গল্প ধনেশ টুপি ‘বোপিয়া’ রাজীব কুমার সাহা শরৎ ২০১৭

রাজীব কুমার সাহা র সব লেখা একত্রে

“যাবেন কোথায়, স্যার?”

“নাহারলগুন। মাঝারিগোছের কোনও হোটেল বা গেস্ট-হাউস মোটামুটি কততে মিলতে পারে আইডিয়া দিতে পারেন?”

নিরজুলি নেরিস্ট কমপ্লেক্স থেকে নাহারলগুন শহরটা যেহেতু মাত্র আট কিলোমিটারের পথ তাই একটা ট্যাক্সি করতে কোনও আপত্তি ছিল না। এসেছি মাসতুতো ভাইকে নেরিস্টে ভর্তি করাতে। দিন তিনেকের কাজ। সময় আর সুযোগ পেলে ইটানগর আর আশপাশটা ঘুরে যাব যতটুকু সম্ভব হয়। কিন্তু আমার জন্যেই যে এত বিপদ অপেক্ষা করে আছে কে জানত।

ছোট্ট লনওয়ালা গেস্ট-হাউসটার গেটে পৌঁছে গেলাম মিনিট পনেরোর মধ্যেই। একেবারে শেষের কোণে একটা সিঙ্গল-বেডেড রুমও পেয়ে গেলাম। একটা কাঁচের জানালার স্লাইডিং পাল্লার খানিকটা ভাঙা ছাড়া ঘরটায় আর কোনও অসুবিধে নেই। একজনের পক্ষে যথেষ্ট বড়সড়ই। জানালাটার ওপারে খানিকটা দূরে বট বা অশ্বত্থগোছের কী একটা গাছ। অন্ধকার নেমে যাওয়ায় ততটা ঠাহর হয়নি চোখে। ব্যাগ বয়ে আনা বয়টার দিকে দৃষ্টি ঘোরাতেই অল্প হেসে বলে উঠল, “জানালাটার কথা ভাবছেন স্যার? ও কিছু নয়। মোটা পর্দা ঝোলানো রয়েছে। বাতাসটুকুও ঢুকতে পারবে না। অন্যকিছু তো নয়ই। সেফটি নিয়ে আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। আর এটুকু খুঁতের জন্যেই রুমটা প্রায় অর্ধেক দামে পেয়ে গেলেন স্যার।”

ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা টানা চলছে সারাদিনই। ভাইকে পরিচিত এক সিনিয়র স্টুডেন্টের রুমে থাকার ব্যবস্থা করে এসেছি হোস্টেলে। স্নান সেরে সাড়ে আটটা নাগাদ রাস্তার ওপাশে ভাতের হোটেলটায় খেতে বসে দেখা পেয়ে গেলাম সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারটার। আমাকে দেখেই হাসিমুখে জায়গা করে দিয়ে বসল। ফিরোজ খাঁটি বাঙালি। পেটের টানে এখানে এসে থিতু হয়েছে। খেতে খেতে অনেকক্ষণ আলাপ করলাম।

গেস্ট-হাউসে ফেরার সময় একটা দোকানে হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটা জিনিসে। বাঁশের বেত তুলে আর কাঠের টুকরোতে ঠিক ধনেশপাখির ঠোঁটের নকশা করে পালক লাগিয়ে তৈরি দারুণ দেখতে টুপিটা না কিনে পারলাম না। দোকানি জানালেন, “একে বোপিয়া বলে স্যার। আদিবাসিদের জিনিস।”

খেয়ে এসেই সটান বিছানায়। আগেরদিন রাত আটটা নাগাদ বাসে রওনা হয়েছি গৌহাটি থেকে। পাহাড়ি রাস্তা, গায়ে লাগে বেশ। সকাল সকাল নিরজুলি পৌঁছেই কলেজের কাজকর্মে লেগে যেতে হল। শরীরটা আর দিচ্ছিল না। কালকের দিনটা পার করতে পারলে অনেকটাই হালকা হয়ে যাব। পরশুদিন কাজ বলতে শুধু ভাইয়ের নামে একটা ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্ট খুলে তাতে টাকা জমা করে দেওয়া আর টুকিটাকি দুয়েকটা কাজ। তারপরেই আমার ছুটি।

মাঝরাতে যখন ঘুমটা ভেঙে গেল হঠাৎ, ঘড়িতে তখন পৌনে তিনটে। শরীরটা কেমন ভার ভার ঠেকছিল। অজানা একটা অস্বস্তি হচ্ছিল মনে মনে। লাইট জ্বালিয়ে দু’বার দু’ঢোঁক জলও খেলাম। জানালার পর্দাটা খানিকটা সরে গেছে কখন। ভাঙা কাঁচটা দিয়ে ভেজা হাওয়া ঢুকছে হু হু করে। বাইরের আবছা গাছটায় চোখ যেতে অকারণেই গাটা ছমছম করে উঠল আচমকা। কোনওমতে পর্দাটা টেনে দিয়ে শুয়ে পড়লাম আবার। মাথাটা ভোম মেরে আসছে আস্তে আস্তে। বারবার একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে। আমি কে? কোত্থেকে এসেছি? যাব কোথায়? এখানটায় কি এসেছি আগে আরও? ধুস, দু’দিনের অনভ্যস্ত দৌড়োদৌড়িতে পেটে গ্যাস জমেছে নিশ্চয়ই। সকালেই ওষুধ কিনে খেতে হবে।

