা বলেন খুব কম। সব সময় কেমন ভাবুক ভাবুক। আড়ালে বাড়ির সবাই হাসাহাসি করে শিবুমামাকে নিয়ে। শিবুমামা নাকি ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কবিতা মেলান। বাচ্চু কিন্তু এই শিবুমামাকে পেয়েই বেঁচে গেল। কলকাতার এই এঁদো গলির অন্ধকারের ভেতর শিবুমামাই যেন একমাত্র ব্যতিক্রম। কতই বা বয়স। অথচ এই বয়সেই নাকি ভারতবর্ষের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। কথা কম বলেন, কিন্তু একবার শুরু করলে আর থামতে চান না। কত খবরই যে রাখেন শিবুমামা।

শিবুমামা ওদের একদিন বেড়াতে নিয়ে গেলেন দক্ষিণেশ্বরে। সেখান থেকে বেলুড়। আর একদিন বট্যানিক্যাল গার্ডেন। তারপর আজ এই আলিপুর চিড়িয়াখানায়। দক্ষিণেশ্বর, বেলুড় খুব ভালো লেগেছিল। বট্যানিক্যাল গার্ডেন তো আরও ভালো। কিন্তু চিড়িয়াখানা যেন সবাইকে ছাড়িয়ে গেল।

বাচ্চু গ্রামের মেয়ে। কিন্তু এত পাখি এক সাথে কোনও দিন দেখেনি। বিরাট  জলাশয় ভর্তি শুধু পাখি আর পাখি। পালকে মুখ গুঁজে কেউ জলের ওপর ভাসছে। হঠেৎ দেখে মনে হয় বুঝি অসংখ্য ফুল ফুটে রয়েছে জলের ওপর। কেউ দল বেঁধে সাতাঁর কাটছে। আর সবচেয়ে মজার দৃশ্য তখন, যখন হঠাৎ কোনও অজানা কারণে এক সাথে প্রায় সবগুলো পাখি জল ছেড়ে আকাশে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। এক সঙ্গে অতগুলো পাখির ডানার ঝাপটানিতে তখন যেন ঝড় বইছে চারপাশে। সেই সাথে বাতাসে শন্‌শন্‌ শব্দ। এক কথায় রোমাঞ্চকর।                  বাচ্চু আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠতে শিবুমামা বললেন, “দারুণ লাগছে দেখতে, তাই না?”

বাচ্চু ঘাড় নাড়িয়ে বলল, “খুব ভালো লাগছে মামা। এত পাখি এক সাথে আগে তো কখনো দেখিনি।”

শিবুমামা বললেন, “তাও তো এবার পাখি সবে আসতে শুরু করেছে। আর দিন পনেরো পরে এলে এর প্রায় দ্বিগুণ পাখি দেখতে পেতি।”

শিবুমামার কথায় বাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “সে কী মামা! এগুলো চিড়িয়াখানার পাখি নয়?”

শিবুমামা একটু হেসে বললেন, “না রে পাগলি। এদের কোনোটাই চিড়িয়াখানার পাখি নয়। সারাবছর এরা এখানে থাকেও না। এরা পরিযায়ী পাখি। শীতের শুরুতে উত্তরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উড়ে আসতে শুরু করে আমাদের সমতল বাংলায়। প্রতি বছর এদেরই কিছু এসে আশ্রয় নেয় চিড়িয়াখানার এই জলায়। হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে এরা উড়ে আসে আমাদের দেশে। আসে ভারতবর্ষের বাইরে থেকেও। সারা শীতকালটা এখানে কাটিয়ে আবার ফিরে যায় নিজ নিজ দেশে। সাধারণ মানুষ এদের চেনে বুনোহাঁস বলে। তবে প্রজাতি হিসেবে কিন্তু আলাদা আলাদা নাম রয়েছে এদের। দূর থেকে আলাদা করে চেনা না গেলেও এই লেকের জলেই রয়েছে অন্তত পাঁচ জাতের হাঁস। এই যে আমাদের সবচেয়ে কাছেই যে দলটাকে দেখতে পাচ্ছিস, পালকে মুখ গুঁজে ভাসছে-ওগুলো সরাল। চিড়িয়াখানার লেকে এই সরালেরাই সংখ্যায় বেশি। আর ওই দ্যাখ কোণের ওই দিকে ওই যে ঝাঁকটা জল ছেড়ে আকাশে উড়ল- বেশ লম্বাছাঁচের শরীর, বুক আর গলা সাদা, তল পেটটা কালো-ওগুলো দিগহাঁস। ওরা আসে ইউরোপ অথবা এশিয়ার উত্তরের দেশগুলো থেকে। সুদূর সাইবেরিয়া থেকেও কয়েক হাজার হাঁস আমাদের এই চিড়িয়াখানায় আসে। তাদের বলে গারগেনি টিল বা নীলপাখা হাঁস। ওদের দেখতে পাচ্ছি না। বোধহয় এখনো এসে পৌঁছতে পারেনি। হয়তো আর দু’চার দিনের মধ্যেই এসে পড়বে।”

