অরিন্দম দেবনাথ
নিস্তব্ধ স্টেশানে মাথার ওপরে বসে থাকা একটা কাক আচমকা ডানা ঝটপটিয়ে বিকট স্বরে কয়েকবার ডেকে চুপ করে গেল।
এক সহযাত্রী সিমেন্টের বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কাকটাকে তাড়াবার জন্য “এই হুশ্ হুশ্” বলে আওয়াজ করতে করতে বলে উঠলেন -“মাথার ওপর না আবার ‘ইয়ে’ করে দেয়।”
সিগন্যাল না পেয়ে প্ল্যাটফর্মের পাশের লাইনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়িটাও ঠিক এসময়ই ঘট্-ঘটাং-ঘট্ শব্দ করে খানিক নড়ে উঠল। আওয়াজটা বিকট হলেও খানিক প্রান পেল যেন আধাঘুমন্ত যাত্রী বোঝাই স্টেশানটা। ড্রাইভার ট্রেনের ব্রেক চেক করছে বোধহয়। প্রায় সাথে সাথেই মাইকে ঘোষণা হল “খানিক সময়ের মধ্যেই মালগাড়িটা ছেড়ে যাবে। যাত্রীসাধারণ প্ল্যাটফর্মের ধার থেকে সরে দাঁড়াবেন।”
রাত এগারোটা।
মেরামতির জন্য মোগলসরাই স্টেশানের ছ’নম্বর প্ল্যাটফর্মটার অনেকটাই ভাঙ্গা। এখানে ওখানে স্তুপ করে রাখা ‘টাইলস’, ছোট পাথরকুচি, বালি আর সিমেন্টের বস্তা। জানুয়ারির শীতের রাতে স্টেশনের প্রতিটি বেঞ্চে জুবুথুবু হয়ে বসে অসংখ্য যাত্রী। তাপমাত্রা সাত ডিগ্রি সেলসিয়াসের আসে পাশে ঘোরা ফেরা করছে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় ফিল টেম্পারেচার কমে গিয়ে হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ওয়েটিং রুমে পা রাখার জায়গা নেই, মেঝে জুড়ে প্লাস্টিক আর চাদর বিছিয়ে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা যে যেখানে পেরেছে শুয়ে বসে আছে। খানিক যা উত্তাপ, ওই ঘরের ভেতরে।
আমরা ওয়েটিং রুমে স্থান পাইনি। তাই বসে আছি খোলা প্লাটফর্মে। আমাদের ট্রেন ‘আনন্দ-বিহার এক্সপ্রেস’ পাঁচ ঘণ্টা লেট রান করছে। শুধু আমাদের ট্রেন কেন সব ট্রেনই ঘন কুয়াশার জন্য অস্বাভাবিক দেরীতে চলছে। কুয়াশা এত ঘন, যে দশ-হাত দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। দূরে অনেক দূরে কুয়াশায় মাঝে সিগন্যালের লাল টিমটিমে আলোটা ভুতুড়ে লাগছে।
“চল, একটু হেঁটে দেখে আসি কোথাও চা পাওয়া যায় কিনা,” দেবু বলল।
প্রস্তাবটা মন্দ লাগল না। ট্রেন আসতে এখনও ঢের দেরী। চা পেলে শরীরটা একটু গরম হত। প্ল্যাটফর্মের অধিকাংশ খাবারের দোকান, এই ঠাণ্ডায় সাটার নামিয়ে দিয়েছে। দু একটা যাও খোলা, তাতে কেক ও বিস্কুট ছাড়া আর কিছু নেই। প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে কুয়াশা ভেসে যাচ্ছে মেঘের মত।কোন চা-ওয়ালারও দেখা নেই।
চায়ের খোঁজে, হাওড়াগামী সদ্যপরিচিত সহযাত্রী এক পরিবারের জিন্মায় আমাদের ব্যাগ দুটো রেখে, প্ল্যাটফর্মের প্রায় তিরিশ মিটার লম্বা শেডটা ছাড়িয়ে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়াতে সাদা অন্ধকার আরও ঘন হয়ে চেপে ধরল। এখানে শেডের নিচের মত আলো নেই। খানিক পর পর উঁচু বাতিদানে আলো জ্বলছে ঠিকই, কিন্তু সে আলো কুয়াশা ভেদ করে নীচে পৌঁছতে পারছে কই! একটু পরপরই ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা লাগানো। সেগুলোতে এই সাদা-আঁধারে কি ছবি উঠছে কে জানে? সামনের ল্যাম্পপোস্টের একটা টিউবলাইট একবার জ্বলছে আবার পরক্ষনেই নিভে যাচ্ছে। অমাবস্যার রাত। আলোটা জ্বলে উঠতেই কুয়াশা সাদা হয়ে ঝলকে উঠছে, পরমুর্হুতে আলোটা নিভে যেতেই নিকষ অন্ধকার। আলোতেই প্রায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। ধোঁয়া-ধোঁয়া চারদিক।
