সাগরিকা রায়ের আগের গল্প ওরা ভূত
খুব সকালেই স্নান সেরে নেন কালীবাড়ির পুরোহিতমশাই গোকুল ভটচায । স্নান করতে করতে মিউজিক সিস্টেমে ‘ওঁ ভুর্ভুভুবস্য তৎসবিতুর্বরেণ্যম ভার্গোদেবস্য ধীমহি…’ শুনছেন । সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট নড়ছে তাঁর । শ্যামলাল পাড়ার দয়াময়ী মন্দিরের পুরোহিত তিনি । এমন নিষ্ঠার সঙ্গে মন্ত্র উচ্চারণ করেন , যে শোনে , সেই ভক্তিতে গলে পড়ে । তো সেদিন ও স্নান সেরে শুদ্ধ বস্ত্র পরে মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন । অল্প অল্প রোদের তাপে স্নান- শীতল শরীরে বেশ আরাম বোধ হচ্ছে । প্রসন্নমুখে ‘ মা কি আমার কালো রে শ্যামা , মা কি আমার …’ গাইতে গাইতে হাঁটছেন । মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে তিনি পৌঁছে যাবেন মন্দিরে । ততক্ষণে কাদামণি মন্দির ধুয়ে মুছে রাখবে । মনিং ওয়াকারেরা ফুল দিয়ে যায় মন্দিরে । সকালে প্রচুর ফুল জড়ো হয় । কাদামণি সেই ফুলের মালা গাঁথে ।
গোকুল ভটচায মোবাইল ফোনটা বের করে সময় দেখলেন । ছটা বেজে দশ । এতক্ষনে কাদামণির মালা গাঁথা হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি করে পা চালান পুরোহিত মশাই ।
মন্দিরের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলেন কাদামণি কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসছে ! যেন এতক্ষণ তার জন্যই অপেক্ষা করছিল কাদামণি । অবাক হলেন গোকুল ভটচায । দশ বছর ধরে এই মন্দিরে কাজ করছে কাদা , এমন কান্ড কখন করেনি কাদা , বা তিনিও কাদার এই চেহারা দেখেননি । কী হল ? গতকাল কাদামণির গ্রাম কেষ্টপুরে প্রাণীসুমারির কাজ চলছিল । কাদা আতঙ্কে ছিল ওর শশী মোরগটাকে বাবুরা ধরে নিয়ে না যায় । কারণ হাঁস মুরগি , গৃহপালিত গবাদি পশুর সংখ্যা গণনার সময় শশী যদি কাউকে ঠুকরে দেয় ! শশীর স্বভাব ভাল না । তেমনই কিছু হল নাতো ?
না, তেমন কিছু নয় । কাদা কেঁদে ককিয়ে খবর দিল, “মন্দিরে চুরি হয়ে গেছে ঠাউরমছাই , ছব্বসসো নিয়ে গেছে !”
পুরোহিত মশাই ছুটে মন্দিরে ঢুকে দেখেন মায়ের গয়নার বাক্স খোলা পড়ে আছে । প্রণামীর বাক্সটাও ফাঁকা! থালাবাসন ? কাদামণি চোখ মুছতে মুছতে বলে, “না ঠাউর মছাই , কিচ্ছুটি নেই , ছব নিয়ে গেছে ।”
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন পুরোহিত মশাই । মন্দিরের ট্রাস্টিবোর্ডকে খবর দিতে হবে । মন্দির কমিটির লোকেরা কী ডিসিশন নেন দেখা যাক । এরপর আছে পুলিশ । সারাদিন হুজ্জোতি চলবে । এখন কথা হল , গত মাসে ঠাকুর গোপাল মন্দিরেও চুরি হয়েছিল । আজ পর্যন্ত চোরের টিকি দেখা যায় নি । আজ হল বেস্পতিবার । গত সোমবার গভীর রাতে পরপর চারটি দোকানে আর দুটো বাড়িতে চুরি হয়েছে । বাড়ি থেকে ল্যাপটপ , মোবাইল , ক্যামেরা চুরি করেছে । দোকানের শাটার ভেঙে চুরি হয়েছে । মনে হয় একই লোক বা গ্রুপের কাজ ! যে বা যারা চুরি করে , তাদের স্পাই আছে খবর পৌঁছে দেওয়ার । থাকতেই হবে । এত নিপুণ কাজ , একার পক্ষে অসম্ভব । অন্যদিন পুরোহিত মশাইয়ের ভাগ্নে বিশু মন্দিরে রাতে শোয় । গতকাল ও মালদায় গিয়েছিল । এস এস সি পরীক্ষার সিট পড়েছে ওখানে । চোরের দল জানল কী করে যে বিশু রাতে থাকবে না !
