ফোচনের আগের কীর্তি জয়ঢাকের সব বেড়ালের খবর লেখা বিল্লিপাতা
পিয়ালি গাঙ্গুলী
ঠিক হল, স্কুল ছুটি পড়ার আগেরদিন স্টাফ-রুমে খাওয়াদাওয়া হবে। না, বাইরের কেনা খাবার নয়, নিজেরা রান্না করে। ফিসফিস করে আলোচনা চলছে। সহকর্মীদের মধ্যে বেশি ভাব-ভালোবাসা ম্যানেজমেন্ট পছন্দ করে না। তারা ‘divide & rule policy’-তে বিশ্বাসী। কে কী রান্না করে আনবে সেটা দ্রুত ঠিক হয়ে গেল। বলাই বাহুল্য, ঝিমলির ঘাড়ে পড়ল পাস্তা। সত্যিই, পাস্তাটা অসাধারণ বানায় ঝিমলি। বাড়ি ফেরার পথে More থেকে ফ্রেশ ক্রীম, টোম্যাটো পিউরি এসব কিনে ঢুকল। এই গরমে হোয়াইট সসের পাস্তা তাড়াতাড়ি খারাপ হয়ে যাবে, তাই রেড সসের পাস্তা বানাবে বলেই দিয়েছে।
বাড়ি ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে বড়ো এক মগ কফি নিয়ে ঝিমলি কাজে নামল। সবজি কাটাকুটিটাই সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজ। ইয়ার ফোনে একটা সুন্দর গান শুনতে শুনতে চপিং-বোর্ডে হাত চালাতে লাগল। ব্যস, শান্তিতে কাজ করার কি আর উপায় আছে? ঝিমলিকে রান্নাঘরে দেখেই ফোচনও পায়ে পায়ে ঘুরতে লাগল। কাজের সময় বড্ড বিরক্ত করে ছেলেটা। সে বুঝতেই পেরেছে ভালো কিছু রান্না হতে চলেছে। পিজ্জা, পাস্তা, চাউমিন, যত রাজ্যের জাঙ্ক-ফুড তার খুবই প্রিয়। আর ঝিমলি পাস্তা বানালে তো আর রক্ষে নেই। প্রায় পুরোটাই পারলে তিনি সাবাড় করে দেন। নেহাত ফ্রিজটা খুলতে পারে না এখনও, এটাই শান্তি। নইলে যে কী হত!
সন্ধেটা প্রায় কেটেই গেল পাস্তা বানাতে। ফোচন ততক্ষণে বুঝেই গেছে পাস্তা হচ্ছে। তাকে আর আটকে রাখা যাচ্ছিল না। প্রথমেই তাকে এক বড়ো বাটি করে দেয়া হল। নিমেষের মধ্যে চেঁটেপুটে পাস্তা হাওয়া। শেষ করেই আবার এক বাটির জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। এবার ঝিমলি এক ধমক লাগাল, “না, আর একদম হবে না। অনেকটা খেয়েছ।”
পরদিন সকালে তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে পাস্তার কৌটোটা একটা বড়ো জুটের ব্যাগে ভরে ঝিমলি বেরিয়ে পড়ল। আজ উঠতে দেরি হয়ে গেছে। সাড়ে ছ’টার Volvo-টা মিস হয়ে গেল। স্টাফ-রুমে ঢুকে ব্যাগ, খাবারের ঝুলি টেবিলে রেখেই এসেম্বলিতে ছুটল। তারপর আর দম ফেলার সময় কোথায়? পরপর ক্লাস। তার মধ্যে কতরকমের অ্যাক্টিভিটি, খাতা দেখা, লেসন-প্ল্যান জমা দেয়া, কাজের কি আর শেষ আছে? মাঝে হয়তো ছুটে এসে একটু জল খাওয়া বা খাতাবই নিয়ে যাওয়া। নানারকম খাবারের গন্ধে স্টাফ-রুম সেদিন ম ম করছে। সবাই ছটফট করছে কতক্ষণে ব্রেক হবে।
ঘটনাটা ঘটে গেল টিফিনের ঠিক আগেই। টিফিনের আগের পিরিয়ডটা ঝিমলির অফ ছিল। তাই আগের ক্লাসটা শেষ হতে হেলতে দুলতে নামছিল সিঁড়ি দিয়ে। হাতে একগাদা প্রজেক্টের বোঝা। স্টাফ-রুমের ফ্লোরে নামতেই দেখে সাংঘাতিক কান্ড। সব ক্লাস থেকে ছেলেমেয়েরা বাইরে বেরিয়ে হই হই করছে। চারদিকে হাসির রোল। সিকিউরিটি আর হাউস-কিপিং কর্মীরা ছুটোছুটি করছে। ঝিমলি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “What is the matter?”
পাশে দাঁড়ানো ছেলেমেয়ের দল জবাব দিল, “Ma’am, there’s a cat in the classroom.”
স্কুলের মধ্যে বেড়াল? যাক গে, তাও যদি হয়, এত ন্যাকামোর কী আছে? সকাল থেকে ক্লাস নিয়ে নিয়ে এমনিতেই ক্লান্ত, ঝিমলি বেশ খেঁচিয়ে উঠে বলল, “Stop behaving like idiots. It’s only a cat, not a tiger.” বলে গটমটিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
স্টাফ-রুমে ঢুকে দেখল অনেক টিচারই এসে জড়ো হয়েছেন। ঝিমলি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে গো?”
