গল্প বিষধর অদিতি সরকার শরৎ ২০১৭

অদিতি সরকারের আগের গল্প–ভয় 

“ছুটিতে চেনা জায়গায় বেড়াতে যেতে চাও না সে তো ভালো কথা। কিন্তু ঠিক কীরকম জায়গা তোমরা চাইছ বলো দেখি। আমি হয়তো একটা অচেনা জায়গার সন্ধান দিতে পারি তোমাদের,” নীরজের কাকু চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখলেন।

 “টিপিক্যাল টুরিস্টের ক্যালরব্যালর থেকে দূরে, এইটাই মেন পয়েন্ট কাকু। আর তার সঙ্গে পাহাড় কিংবা জঙ্গল টঙ্গল থাকলে তো দশে দশ।” সন্দীপের স্পষ্ট উত্তর।

কাকু বাকি চাটুকুও আর এক চুমুকে শেষ করে চশমার ওপর দিয়ে সন্দীপের দিকে তাকালেন, “সারান্দার নাম শুনেছ?”

“শোনা শোনা লাগছে যেন।ওই ঝাড়খন্ড না ওড়িশা ওদিকে কোথায় না? কিন্তু সেখানে তো শুনেছি আজকাল দলে দলে লোক বেড়াতে যাচ্ছে।”

“ঠিকই বলেছ। জায়গাটা ঝাড়খন্ড ওড়িশা দু রাজ্য জুড়েই ছড়ানো। এককালে সরাইকেলার রাজাদের নিজস্ব শিকারের বন ছিল ওটা। এখন এশিয়ার সবথেকে বড় সেগুনগাছের জঙ্গল। আর হ্যাঁ, টুরিস্টের কথাটাও নেহাত ভুল বলোনি। তবে আমি যে জায়গাটার কথা বলছি সেটা সারান্দায় হলেও সাধারণ টুরিস্ট এখনও তার খবর পায়নি।

“সারান্দার মানে জানো তো? সাতশো পাহাড়ের দেশ। গেলেই দেখবে একটার পর একটা রেঞ্জ আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘাতাবুরু, কিরিবুরু, আরো কত।”

“কী অদ্ভুত নাম। মানে কী এই নামগুলোর?” নীরজ কৌতূহল চাপতে না পেরে প্রশ্ন করে।

“বুরু মানে ওখানকার ভাষায় পাহাড়। এক একটা পাহাড়ের এক একরকম বৈশিষ্ট্য, আর সেই অনুযায়ী সোজাসাপটা নাম আরকি। যেমন ধরো কিরি মানে পোকা। কিরিবুরু মানে পোকার পাহাড়। পোকা টোকা খুব ছিল বোধহয় এককালে। এই পাহাড়গুলো হচ্ছে ম্যাঙ্গানিজ আর লোহার একেবারে  খাস আড়ত। মাটি দেখলেই বুঝবে। লাল টুকটুকে লোহা মেশা মাটি। বড় বড় খনি আছে ওখানে। সারাদিন শুধু আয়রন ওর উঠছে আর ট্রাক ভর্তি হয়ে হয়ে সারা দেশের বড় বড় স্টিল প্ল্যান্টে ছুটছে। তোমাদের কাকিমার এক মামা  এক সময় ওখানে অনেকদিন কাজ করেছেন। সেই মামার বাড়িতেই তোমাদের পাঠানোর কথা ভাবছি।”

“মামার বাড়ি? এই যে বললেন সারান্দার জঙ্গল?” সন্দীপ একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করে।

“জঙ্গলেই বাড়ি তো। সেও এক কান্ড, বুঝলে তো। এই ধরো বছর পাঁচেক আগে, আমরা তখন দেশের বাইরে, খবর পেলাম আমার মামাশ্বশুর মারা গেছেন। আর উইল করে তোমার কাকিমাকে একটা আশ্চর্য জিনিস উপহার দিয়ে গেছেন।”

“আশ্চর্য জিনিস মানে?” সন্দীপ কাকুর দিকে ঝুঁকে বসল।

“বলছি। তোমাদের কাকিমার এই মামাটি একটু অন্যরকমের মানুষ ছিলেন, বুঝলে সন্দীপ। বিয়েটিয়ে করেননি। উঁচুদরের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, ওঁর ফিল্ডে সবাই একডাকে চিনত। কিন্তু ওঁর আসল ভালোবাসা ছিল প্রকৃতি। দেশের এমন একটা জঙ্গল বোধহয় নেই যেখানে উনি যাননি। আর এই সারান্দায় আস্ত একটা বাড়িই করে ফেলেছিলেন শেষ বয়সে। সেই বাড়িটিই উনি রীতিমতো লেখাপড়া করে দিয়ে গিয়েছেন আদরের ভাগ্নি, মানে তোমাদের কাকিমাকে।”

“আরেব্বাস। দারুণ তো!” সন্দীপের সোফার ধারে এগিয়ে এসে বসার ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তার উৎসাহের পরিমাণ।

“দারুণ তো বটেই। কিন্তু আমাদের সত্যি বলতে ওটা কোনো কাজেই লাগে না। পড়েই আছে, বুঝলে। দিল্লির বাড়ি ছেড়ে সারান্দায় কে থাকতে যাবে বলো দেখি। বিক্রিও করা যাচ্ছে না। সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু বাদ দিলেও, জঙ্গলে বাড়ি কেনার মতো পাগল আপাতত তেমন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

“আপনি গেছেন বাড়িটায়?” সন্দীপ জানতে চায়।

“গেছি। একবারই। খুব অন্যরকম একটা বাড়ি। ওঁর ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান আর প্রকৃতিকে ভালোবাসা, এই দুটো জিনিসকে মিলিয়ে মিশিয়ে কী হয় সেটার আস্ত প্রমাণ। প্র্যাকটিক্যালি গভীর জঙ্গলের ভেতরে,বুঝলে। না জানলে কেউ খুঁজেও পাবে না। তোমাদের অন্যরকম জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার শখ শুনে হঠাৎ মনে পড়ল। ট্রাই করে দেখতে পারো। আমার দুটি লোক রাখা আছে ওখানে, তাদের খবর পাঠাব তাহলে।”