ভোরের আলো ফোটেনি তখনও ঠিক করে। দরজা খুলে শিরশিরে ঠাণ্ডায় বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টিটা চলছেই ঝিরিঝিরি একটানা। চারদিক শুনশান একেবারে। শুধু লনের দিক থেকে দু’চারটে ভেজা ঘোলাটে আলো আবছা চোখে পড়ছে। দরজাটা আলতো করে টেনে দিয়ে পা বাড়ালাম বৃষ্টিতে। লন পেরিয়ে গেটের কাছে পৌঁছতেই ভিজে সপসপে হয়ে গেলাম। মাথাটা বাঁচল, কারণ সেই রঙচঙে টুপিটা রয়েছে। নিজের অজান্তেই কখন ওটা পরে বেরিয়েছি জানি না। এবারে গেটটা টপকাতে হবে। সন্ত্রস্ত দৃষ্টি ফেলে পরখ করে নিলাম চারদিক।

হঠাৎ একটা জোর ঝাঁকুনিতে সব গণ্ডগোল হয়ে গেল। কে একজন আপাদমস্তক বর্ষাতি পরা মুশকোমতো লোক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী যেন বলতে লাগলেন। আবছা দৃষ্টিটা পরিষ্কার হতেই চিনতে পারলাম। গেট-কীপার। শুনতে পাচ্ছি, “আপনি এ সময়ে এখানে কী করছিলেন? বাইরে গেলে আমায় ডাকতে পারতেন। এরকম বিপজ্জনকভাবে গেটে চড়তে যাচ্ছিলেন কেন শুনি? আপনি তো মশাই আমার চাকরিটা খাবার তাল করেছিলেন যা দেখছি। ওপর-নিচ কিছু একটা যদি হয়ে যেত? আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো, ও মশাই?”

ভদ্রলোকের কোনও প্রশ্নেরই সদুত্তর আমার কাছে ছিল না। কয়েক মিনিটের জন্যে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ একেবারেই হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। দুয়েকজন হোটেল বয়ও পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে দেখলাম। ফ্যাল ফ্যাল করে সবার মুখে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ঘরমুখো রওনা হয়ে গেলাম দ্রুতপায়ে। রুমে ছিটকিনি এঁটে মনের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে তোলপাড় করেও ঘটনাটার মাথামুণ্ডু কিছুই বোধগম্য হল না। এ কী করছিলাম আমি? কোথায় চলেছিলাম এভাবে?

ন’টা বাজতেই ভাই ফোন করল। শরীরটায় ঠিক জুত না পেলেও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম নেরিস্টের উদ্দেশ্যে।

সন্ধের মধ্যেই ফিরে এলাম আবার গেস্ট-হাউসে। তালা খুলে দরজার কবাট ঠেলতে ঈষদুষ্ণ একরাশ গুমোট হাওয়া শরীর ছুঁয়ে বেরিয়ে যেতেই গাটা ছমছম করে উঠল। সারাদিন দম ফেলারও ফুরসত পাইনি। গেস্ট-হাউসটা পালটে ফেললে ভালো হত। ফ্রেশ হয়ে খেতে গিয়ে আবার ফিরোজের সঙ্গে দেখা। মুখে সেই অমলিন হাসি। বলল, “কাজকর্ম যা আছে কাল সেরে নিন। পরশু আপনাকে আমি আশপাশটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব’খন।”

আমি ওর ফোন নম্বরটা নিয়ে মুচকি হেসে ঘাড় কাত করে ফিরে এলাম নিজের রুমে।

সারাদিন এত ধকলের পরও নার্ভ বেশ টানটান হয়ে আছে আজ। ঘুম আসছিল না কিছুতেই। কীসের একটা ছটফটানি সারা শরীর জুড়ে। একটা বই হাতে নিয়ে ঘণ্টা খানেক এপাশ ওপাশ করতেই ঝিমুনিমতো এসে গেল। হাত বাড়িয়ে আলোটা বন্ধ করতে গিয়ে জানালাটার দিকে চোখ পড়তেই কেমন যেন অস্বস্তি হল বেশ। গুটিয়ে নিলাম হাতটা। চটকে গেল তন্দ্রাটা মুহূর্তের মধ্যেই। নাহ্‌, কাল সকালেই এ গেস্ট-হাউস আমি ছেড়ে দেব।

ভোর চারটে বাজতে এখনও মিনিট পনেরো বাকি। তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলাম করিডোরে। ফিরোজ অপেক্ষা করছে গেটের বাইরে। সন্তর্পণে গেটটা টপকে গাড়িতে গিয়ে বসলাম ওর। আজ আর কেউ বাদ সাধেনি। সাঁ সাঁ করে টায়ারের আওয়াজ তুলে ট্যাক্সি ছুটে চলেছে সত্তর-আশি কিলোমিটার বেগে। বৃষ্টিটা এবারে ঝমঝম করে নেমে এল আচমকা।