শিবুমামার স্বভাবটাই এই রকম। একবার শুরু করলে আর থামতে চান না। অনেকেই বেশ বিরক্ত বোধ করে। কিন্তু সেই মুহূর্তে বাচ্চুর মনে হচ্ছিল শিবুমামা বড্ড তাড়াতাড়ি থেমে গেলেন। একগাদা প্রশ্ন ইতিমধ্যে ওর মনের কোণে ভিড় জমিয়েছে। ভুরু উঁচিয়ে বলল, “ওরা প্রতি বছর আসে মামা?”

“প্রতি বছর। এর কোনও অন্যথা নেই। কেন, শীতের শুরুতে আকাশে বুনো হাঁসের ঝাঁক উড়ে যেতে দেখিসনি?”

খুব দেখেছে। কিন্তু সে কথা বলি বলি করেও শিবুমামাকে বলতে পারল না বাচ্চু। আসলে তখন তো এত কিছু জানতই না ও। ছোট্ট করে শুধু বলল, “অত দূর দেশ থেকে প্রতি বছর এতটা পথ ওরা কী করে চিনে আসে মামা?”

বাচ্চুর প্রশ্ন শুনে সামান্য মাথা নাড়ালেন শিবুমামা। বললেন, “কী করে যে ওরা প্রতি বছর এই হাজার হজার মাইল পথ চিনে আসে সে রহস্যের হদিস বিজ্ঞানীরা আজও করে উঠতে পারেননি। এই চিড়িয়াখানাতেই বিশেষজ্ঞরা কিছু পাখির পায়ে রিং পরিয়ে দিয়ে দেখেছেন আগের বছর যে পাখিটা লেকের ধারের যে গাছটা বিশ্রামের জন্য বেছে নিয়েছিল, পরের বছর ঠিক সেই গাছেই এসে বসে আছে।”
শিবুমামা দেখতে পেলেন না বাচ্চুর চোখ দুটো মুহূর্তের জন্য হঠাৎ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চট করে চোখটা নামিয়ে নিয়ে ও বলল, “প্রতি বছর নিজেদের দেশ ছেড়ে ওরা আমাদের দেশে কেন আসে মামা?”

শিবুমামা এবার ছোট্ট করে একটু হাসলেন। বললেন, “এই দ্যাখ ফের মুশকিলে ফেললি। কী বলি বল দেখি? আসলে কারণটা যে সঠিক ভাবে কেউ এখনও বুঝতে পারেনি। বিজ্ঞানীরা অবিশ্যি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আগে ধারনা ছিল এসময় উত্তরের দেশগুলোর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পেরে অপেক্ষাকৃত গ্রীষ্মাঞ্চল আমাদের দেশে উড়ে আসে। কিন্তু সম্প্রতি ধারণটা সম্পূর্ণ সঠিক নয় বলেই প্রমাণিত হয়েছে। তাই কারণটা সঠিক ভাবে বলা যাচ্ছে না। এমনও হতে পারে আমাদের এই দেশটাকে ওরা ভালোবাসে। ভালোবাসে এদেশের মানুষকে। তাই প্রতি বছর একবার করে বেড়িয়ে যায়? কিন্তু লোভী মানুষের হাত এড়িয়ে সবাই কি আর দেশে ফিরতে পারে? প্রতি বছর কত লক্ষ পাখি যে লোভী নিষ্ঠুর মানুষের হাতে প্রাণ দেয় ভাবাও যায় না। এই যে চিড়িয়াখানার ভেতর এই জায়গাটুকুতে ওরা এসে আশ্রয় নেয়-মানুষের লোভের হাত থেকে এদেরও কি রেহাই আছে! চিড়িয়াখানার ভেতরে কিছু করার উপায় নেই। তাই আক্রমণটা হয় বাইরে। সকাল সন্ধ্যায় ওরা যখন ঝাঁক বেঁধে ওড়ে, তখন ঘুড়ির সুতোয় তীক্ষ্ণ বঁড়শি বেঁধে শিকারীরা উড়িয়ে দেয় আকাশে। বঁড়শিতে গেঁথে ফেলে নামিয়ে আনে অতিথি পাখিদের। ভোজের টেবিলে দারুণ কদর এদের।”