কোথাও একটা জলের কল খোলা। ছর-ছর করে তীব্র বেগে জল পরার আওয়াজকে কুয়াশার আঁধারে নিস্তব্ধ স্টেশানে মনে হচ্ছে যেন জলপ্রপাতের শব্দ। প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে জল বয়ে চলছে অনেকটা জায়গা জুড়ে।
একটু এগোতেই সামনে জমাট কুয়াশার মধ্যে দেখি কমলারঙা আবছা একটা কিছু আচমকা একবার হেলে পরেই আবার সোজা হল। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম দুজনে। আরও একটা কমলারঙা কিছু মাটি থেকে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। শূন্যে ভাসতে ভাসতে আর মাটিতে শব্দ করে হ্যাচড়াতে হ্যাচড়াতে কমলারঙটা ধীরেধীরে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। শরীরের সবকটা লোম খাড়া হয়ে গেল।
কয়েক মুহূর্ত পরে খাকি রঙের পোশাকের ওপর কমলা জ্যাকেট পরা, কমলা প্লাস্টিকের বস্তা টেনে নিয়ে চলা রেলের এক সাফাইকর্মী আমাদের পাশ কাটিয়ে মিলিয়ে গেল কুয়াশার আড়ালে।
প্ল্যাটফর্মের এই অংশ বিলকুল ফাঁকা। কোথাও কোন যাত্রী বসে নেই। হাতে টর্চ আর কাঁধে বন্দুক নিয়ে খানিক পরপরই ক্ষণিক দেখা দিয়ে আবার কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে উর্দিধারি পুলিশ।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে প্ল্যাটফর্মের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। দুটো লাইনের মাঝের চওড়া প্ল্যাটফর্মের মাঝে একটা লম্বা ঘর। ঘরটার গায়ে বড় বড় করে লেখা গোডাউন। ঘরটার শেষ প্রান্তে সামান্য টিনের শেড। ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে সেখানে কয়েকজন মহিলা পুরুষ কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে। মাথার ওপর একটা আলো টিমটিম করে জ্বলছে। খানিক দূর থেকে নজরে এল পায়ের কাছে চাদর মুড়ি দিয়ে এক টুকরো প্লাস্টিকের ওপর শোয়ানো ছোট্ট একটি শিশু। উলের টুপির ফাঁক দিয়ে নাকটা দেখা যাচ্ছে শুধু। কিছু মালপত্র পাশে রাখা। একটা চটের বিগ-শপার ব্যাগের ওপর বাংলায় কৃষ্ণনগরের একটি দোকানের নাম ঠিকানা লেখা।
পায়ের কাছটা হটাৎ সুড়সুড় করে উঠল। তাকিয়ে দেখি বিশাল একটা ইঁদুর জুতোটা প্রায় কামড়ে ধরেছে। এক ঝটকা মারতেই, ইঁদুরটা হেলতে দুলতে প্ল্যাটফর্মের ধার থেকে রেললাইনে লাফ মেরে হারিয়ে গেল অন্ধকারে। পকেট থেকে টর্চটা বের করে জ্বালিয়ে আশেপাশে আলো ফেলতেই নজরে এল বেশ কয়েকটা ধেড়ে ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। পা দিয়ে থপ্ থপ্ করে আওয়াজ করতে দৌড়ে কুয়াশায় মিলিয়ে গেল ইদুরের দল।
পিছু ফিরলাম আমরা। চায়ের জোগাড় হল না এখনও পর্যন্ত।
আচমকা কানে এল শব্দটা, “গরম চায়ে!”
