
ভাষান্তর: পার্থ মন্ডল
“সূর্যমুখীতে জল দেবার সময় হয়ে এল”, জানলা দিয়ে রোদে ভেসে যাওয়া বাইরের পৃথিবীটাতে উঁকি দিয়ে তৃপ্ত স্বরে খিলখিলিয়ে উঠল মোনালিসা।
“জাপানি সাঁকোটার পাশে একটু হেঁটে এলে কেমন হয়? ঐখানটাতে বেশ সুন্দর জলজ লিলি হয়েছে। শরীরে একটু ভিটামিন ডি’রও তো প্রয়োজন”, পরমুহূর্তে বিড়বিড়িয়ে উঠল সে।
“আসবে নাকি আমার সাথে?” সে জিজ্ঞেস করল।
“মনে হয়, না”, উত্তর দিল মুক্তোর দুলে শোভিতা পরিচারিকা।
অগত্যা, মোনালিসা পুরোনো রেকর্ড প্লেয়ারে তার সবচাইতে পছন্দের বাজনাটা চালানোই ঠিক সাব্যস্ত করল এই মুহূর্তে। ওয়াগনারের ‘লোহয়ংগ্রিন’ এর সুরমূর্ছনার তালে তার কমনীয় শরীর আন্দোলিত হল, শুরু হল ছন্দময় নাচ।
“আমার কিন্তু এইসব দৌড়ঝাঁপ করবার ইচ্ছে নেই মোটেও, দয়া করে আমাকে দলে টানবার চেষ্টা করো না”, হিসহিসিয়ে উঠলো ডোরা মার্।
“তাসুড়ে হয়ে গেলে কেমন হয়?”, জিজ্ঞেস করলো মুক্তোর দুলে শোভিতা পরিচারিকা।
খেলা শুরু হল, চলতে থাকল শেষ বিকেল গড়িয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না হলুদ, জাফরান আর লালের মিশেলওয়ালা সন্ধে এল।
“আহা, হোমারের সূর্যকরোজ্জ্বল তটভূমির কথা মনে পড়ল। আমার স্মৃতির অস্তিত্ব এখনো আছে, কী বলো হে?”, লজ্জারুণ মোনালিসা বলে উঠল।
কিন্তু শীতের দিন হাল ছেড়ে দেয় বড়ো তাড়াতাড়ি। নিকষ কালো আকাশের পটে দূরে সন্ধ্যাতারা ফুটে উঠল।
“কী সুন্দর রুপোর মতো সাদা। শুক্রের জন্মের কী অনাবিল রূপ!” বিস্ময়াবিষ্ট ডোরা মার্ বলে উঠল অস্ফুটে, “আমরা এই সুন্দর তারা জ্বলা রাত্রে বাইরে যেতে পারি?’ জিজ্ঞেস করল সে। মোনালিসা তার রহস্যময়ী হাসি হেসে বলে উঠল, “রাত-পাহারার উত্তেজনা চাইছ নাকি?”
***
ট্রিং …. ট্রিং ….
“ওক স্ট্রিট থানা, কনস্টেবল টার্নার বলছি, বলুন কী চান?”
“হ্যালো! গত তেসরা মে থেকে আমার নিচের ফ্ল্যাটে ক্রমাগত উঁচুগলায় কথাবার্তার আওয়াজ পাচ্ছি। সাত মাস হয়ে গেলো, আর সহ্য হচ্ছে না! সারাদিনের ক্লান্তির শেষে আমারও একটু ঘুমের দরকার।”
“ম্যাডাম, আপনার ঠিকানাটা বলুন, আমি এখুনি দেখছি ব্যাপারটা।”
“অশেষ ধন্যবাদ। পাঁচ নম্বরের ১৯৪৮, রিজেন্ট স্ট্রিট লিথহ্যাম”।
***
খট খট খট ….
কোনো উত্তর নেই।
কনস্টেবল টার্নার দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। ভেতর থেকে চারটে মহিলা কণ্ঠের আলাপচারি কানে এল।
খট খট খট … আরো জোরে ধাক্কা দিল টার্নার।
কোনো উত্তর নেই।
শেষে দরজা ভেঙেই ভেতরে ঢুকতে হল; শিকারসন্ধানী বাঘের মতো চুপিসারে এগোল সে।
আলোআবছায়া মাখা সাধারণ ঘরে ভ্যান ঘঘ এর সূর্যমুখী যেন অভ্যর্থনা জানাল টার্নারকে। পায়ের ডগায় ভর দিয়ে চুপিসারে হাঁটতে হাঁটতে চারিদিকে সাবধানী দৃষ্টি ছুঁড়ে দিচ্ছিল সে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিছু চিত্র প্রতিভাত হলো ধীরে ধীরে, ঘরের দেয়াল শোভিত করে আছে – মোনালিসা, ডোরা মার্, মুক্তোর দুলে শোভিতা পরিচারিকা, তাসুড়ে ….…. রেনোঁ, রুবেন্স, ডালি, দ্য ভিন্সি, কাহলো, ক্লিমৎ ….…. কে আছে আর কে নেই!