শিবুমামার কথা শুনতে শুনতে শেষ দিকে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল বাচ্চুর। শিবুমামা বোধহয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। বাচ্চু ধরা গলায় তাড়াতাড়ি বলল, “বাড়ি চল মামা।”

শিবুমামা অবাক হয়ে বললেন, “সে কী রে! এখনই বাড়ি যাবি কি! সবে তো ঢুকলি। এখনো কিছুই যে দেখা হয়নি।”

বাচ্চু ঠাণ্ডা গলায় শুধু বলল, “পরশু ডিসেম্বরের কুড়ি তারিখ, তাই না মামা?”

“হ্যাঁ, কেন বল দেখি?”

কিন্তু শিবুমামার কথা যেন শুনতেই পেল না বাচ্চু। বিড়বিড় করে কতকটা স্বগতোক্তির মতো শুধু বলল, “মামা, তুমি আমায় কালকে বাড়িতে রেখে আসবে? খুব দরকার।”

পরদিনই আমডাঙায় মা’র কাছে ফিরে এল বাচ্চু। শিবুমামাই পৌঁছে দিলেন। বড়দিনটা কাটিয়ে যাবে এমন কথা ছিল। কিন্তু কারুর অনুরোধই কানে তোলেনি। এমন কী শিবুমামারও নয়। হঠাৎ কেন যে ওর এত বাড়ি যাওয়ার তাড়া পড়ল বার বার প্রশ্ন করেও জবাব পেল না কেউ। একমাত্র শিবুমামাই ওকে আর কিছুই জিজ্ঞাসা করেননি। তাই ট্রেনের কামরায় শিবুমামার পাশে বসেও বলি বলি করে কিছুতেই আর বলা হল না বাচ্চুর। টুসির কথা সত্যিই কি কারুকে বলা যায়?

আগামী কাল কুড়ি তারিখ। টুসির আসার দিন। কোথায় কোন্‌ সুদূরে সাইবেরিয়ার বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে কত হাজার বছরের পুরনো বরফ জমাট বেঁধে রয়েছে। সারা শরীর ফারের পোশাকে ঢেকে বিজ্ঞানীরা বরফ খুঁড়ে টেনে বার করছেন প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রাণী ম্যামথের জমাট মৃতদেহ। শিবুমামা না বললেও বাচ্চু জানে এসব। বইতে পড়েছে। সেই সাইবেরিয়ার জমাট বরফের ওপর শীতের শুরুতে ফের নতুন বরফের স্তর জমতে শুরু করেছে। টুসির আসার সময় হল। হে ভগবান শিবুমামার কথা যেন সত্যি হয়।

বাড়িতে ফিরে সারা রাত্তির চোখের পাতা এক করতে পারেনি বাচ্চু। উৎকণ্ঠা শতগুণ বেড়ে গেল শেষ রাত্তিরে। বার কয়েক একা একাই দরজা খুলে বাইরে চোখ বুলিয়ে এল।

পরদিন কুড়ি তারিখ। শিবুমামা সকালেই কলকাতা ফিরে যাবেন। বাচ্চু বলল, “লক্ষ্মীটি মামা আজকের দিনটাও থেকে যাও।”

ওর গলায় ব্যাকুলতা দেখে শিবুমামা বললেন, “কেন রে।”

বাচ্চু চোখ নামিয়ে বলল, “থাকোই না মামা। তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব আজ।”

কিন্তু কিসের সারপ্রাইজ, অনেক পীড়াপীড়িতেও ভাঙল না বাচ্চু।

শিবুমামা থেকে গেলেন। সারাদিন প্রবল উৎকণ্ঠার মধ্যে কেটে গেল বাচ্চুর। শিবুমামা তো বটেই, এমন কী মা’র সঙ্গেও ভালো করে কথা বলতে পারেনি সারাদিন। শেষে সন্ধ্যায় উৎকণ্ঠার বদলে এল ভীষণ লজ্জা। হায় শিবুমামাকে এখন কী কৈফিয়ত দেবে ও? কিন্তু বাঁচিয়ে দিলেন শিবুমামা। সারপ্রাইজের প্রসঙ্গ একবারের জন্যও তুললেন না তিনি। তুললেন না বাচ্চুর মুখের অবস্থা দেখেই। বরং রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে নানা গল্প শোনালেন। তবে কোনো গল্পই আজ আর ভালো লাগল না ওর।