“এটা গ্র্যান্ড আইডিয়া কাকু। কী বলিস সন্দীপ?” নীরজের চোখ উৎসাহে চকচক করে ওঠে। সন্দীপেরও মুখে বেশ আগ্রহের ছাপ। সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই কাকু আবার কথা বলেন, “তবে একটা ব্যাপার তোমাদের বলে রাখি বাপু, বাড়িটার কিন্তু কিঞ্চিৎ দুর্নাম আছে।”

“দুর্নাম মানে? ভূতটুত আছে নাকি?” চুপচাপ শুনতে থাকা রোহণ এতক্ষণে মুখ খোলে।

“কী যে আছে সে তো জানি না, কিন্তু গ্রামের লোকে নাকি খালি বাড়িতে মাঝেমধ্যে গভীর রাতে আলো টালো জ্বলতে দেখেছে, কীসব আওয়াজও নাকি শোনা যায়।”

রোহণের মুখটা এমনিতেই গম্ভীর গোছের, এখন আরও গম্ভীর হয়ে গেল। নীরজ আর সন্দীপের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে কাকুর দিকে ঘুরে বসল সে, “কী দরকার তাহলে ওসব জায়গায় যাওয়ার? অকারণ রিস্ক নেওয়ার মধ্যে আমি তো কোনও বাহাদুরি দেখি না। হাতের কাছে চেনাশোনা কত বেড়ানোর জায়গা আছে তো।”

“আরে, ভয় পেলে গেলে নাকি?” কাকা হাহা করে হেসে ওঠেন, “এই না অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে উতলা হচ্ছিলে সবাই? আরে বাপু, বনে জঙ্গলে একটা আস্ত বাড়ি দিনের পর দিন একলা পড়ে থাকলে ওরকম হাজার গুজব রটে। বুঝলে? একবার সবাই মিলে গিয়েই দ্যাখো না কান্ডখানা কী।”

 

দুই

দেখতে দেখতে আকাশের রঙ আরও কয়েক পোঁচ গাঢ় হয়ে এল। হাওয়ার ফোঁসানি বাড়ছিল। ছেঁড়া কাগজ, পুরোনো পলিথিনের প্যাকেট, আরও কত  জঞ্জাল এলোমেলো উড়তে উড়তে উইন্ডস্ক্রিনে, চাকায় লেপটে যাচ্ছিল।

বৃষ্টিটা আস্তেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই ঝরতে থাকা ফোঁটাগুলো প্রায় জলপ্রপাতের চেহারা নিল। ওয়াইপারের দুর্বল সাপটানিতে কোনো লাভই হচ্ছিল না।

“কী হে চক্রধরদাদা, চক্রধরই নাম বলেছিলে তো, না কী?” সন্দীপ জানতে চায়।

“হ্যাঁ দাদা, চক্রধর বিরুয়া।”

“তা চক্রধর, তোমার চৌধুরি সাহেবের প্যালেস আর কতদূরে হে? রাস্তা তো ফুরোচ্ছেই না।”

চক্রধর কম কথার মানুষ। উত্তর দিল না।

“তখন ভাতফাত খাওয়ার জন্য দেরি না করলেই হত।” রোহণ গজগজ করতে থাকে।

“কী করে বুঝব বল ওয়েদার এরকম চেঞ্জ হয়ে যাবে। খাওয়ার সময় তো বেশ রোদ ছিল।” নীরজ রোহণকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল।

“আজকে আসলে কপালটাই খারাপ। জনশতাব্দী হাওড়া থেকে ছাড়লই লেট করে। যদি বা ছাড়ল, নোয়ামুন্ডিতে এসে ইঞ্জিন খারাপ। বারবিল পর্যন্ত এলই না। ভাগ্যিস তোর কাকা চক্রধরের ফোন নম্বরটা দিয়েছিলেন।”

“কোথায় যাচ্ছি বল তো? পাকা রাস্তা তো সেই কোনকালে ফুরিয়ে গেছে।” সন্দীপ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার প্রশ্ন করে সে।

সত্যিই রাস্তাটার অবস্থা খুবই খারাপ। আদৌ রাস্তাই নয় আসলে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা সুঁড়িপথের চেয়ে একটু চওড়া কিছু একটা। লাল পাথুরে মাটির ওপর বৃষ্টির ধারা পড়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি দশা হয়েছে। মাঝে মাঝেই হাঁড়ল হাঁড়ল গর্তে চাকা পড়ে গাড়ি লাফিয়ে উঠছে। দুধারে আকাশ আড়াল করা লম্বা লম্বা শাল আর সেগুনের বন।

“ও চক্রধরদা, আর কতক্ষণ। সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে গেল যে।” রোহণের গলায় এবার ক্লান্তি।

চক্রধর এমন আচমকা ব্রেক কষবে কেউই আন্দাজ করতে পারেনি। নীরজের কপালটা বেশ জোরেই ঠুকে গেল। বিরক্ত হয়ে কিছু একটা কড়া কথাই বলতে যাচ্ছিল সে, তার আগেই চক্রধর মুখ খুলল, “এসে গেছি। এই যে চৌধুরি সাহেবের বাড়ি।”

তারা তিনজনেই চক্রধরের দেখানো দিকটায় তাকাল এবং হতভম্ব হয়ে গেল। বলে না দিলে কেউ বুঝবে না যে ওই ঘোর গাছে পাতায় ছাওয়া জায়গাটার আড়ালে অমন পরিপাটি একটা বাংলোবাড়ি লুকিয়ে থাকতে পারে।

চক্রধরের হর্নের আওয়াজ শুনে ততক্ষণে বাড়ির ভেতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসেছে। বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। কালো মুখে ঝকঝকে সাদা হাসি।

“ইস, বড্ড বিষ্টি হল আজ, আপনাদের কত মুশকিল হল রাস্তায়। চলেন চলেন, ভিতরে চলেন।”