কিন্তু চা-ওয়ালা কোথায়? দেখাই যাচ্ছে না লোকটাকে!
হাঁক মারলাম “এই চায়ে।”
একটা খট্ খট্ আওয়াজ ক্রমেই এগিয়ে আসতে লাগল। সাদা কুয়াশার মাঝে দেখা গেল লোকটাকে। ক্রাচ বগলে পুলিশদের একটা বাতিল ছেঁড়া ওভারকোট গায়ে, হাতে ইয়াবড় ফ্লাস্ক ঝুলিয়ে লোকটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল, “বলিয়ে সাব।”
এই ঠাণ্ডায় যখন প্রায় সব দোকানি ঝাঁপ বন্ধ করে বসে আছে তখন ক্রাচ বগলে চা-ওয়ালাকে দেখে খানিক অবাক হলাম। কাগজের কাপে ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে ঢালতে চা-ওয়ালা নিজেই মুখ খুলল। “হাম স্টেশানমেই রহতা হুঁ, আউর রাতমে চায়ে বেচতা হুঁ।”
চায়ের দাম মিটিয়ে দিতে ঠক্-ঠক্ শব্দ তুলে ধীরে ধীরে কুয়াশার আড়ালে মিলিয়ে গেল লোকটা। দু-চুমুকেই চা শেষ হয়ে গেল। আমরা হাঁটা লাগালাম আমাদের মালপত্রের দিকে।
মাইকে একটা ক্ষীণ ঘোষণা শোনা গেল। কি বলল বোঝাই গেল না। কুয়াশা কি আওয়াজকেও স্তব্ধ করে দিল?
আমরা প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি পৌঁছনর আগেই স্টেশান কাঁপিয়ে একটা ট্রেন এসে দাঁড়াল ৫-নম্বর প্লাটফর্মে। কুয়াশায় ভিজে সমস্ত ট্রেনটা স্নান করে আছে যেন। ট্রেনের গায়ের বোর্ড দেখে বুঝলাম এটা হাওড়া থেকে দিল্লিগামী একটি ট্রেন।
খানিক দাঁড়িয়ে ট্রেনটা ছেড়ে যেতে স্টেশানটা প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল।ঠাণ্ডাটা যেন আরও বেড়ে গেল আচমকা। দেবু বলল “ওইটুকু চায়েতে ঠিক পোষাল না। চল, আরও এক কাপ করে চা খেয়ে আসি। কখন আমাদের ট্রেন আসবে তার তো কোন ঠিক নেই।“
আমরা আবার হাঁটা লাগালাম খানিক আগে যেখানে চা-ওয়ালাকে ছেড়ে এসেছিলাম সেই দিকে। কুয়াশাটা যেন আরও ঘন হয়েছে। আবছায়া আরও ধোঁয়াটে হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় চলে এলাম আবার। চা-ওয়ালা গেল কোথায়?