পরদিন সকালেই শিবুমামা কলকাতা রওনা হয়ে গেলেন। ঘটনাটা ঘটল ঠিক তার দু’দিন পর। ইতিমধ্যে টুসির ব্যাপারটা মনের মধ্যে অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। কদিন আগের সেই দম বন্ধ করা উৎকণ্ঠাও আর নেই। সেদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবে বাইরে এসেছে বাচ্চু। ঘুম ভাঙতে একটু দেরিই হয়ে গেছে আজ। নয়নদের বাগানে গাছগুলোর মাথায় ইতিমধ্যে চাঁপাফুল রঙের রোদ জমতে শুরু করেছে। ঘুম থেকে উঠে মায়ের মতো বাচ্চুরও সূর্যপ্রণাম করে অভ্যাস। হাতদুটো কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে মায়ের কাছে শেখা মন্ত্রটা সবে বলতে যাবে, হঠাৎ ঝুপ করে কী একটা ওর বুকের ওপর এসে পড়ল। চমকে উঠে চোখ মেলে তাকাতেই ওর গলা দিয়ে অজান্তে একটা শব্দ বেরিয়ে এল, “মা-টুসি।”

বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই একটা বুনোহাঁস বাচ্চুর কোল থেকে উঠে এসেছে ওর বাঁ-কাঁধের ওপর। তারপর ওর একমাথা চুলের ভেতর ঠোঁট গুঁজে দিয়ে বিলি কাটতে শুরু করেছে। এক বছর আগে ঠিক এইভাবেই টুসি আদর জানাত বাচ্চুকে। এই এক বছরে ব্যাপারটা বাচ্চু প্রায় ভুলে গেলেও টুসি একটুও ভোলেনি। ওর টুসিই যে আবার ফিরে এসেছে সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। এক রাশ আনন্দে বাচ্চু চেঁচিয়ে উঠল, “মা-দেখে যাও, টুসি এসেছে। আমার সেই টুসি।”

আজ থেকে এক বছর আগে। আর একটু সঠিক করে বললে ঠিক এক বছর তিন দিন আগে এমনই এক সকালে টুসিকে প্রথম কুড়িয়ে পেয়েছিল বাচ্চু। শিবুমামাকে কদিন বলি বলি করেও শেষ পর্যন্ত সেকথা ও বলতে পারেনি।

সেদিন ভোরে বাচ্চু পুজোর ফুল তুলতে গিয়েছিল নয়নদের বাগানে। হঠাৎ বাগানের কোণে ঝাঁকড়া জবাগাছটার দিক থেকে একটা ঝট্‌পট্‌ শব্দ শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখে বাদামি রঙের একটা হাঁস নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয়েছে গাছতলায়। একটা ডানা ঝুলে পড়েছে। অসংখ্য লাল পিঁপড়ে ছেঁকে ধরেছে পাখিটাকে। মাঝে মাঝে ডানা ঝাপটে পাখিটা পিঁপড়েগুলোকে তাড়াবার বৃথা চেষ্টা করছে। দেখে ছুটে গিয়ে পাখিটাকে পরম মমতায় কোলে তুলে নিয়েছিল বাচ্চু। গা থেকে একটা একটা করে পিঁপড়ে খুঁটে ফেলতে গিয়ে দেখে হাঁসটার ডান পাখনার নীচে মস্ত একটা ক্ষত-চিহ্ন। রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। ওটা যে বুনোহাঁস, আর ক্ষতচিহ্নটা যে গুলির তখন বুঝতে পারেনি ও। মা অবিশ্যি দেখে ঠিকই চিনেছিলেন। পাখিটাকে নিয়ে বাড়ি আসতেই মা বললেন, “ওমা ওই বালিহাঁসটাকে আবার কোত্থেকে আনলি তুই।” তারপর বাচ্চুর কাছে সব শুনে বললেন, “কেন আনতে গেলি? বরং নয়নদেরই দিয়ে আয়। ওসব খেতে নেই আমাদের।”

শুনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল বাচ্চু। দুহাতে পাখিটাকে কোলের ভেতর আঁকরে ধরে শুধু বলেছিল, “মাগো ওকথা বোলো না। ওকে আমি পুষব।”

মা আর কিছু বলেননি। সেই দিনই পাখিটাকে নিয়ে ওদের গ্রামের হেলথ্‌ সেন্টারে গেল বাচ্চু। হেলথ্‌ সেন্টারের ডাক্তার অনন্তবাবু দেখে বললেন, “এটা যে ছররার ক্ষত রে। হাড়ে চোট খেয়েছে দেখছি।”

বাচ্চু ভয়ে ভয়ে বলল, “সারবে তো ডাক্তারকাকু?”

ডাক্তার অনন্তবাবুকে ওরা ডাক্তারকাকু বলে ডাকে। বাচ্চুর কথা শুনে একটু হেসে বললেন, “ঘাবড়াসনি দিদি। দ্যাখ না ঠিক সারিয়ে তুলব। তবে সময় একটু লাগবে।”

ডাক্তারকাকুই পরে একদিন ওকে বলেছিলেন পাখিটা নাকি গারগেনি টিল জাতীয়। অনেক দূর থেকে এদেশে আসে।

তখন অবশ্য এসব কথা মোটেই কান পেতে শোনেনি বাচ্চু।

অনন্তবাবু সত্যিই তাঁর কথা রেখেছিলেন। ওষুধ আর প্লাস্টারের সাহায্যে মাস দুয়েকের মধ্যে তিনি সারিয়ে তুললেন চোটটা। ইতিমধ্যে বুনোহাঁসটা পোষ মেনে গেছে বাচ্চুর। সারাদিন বাড়ির পোষা বেড়ালের মতো ওর পায়ে পায়ে ঘোরে। আশেপাশে কোথাও বেরুলে পাখিটা চুপটি করে ওর কাঁধের ওপর বসে থাকে। বাচ্চু পাখিটার একটা নামও দিয়ে ফেলেছে-টুসি।

এর মধ্যে ডাক্তারকাকু একদিন পরীক্ষা করে টুসির ডানার প্লাস্টার কেটে দিয়েছেন। টুসির ডানার ভাঙা হাড় একদম জুড়ে গেছে। এরপর থেকেই টুসি একটু আধটু ডানা ঝাপটায়; ওড়ার চেষ্টা করে। ঝুপ করে যখন তখন বাচ্চুর কাঁধে উড়ে এসে বসে। একটা অনাবিল আনন্দে ওর বুকটা তখন ভরে যায়। কিন্তু টুসির এই উড়তে পারাটাই যে শেষ পর্যন্ত বাচ্চুর কাছে বিষাদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, ভাবতেও পারেনি ও।

সেদিনও এমনই এক সকাল। শীতের পর বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। টুসিকে কাঁধে নিয়ে বাচ্চু সেদিন নয়নদের বাগানেই ফুল তুলছিল। হঠাৎ টুসি কাঁধের ওপর থেকে উড়ল। ইদানীং টুসি মাঝে মধ্যেই ওড়ে। একটু উড়েই অবশ্যি মাটিতে নেমে আসে। সেদিন মাথার ওপর দিয়ে মস্ত একটা বুনোহাঁসের ঝাঁক সোঁ-সোঁ শব্দে দক্ষিণ থেকে উত্তরে উড়ে যাচ্ছে। আর ওর টুসি পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে চলেছে সেই দিকে। দেখতে দেখতে ওর চোখের সামনেই টুসি সেই ঝাঁকটার সঙ্গে মিশে গিয়ে হারিয়ে গেল দিগন্তের বুকে। হায় হায় করে উঠেছিল বাচ্চু। দু’দিন কিচ্ছু খায়নি। মা ওকে সমানে সান্ত্বনা দিয়েছেন, “ওরা বনের পাখি রে বাচ্চু। তোর কাছে চিরকাল থাকবে কেন? আর তোরই কি উচিত ওকে বন্দী করে রাখা?”

সেই টুসিই আবার এক বছর পর ফিরে এসেছে বাচ্চুর কাছে। শিবুমামার কথা তাহলে সত্যি হল।

ইতিমধ্যে মা কখন ছুটে এসেছেন বুঝতেই পারেনি বাচ্চু। চমক ভাঙল মা’র কথায়, “ওমা! ওকে আবার কোত্থেকে পেলি?”