“তুমি কে ভাই?” গাড়ি থেকে নামতে নামতে নীরজ জানতে চায়।

“আমার নাম সোমরা বাবু, এই বাড়িতেই থাকি। আপনার কাকা এই বাড়ির দেখভালের জন্য আমায় রেখেছেন। আপনারা যতদিন থাকবেন, আপনাদের সব দায়িত্ব আমার। মজাসে ছুট্টি কাটান বাবুরা। সোমরা থাকতে আপনাদের কোনো চিন্তা নাই।” গাড়ি থেকে মালপত্র বার করতে করতে লোকটি জবাব দেয়।

সন্দীপ অবাক হয়ে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। এই জঙ্গলের মধ্যে এরকম চেহারার একটা বাড়ি সে আদৌ আশা করেনি। কাকুর কথা শুনে তার মনের মধ্যে যে আবছায়া ছবিটা তৈরি হয়েছিল তার সঙ্গে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটার কোনো মিলই সে খুঁজে পাচ্ছিল না। সোমরাকে জিজ্ঞেস করে সে জেনেছে  বাংলো প্যাটার্নের বাড়িটার মোটা মোটা দেওয়ালগুলো গাঁথা হয়েছে কাদা আর মাটি দিয়ে । জলের পাইপের জায়গায় ব্যবহার হয়েছে বাঁশ। ঢালু টালির ছাদের জায়গায় জায়গায় আলো আসার জন্য স্কাইলাইট, আর কিছু দূরে দূরে সোলার প্যানেল।

“দারুণ, না রে?” নীরজের গলায় অকৃত্রিম বিস্ময়।

“সত্যি দারুণ। কাকু একটুও বাড়িয়ে বলেননি।” রোহণও মানতে বাধ্য হল।

“শুধু ওই চক্রধরটাই একটু কীরকম যেন। দশবার খোঁচালে একটা উত্তর দেয়। আমরা আসাতে একটুও খুশি হয়নি মনে হচ্ছে।”

“বাদ দে তো। সোমরা মুরগি রাঁধছে, গন্ধ পাচ্ছিস? খেয়েদেয়ে একটা জম্পেশ ঘুম। বৃষ্টি ধরে যাবে মনে হয় রাতের মধ্যেই। কাল থেকে সলিড জঙ্গল ঘুরব। যা ফাটাফাটি ফটো হবে না, দেখিস। সন্দীপ হাতে ক্যামেরা ধরার ভঙ্গি করে।”

ঘুমটা কিন্তু সেভাবে জম্পেশ হল না কারোই। মুরগির কারিটা নিঃসন্দেহে দুর্ধর্ষ হয়েছিল। বেশ বেশি বেশিই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল তিন জনেরই। সোমরা বড় হলঘরে পরিষ্কার বিছানা পেতে দিয়েছিল। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বালিশে মাথা ছোঁওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম এসে গিয়েছিল সবার।

প্রথম ঘুম ভাঙল সন্দীপের। কী যেন একটা অস্বস্তি, ঠিক বুঝতে পারছিল না সে। ঘুমের মধ্যে যেন কয়েকটা চাপা গলার কথাবার্তা, চলাফেরার আওয়াজ। কান খাড়া করে কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করল সে।

পাশের খাটিয়া থেকে সামান্য উসখুস শুনে সেদিকে ফিরল সন্দীপ।

“জেগে আছিস নাকি?”

“হুঁ,” খুব আস্তে জবাব দেয় নীরজ।

“কিছু শুনতে পাচ্ছিস?”

“কেমন যেন মনে হল কারা কথা বলছে কাছেই। কিন্তু এত রাতে, কে আসবে এখানে?”

“সোমরা হবে হয়তো। চক্রধরের সঙ্গে কথা বলছে।”

“এখন? কটা বাজে দেখেছিস? রাত দুটোর সময় ওদের কী এত কথাবার্তার দরকার পড়ল? আর আওয়াজটাও ঠিক কোথা থেকে আসছে বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে যেন মাটির তলা থেকে। কিন্তু তাই বা কী করে হয়।”

“ঘুমিয়ে পড়, কাল সকালে দেখা যাবে।”

ওদের ফিসফিসানির মধ্যেই হঠাৎ দরজার বাইরে ঝনঝন করে কী যেন পড়ল। কাচের বড় বাসন ভাঙার মত আওয়াজ। রোহণ এতক্ষণ এত ফিসফাসেও জাগেনি, এই আওয়াজে একেবারে চমকে জেগে উঠল।

“কী রে, কী হল বলতো? কী যেন পড়ে ভাঙল মনে হল না?”

“কেউ খাট থেকে নামিস না। আমি দেখছি।” সন্দীপের গলায় এমন একটা সুর শোনা গেল যেটা নীরজ রোহণ দুজনকেই একটু ভয় পাইয়ে দিল।

“কী হল রে?” নীরজও  উঠে বসে।

সন্দীপ ততক্ষণে টর্চ জ্বালিয়ে ফেলেছে বিছানায় বসেই। তার চোখ টর্চের জোরালো আলোর রেখাকে অনুসরণ করতে করতে একটা জায়গায় গিয়ে আটকে গেল।

“ওই দ্যাখ।”

দুটো আতংকিত শ্বাস টানার শব্দ ঘরটার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল।

“সা-সাপ?”

একটা চকচকে কালো দড়ি ঠিক চৌকাঠের সামনে মোচড়াচ্ছে, পাক খাচ্ছে। টর্চের আলো তার মসৃণ গায়ে পিছলে পিছলে যাচ্ছে।

“ওটা ঘরে এল কী করে?” রোহণের গলা কেঁপে যাচ্ছিল।

“বোধহয় বাইরে থেকে কেউ ঢুকিয়েছে। কাচ ভাঙার আওয়াজ পেলি না? বয়াম টয়াম কিছুতে করে এনেছিল বোধহয়। অন্ধকারে হাত ফসকে পড়ে গেছে। ইচ্ছে করে কি আর আওয়াজ করে ঘরে সাপ ছাড়বে?”