দু’দুটো লজঝড়ে বেইলি ব্রিজ, বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি সর্পিল পথঘাট, নিঝুম বনবাদাড় একটানা পেরিয়ে ফিরোজের গাড়ি যখন দম নিল তখন মধ্যাহ্ন। বৃষ্টির তোড়টা অনেকটাই কমে এসেছে। আচ্ছন্নের মতো পড়ে ছিলাম গাড়ির পেছনের সীটে। সময়ে সময়ে শুধুমাত্র রাস্তার হদিশ দেওয়া ছাড়া আর কোনও নিয়ন্ত্রণ নিজের ওপর ছিল না। আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। এই তো আমার গ্রাম! চারদিক ঘন বনে বেড় দেওয়া নঈশি জনপদ। ছোটোবড়ো পাহাড়ের কোলে ইতিউতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মাটি থেকে ফুট চারেক উঁচু কাঠের মাচানের ওপর বাঁশবেতের ঘরদোর। লম্বা লম্বা সবুজ ঘাস প্রাবৃত পাহাড়ের ঢালে চরে বেড়াচ্ছে পুরুক (মোরগ), সেবিং (ছাগল), এরিক (শুয়োরছানা), শেয় (গরু) আর তাগড়া তাগড়া পবিত্র সেব্বে (মিথুন)। ওই তো জুমক্ষেতে হাসছে তাপিও (ভুট্টা), মেকুং (শসা), তাকিই (আদা), আঞ্জে (রাঙা আলু) আর তেমি (বাজরা)। তরতর করে নামতে নামতে পাথরের থাকে থাকে পড়ে ছিটকে যাচ্ছে পাহাড়ি ঝর্না। ঘন সবুজ ঝাঁকড়াগাছগুলো থেকে ভেসে আসছে ভিজে পাতার মাতাল করা গন্ধ।

ধনেশ-টুপিটা খুলে হাতে নিতে না নিতেই একটা হল্লামতো কানে এল। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম নারীপুরুষ মিলে প্রায় জনাকুড়ি লোক ছুটে আসছে এদিকপানেই। ফিরোজের গলা কেঁপে উঠল সহসা, “এ আপনি কোথায় নিয়ে এলেন আমায়? ঘরে দু’দুটো দুধের শিশু রয়েছে স্যার। লোকগুলোর হাতে হাতে খোলা দা, ছোরা চকচক করছে যে!”

রুক্ষ গলায় বললাম, “এরা প্রত্যেকেই আমার অতি আপনজন, ফিরোজ। তুমি যখন খুশি ফিরে যেতে পার।”

লোকগুলো কাছাকাছি আসতেই আমার চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল অনাবিল আনন্দে। নোকো, নেগিন, লোতে, নোনাং আর নোশো তো হুমড়ি খেয়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমায় একসাথে মিলে। এদের সাথেই আমার সখ্যতা সবচেয়ে বেশি। আমার যেন দশমুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে অনর্গল। এ গ্রামে নঈশি ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা নিষিদ্ধ। ফিরোজ একটা কথাও বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইল হাঁ করে। আর বাকিরা ‘আভু থনঈ’, ‘আভু থনঈ’ বলে সারবেঁধে দাঁড়িয়ে জয়ধ্বনি শেষে হাত বেঁধে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল। মেয়েরা তো খানিক অপেক্ষা করেই একে অপরের পিঠ জড়িয়ে গোল হয়ে নাচতে নাচতে গান ধরল। তাদের গলায় রঙচঙে তসং (পুঁতি)-এর লম্বা লহরের মালা। দু’হাতে কোজি (বাঁশের চুড়ি)। গলায় আর কোমরেও পাকা বাঁশের চাকতি কাটা অলঙ্কার। পুরুষদের মাথার চুল মুঠো করে কপালের ওপর বাঁধা। তাতে উলের কাঁটার মতো দুটো করে ইঞ্চি ছয়েক লম্বা ছুঁচলো চুলের কাঁটা সমান্তরালভাবে গাঁথা। গায়ে ঐতিহ্যবাহী সাজপোশাক, এরি। প্রত্যেকের কোমরে চামরের খাপে ঝুলছে ওরিওক (ছোট্ট তরোয়াল)।

জোর জলো হাওয়া উড়ে আসছে দিক্রং নদী থেকে। প্রাণভরে একবুক নিঃশ্বাস টেনে নিতেই প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল মনে, সারাদেহে। কয়েকজন এর মধ্যেই এনে হাজির করেছে হাতাকাটা রঙিন মোটা সুতোর হাঁটু-ঝুলের নতুন নকশি জামা, সেব্বের মোটা চামড়ার বর্ম।

একজন এগিয়ে এসে আমার হাত পা ধুইয়ে দিতেই বড়ো একটা কচুপাতায় সেব্বের মাংস আর ভাত বেড়ে দিল আরেকজন। বাজরা আর ভাত গেঁজিয়ে ‘আপ্প’ নামে একরকমের উত্তেজক পানীয় তৈরি করে নঈশিরা। সেটাও রেখে গেল একজন একটা ছোট্টমতো শুকনো পাকা লাউয়ের খোলে করে। আমি নঈশিদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকআশাকে সজ্জিত হয়ে খেতে বসলাম।

ফিরোজকেও খাবার দেওয়া হল আলাদা জায়গা করে। আমার সঙ্গে বসে খাওয়ার অনুমতি নেই কারও। সবাই কেমন যেন ভুরু কুঁচকে তেরচা চোখে তাকাচ্ছে ওর দিকে। খাওয়া শেষে ও এগিয়ে এসে কানে কানে বলল, “স্যার, কোথায় এলেন, কী বলছেন, কী করছেন, এরা কারা কিছুই তো বুঝতে পারছি না আমি! এই গ্রামের উপজাতিদের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?”