শিল্প অনুরাগের সময় নয় এটা।
জীবনের চিহ্ন নেই। নৈঃশব্দ শুধু চারিদিকে।
সে এগোল আরেকটু।
জীবনের চিহ্ন নেই। নৈঃশব্দ শুধু চারিদিকে।
এবারে দেখা গেল ….… চেয়ারে উপবিষ্টা এক মহিলা, তার দিকে পেছন ফিরে। ঢলঢলে কালো গাউন পরে, মাথায় সাদা স্কার্ফ ….… আরে, এ তো হুইসলারের মা!
না, না, আঁকা ছবি না। একেবারে আসল, রক্তমাংসের!
কী আশ্চর্য! মহিলা এতই ভাবাবিষ্ট যে টার্নারের উপস্থিতি বুঝতেই পারেননি। দরজা ভাঙার প্রতিক্রিয়া জানানো দূরে থাক।
জাগতিক অনুভূতিহীন বা, বদ্ধকালা নয়তো?
হঠাৎ একটা আওয়াজ ভেসে এল শরীরটা থেকে, তীক্ষ্ণ স্বরে, “মোনালিসা, দরজা খোলো!”
“এ তো দরজা খটখটানোর থেকে অনেক বিকট আওয়াজ হল!”, এবারে কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি।
“হাতির পাল এসেছে নাকি হে বাড়িতে, ডোরা?”, এবারে কণ্ঠে তীব্র শ্লেষ।
অসংখ্য বলিরেখাময়, দুঃখ জর্জরিত মহিলার মুখ আস্তে আস্তে ঘুরল যতক্ষণ না তার দৃষ্টি মিলিত হল কনস্টেবল টার্নারের দৃষ্টিতে।
পিন পতন নৈঃশব্দ।
মহিলা হতবাক, পাথরের মতো স্থির, যেন তিনি নিজের চোখের সামনে নিজের ভূত দেখছেন।
রাতের নৈঃশব্দ খান খান করে এল এবার মহিলার চিল-চিৎকার; কিংবদন্তি চিত্রশিল্পীদের অসাধারণ সৃষ্টির মাঝে বাঙময় হয়ে উঠলো এক অনন্য সাধারণ বাচিকশিল্পীর কণ্ঠ – এডভার্ড মানচ এর সেই অনবদ্য সৃষ্টিও হার মেনে যাবে এই দৃশ্যে।
—————————————————————————————-
Painting References:
- সূর্যমুখী – Sunflowers by Vincent van Gogh
- মোনালিসা – Mona Lisa by Leonardo da Vinci
- জাপানি সাঁকো, জলজ লিলি – Japanese Footbridge and Water lilies by Claude Monet
- মুক্তোর দুলে শোভিত পরিচারিকা – Girl with a Pearl Earring by Johannes Vermeer
- নাচ – La Danse by Henri Matisse
- ডোরা মার্ – Potrait of Dora Maar by Picasso
- তাসুড়ে – The Card Players by Paul Cézanne
- সূর্যকরোজ্জ্বল তটভূমি – Sunlight on the Coast by Winslow Homer
- স্মৃতির অস্তিত্ব – Persistence of Memory by Salvador Dali
- শুক্রের জন্ম – The Birth of Venus by Sandro Botticelli
- তারা জ্বলা রাত – Starry Night by Vincent van Gogh
- রাত-পাহারা – Night Watch by Rembrandt van Rijn
- ওক স্ট্রিট থানা – Police Station Lodgers in Oak Street Station by Jacob August Riis
- Constable P C টার্নার – William Turner, the famous English Romantic Painter
- তেসরা মে – The Third of May 1808 by Francisco Goya
- পাঁচ নম্বরের ১৯৪৮ – No. 5, 1948 by Jackson Pollock
- রিজেন্ট স্ট্রিট লিটহ্যাম – Regent Street Lytham by L S Lowry
- হুইসলারের মা – Whistler’s Mother by James McNeill Whistler
- চিৎকার – The Scream by Edvard Munch
বিন্দু তে সিন্ধু, অতি চমৎকার একটি পরিণত মনের গল্প, চমক লাগায়, ভাবতে বাধ্য করে!
LikeLike
খুব ভালো
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ
LikeLike