“কিন্তু, কেন?”

“আমাদের এই বাড়িতে থাকতে আসা মনে হয় কারো পছন্দ হচ্ছে না। সাপের ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইছে। অত সোজা না।” সন্দীপের গলা শক্ত, টানটান।

“আগেই বলেছিলাম, রিস্ক নেওয়ার কোনো মানে হয় না। তোরা কেউ আমার কথা শুনলি না। এখন বেঘোরে সাপের কামড়ে মরতে হবে।” রোহণ প্রায় কেঁদে ফেলে আর কি।

সন্দীপ খুব সন্তর্পণে খাট থেকে নেমে পড়েছে ততক্ষণে। নীরজ আঁতকে উঠল।

“কী পাগলামি করছিস সন্দীপ? শিগ্গির খাটে উঠে বোস।”

“ভয় নেই। এ সাপের আর কোনো ক্ষমতা নেই আমাদের ছোবলানোর। দ্যাখ ভালো করে। কোমরই তুলতে পারছে না। বেকায়দায় পড়ে চোট খেয়েছে মনে হয়।”

সন্দীপের এক হাতে টর্চ, অন্য হাতে তার জ্যাকেটটা কখন যেন তুলে নিয়েছিল। কথা বলতে বলতেই সেটা ছুঁড়ে দিল সাপটাকে লক্ষ করে সে, “থাক ব্যাটা জামাচাপা। সকালে দেখা যাবে। আর ওই হতভাগা সোমরাকেও কাল মজা দেখাচ্ছি, দাঁড়া।”

বাকি রাতটুকু প্রায় জেগেই কাটাল তিনজন।

 

তিন

 

সকালে কিন্তু রাতের বিভীষিকার কোনও চিহ্ণই খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও। সন্দীপের জামাটা এক কোনায় দলা হয়ে পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার তলায় সাপের লেজটুকুও দেখা গেল না।

রোহণ আবার শিউরে উঠল, “তুই বললি চোট খাওয়া সাপ নড়তে পারবে না, এ তো দিব্যি বেরিয়ে গেছে। ঘরের ভেতর সারা রাত সাপ ঘুরেছে তার মানে। আর আমরা নিশ্চিন্তে তার মধ্যে শুয়ে রইলাম। যদি খাটিয়ার পায়া বেয়ে উঠত?”

সন্দীপ ততক্ষণে দরজার বাইরেটা খুঁটিয়ে দেখছিল।

“একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?”

“কী?” রোহণের মুখ থেকে ভয়ের ছাপ যায়নি।

“আমরা সবাই কাচ ভাঙার আওয়াজ শুনেছিলাম, কিন্তু একটা কাচের টুকরোও কোথাও পড়ে নেই। দেখেছিস?”

“ভুল শুনেছিলাম হয়তো।” নীরজ বলে।

“তিনজনেই একসঙ্গে ভুল শুনব? উঁহু। কোনও একটা সময় সুযোগ বুঝে এসে চুপিচুপি সব সাফ করে ফেলেছে। ইনক্লুডিং কোমরভাঙা সাপ। মনে হয় ভোরের দিকে, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তক্কে তক্কে ছিল।”

কথা বলতে বলতে হঠাৎ সন্দীপ নিচু হয়ে কী একটা কুড়িয়ে নেয়, “ভুল শুনিনি। খুব ভালো করে পরিষ্কার করার চেষ্টা করলেও পুরোটা পারেনি। এই দ্যাখ।” সন্দীপের হাতে ছোট্ট এক টুকরো কাচ।

সোমরাকে জিজ্ঞাসা করে কিছুই লাভ হল না। সাপের কথায় সে যাকে বলে একেবারে গাছ থেকে পড়ল, “আমি তো কিছুই টের পাইনি বাবু। ঘরে ঘুমিয়েছিলাম, কারও কোনও কথা, কোনও আওয়াজ টাওয়াজও শুনিনি। এই জঙ্গলের মধ্যে কে আসবে এত রাতে, কেনই বা আসবে। বেছে বেছে আপনাদের ঘরে সাপই বা কেন ছাড়বে। আর যদি ছাড়লই তো সে সাপ গেল কোথায়?”

খুব সন্দেহের দৃষ্টিতে সোমরা তাদের তিনজনের দিকে দেখতে থাকে।

রহস্যের কোন সমাধান না মেলায় ও নিয়ে ভাবনাচিন্তা আপাতত মুলতুবি রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে স্থির হল। পেট ভরে জলখাবার খেয়ে তিনজন জঙ্গলের দিকে রওনা দিল। পায়েচলা পথের দাগ ধরে ডান দিকে কিছুদূর গেলেই কারো নদী পড়বে, সোমরা বলে দিয়েছিল। সেখানেই স্নান টানের ইচ্ছে সকলের। সাপখোপের সমস্যা আপাতত মাথা থেকে দূরে।

সত্যিই জঙ্গলের ভেতরের দৃশ্য যাকে বলে অপূর্ব। মস্ত মস্ত সেগুনের ফাঁকে ফাঁকে পিয়াল আর মহুয়া। একেকটা গাছ থেকে সাত আটটা করে মৌচাক ঝুলছে কোনও কোনও জায়গায়। একবার তো খচমচ করে চারটে চিতল হরিণই এদিক থেকে ওদিকে দৌড়ে চলে গেল তাদের চমকে  দিয়ে।

একটা বাঁক ঘুরতেই পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকা ঝর্নার ধারা তাদের মুগ্ধ করে থামিয়ে দিল। গতকালের তুমুল বৃষ্টির পরে আজ সকাল থেকে ঝকঝকে রোদ উঠেছে। ঝর্নার জলের ফোঁটায় ফোঁটায় সে রোদের চিকমিকে ঝলক। এমন সুন্দর সকালে, এমন সুন্দর জায়গায় দাঁড়িয়ে কাল রাতের ঘটনাটা যেন অবিশ্বাস্য একটা দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছিল তাদের তিনজনেরই।

বাড়ি ফিরে একটু অবাক হতে হল। বারান্দায় একটা মোড়া পাতা। তাতে বসে আছেন একজন মাঝবয়েসি ভদ্রলোক। পরনে ধুতি আর হাফ হাতা ফতুয়া। একসময় সেগুলো হয়তো ধবধবে সাদা ছিল, এখন লালচে। এখানকার লোহাগুঁড়ো মেশা ধুলো আর জলের গুণেই হয়তো।

এদের আসতে দেখেই ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার দুহাত জোড়া করে এগিয়ে এলেন।

“নমস্কার, নমস্কার। ঝর্নায় যাওয়া হয়েছিল বুঝি? চানটান হল? বেশ বেশ।”

অচেনা মানুষ দেখে ওরা তিনজনেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এবার নীরজ কথা বলল, “আপনাকে তো চিনতে পারলাম না?”