“তুই চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসে থাক, মূর্খ। আমি কে জানিস না? আমি নঈশিদের আদিপুরুষ আভু থনঈ। এরা সবাই আমার বংশজ।” হুঙ্কার দিয়ে আরক্ত চোখে একবার ওর দিকে দৃষ্টি ফেলতেই সাত-পা পিছিয়ে গেল ও।

অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সরু সরু গাছের গুঁড়ি আর বাঁশ কেটে চার ধাপ উঁচু একটা বসার প্রশস্ত জায়গা বানিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে কয়েকজন মিলে। এখান ওখান থেকে মুঠো মুঠো বনফুল এনে সাজিয়েও তোলা হয়েছে। আমি দৃঢ় পদক্ষেপে ধীরে ধীরে গিয়ে উঠে বসলাম ওতে। এই আমার সিংহাসন। নঈয়ুভ (পুরোহিত) এসে মন্ত্র পড়ে আমার ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা প্রাবরণ চড়িয়ে দিলেন। উপস্থিত বংশধরেরা একে একে ওপরে উঠে একটা করে চুলের কাঁটা নিবেদন করে অভিবাদন জানিয়ে গেল। কোমরবন্ধনীতে গুঁজে রাখলাম সেগুলো। মোড়ল আর তার সহযোগী দু’জনে সবচেয়ে উঁচু ধাপটায় হাঁটু গেঁড়ে বসে দু’হাত উঁচিয়ে একটা দাও (ছোটমতো তরোয়াল) আর একটা রইয়ুচক (ঐতিহ্যবাহী ছোরা) অর্পণ করে বলল, “আপনার অস্ত্র, প্রভু। সাতপুরুষ ধরে বুকে করে আগলে রেখেছি আমরা। গ্রহণ করতে আজ্ঞা হোক।”

এক ঝটকায় উঠে গিয়ে ছিনিয়ে নিলাম ও দুটো। আর মুহূর্তের মধ্যেই সারা দুনিয়া কেঁপে উঠল আচমকা। বসুমতী শিউরে উঠলেন যেন। ইতিমধ্যে আরও লোকজনসব কোত্থেকে ছুটে এসে জমতে শুরু করেছিল আমায় ঘিরে। উপস্থিত প্রত্যেকটা প্রাণী চঞ্চল হয়ে পড়ল এবারে। মাটি স্থির হতে না হতেই গগনবিদারী শব্দে সবাই দু’হাতে কান চাপা দিয়ে দৌড়তে শুরু করে দিল এলোপাথাড়ি। মহাপ্রলয় যেন ছুটে আসছে এই ক্ষুদ্র জনপদকে লক্ষ্য করে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বিশাল বিশাল মেঘের টুকরো ছড়িয়ে পড়ছে মাথার ওপরে। কোন এক অতি বলশালী দৈত্য যেন ওগুলো তাড়িয়ে আনছে আর দুর্দান্ত হুঙ্কার ছাড়ছে। সাথে রয়েছে মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ঝলকানি। দিনের আলো নিভে গেল দপ করে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আশেপাশের তিন-চারটে গাছের মাথায় ক-ক্কড়াৎ শব্দে আগুন ধরে গেল দাউ দাউ করে। তারপরেই শুরু হল প্রলয়ঙ্কর বৃষ্টি। এ কোনও সাধারণ বৃষ্টি-বাদলা নয়। হড়কা বান। পাহাড় পর্বতের উঁচু উঁচু গাছের মাথায় গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে একেকটা দৈত্যাকৃতি মেঘখণ্ড। সঙ্গে সঙ্গেই পাহাড়-পর্বত ভাসিয়ে নেমে আসছে উপত্যকায়। সে কী স্রোত, কী তার বেগ! পাহাড়ি-বানের জলে অতর্কিতে ভেসে আসছে সেব্বে, ছাগল, শুয়োর আর ছোটোবড়োসব অসংখ্য গাছপালা। নিচে নেমেই সঙ্গে করে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষজন আর ঘরবাড়ি। চারদিকে শুধু প্রলয়ের হুঙ্কার আর আমার প্রজাদের আর্ত চিৎকার। কারও রক্ষে নেই আজ।

সেদিন নাহারলগুনের সেই গেস্ট-হাউসে কীভাবে ফিরেছিলাম তা সঠিক মনে নেই। দুটো বলশালী হাত আমায় কাঁধে তুলে নিয়ে নরমমতো কিছু একটায় শুইয়ে দিয়েছিল, এতটুকু শুধু আবছা মনে করতে পারছি। নিশ্চিত মৃত্যুপুরী থেকে অচেনা নির্জন পাহাড়ি পথঘাট চিনে ফিরোজ কী করে শহরে পৌঁছেছিল সেটা ওর কাছেও দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই।

সকালে ঘুম ভাঙল মাসতুতো ভাইয়ের হাঁকডাকে। কাল সারাদিন ও আমায় খুঁজে হয়রান হয়েছে এখানে ওখানে। রুমের চাবি আমি পকেটে নিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। ম্যানেজারও ডুপ্লিকেট চাবি দেননি। বরং দু’জনে মিলে থানায় মিসিং ডায়েরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন। আজ থানায় যাওয়ার আগে শেষ একবার ঢুঁ মারতে এসেছিল ভাই। আমি সাইট-সিয়িংয়ে বেরিয়ে জোর বৃষ্টি-বাদলায় আটকে পড়েছিলাম বলে কৈফিয়ত দাখিল করে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম মোট ছাপ্পান্নটা মিসড কল। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল আমার। দুর্বল গলায় কোনওমতে জিজ্ঞেস করলাম, “তোর ব্যাঙ্কের কাজটা?”

“ও আমিই করে নিয়েছি ওই সিনিয়র দাদাটার হেল্প নিয়ে। তুমি চিন্তা কোরো না। ফিরে এসেছ, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। উফ্‌, কী যে দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছি সারাটা রাত!”

আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, “অ্যাই, বাড়িতে আবার…!”