আমাদের পায়ের শব্দে কিনা জানি না একটা কুকুর বিকট চিৎকার করতে করতে সামনে হাজির হল। দেখি কুকুরটাকে তাড়া করে আসছে একপাল ইঁদুর। সংখ্যায় প্রায় গোটা দশেক হবে। এত বড় বড় ইঁদুর আমি আগে কখনও দেখিনি। বেড়ালের থেকেও বড় বড় একেকটা। কুকুরটা তারস্বরে ডাকতে ডাকতে গোল হয়ে ঘুরতে লাগল। তেড়ে যেতে লাগল ইঁদুরগুলোর দিকে।
কুয়াশার আড়াল থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল ঠক্-ঠক্। তারপর শোনা গেল একটা গলার স্বর “মুন্সি, মুন্সি বেটা কেয়া হুয়া?”
দেখি সেই চা-ওয়ালা। কুকুরটা দৌড়ে গিয়ে লোকটার ওভারকোটের ওপর দু’পা তুলে চিৎকার করতে লাগল সমানে। ইঁদুরগুলো সব আবার মিলিয়ে গেছে কুয়াশার আড়ালে।
লোকটা আমাদের দেখে বলল “কেয়া হুয়া সাব?”
আমি বললাম “খানিক আগে কয়েকটা ইঁদুর কুকুরটা তাড়া করেছিল। সামনে কোথাও খাবার টাবার ছিল হয়তো, কুকুরটা না পেয়ে …”
লোকটা বেশ বাংলা বোঝে। বলল “তাজ্জব বাত! খানেকে লিয়ে মুন্সি কভি এয়সা নেহি করতা।”
দেবু বলল “আমাদের দু’ কাপ চা দাওতো ভাই, তোমার কাপ গুলো বড্ড ছোট।“
লোকটা যখন আমাদের জন্য কাগজের কাপে চা ঢালছে তখন কুকুরটা চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল প্ল্যাটফর্মের শেষের দিকে। যেদিক থেকে ইঁদুরগুলো এসেছিল।
আমাদের চা দিয়ে, পয়সা নিয়ে চা-ওয়ালা ক্রাচ বগলে “মুন্সি, মুন্সি” বলে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে গেল।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমরা ফিরে চললাম আমাদের মালপত্রের দিকে।
মোবাইলের ব্যাটারি শেষ হতে চলেছে। চার্জ না দিলেই নয়। প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালের গায়ে অনেক ইলেকট্রিক প্লাগ পয়েন্ট রয়েছে। ব্যাগ খুলে মোবাইলের চার্জারটা বের করে প্লাগ পয়েন্টের দিকে যেতে গিয়ে দেখি কাঁদতে কাঁদতে একজন মহিলা আর দুজন পুরুষ দৌড়তে দৌড়তে আসছে। আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল মহিলা।
“আরে এরা প্ল্যাটফর্মের শেষে শেডের নীচে বসে ছিল না?” বলে উঠল দেবু।
“বাবু আমার বাচ্চা চুরি হয়ে গেছে” বলে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ল মহিলা।
“বাচ্চা চুরি হয়ে গেছে মানে?”
“হ্যাঁ বাবু, ঠাণ্ডায় কম্বল মুড়ি দিয়ে আমাদের সবার চোখ লেগে গেছিল, একটা ট্রেন ঢোকার শব্দে চোখ খুলে দেখি, সামনে শোয়ানো বাচ্চা নেই। কেউ চুরি করে নিয়ে ট্রেনে উঠে পালিয়ে গেছে। হায় হায় হায় হায়। বাবু আমাদের পুলিশের কাছে নিয়ে চলুন।” বলল দলের একজন পুরুষ।
দেবু বলল “চল স্টেশান মাস্টারের কাছে যাই।“
স্টেশান মাস্টারের অফিসে গিয়ে ঘটনাটা বলতেই চেয়ার থেকে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন স্টেশান মাষ্টার বঙ্গসন্তান অসিত রায়। “বলেন কী? বাচ্চা চুরি। আমার স্টেশান থেকে? এই স্টেশানে ছিঁচকে চুরিও হয়নি বহুদিন!”