একজন সিনিয়র বললেন, “আরে, এইট কে-তে ক্লাস নিচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা বেড়ালের ডাক শুনলাম। তাকিয়ে দেখি একটা বেঞ্চের তলায় ভারি মিষ্টি গোলগাল এক সাদা বেড়াল বসে আছে। ব্যস, যেই না দেখা, ছেলেমেয়েগুলো সব হই হই করে সিট ছেড়ে বেরিয়ে হাসাহাসি, ঠ্যালাঠেলি শুরু করল। কেউ কেউ আবার ভয়ে বেঞ্চের ওপর উঠে পড়ল। জানিসই তো আমাদের স্টুডেন্টদের। ক্লাস না করার বাহানা চাই একটা।”
আরেকজন সতর্ক করে দিল, “এই চল চল, গিয়ে সবক’টাকে ক্লাসে ঢোকাই আগে। এক্ষুনি প্রিন্সিপাল নিচ থেকে ছুটে আসবেন।”
সবাই মিলে বেরিয়ে তখন গরুর পাল ঘরে ঢোকানো হল। ক্লাস শুরু হল। সিকিউরিটিরা তখনও বেড়াল ধরার চেষ্টা করে চলেছে। আমাদের মাথায় দুশ্চিন্তা। এখন না হয় ক্লাসে ঢোকানো হল, ব্রেকে এদের আটকাব কী করে? খাওয়াদাওয়া আজ মাথায় উঠল।
টিফিনের বেলটা বাজতেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারের ওপর। একে খিদে পেয়েছে, তার ওপর টেনশান – এই বুঝি ডিসিপ্লিন মেনটেন করতে বেরোতে হয়। গোগ্রাসে গিলে চলেছে সকলে। টুকটাক হাসিঠাট্টা হচ্ছে। কিন্তু সেভাবে উপভোগ করতে পারছে না কেউই। ঝিমলি তখন মন দিয়ে ফিশ-চপ আর কফি খাচ্ছে। পরের পিরিয়ডটাও অফ আছে, তাই একটু রিল্যাক্সড। এমন সময় স্টাফ-রুমের দরজা ঠেলে, “এই দেখুন ম্যাম, ধরতে পেরেছি,” বলে এক সিকিউরিটি মুখ বাড়াল। ঝিমলি মুখ তুলতেই মুখ থেকে ফিশ-চপটা পড়ে গেল। মনে হল, এক্ষুনি হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যাবে। সিকিউরিটির হাতে বন্দী, কাঁচুমাচু মুখ করে তাকিয়ে ও যে ফোচন! ঝিমলিকে দেখামাত্রই এক লাফে ঝিমলির কোলে। ঝিমলি অপ্রস্তুত। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। ফোচন কী করে স্কুলে এল ঝিমলির কিছুতেই মাথায় আসছে না। ঠিক দেখছে তো ও? নাকি ফোচনের মতো দেখতে এ অন্য কোনও বেড়াল? কিন্তু তাহলে লাফিয়ে ওর কোলে আসবে কেন? এসব ভেবে যখন ঝিমলির প্রায় মাথা ঘুরছে, ফোচন তখন মহা আনন্দে লেজ নাড়াচ্ছে আর ঝিমলির হাত চাটছে।
স্টাফ-রুম নিস্তব্ধ। অনেকেই হয়তো ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে। ঝিমলির বেড়াল পরিবারের কথা সকলেই জানে।
“আসলে আমার বাড়িতে তো অনেক বেড়াল আছে, ওরা বোধহয় গন্ধ পায়। তাই লাফিয়ে আমার কাছে চলে এসেছে নিরাপত্তার আশায়।” এই বলে ঝিমলি সিকিউরিটিকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করল।
“দিন ম্যাডাম, ওকে বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসি।”
ঝিমলি লাফিয়ে উঠল, “না না থাক। অসহায় প্রাণী একটা, ভয় পেয়ে গেছে, আমি ঠিক ওকে ছেড়ে দেব বাইরে।”
“কী বলেন ম্যাডাম? প্রিন্সিপাল জানলে আমার চাকরি চলে যাবে।”
ঝিমলির এবার প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। বেগতিক দেখে সবচেয়ে সিনিয়র টিচার ত্রিপাঠীস্যার উঠে সিকিউরিটির কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তোর কোনও চিন্তা নেই, তোর চাকরি যাবে না। এই কথাটা এই স্টাফ-রুমের বাইরেই যাবে না। তুই খুব ভালো কাজ করেছিস। এই নে, মিষ্টি খা।” বলে একটা সন্দেশ তুলে দিলেন ওর হাতে।
সিকিউরিটি খানিক ইতস্তত করে চলে গেল।
ঝিমলির যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। ছাড়তেই খেয়াল হল, আরে, ফোচন তো তার কোলে নেই! আবার কোথায় গেল ছেলেটা? ঘাড় ঘোরাতেই পুরো ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ফোচন পাস্তার টিফিন-বক্সে মুখ ঢুকিয়ে লেজ নেড়ে নেড়ে পাস্তা খাচ্ছে।
“ওহ, তুই তার মানে পাস্তার লোভে আমার জুট-ব্যাগে চড়ে স্কুলে এসেছিস? শয়তান ছেলে, দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি মজা,” বলে ঝিমলি কষে ফোচনের কানটা মুলে দিল। এতক্ষণের উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তা ভুলে স্টাফ-রুমের সকলে হো হো করে হেসে উঠল। সে যাত্রায় আর প্রিন্সিপালের কান অবধি পৌছয়নি ব্যাপারটা। তাই ঝিমলি আর সিকিউরিটি দু’জনেরই চাকরি বহাল আছে।
ছবিঃ ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে
Khub misti Akta galpo… Khub halka Kintu sundor
LikeLike
beral nie galpo khub bhalo lage,dhanyobaad
LikeLike