ভাই হেসে বলল, “নাহ্‌, জানাইনি এখনও। তবে থানায় যাওয়ার আগে না ফিরে এলে সবই জানাতে হত বৈকি।”

“ভাই, একটা কাজ করবি? বিকেলে বাসের একটা টিকিট কিনে আনবি? খুব টায়ার্ড ফিল করছি রে, নইলে আমিই বেরোতাম।”

ভাই আরও দুয়েকটা দিন থেকে যেতে আবদার ধরল। আমি রাজি হলাম না। গত দু’দিনের এই ভয়ংকর ঘটনাগুলোর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। ভেতরে ভেতরে ভয়ে কুঁকড়ে আছি খুব। নিজের বাড়িটা ভীষণ টানছে আমায় এখন। মাথায় রইল অরুণাচল বেড়ানো। অনেক হয়েছে। কয়েকটা জরুরি আলোচনা সেরে নিয়ে ভাই বেরিয়ে গেল।

মিনিট পাঁচেক পরেই দরজায় আবার ঠকঠক আওয়াজে খুলে দেখলাম ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে চিন্তিত মুখে। হাতের একগাদা পত্রপত্রিকা নামিয়ে রাখল সামনের টি-টেবিলটায়। আরোহীদের কথা মাথায় রেখে বেশ কয়েকটা কাগজ রাখে ও গাড়িতে। একটা ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা তুলে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরতেই শরীরটা কেমন যেন টাল খেয়ে উঠল হঠাৎ। বীভৎস হেডলাইন। ইটানগর থেকে প্রায় নব্বই কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত এলাকায় কুংরিখেমা নামে একটা প্রাচীন নঈশি জনপদ চিরদিনের মতো মুছে গেছে একেবারে। গতকাল বিকেল তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ আচমকা এক ভয়ংকর হড়কা বানে ভেসে যায় পুরো গ্রামটা। দিক্রং নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে লাশের পর লাশ আর গবাদি পশু।

দুঃস্বপ্নটা আবার পরিষ্কার হতে থাকল আস্তে আস্তে। ঝিম মেরে আসছে শরীরটা ধীরে ধীরে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল ভীষণ। ইচ্ছে করছিল লণ্ডভণ্ড করে দিই সব – এই সৃষ্টি, এই পৃথিবী। জোর করে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণটা ফিরিয়ে এনে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে জিজ্ঞেস করলাম, “কাল ভোররাত থেকে মাঝরাত অবধি গায়েব ছিলে, বিবি চোটপাট করেনি? বাচ্চারা কেমন আছে?”

ফিরোজ অবাক চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শেষে প্রশ্নটা উড়িয়ে দিল আমার। দাঁত বের করে বলল, “স্যার সিরিয়াস মজাক খুব ভালো করেন তো! আমি আবার কোথায় গায়েব থাকব! কাল সারাদিন তো শহরেই ড্রাইভ করলাম, অন্যদিনের মতো।”

“সে কি! তুমি কাল আমার সাথে ট্রিপে যাওনি বলছ? মাঝরাতে তোমায় ফোন করে গেস্ট-হাউসের গেটের বাইরে গাড়ি নিয়ে আসতে বলিনি? কী যা তা বলছ!”

বলেই ব্যস্ত হাতে কল লিস্টটা পরীক্ষা করলাম একবার। নাহ্‌, আমার ফোন থেকে ফিরোজকে সত্যিই কোনও ফোন করা হয়নি।

ফিরোজ অল্প হেসে বলল, “দেখলেন? কাল সারাদিন ফোন করেননি বলেই তো আজ একেবারে রেডি হয়ে এসে গেলাম আপনাকে ঘুরিয়ে আনব বলে। চলুন স্যার। গাড়ি বাইরে দাঁড় করিয়ে এসেছি।”

আমি অল্পক্ষণ থম মেরে থেকে ভারী গলায় ধীরে ধীরে বললাম, “এবারে হচ্ছে না ফিরোজ। আমি বিকেলে ফিরে যাচ্ছি। তুমি এখন এস। ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে তোমার। খুব ভালো লাগল তোমার সাথে পরিচয় হয়ে। নম্বর রইল, কথা হবে নিশ্চয়ই।”

আমার চোখদুটোতে তখন কী ছিল জানি না। ফিরোজ একবার আমার চোখের দিকে আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মাথা নিচু করে। মনটা বেশ ভার হয়ে গেল আমার।

সারাটা দিন ভাইয়ের সাথেই কাটালাম নেরিস্টের কমপ্লেক্সের ভেতরে। একবার বেরিয়ে ওর জন্যে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করলাম। ব্যাগ গুছিয়ে নাহারলগুনের গেস্ট-হাউস থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম ফিরোজ বিদেয় নেওয়ার পর পরই।

বিকেল সাড়ে চারটায় নিরজুলি থেকেই বাসে চড়ে বসলাম। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। করুণ চোখে তাকিয়েছিল ও বাসটা চোখের আড়ালে চলে না যাওয়া অবধি। গুছিয়ে বসতেই এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সবকিছু পুকুরে মাছের ঘাইয়ের মতো শুরু করে দিল মাথার ভেতরে। কখনও ভেসে উঠছে, কখনও তলিয়ে যাচ্ছে। কখনও মাঝপথ থেকেই বেপাত্তা হয়ে যাচ্ছে সূত্রগুলো। আমার সাথেই কেন শুরু হয়েছে এসব? কিছুক্ষণ পর আজেবাজেসব চিন্তাভাবনা ঝেড়ে-ঝুড়ে সীটে মাথা ফেলে একটু ঘুমনোর চেষ্টা করলাম। বাস ছুটে চলেছে হু হু করে ন্যাশনাল হাইওয়ে পনেরোর আঁকাবাঁকা কালো পথে। আজও বৃষ্টিটা ধরেনি। এই বাড়ছে, এই কমছে।

কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানি না। তন্দ্রামতো এসে গিয়েছিল খানিকটা। চটকটা ভাঙল কোমরের দিকে হালকামতো একটা ধাক্কায়। ক্লান্তি জড়ানো চোখ মেলে টের পেলাম, পাশে বসা লোকটা যতটা পারছে ঝুঁকে কী যেন তুলে আনার চেষ্টা করছে মেঝে থেকে। সোজা হয়ে চোখাচোখি হতেই হেসে বললেন, “আমার কলমটা। পড়ে গিয়েছিল।”

তন্দ্রার আবেশ যেটুকু চোখে লেগেছিল তখনও, এক ঝটকায় পালিয়ে গেল। “ফিরোজ, তুমি!”

“ফিরোজ? আজ্ঞে, আমি সিতাংশু রায়। এফএমসিজি এরিয়া ম্যানেজার। গৌহাটি যাচ্ছি, উজানবাজারে থাকি। একটু আগেই উঠলাম বাসে। আপনি ঘুমোচ্ছিলেন। কে ফিরোজ?”

এ কী করে সম্ভব? সেই চোখ, সেই মুখ, মাথার সিঁথিটা পর্যন্ত একইরকম! জোর করে একটু হাসি টেনে বললাম, “মজাকিতে তুমিও তো কম যাও না ফিরোজ। এখন বল, যাচ্ছ কোথায়? সকালে বললেই তো পারতে, টিকিটদুটো একসাথেই কেনা যেত। লুকোনোর কী ছিল?”

শ্লেষটা কানে যেতেই খাপ্পা হয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। পকেট থেকে নিজের আই কার্ডটা বের করে নাকের সামনে ধরলেন, “কী যা তা বলছেন বুঝতে পারছি না মশাই। এই দেখুন। আমি আপনার ফিরোজ নই।”

আই কার্ডটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই চুপ মেরে গেলাম আমি। বলার কিছুই ছিল না একবার ক্ষমা চাওয়া ছাড়া। নামধাম সবই আমার কাছে নতুন। জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বুজে রইলাম। মাথার ভেতর তোলপাড়।

ক্লান্ত চোখদুটো কখন আবার বুজে এসেছে টের পাইনি। সাড়ে আটটা নাগাদ বাস-কন্ডাক্টরের চিৎকারে ঘুমটা কেঁচে গেল। তেজপুরের কাছাকাছি পৌঁছতেই কানে এল, “খাওয়াদাওয়া এখানেই সেরে নিন আধঘণ্টার মধ্যে। বাস এরপর সোজা গৌহাটি গিয়েই থামবে।”

বৃষ্টি পড়ছে। সিতাংশুবাবু কখন নেমে গেছেন টের পাইনি। খিদে তেমন ছিল না। তবুও নেমে গিয়ে একদৌড়ে একটা ধাবায় ঢুকে দেখলাম উনি রুটি-তড়কা খাচ্ছেন। পাশেই বাটিভরতি মাংস রাখা আছে। আমায় দেখতে পেয়েই হাত তুলে ডেকে নিলেন। খেতে খেতে বললেন, “এই ধাবার চিকেনটা মিস করবেন না কিন্তু। দুর্দান্ত রাঁধে।”

তেজপুরেই কানাঘুষা একটা চলছিল বটে। ততটা গা করিনি তখন। ঘণ্টা দুই আড়াই পর বরগাং এলাকায় পৌঁছতেই গাড়ি আটকে গেল। সামনেই যে নদীটা ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে মিশেছে তাতে ভয়ংকর বান ডেকেছে। চাকার ওপর অবধি রাস্তায় জল। একটা দুটো খালি লরি সাহস করে পেরোচ্ছে বটে, তবে যাত্রীবোঝাই বাস পেরোনোটা ভীষণ বিপজ্জনক হয়ে যাবে। ড্রাইভার কাল সকাল ছাড়া স্টিয়ারিং ছুঁচ্ছেন না জানিয়ে দিয়ে বালিশ কম্বল নিয়ে উঠে গেলেন মাথার ওপর বার্থে। কিছুক্ষণ চেঁচামেচি আর বাকবিতণ্ডা চলল। লাভ হল না কিছুই। তাসের বাতিক সিতাংশুবাবু ভিড়ে গেলেন পেছনের সীটে একটা দলের সঙ্গে। আমি নিষ্কর্মা বসে থেকে অস্থির হয়ে পড়লাম একসময়। কন্ডাক্টরকে ডেকে বললাম, “অনেকেরই আর্জেন্ট কাজ রয়েছে কাল সকালে গৌহাটিতে। কতটুকুই বা রাস্তা, একটু রিস্ক কি নেওয়া যায় না? রাস্তা একেবারে বন্ধ এমন তো নয়। ওই তো এগিয়ে যাচ্ছে একটা গাড়ি। পেছন পেছন গেলেই তো হয়। ড্রাইভারবাবু এতদিন কী ড্রাইভারি করলেন তাহলে?”