ফোন তুলে কাউকে একটা কিছু বলার কয়েক মিনিটের মধ্যে ওনার কামরা ভরে গেল পুলিশে।একজন পুলিশ অফিসার কথা বলতে শুরু করলেন মহিলার সাথে।কয়েকজন বসে গেলেন সি সি ক্যামেরায় ওঠা ছবি দেখতে।
দু-এক মিনিট পরে মহিলার সাথে কথা বলতে থাকা পুলিশ অফিসারটি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন “স্টেশান থেকে বেরোনোর সব রাস্তায় খোঁজ লাগাচ্ছি। স্থানীয় থানাকে ডিটেল জানিয়ে বলে দিচ্ছি স্টেশান থেকে ছেড়ে যাওয়া সব বাস, অটো চেক করতে। বাচ্চা চুরি করে এখান থেকে কেউ পালাতে পারবে না। চলুন স্পটে যাই।“
“কিন্তু চোরেরা এই খানিক আগে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনে করে যদি বাচ্চাটাকে নিয়ে পালিয়ে যায়?” আমি বললাম। “কারণ ট্রেনটা ছেড়ে যাওয়ার পরেই তো বাচ্চাটা নিপাত্তা?”
স্টেশান মাষ্টার বললেন “ট্রেনের গার্ডকে সব জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উনি ট্রেনে থাকা পুলিশ দিয়ে ট্রেন স্ক্যান করাবেন।“
স্টেশান মাস্টারের ঘর থেকে বেরোতে শুনতে পেলাম মাইকে হিন্দিতে ঘোষণা হচ্ছে – “খানিক আগে স্টেশানের দক্ষিণ প্রান্তে ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ একদল ঘুমন্ত যাত্রীর মাঝখান থেকে একটি দু’মাসের শিশু কন্যা হারিয়ে গেছে। যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে, কেউ যদি শিশু কন্যাটির সন্ধান পান তবে অবিলম্বে রেলপুলিশের সাথে যোগাযোগ করুন।”
স্টেশানে অপেক্ষমাণ আধঘুমন্ত যাত্রীরা ঘোষণাটা শোনার পর নড়েচড়ে বসছে। অনেকেই ব্যাগপত্র গুনে চলেছেন। কি জানি চোরডাকাতের দল তাদের মালপত্র নিয়েও হাঁটা লাগাল কি না?
গাদাগাদা রেল পুলিশ আর রেল কর্মচারী হাতে ওয়াকিটকি নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্ল্যাটফর্ম। আমরা চললাম যেখানে ঘটনাটা ঘটেছে সেদিকে।
স্পটের খানিক দূর থেকেই কুয়াশার মাঝে অনেক লোকের গলার আওয়াজ আর ইতিউতি জ্বলতে থাকা টর্চের আলো নজরে এল।
ভিড়টা লক্ষ করে এগোতেই দেখি খানিক দূরে ক্রাচ বগলে ওভারকোট পরে দাঁড়িয়ে আছে সেই চা-ওয়ালা। লোকটার হাতে এখন আর চায়ের ফ্লাস্কটা নেই। আর সেই কুকুরটা চিৎকার করতে করতে ছুটোছুটি করেই চলেছে।
চা-ওয়ালা এখানে করছে কী?
একটা পুলিশ চিৎকার করে উঠল “এ রহমত, এ চায়ে-ওয়ালা, ‘মুন্সি’-কো সামাল!”
তার মানে চা-ওয়ালার নাম রহমত।
রহমত কুকুরটাকে চিৎকার করে ডেকে উঠল “এ মুন্সি ইধার আ।”
মাইকে একটা ক্ষীণ ঘোষণা শোনা গেল, “ছয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে একটা মালগাড়ি আসবে। যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে প্ল্যাটফর্মের ধার থেকে সরে দাঁড়াতে।” তার মানে আমরা যেই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি সেখানেই আসছে মালগাড়িটা। খানিক আগেই তো একটা মালগাড়ি ছেড়ে গেল!