ওষুধের দোকানের ক্যাশ ভেঙে ছত্রিশ হাজার টাকা চুরি হয়েছে । সরাফত আলির পেটের ব্যথাটা বাড়ায় সেদিন ক্যাশ বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেননি । সেই টাকার খবর কে দিল চোরকে ? কে আছে এর পেছনে? সরাফত নিজেই অবাক , “হরবখত আমি রূপিয়া পইসা ঘরে লে যাই । কাল নিয়ে গেলাম না । চোরকো পতা কৈসে লগা?”
নাহ , খোঁজ কর , কে আছে আড়ালে ? মন্দিরে সারাক্ষণ ভক্ত সমাগম লেগে থাকে । গতকাল ছিল অমাবস্যা । পুজো হয়েছে গভীর রাতে । জনাসাতেক লোক ছিল । হারু মোক্তারের মা , কাকি , তুলসীর জেঠিমা , দাদু , কমল , নকুল রাঠি , …আর যে কে মনে পড়ছে না । তিনি অবশ্য পুজো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কাদামণি পুজোর জোগাড়যন্ত্র করছিল । রাধু চক্কোত্তি ভোগপ্রসাদ রাঁধতে ব্যস্ত ছিলেন । তিলির মা মশলা বাটছিল মনে হচ্ছে। এর মধ্যে স্পাই এল কোথা থেকে , গেলই বা কোথায় ?
এরই মধ্যে পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করেছে । জিজ্ঞাসাবাদ করে যখন তারা গেল , বেলা তখন পড়ে এসেছে।
পুরোহিত মশাই ভাবলেন এতক্ষণ মাকালী পুজো পাননি । জলমিষ্টি ভোগ পাননি । না , তাড়াতাড়ি মন্দিরের পেছনের পুকুর থেকে স্নান সেরে নিয়ে পুজোয় বসবেন । মন উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে । স্নানের পর শীতল হবে। শান্ত মনে পুজো করা উচিৎ ।
তিনটে ডুব দিয়ে মা কালীর স্তবপাঠ করতে করতে পুরোহিত গোকুল মশাইয়ের মনে হচ্ছিল এই পুকুরে তিনি যেন একা নন । যেন আরও কেউ আছে ! চারধারে ভাল করে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলেন না । চিন্তিত মনে ওঁ করাল বদনাং ঘোরাং মুক্তকেশী জপতে জপতে উঠে পড়লেন পুকুর থেকে । তিলি গুচ্ছের পেয়ারা নিয়ে যাচ্ছিল ফল প্রসাদের জন্য । ছেলেটা ভাল । ওর মা ফল কেটে সাজিয়ে দেবে ঠাকুরের সামনে । যা গেল সারাদিন ! ।
পুজোতে বসেও মনের খচখচানি গেল না । কী যেন একটা ভুলে ভুলে যাচ্ছেন ! মানুষের দুটো মন থাকে । একটা হল চেতন , যে সবকিছু সরাসরি দেখে । অন্য মনের নাম অবচেতন । যে দেখে , কিন্তু , লুকিয়ে দেখে । আজ পুরোহিতমশাইএর অবচেতন মনটা তাঁকে কিছু বলতে চাইছে । কিছু যেন মনে করিয়ে দিতে চাইছে । কী সেটা ?
কাদামণি ফুল গুছিয়ে দিচ্ছিল । কাদামণির হাতে সোনার বাউটি । কানে সোনার ফুল । এত সোনা কাদামণি কোথায় পেল ? এতদিন তো খেয়াল হয়নি !
“ঠাকুরমশাই , পেয়ারা কেটে দিচ্ছি ,” তিলির মা রোজের মত ফল প্রসাদের থালা সাজিয়ে দিচ্ছে । একপাশে হাতজোড় করে বসে আছে তিলি । পুজোর শেষে অঞ্জলি দেবে ।
আজ মন্ত্র বলতে ভুল হয়ে যাচ্ছে পুরোহিত গোকুল ভটচাযের । চোখ বুজলেই কাদামণির সোনার বাউটি চোখের সামনে ঝিলিক দিয়ে উঠছে । পুরোহিত মশাই প্রার্থনা করেন, “মাগো করালবদনী , মনটা শান্ত করে দাও মা !”
কোনরকমে পুজো শেষ করে প্রণাম সেরে যখন উঠে দাঁড়ালেন , তখন মন অনেক শান্ত হয়ে গেছে । আর তখনই বুঝে ফেললেন অবচেতন মনটা কী বলতে চাইছে ! মনে পড়ে গেল, তিনি যখন স্নান করছেন , তিলি পেয়ারা নিয়ে আসছিল । তিলির গলা পর্যন্ত ভেজা ছিল । তিলির পায়ে পুকুরের তলার কাদা ! পেয়ারা পেড়েছে গাছে উঠে , তাহলে পায়ে কাদা কেন ? গা ভেজা কেন ?