উস্কানি কাজে এল না। কন্ডাক্টর কানেই তুললেন না কথাটা। আমিও নাছোড়বান্দা। যাত্রীরা একজন দু’জন করতে করতে অনেকেই সাপোর্ট করলেন আমায়। আরও প্রায় মিনিট দশেক কিছু ঝাঁঝালো বাকবিতণ্ডার পর তেড়েফুঁড়ে নেমে এলেন ড্রাইভার বার্থ থেকে। সটান এসে বললেন, “ঠিক আছে, আমি রাজি। তবে কারও কিছু হলে সে দায় কিন্তু আমরা নেব না।”

একমুহূর্ত ভেবে বললাম, “বেশ। তাহলে একটা ব্যবস্থা করা যাক। বাসে যতজন পুরুষ রয়েছেন সবাই মিলে রাস্তার দু’ধারে হাত ধরাধরি করে লাইন দিয়ে দাঁড়াবেন। অনেকটা রোড সাইড গার্ড পোস্টের মতন। মাঝখান দিয়ে আপনি বাস নিয়ে এগিয়ে যাবেন। তাতে বাস ডিরেইলড হবে না। কী, পারবেন তো? জল আশা করি পেটের ওপর উঠবে না কারও।”

ড্রাইভার একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে স্টিয়ারিংয়ে বসলেন গিয়ে। প্রস্তাবটা শুনে অনেকেই যেমন হই হই করে উঠল, কেউ কেউ আবার মুষড়েও পড়ল। শেষে বাস চলল। আমরা জনাকুড়ি লোক কাপড়জামা খুলে রেখে দু’পাশে লাইন দিয়ে দাঁড়ালাম রাস্তার জলে নেমে। বাস আমাদের ছাড়িয়ে গেলে আবার সামনে এসে দাঁড়াই।

আধা কিলোমিটারও পেরোইনি। জিজ্ঞেস করলাম, “সামনের ওই ঢিবিমতো জায়গাটায় তিনটে লরি দাঁড়িয়ে আছে না?”

সিতাংশুবাবু ভুরু কুঁচকে, “দাঁড়ান, দেখছি।” বলে এগিয়ে গেলেন জল ভেঙে।

খবর নিয়ে জানা গেল, সামনে আরও দু’মানুষ সমান গভীর জল। না নামলে পার হওয়া অসম্ভব। এমন বানের দিনে জায়গাটার ডাকাতের বদনামও রয়েছে খুব। লুঠপাটে বাধা দিলে দু’চারটে লাশও পড়ে যায়।

সবাই একজোট হয়ে আমার দিকে চোখেমুখে কেমন যেন আক্রোশ নিয়ে তাকাতে লাগল। তাড়াতাড়ি বললাম, “চিন্তা করবেন না, কিচ্ছু হবে না। আমরা কয়েকজন পাহারায় থাকব সারারাত। কী, সিতাংশুবাবু? থাকছেন তো আমার সঙ্গে?”

কে একজন তেড়েফুঁড়ে উঠলেন, “কেন বাতেলা দিচ্ছেন মশাই? অ্যাঁ? রাম-দা, ছেনি আর কিরিচের সামনে ওই দু’জোড়া খালি হাত-পা নিয়ে লড়ব নাকি? হুহ্‌, পাহারা দেখাচ্ছেন! ওখানেই রাতটা কাটানো উচিত ছিল। অনেকটা সেফ হত।”

বাসের দরজা জানালাসব ভালো করে এঁটে রাখা হয়েছে। আমরা ছ’জন উঠে এসেছি বাসের ছাদে এক বান্ডিল তাস নিয়ে। কী মনে করে নাহারলগুনের দোকানটা থেকে কেনা ধনেশ-টুপিটা বাসের বার্থ থেকে নামিয়ে নিয়ে এলাম। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। আকাশে একটাও তারা নেই। যার যার মোবাইলের ফ্ল্যাশ-লাইটটুকুই শুধু ভরসা। স্ক্রিনের আলো জ্বালিয়ে নিবিয়ে খেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবে খেলা জমে? চারদিকে শুধু জলো হাওয়ার গন্ধ আর ঝিঁঝিঁপোকার একটানা কোরাস। ভাগ্যিস, প্যানপ্যানে বৃষ্টিটা ধরে গেছে মিনিট কুড়ি আগেই। কুটকুট করছে সারা গা এখন বানের জলে ভিজে।

রাত প্রায় দুটো পেরিয়েছে তখন। সিতাংশুবাবুর ধাক্কায় উঠে বসলাম ধড়মড়িয়ে। আধশোয়া অবস্থায় কথা বলতে বলতে কখন চোখদুটো লেগে গেছে ঠাহর করতে পারিনি। মাইলটাক দূরে ছোটো ছোটো আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে তিন-চারটে। আমরা ছ’জনই উঠে বসেছি ততক্ষণে। কাউকে চিৎকার চেঁচামেচি না করতে সাবধান করে দিয়ে চোখ ফেলে রাখলাম আলোগুলোর দিকে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই আশঙ্কাটা সত্যি হয়ে উঠল। চারটে ছিপছিপে ডিঙি দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে এদিকপানেই। নিজেদের অজান্তেই সবাই গা ছেড়ে দিয়ে বসে রইলাম থেবড়ে। এখন উপায়! একটা রক্তারক্তি না বেধে যায় শেষে। গাড়িটা জোর করে এগিয়ে আনাটা উচিত হয়নি দেখছি একেবারেই।

সিতাংশুবাবু বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন উপায়? ব্যাটারা জনাদশেকের কম হবে না নির্ঘাত। কী ভেবেছেন?”