“ওহো তাইতো, তাইতো। আমার পরিচয়টা তো দেওয়া উচিত ছিল। আমি হলাম গিয়ে ব্রজনাথ পাল।”

ভদ্রলোক নিজের নামটা বলেই চুপ করে গেলেন, যেন কোনও কিছুর অপেক্ষায়। এদের ফাঁকা চাউনি দেখে একটু হতাশই হলেন মনে হল।

“আমার নাম শোনা হয়নি মনে হচ্ছে? স্বপনবাবু বলেননি বুঝি কিছু?”

“না তো!” নীরজ ইতস্তত করে, “কাকু আপনাকে চেনেন নাকি?”

“অবশ্যই, অবশ্যই। স্বপনবাবু, তাঁর মামাশ্বশুর, মানে আমাদের চৌধুরি সাহেব, আহা, অমন মানুষ হয় না, ভগবান ওঁর আত্মাকে শান্তি দিন, এঁদের সকলের আমি ঘরের লোক যে গো। বারবিলে নেমে একবার শুধু বলতে হবে, চৌধুরি সাহেবের বাংলোয় যাব, পালবাবুকে খবর দিন। আর একটি কথাও খরচ করতে লাগবে না। কাল অমন দুর্যোগে আসতে পারি নাই, নইলে আমি শুধু ওই চক্রধর আর সোমরার ভরসায় অতিথিদের রাখি?”

“না না, তাতে কী হয়েছে। ওরা তো ভালোই দেখাশোনা করছে। আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন না!” সন্দীপ বারান্দার দিকে এগোতে এগোতে বলে।

“হুঁ। দেখাশোনা। এসেই যা খবর শুনলাম!” মোড়া টেনে বসতে বসতে বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করলেন ভদ্রলোক।

“কী বলুন তো?”

“কী আবার। আপনাদের ঘরে নাকি রাতে সাপ ঢুকেছিল। পই পই করে বলে গেছি, বাংলো ফাঁকা পড়ে আছে এতদিন, ভালো করে চারধারে কার্বলিক ছড়াবি। কলকাতা থেকে স্বপনবাবুর ভাইপো আসছেন বন্ধুবান্ধব নিয়ে, বিপদ না হয়। কথা কানে তুললে তো। দাঁড়িয়ে থেকে যেটি না করাব সেখানেই ফাঁকি। আরে ও সোমরা, শুধু কি আমিই বসব রে হতভাগা? আর তিনটে মোড়া এনে দেওয়ার কথাও কি মনে করাতে হবে?”

ব্রজনাথবাবু বেশ অনেকক্ষণই ছিলেন। অনেক কথা বলছিলেন চৌধুরি সাহেবের প্রশংসায়। অপঘাতে অমন করে মারা গেলেন বলে দুঃখও করছিলেন। এটা সন্দীপরা জানত না। কাকু বলেননি কিছু। জঙ্গল ভালোবাসা চৌধুরি সাহেব নাকি শেষ পর্যন্ত জঙ্গলেই বিষধর সাপের ছোবলে মারা যান।

ব্রজনাথ যে এ অঞ্চলের একজন পরিচিত লোক সেটা ওঁর কথার ধরনেই বোঝা যাচ্ছিল। জঙ্গলেরও অনেক খোঁজখবর রাখেন ভদ্রলোক। শুধু নিজের সম্বন্ধে কিছু বলতেই বড় সংকোচ ভদ্রলোকের। কিছু জানতে চাইলেই লজ্জা পাচ্ছিলেন।

“ও কিছু না, এই একটা ছোটখাটো ব্যবসা করি আরকি। সে বলার মতো কিছু না। আমার আসল নেশা লোকের সাহায্য করা। যতটুকু পারি। ওই নিয়েই মেতে থাকি। এখানে আমাদের চার পুরুষের বাস, জানেন তো ভাইপোবাবুরা? সবাই চেনে, মানে। দুটো কথা বললেই কাজ হয়ে যায়। আপনাদের যা দরকার এই চক্রধরকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দেবেন, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, একটু দেখেশুনে চলাফেরা করবেন, বুঝলেন কিনা। জঙ্গল জায়গা, আপনারা শহুরে ছেলেপুলে তো অত চেনেন না। কিছু একটা অঘটন ঘটে গেলে স্বপনবাবুর কাছে মুখ দেখাতে পারব না।”

চার

অঘটন কিন্তু ঘটেই গেল। নীরজ বেমালুম হারিয়ে গেল। সন্দীপ শালবনের পেছনে সূর্য ডোবার ছবি তুলবে বলে বাড়ি ছেড়ে একটু এগিয়ে গিয়েছিল, রোহণ ঘুমোচ্ছিল ঘরে। নীরজ কোথায় ছিল কেউই দ্যাখেনি। সোমরা চা নিয়ে ডাকাডাকি করে সবাইকে বারান্দায় জড়ো করছিল। তখনই খেয়াল হল যে নীরজকে সেই বিকেলের পর থেকেই কেউ দেখতে পায়নি।

“আমার পাশে শুয়ে শুয়েই তো বই পড়ছিল। তারপর আমি কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি, এই উঠলাম তোদের চ্যাঁচামেচি শুনে।” রোহণের চোখমুখ এখনও ঘুমে ফোলা ফোলা।

সন্দীপের মুখটা ক্রমশ শক্ত হচ্ছিল। কপালে চিন্তার ভাঁজ। একবার পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে আবার ঢুকিয়ে রেখে দিল সে। এখানে টাওয়ার মেলে না।

“ব্রজবাবুকে একটা খবর দেওয়া যাবে কি? চক্রধর যেতে পারবে?”