ঘোষণাটা হবার পর রেলের ইঞ্জিনের ক্ষীণ হুইসেলের আওয়াজ শোনা গেল। কুকুরটা করুন স্বরে ডাকতে ডাকতে একবার ছুটে যাচ্ছে পুলিশগুলোর দিকে আর একবার রহমতের দিকে। একটা পুলিশ কুকুরটার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল “কেয়া হুয়া মুন্সি, চিল্লা রাহা কিউ?”
কুকুরটা রহমতের কাছে দৌড়ে গিয়ে ওর ওভারকোটটার একটা কোনা মুখে করে টানতে লাগল। তারপর কোটটার কোণাটা ছেড়ে খানিক দৌড়ে গেল স্টেশানের শেষ প্রান্তের দিকে।
আমাদের দেখে স্ক্রাচ বগলে ঠক্ ঠক্ করে এগিয়ে এল রহমত। “দেখিয়েতো সাব কেয়া হো গিয়া! কভি এয়সা নেহি শুনা। ছোটিসি বাচ্চিকো কৌন উঠাকে লে জায়েগা?”
কুকুরটা আমাদের দেখে ভয়ঙ্কর চিৎকার করতে করতে তেড়ে এলো আমাদের দিকে তারপর আবার ছুট লাগাল স্টেশানের ঢালু জায়গাটার দিকে।
খানিক আগে ওই দিকেই ইঁদুরের দলের সাথে লড়াই বেঁধে ছিল কুকুরটার। পাগল হয়ে গেল নাকি কুকুরটা?
রহমত হটাৎ বলে উঠল “আপলোগোকা পাস টর্চ হ্যায়?”
পকেট থেকে টর্চ বের করে বললাম “আছে কেন বলত?”
“আইয়ে তো মেরা সাথ, মুন্সি কভিভি এইসা চিলালাতা নেহি।“
আমাদের কিছু না বলতে দিয়েই ক্রাচ বগলে ঠক্ ঠক্ করে স্টেশানের ঢালু অংশ দিয়ে নামতে লাগল রহমত। কুকুরটা চিৎকার করে লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে যাচ্ছে লাইনের পাশে নালার দিকে। তারপর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নালার মধ্যে ঝুঁকে পরে প্রবল আক্রোশে চিৎকারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। রেললাইনের কয়েকটা আলগা পাথর গড়িয়ে পড়ল নালায়। বেশ কয়েকটা মুষকো ইঁদুর নালা বেয়ে উঠে এল। টর্চের আলো ঘন কুয়াশা ভেদ করে নালায় পড়তে একটা বাচ্চাদের শোয়ানোর ফুল ফুল ছাপওয়ালা সাদা প্লাস্টিক ঝলসে উঠল।
নালার কাছে পৌঁছে প্লাস্টিকের দিকে তাকিয়ে ককিয়ে উঠল রহমত। “হায়আল্লা এ ক্যায়সে হুয়া।” ক্রাচটা ফেলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে নালার ধারে। তারপর নালার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে প্লাস্টিকের ভেতর থেকে বের করে নিয়ে এল একটা ছোট্ট মানব শিশু। হাত-পা নাড়িয়ে ককিয়ে কেঁদে উঠল শিশুটি।
রেল লাইন হালকা কাঁপছে। তীব্র আওয়াজ করে একটা লালচে হেড লাইটের আলো ক্রমেই এগিয়ে আসছে।
ছবি ইন্দ্রশেখর
ফাটাফাটি.. সত্যি ঘটনা?
LikeLike
এর উত্তরটা আমি জানি কিন্তু বলব না।
LikeLike
যাচ্চলে..সত্যি না হলেও সত্যি ভাবতেই ভালো লাগছে পড়ার সময়ে
LikeLike
osadharon, kono biseshon jothesto noy.
LikeLike