বাচ্চু তাকিয়ে দেখল মা তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। বাচ্চু বলল, “ওকে চিনতে পারছ না মা? ও আমাদের সেই টুসি। এক বছর পর আবার দেখতে এসেছে আমাদের। ওকে খেতে দাও না মা। টুসি কত দূর থেকে এসেছে জান? সেই সাইবেরিয়া-তিন হাজার মাইল দূরের দেশ থেকে। শিবুমামা বলেছেন?

মেয়ের কথার সবটা না বুঝতে পারলেও, মা তখুনি ঘরে গিয়ে মস্ত জামবাটিটায় কতকগুলো নতুন ধান ভিজিয়ে নিয়ে এলেন। টুসির সবচেয়ে প্রিয় খাবার।

টুসিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে কোলে তুলে নিয়ে বাটিটা ওর মুখের সামনে ধরল বাচ্চু। মুখ দিতে গিয়েও হঠাৎ যেন থমকে গেল টুসি। মুখ তুলে ডানা ঝাপটে বার দুই তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকল। আর তখনই বোঝা গেল টুসি একা নয়। সঙ্গে আরও একজন রয়েছে। কেউ লক্ষ করেনি। উঠোনের কোণে ঝাঁকড়া বেলফুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরও একটি পাখি। উশখুশ করছে। অথচ আসতে সাহস পাচ্ছে না।

টুসি যে তার সঙ্গীটিকে ডাকছে বুঝতে অসুবিধা হয় না বাচ্চুর। পায়ে পায়ে ও এগিয়ে যায় বেলফুল ঝাড়টার দিকে। ওকে এগিয়ে আসতে দেখে পাখিটা একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেও শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকে। কাছে গিয়ে বাচ্চু আস্তে আস্তে নিচু হয়ে হাতের বাটিটা ওর মুখের সামনে ধরে। টুসিকেও নামিয়ে দেয় কোল থেকে। দুটি পাখি এবার এক সঙ্গে বাটিতে মুখ ডুবিয়ে দেয়।

মিনিট কয়েক একটানা ঠোঁট চালিয়ে মুখ তোলে টুসি। ওর খুদে দু’ চোখে তখন তৃপ্তির ছোঁয়া। এতক্ষণ দুটির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল বাচ্চু। টুসি মুখ তুলে তাকাতে বলে, “শিবুমামার কথাই সত্যি হল রে টুসি! তুই যে আবার আমাদের খবর নিতে আসবি ভাবতেও পারিনি। এত পথ উড়ে এলি! পথে কোনো কষ্ট হয়নি তো? এবার তোদের দেশে কেমন বরফ পড়েছে রে? শিবুমামা না বললেও তোদের দেশ সম্বন্ধে আমি অনেক কিছুই জানি রে টুসি। ফেরার পথে আবার আসবি তো?”

টুসি কিছু বুঝল কিনা কে জানে। হঠাৎ ঘাড় কাত করল একটু। হঠাৎই যেন চঞ্চল হয়ে উঠল ওর চোখ দুটো। বাচ্চু তাকিয়ে দেখল সোঁ-সোঁ শব্দে মস্ত একটা বুনোহাঁসের ঝাঁক উত্তর থেকে দক্ষিণে উড়ে চলেছে। টুসির সঙ্গীও ইতিমধ্যে খাওয়া থামিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে।

হঠাৎ দুজনেই এক সাথে ডানা ঝাপটে বাচ্চুর দুই কাঁধের ওপর এসে বসল। ওর চুলে ঠোঁট গুঁজে আদর করল কয়েক বার। তারপর দুটো হাঁসই এক সাথে আকাশে উড়ল। আকাশে বুনো হাঁসের ঝাঁকটা ইতিমধ্যে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।

হাতে খালি বাটিটা নিয়ে বাচ্চু অনিমেষ নয়নে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে।

মাঠের ওপারে দিগন্তের কাছে রায়চক গাঁয়ের সবুজ রঙের সীমারেখাটা না টপকানো পর্যন্ত ওদের দেখতে পাবে বাচ্চু। কিন্তু তাও যে আর পারছে না। দু’ চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে যে। কখন যেন অঝোরে শ্রাবণের ধারা গড়াতে শুরু করেছে ওর দু’ চোখ বেয়ে।

ছবিঃ অংশুমান

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

2 thoughts on “গল্প টুসি শিশির বিশ্বাস শীত ২০১৮

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s