“না দাদা, ওবেলা পালবাবুকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় আমার গাড়ি বিগড়েছে, রাতে এ গাড়ি নিয়ে আবার অতদূর যাওয়া যাবে না। অন্ধকার হয়ে গেছে, নইলে সাইকেল নিয়ে একবার চেষ্টা দেখতাম। কাল সকালের আগে কিছু পারব না দাদা, সরি। মুখে সরি বললেও চক্রধরের হাবেভাবে সরি হওয়ার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না।”

“কোথায় গেল বল তো ছেলেটা? বনের মধ্যে পথটথ হারাল, নাকি অন্যকিছু বিপদ হল? এই অন্ধকারে কোথায় পড়ে রইল কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। বেড়াতে এসে এ কী কান্ড বল দেখি।  বার বার মানা করেছিলাম এরকম বিদঘুটে জায়গায় আসতে, কেউ তোরা আমার কথা শুনলি না।”

রোহণের গজগজানির উত্তর কেউই দিল না।

রাতে কারোরই খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তবু জোর করে কিছুটা মুখে দিতেই হল।

সন্দীপ অশান্ত মন নিয়ে বাড়ির ভেতর পায়চারি করে বেড়াচ্ছিল এ ঘর থেকে ও ঘর। একতলা বাংলোটার বড় বড় তিনটে ঘরের একটায় তারা শুচ্ছে, অন্যটায় খাওয়া দাওয়া। পেছনের ঘরটা আপাতত কোনো কাজে লাগছে না। সোলার লন্ঠন হাতে সব কটা ঘরেই ঘুরছিল সন্দীপ। যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায়। একটা জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে তো যেতে পারে না। রান্নাঘরেও উঁকি দিয়ে এসেছে সে আর রোহণ মিলে। কোত্থাও নীরজের চুলের ডগাটুকু দেখা যায়নি।

রোহণ কী যেন বলল। দ্রুত তার দিকে ঘুরতে গিয়ে টাল হারিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল সন্দীপ। দেওয়ালে হাতের ভর রেখে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে সে। এবং স্তম্ভিত হয়ে দ্যাখে তার হাতের চাপে দেওয়ালটা আস্তে আস্তে ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। লন্ঠনের আলোয় সেই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়ির কিছু ধাপ।

“রোহণ।” চাপা গলায় ডাকে সন্দীপ।

“কী হল?”

“এদিকে আয় একবার।”

রোহণের মুখটাও প্রায় ওই দেওয়ালের মতোই হাঁ হয়ে গেল।

“এটা কী ব্যাপার?”

“জানি না। তুই এখানে থাক। আমি নিচে নামছি। ব্যাপারটা কী একবার দেখে আসি। সিঁড়িটা কোথাও একটা নিশ্চয়ই গেছে।”

“পাগলামি করিস না সন্দীপ। বরং সোমরাকে ডাকি।”

“না। কাউকে ডাকবি না। কিচ্ছু বলবি না। আমি এক্ষুনি উঠে আসব। বাই এনি চান্স যদি না আসি তাহলে কাল সকালে চক্রধরকে দিয়ে ব্রজবাবুকে একটা খবর পাঠাস।”

ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া রোহণকে দেওয়ালের পাশে রেখে সন্দীপ আস্তে আস্তে পাতালের দিকে নামতে শুরু করে।

সিঁড়িটা খুব একটা চওড়া না হলেও সরুও নয়। দুজন মানুষ পাশাপাশি অনায়াসেই নামতে পারবে। ধাপ গুনে গুনে নামছিল সন্দীপ। দশটা ধাপের পরে একটা চাতাল, তার পর বাঁদিকে আরও দশটা ধাপ। তারপর আরও একটা চাতাল এবং একটা খুব মোটা লোহার দরজা। দরজায় তালা দেওয়া থাকলে সন্দীপ কখনওই সেটা খুলে ভেতরে ঢুকতে পারত না। সন্দীপের সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য জানা নেই, কিন্তু দরজাটা শুধু টেনে হুড়কো দিয়ে রাখা। একটা তালা ঝুলছে বটে হুড়কোয়, কিন্তু সেটা খোলা। সম্ভবত ভেতরে দামি কিছু নেই। কিংবা হয়তো এই দরজার কথা বিশেষ কজনেরই জানা আছে বলে তালা দেওয়ার প্রয়োজনই হয় না।

খুব সাবধানে ভারি দরজাটা ঠেলতে থাকে সন্দীপ।

লন্ঠনের আলোয় ঘরের ভেতরের যে দৃশ্য তার চোখে পড়ে সেটা তার চরম উন্মাদ কল্পনাতেও ছিল না।

রোহণ বসে থাকতে থাকতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ কারো গলার শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। দুজন বা তিনজন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এদিকে আসছে। আগেপিছে কিছু না ভেবেই সে নিজেকে দেওয়ালের পাশ থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। লুকিয়ে পড়ে দু ঘরের মাঝের দরজার পেছনে।

অবশ্য তার পরেই সে যাদের দেখতে পায় তারা দুজনেই খুব চেনা লোক। ব্রজবাবু, আর সোমরা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আড়াল থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল রোহণ, কিন্তু কী জানি একটা দ্বিধা তাকে আটকে দেয়। ব্রজবাবু এত রাতে এখানে কেন? এই প্রশ্নটা তাকে ছুঁচের মতো বেঁধে। নীরজের হারিয়ে যাওয়ার খবর তো তাঁকে জানানো যায়নি। তবে তিনি আবার এখানে ফিরে এলেন কেন? তাও এই গভীর রাতে? সঙ্গে সোমরাই বা কী করছে। সে তো অনেকক্ষণ আগেই শুয়ে পড়েছিল। রোহণ নিজেকে আরও ছোট করে গুটিয়ে নেয়।

