গল্প দাদু বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত বর্ষা ২০১৮

বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত

রোহনের যত বন্ধুত্ব, ভালবাসা সবই তার দাদুর সঙ্গে। বাড়িতে দাদুই তাকে বেশি ভালবাসে। সেই ছোটবেলা থেকে যত বায়না, আব্দার সবই তার দাদুর কাছে। দেখতে দেখতে সেই ছোট্ট রোহন এখন শিলিগুড়ির নামকরা এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র। পড়াশুনাতে খুবই ভাল আর এ ব্যপারে দাদুর উৎসাহ সব থেকে বেশি। দাদুই তাকে স্কুলের পড়াশুনার বিষয়গুলি বাড়িতে সুন্দরভাবে পড়িয়ে আর বুঝিয়ে দেন। পড়াশুনার ফাঁকে দাদু উৎসাহিত করেন নানা ধরনের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করবার জন্য আর মানুষকে ভালবাসতে, শ্রদ্ধা করতে আর এমন কাজ করতে যাতে দেশের লোকের উপকার হয়। দাদুর থেকেই রোহন জানতে পারে দেশ-বিদেশের মহাপুরুষদের জীবনের গল্প। 

রোহনের বাবা যখন খুব ছোট তখন থেকেই তারা শিলিগুড়ির আশ্রমপাড়ার বাসিন্দা। রোহনের দাদু ছিলেন শিলিগুড়ির এক হাইস্কুলের একজন আদর্শবান প্রধান শিক্ষক। তিনি ছিলেন প্রত্যেকের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার মানুষ। তাঁকে বলা হত ছাত্র বানাবার কারিগর। তাঁর হাতে তৈরি বহু ছাত্ৰ-ছাত্রী আজ দেশে-বিদেশে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত। তিনি বলেন, লেখাপড়া যেমন করতে হবে, তার সাথে সাথে মানুষের অন্যান্য ভাল দিকগুলিকে বিকশিত করতে হবে।

রোহনের বাবাও দাদুর কাছে লেখাপড়া শিখে আজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত। কলকাতায় এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খুব উচ্চপদে কাজ করার জন্য তাঁকে কলকাতাতে থাকতে হয়। মাসে অন্তত বারদুয়েক তিনি কলকাতা-শিলিগুড়ি যাতায়াত করেন। রোহনের স্কুল ছুটি থাকলে সে-ও তার মায়ের সঙ্গে কলকাতা থেকে ঘুরে আসে। বাড়িতে দাদু, ঠাকুমা, মা আর বাবা যখন ছুটিতে বাড়িতে আসে, সবাই মিলে হৈ হৈ করে দিন কেটে যায়। মধ্যমনি অবশ্যই দাদু। 

একদিন রোহন স্কুল থেকে ফিরে দাদুকে বলল তাদের স্কুলের এক বন্ধুর ছোট ভাই চোখে কিছুই দেখতে পেত না। ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে হাসপাতালে অপরেশন করে অন্য মৃত মানুষের দান করা চোখ লাগিয়ে দিয়ে সে এখন পৃথিবীর সব কিছু দেখতে পায়। সে বলল, “জানো দাদু, তাদের বাড়িতে আজ কত আনন্দ, কত উৎসব।”

দাদু বললেন, “আমরা সবাই যদি এইরকম অঙ্গীকার করে যাই যে মৃত্যুর পর আমাদের চোখ দান করে দিয়ে যাব, তবে যারা জীবনে শুধুই অন্ধকার দেখে, তারা মৃত মানুষের দান করা চোখের মধ্য দিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীকে প্রাণভরে দেখতে পারে, তবে সেটাই হবে আমাদের সত্যিকারের মানুষের প্রতি ভালবাসা।”

এই কথা বলে দাদু রোহনকে আলমারি খুলে সযত্নে রাখা একটি কাগজ দেখালেন। বললেন, “বাড়ির সবাইকে আমার জানানো আছে, তবু তোমাকেও বলি, আমি যদি হঠাৎ করে কখনো মরে যাই, বাড়ির সবাই যদি ভুলেও যায় তুমি কিন্তু ভুলো না দাদুভাই। তুমি মনে করে এই কাগজে যে ফোন নাম্বারটি দেয়া আছে সেখানে ফোন করলেই তারা এসে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আমার চোখ দুটো নিয়ে যাবে যারা চোখে দেখতে পায় না তাদেরকে দৃষ্টি দেবার জন্য।”

দাদুর এই কথাগুলি বলার মাসছয়েক পর একদিন রোহন স্কুলে ক্লাস করছে হঠাৎ হেডস্যার এসে রোহনকে বললেন, “তোমার বাড়ি থেকে লোক এসেছে তোমাকে নিতে। তুমি বাড়ি চলে যাও।”

বাড়িতে গিয়ে সে দেখল বাড়িভর্তি লোকজন। বাবাকেও কলকাতায় খবর দেওয়া হয়েছে, আজকের সন্ধের বিমানে বাবা চলে আসছে। রোহনের দাদু আর বেঁচে নেই। দাদুকে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিয়ে খাটে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মনে হচ্ছে দাদু হয়ত এখনই রোহনকে বলবেন, “মানুষকে ভালবাসতে শেখ, তোমার কর্মই হবে তোমার একমাত্র পরিচয়। মানুষের জীবন হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী কিন্তু তার কর্ম থেকে যাবে চিরকাল।”

দাদুকে সে এতটাই ভালবাসত! আজ এই অবস্থায় দাদুকে দেখে তার চোখের সব জল শুকিয়ে গিয়ে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল আর মনে পড়তে লাগল তাকে বলা দাদুর কথাগুলি। হঠাৎ তার মনে পড়ে যেতে মনে মনে দাদুকে বলল, “তোমার চোখ দানের অঙ্গীকারপত্রটি আমি এখুনি বের করে যথাস্থানে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি। তুমি আমাকে ঠিকই বলেছিলে দাদু, পৃথিবীতে আজ বহু মানুষ অন্ধত্বের জ্বালা বহন করছে। একজন অন্তত তোমার দান করা চোখ দিয়ে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীকে প্রাণভরে দেখতে পাবে। আমরা সবাই যদি মৃত্যুর পর চোখ দান, মরণোত্তর দেহদান করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হই তবে জাতিভেদ নির্বিশেষে বহু মানুষই উপকৃত হবে। সেটাই হবে মৃত্যুর পরেও অন্য মানুষের প্রতি ভালবাসার নিদর্শন।”

রোহন সজল চোখে দাদুর পা-দুটো জড়িয়ে ধরে বলল। “দাদু, তুমি আমাকে আশীর্বাদ কর আমি যেন তোমার মহান আদর্শগুলিকে আঁকড়ে ধরে জীবনে বড় হতে পারি।

ছবিঃ শিমুল

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s