চেপে ধরতেই তিলি ভয়ে কেঁদে ফেলল । বলতে চায়নি প্রথমে । কিন্তু গোকুল ভটচাযের জেরায় সামলাতে পারল না নিজেকে । জানাল ওই-ই স্পাই । ওষুধের দোকানের খবরটা অবশ্য ও দেয়নি চোরেদের । তবে মন্দিরের খবরদাতা তিলি-ই । মাল সরানো যায়নি । কাদামণি শেষ রাতে ফুল তুলতে চলে আসে । ও আসাতে মাল রেখে পালাতে হয়েছে চোরেদের । চোরেরা দলে ছিল চারজন ।
মোবাইল ফোনে পুলিশকে ডাকলেন পুরোহিতমশাই, “আসুন ইন্সপেক্টর , চোরের খোঁজ পাওয়া গেছে।” পুলিশের সঙ্গে ঠাউর মছাইএর কথাগুলো শুনে কাদামণি অবাক, “মাল কোথায় গো ঠাউর মছাই?”
“পুকুরে । তাই না তিলি?”
ঘাড় নাড়ে তিলি । ঠিক । ব্যাগে পুরে রাখা আছে সব । পুকুরের মাঝখানে , যেখানে পানা জমে আছে , তার নীচে আছে মাল । সারাক্ষণ পাহারা দিচ্ছে ও । যাতে কেউ ওখানে পৌঁছতে না পারে । স্নান করতে নেমে পুকুরের মাঝ বরাবর কেউ যাচ্ছে দেখলে তিলি যে করে হোক আটকে দেবে ভুলিয়েভালিয়ে। পুরোহিতমশাই পুকুরের এদিকটাতে চান করছিলেন , কী করে উনি বুঝে ফেললেন তিলি চোরের দলে আছে ? মাল পুকুরে আছে ? পুরোহিত মশাই যে ‘গোন্দা’ তিলি বুঝতে পারেনি ।
পুরোহিতমশাই অবাক হন এই ভেবে যে , তিলি সামনেই আছে , অথচ ওকে সন্দেহ হয়নি । ওর মা মন্দিরের কাজে সাহায্য করে । তিলি মাঝে মাঝে আসে , অঞ্জলি দেয় । মন্দিরের বাগান থেকে পেয়ারা , কলা পেড়ে আনে । চোখের সামনেই আছে , কিন্তু উল্লেখযোগ্য ভাবে নেই বলে মন ওকে নিয়ে ভাবেনি । একেই বলে অপরাধ জগতের অদৃশ্য মানুষ । চেস্টারটনের একটা লেখায় এই রকমই পড়েছিলেন । একটি রহস্য গল্পে পড়েছিলেন , অপরাধী ছিল গাড়ির ড্রাইভার । কিন্তু তার গাড়ি চেপে যারা এসেছিল , পুলিশ তাদের সন্দেহ করেছিল অপরাধী বলে । ড্রাইভারের কথা কারও মাথায় আসেনি । তিলি সেই অদৃশ্য মানুষ । স্নান করতে করতে তিনি বুঝতে পারছিলেন , আশপাশে কেউ আছে । সেটা যে তিলি বুঝতে পারতেন না , যদি না তিলির শরীর অতোটা ভেজা থাকত । পায়ে কাদা থাকত !
তিলির মা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে আছে । তিলি আজ মায়ের সম্মান নষ্ট করে দিয়েছে । মান সম্মান না থাকলে কী থাকে আর ?
কাদামণি এখন সাহস ফিরে পেয়েছে । তিলিকেও সাহস দিচ্ছে, “পুলিছকে ছব বলে দিবি । তাহলে বেছি মারবে না । এপ্পর থেকে গোন্দা মছাইএর কাছে পত্তে বছিছ । কত বুদ্ধি এনার বাবা !”
পুরোহিত মশাই অবাক, “গোয়েন্দা মশাইটি কে ?”
কাদামণি প্রণাম করে, “আপনি গো !”
কাদামণির গায়ে ঝলমল করে গয়না । গোয়েন্দা সাবধান করেন, “এত গয়না পর কেন ? দিনকাল ভাল না ।”
কাদামণি হেসে সারা, “এগুলো ছিটি গোলের গয়না ঠাউর মছাই । নকল । আছল কি ছহজে মেলে?”
ঠিক বলেছে কাদামণি । মানুষও নকল হয়ে উঠেছে । তিলির মত সাদাসিদে ছেলেটা যে গিলটি হয়ে উঠছে , বোঝা গিয়েছিল কি ? সত্যিকারের সোনার মানুষ কবে বানাবেন ভগবান কে জানে !
তিলির মনটাকে পাল্টাতে হবে । অন্তত চেষ্টা তো করা চাই । পুরোহিতমশাই পুলিশের সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিলেন । একটা সুযোগ পাবে কি তিলি ভাল ছেলে হওয়ার ?
ছবিঃ অংশুমান
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে
বাহ
LikeLike
Darun
LikeLike