“ছোঁড়াটা নিচে গেল কী করে? ” ব্রজবাবুর গলায় সকালের সেই নরমভাব এতটুকুও নেই। খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো গরগরে আওয়াজ বেরোচ্ছে এখন তাঁর গলা দিয়ে।

“আমারই কসুর,মালিক।”

মালিক? সোমরা ব্রজবাবুকে মালিক ডাকছে? কিন্তু কেন? সোমরা তো স্বপনকাকুর লোক। রোহণের মাথা কেমন যেন ঝিমঝিম করে ওঠে।

“লুকোনো দরজা খুলে রেখেই নিচে গিয়েছিলাম মালিক, ভেবেছিলাম উৎপাতগুলো ঘুমোচ্ছে। এই বান্দরটা যে আমার পিছে পিছে নেমে আসবে আঁচ করতে পারি নাই।”

“এই একটা ভুল থেকে কত বড় ক্ষতি হতে পারে জানিস? এতদিনের এত বড় ব্যাবসার যদি এতটুকু লোকসান হয় আমি তোকে কিন্তু ছাড়ব না সোমরা, খেয়াল থাকে যেন। চৌধুরি আন্দাজ করেছিল বলে বুড়োর কী হাল করেছিলাম মনে আছে তো? এই ঘোর জঙ্গলে সাপের কামড়ে মরলে কেউ এতটুকু সন্দেহ করে না। করেনি।”

“জি মালিক। আপনি যা শাস্তি দেবেন মালিক।”

“নিচেই আছে এখনও?”

“জি মালিক। হাত পা বেঁধে রেখে এসেছি। এবার আপনি যা হুকুম দেবেন।”

“বেশ। চল, দেখি।”

কাকে হাত পা বেঁধে ফেলে রেখে এসেছে সোমরা? কার কথা বলছে এরা? কীসের ব্যবসা ব্রজবাবুর? রোহণের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।

“এ কী। দরজাটা এখনও খোলা কেন? তুই ওপরে উঠে দেওয়াল বন্ধ করিসনি?”

“করেছিলাম তো মালিক।”

“তাহলে? শিগগির যা। দ্যাখ বাকি ছেলেদুটো কোথায়। সর্বনাশ হয়ে যাবে যদি ওরা সব জেনে যায়।”

সোমরা ছুটে সামনের ঘরে যায় এবং একইভাবে ছুটে ফিরে আসে।

“বিছানা খালি মালিক। একজনও নেই।”

ব্রজবাবু একবার শুধু তাকান সোমরার দিকে। সেই দৃষ্টির সামনে সোমরা শুঁয়োপোকার মত কুঁকড়ে যায়।

“চল।”

আগে আগে  ব্রজবাবু আর পেছন পেছন সোমরা নামতে থাকে। রোহণ ওদের একটু সময় দেয়। তারপর বেড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে সেও পিছু নেয়।

পাঁচ

 

সিঁড়ি দিয়ে পায়ের শব্দগুলো নেমে আসছিল ধপ ধপ করে। লুকোনোর কোনওরকম চেষ্টা না করেই। ঘরের ভেতরেও সে শব্দ পৌঁছে গিয়েছিল। চারদিকের দেওয়াল জোড়া সারি সারি কাঁচের বাক্সের বাসিন্দারাও সেই কাঁপন টের পাচ্ছিল। বিরক্ত হচ্ছিল, বাক্সের ভেতরেই কুন্ডলী পাকাচ্ছিল, ফোঁসাচ্ছিল তারা।

ওদিকে লোহার দরজার উলটোদিকে একপাশে সন্দীপ আর অন্যপাশে নীরজ শরীর শক্ত করে দাঁড়াল। একজনের হাতে ভারি তালাটা, অন্যজনের হাতে সাপ ধরবার একটা লোহার শিক।

“এই দরজাটাও খুলে রেখে গিয়েছিলি? নাঃ, তোকে দিয়ে আর আমার কাজ চলবে না সোমরা। এই ব্যবসায় এত অসাবধান হলে চলে না। ”

কথা বলতে বলতেই দরজাটা ঠেলে ঘরে এক পা দিয়েছিলেন ব্রজবাবু। দ্বিতীয় পাটা ফেলার আগেই দুদিক থেকে দুটো মোক্ষম আঘাত। একটা কপালের ডান দিকে, অন্যটা কাঁধে।

ওভাবে ব্রজবাবুকে কাটা কলাগাছের মতো আছড়ে পড়তে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হকচকিয়ে গিয়েছিল সোমরা। সেই সুযোগটা অবহেলা করেনি রোহণ। সিঁড়ির শেষ দুটো ধাপ আর হেঁটে নামেনি সে। প্রায় উড়েই সোমরার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে।

সোমরাকে কাবু করা অবশ্য খুব একটা সহজ হচ্ছিল না। খ্যাপা ষাঁড়ের মতো লড়ছিল সে। তিনজন মিলেও তাকে দাবিয়ে রাখতে পারছিল না। সারা ঘর জুড়ে উথালপাথাল উঠছিল, পড়ছিল তারা। হঠাৎই একটা ঝনঝন আওয়াজে সবাই নিমেষের মধ্যে স্ট্যাচু হয়ে গেল। সন্দীপের হাত থেকে তালাটা ছিটকে গিয়ে লেগেছে একটা কাঁচের বাক্সে। বাক্সের সামনে এখন মস্ত ফাটল। আর সেই ফাটল দিয়ে নিজেকে পিছলে বার করে নিয়ে আসছে একটা চকচকে শরীর। তার দু চোখ পলকহীন, তার জিভ সরু, লম্বা, চেরা।