“কিছু নয়। ওদের সাথে কথা বলব। অনুরোধ উপরোধ করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। চলুন।” বলেই ধনেশ-টুপিটা মাথায় চড়িয়ে নিচের নামার উদ্যোগ করলাম। ডিঙিগুলো ঢিবিটায় এসে লেগে গেছে ততক্ষণে।

বাসের পেছনের লোহার সিঁড়িটা বেয়ে মাটিতে পা রাখার আগেই ধড়াম করে পিঠে এসে পড়ল একটা পাকানো বাঁশের বাড়ি। চোখেমুখে আগুনের অজস্র ফুলকি ছড়িয়ে পড়ল যেন মুহূর্তেই। ছিটকে পড়েই উঠে দাঁড়ালাম টুপিটা ঝাড়তে ঝাড়তে। বাসের ছাদ থেকে দু’জন মাঝ বরাবর অবধি নেমে এসেছিল আমার পেছন পেছন। আমার অবস্থা দেখে পড়িমরি আবার ছাদে উঠে গেল। কাঁচা বাঁশের খোলে ন্যাকড়া ঠুসে তাতে কেরোসিন ঢেলে তৈরি চারটে মশাল জ্বলছে চারটে ডিঙির গলুইয়ে। সারা গায়ে তেলকালি মাখা জনাবারো মালকোঁচা মেরে গামছা পরা মুশকো জোয়ান ঘিরে ধরেছে আমায়। সবার হাতেই একটা করে লম্বা রাম-দা। আবছা আলোয় পাশ ফিরে দেখলাম, বন্ধ বাসের ভেতরে আতঙ্কে নীল হয়ে আছে একেকজন। ঘাড় ফেরাতে না ফেরাতেই একজন আচমকা আমার হাত থেকে টুপিটা ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়ে নিজের মাথায় বসিয়ে দিল। ছিরকুট্টি বিটকেলে হাসিটা দেখেই রক্ত চড়ে গেল মাথায়। দুম করে একটা ঘুষি হাঁকিয়ে ওর নাকটা ফাটিয়ে দিয়ে টুপিটা ছিনিয়ে নিলাম মুহূর্তেই। একটুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই একযোগে তেড়ে এল সবাই রে রে করে। আমিও উলটো পায়ে গাড়ির দরজার দিকে দৌড় মেরেছিলাম আবছা মনে আছে। এরপর আর কিছু মনে নেই। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণটা অনেকটা আগে থেকেই একটু একটু করে চলে যাচ্ছে টের পাচ্ছিলাম। এবারে সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললাম।

কী করে লাথি মেরে বাসের দরজা ভেঙে ঢুকে কীসব হাতে করে আবার বেরিয়ে এসেছিলাম, কী করে ইঞ্চি ছয়েক লম্বা কতগুলো ছুঁচলো চুলের কাঁটা একেকটা লুঠেরার বুকে পিঠে হাতে পায়ে বসিয়ে দিয়েছিলাম সেসব কিছুই মনে নেই বিন্দুমাত্রও। সেসব ঘটনা শুনেছিলাম গৌহাটির এক নার্সিংহোমে শুয়ে সিতাংশুবাবুর মুখে। কোন এক দৈত্যের শক্তি নাকি ভর করেছিল আমার শরীরে তখন। ওরা বারোজন মিলেও আমায় নাকি আটকাতে পারেনি। তবে হ্যাঁ, জখম করেছিল পিঠে আর ডান-পাতে। পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে এখন শুয়ে আছি নার্সিংহোমের বেডে। ডাকাতদলের সাথে ওই খণ্ডযুদ্ধের পর বিশেষত সিতাংশুবাবুর তৎপরতায় এলাকার লোকজন জুটিয়ে নৌকো করে পার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল, তারপর সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে গৌহাটি অবধি কী করে পৌঁছলাম তা বিশেষ মনে নেই এখন।

গতকাল সন্ধের ভিজিটিং আওয়ারে আবার এসেছিলেন সিতাংশুবাবু। অনেকক্ষণ কথাবার্তার পর আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, “তা হ্যাঁ মশাই, এসব শ্লোক তো গীতায় আছে শুনেছি। বি.আর.চোপড়ার মহাভারতের শুরু আর শেষেও শুনেছি। আপনি সেদিন চোখমুখ লাল করে ওসব আওড়াচ্ছিলেন কেন হঠাৎ? ব্যাটারা তো আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল এতে দেখলাম।”

ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, “কীসের শ্লোক?”

“ওই যে, অভ্যুত্থানম্‌… তারপর কীসব বলছিলেন একবর্ণও বুঝতে পারিনি। বুক ঠুকে ওই শব্দটাই বারবার আওড়ে যাচ্ছিলেন আপনি।”

মুচকি হেসে চোখ নামিয়ে নিলাম। মন পড়ে আছে আমার ধনেশ-টুপিটার দিকে। থানায় জমা আছে সেটা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ঘটনাস্থলে পৌঁছে ডাকাতদের গ্রেপ্তার করে আঁতিপাঁতি খুঁজেও কোনও অস্ত্রশস্ত্রের হদিশ নাকি পায়নি সেখানকার পুলিশ। ডাকাতেরাও বলতে পারছে না ঠিক কীসে জখম হয়েছিল ওরা। এক সিতাংশুবাবু ছাড়া উপস্থিত আর কেউ হয়তো দেখেইনি কাঁটাগুলো।

ছবিঃ মৌসুমী

জয়ঢাকের গল্পঘর

8 thoughts on “গল্প ধনেশ টুপি ‘বোপিয়া’ রাজীব কুমার সাহা শরৎ ২০১৭

  1. একটানা রুদ্ধশ্বাসে পড়তে হল। বহুদিন পর শ্বাসরুদ্ধ হল গল্প পড়তে গিয়ে।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s