“পালা।” কথাটা বলে আর দাঁড়ায় না সন্দীপ।

তিনটে বিরাট লাফে নিজেদের দরজার বাইরে নিয়ে আসে ওরা তিনজন। কাঁপা হাতে দরজাটা টানতে টানতে দ্যাখে সোমরা তখনও সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়েই রয়েছে ঘরের মাঝখানে। ব্রজবাবু তখনও অজ্ঞান।

“ওরা যে রয়ে গেল।”

“থাক।”

বিশেষ সংবাদদাতাঃ সারান্দা অরণ্যের গভীরে অবস্থিত একটি বাংলো থেকে চল্লিশটি বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ ও প্রায় ত্রিশ আউন্স গোখরো সাপের বিষসহ এক পাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আন্তর্জাতিক বাজারে এই বিষের দাম কয়েকশো কোটি টাকা। ব্রজনাথ পাল নামের এই ব্যক্তি অনেকদিন ধরেই এই বেআইনি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল বলে জানা গিয়েছে। এই কাজে তার সহকারী ছিল সোমরা সরেন নামে এক স্থানীয় আদিবাসী ব্যক্তি। আশ্চর্যজনকভাবে তাকে সাপের কামড়েই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কলকাতা থেকে সারান্দায় বেড়াতে আসা তিন যুবকের তৎপরতায় এই পাচারচক্রের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।

কাকু কাগজটা চোখের সামনে থেকে নামিয়ে ওদের দিকে তাকালেন, “তোমরা তো বিরাট কান্ড করে ফেললে হে। কিন্তু আমার অবস্থাটা ভাবো একবার। নিজেকে কিছুতেই মাফ করতে পারছি না। এ রকম বিপদ অপেক্ষা করছে জানলে আমি কখনও তোমাদের ও জায়গায় পাঠাই?”

“কে-ই বা জানত কাকু। কাকিমার মামাকেও তো এই শয়তানদের হাতেই প্রাণ দিতে হয়েছিল। আপনারা কি আদৌ কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিলেন?” রোহণ খুব নিচু গলায় বলে।

“ঠিক। অবিশ্বাস্য। কিন্তু তোমরা লোকগুলোকে ধরালে কী করে?”

“চক্রধরদার জন্য। না হলে হত না।”

“মানে?”

“তুই-ই বল নীরজ। প্রথম থেকে।” সন্দীপ সোফায় হেলান দিয়ে বসে। তার চোখে মুখে এখনও ক্লান্তি।

নীরজ চোখ বন্ধ করে বসেছিল। সন্দীপের কথায় চোখ খোলে সে। চুলের মধ্যে দিয়ে আঙুল চালিয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয়।

“আমি সেদিন নিছকই কৌতূহলে সোমরার পেছন পেছন বেসমেন্টে নেমে গিয়েছিলাম। কোনও লুকোচুরিও করিনি। করার কোনও কারণই অনুভব করিনি। আমার ধারণাই ছিল না যে ওই বাড়ির তলায় এত বড় একটা ভেনম এক্সট্র্যাকশন সেন্টার রয়েছে। বাক্সে রাখা অতগুলো সাপ দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম। আর আমার চমকানোর আওয়াজে চমকেছিল সোমরা।”

“তোকে কাবু করল কী করে?”

“মেরে।” ঘাড়ের পেছনে আলতো হাত বোলায় নীরজ।

“মেরে?”

“হ্যাঁ, মেরে। আমি তো ওরকম কিছু আশা করিনি, তাই তৈরিও ছিলাম না। কিছু বোঝার আগেই ঘাড়ে মারল এক রদ্দা। তারপর দেখলাম আমি মুরগির মতো বাঁধাছাঁদা হয়ে পড়ে আছি ও ঘরেই। ভেবেছিলাম ও ভাবেই বোধহয় তিলে তিলে শেষ হয়ে যাব, পচাগলা কংকালটা তুলে ফেলে দেবে কেউ একদিন। তারপর, তার অনেকক্ষণ পরে, তুই এলি।”

“হ্যাঁ, তারপরের গল্প তো রোহণের কাছে শুনেছি, কিন্তু তোমরা পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছলে কী করে?” কাকু আবার তাঁর প্রথম প্রশ্নটাই করেন।

“চক্রধরদা না থাকলে বাঁচতাম না কাকু। অথচ আমরা প্রথম থেকেই ওকে অপছন্দ করছিলাম। বেচারা সত্যিই এসব ব্যাপারের কিচ্ছু জানত না। সেই রাতে, ও গাড়িতে ঘুমোচ্ছিল। বাড়ির ভেতর থেকে আসা আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙে যায়। ও ভেবেছিল ডাকাত টাকাত কিছু এসেছে বোধহয়। চৌধুরি সাহেবের বাংলোতে থাকতে আসা বাবুদের কথা তো গ্রামে অনেকেই জেনেছিল। একটা রড, জাস্ট একটা রড হাতে ও দেখতে আসছিল ব্যাপারটা কী। আমাদের ও ভাবে বাড়িটা থেকে ওই অবস্থায় বেরিয়ে আসতে দেখে ও অবাক হয়ে যায়।”

সন্দীপের কাছ থেকে এবার সুতোটা রোহণ ধরে নেয়, “চক্রধরদাদার গাড়ি গোলমাল করছিল। আলো জ্বলছিল না, আরও কী সব গন্ডগোল ছিল। তার মধ্যেই ও আমাদের নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে যায়। সারারাত গাড়ি চালিয়ে ভোরবেলা পৌঁছে দেয় সটান রেঞ্জ অফিসারের বাড়িতে। তারপর তো জানেনই কাকু, কী হল।”

“অ্যাডভেঞ্চারের সাধ মিটেছে তাহলে, কী বলো? আর যাবে নাকি, অজানা অচেনা জায়গায় বেড়াতে? নির্জন, বিপজ্জনক জায়গায়?” কাকু মিটমিট করে হাসেন।

“যাব তো। যাবই। আবার যাব। বার বার যাব। এই তো সবে শুরু।” তিনটে গলা থেকেই একসঙ্গে উত্তর আসে। জোরালো, দ্বিধাহীন।

ছবিঃ অংশুমান

 

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s