গল্প বেলুন দাদু পিয়ালী গাঙ্গুলী শীত ২০১৮

পিয়ালি গাঙ্গুলীর আগের লেখা–  ফোচনের  কীর্তি , ফোচনের আরেক কীর্তি                  

পিয়ালী গাঙ্গুলি

ঘরে ঢুকেই মোহর দেখল মিঠাই একটা মস্ত বড়ো বেলুন নিয়ে খেলছে।

“কী রে? এত বড়ো বেলুন কোত্থেকে পেলি?”

“বেলুন দাদু দিয়েছে।”

এই বেলুন দাদু নামটা আগেও অনেকবার শুনেছে, বাড়িতে বেলুন ও দেখেছে মাঝেসাঝে। অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে যখন ফেরে তখন আর এসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে ইচ্ছা করে না। বেশিরভাগ দিনই মোহর বাড়িতে পা দিতে দিতেই আয়া চলে যায়। পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নেওয়ারও অবকাশ পায় না মোহর। ঘরে ঢুকতেই দস্যি ছেলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর পর পর কাজ চলতেই থাকে। তাকে খাওয়ানো, পড়তে বসানো ইত্যাদি। নামে প্লে স্কুল হলে কী হবে, সিলেবাসের বহর দেখলে মাথা ঘুরে যাবে।

“বেলুন দাদু কে রে বাবু?” ছেলের সাথে চটকা চটকি করতে করতে জিজ্ঞেস করল মোহর।

মিঠাইয়ের সোজাসাপ্টা উত্তর “ওই তো যে দাদুটা বেলুন দেয়।”

নাও, বোঝো এবার! দেড়বছর বয়েস থেকেই মিঠাই কথার ফুলঝুড়ি। বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে দুনিয়ার লোকের সঙ্গে কথা বলে। পাড়ার কত লোক যাদের আগে ওরা চিনত না বা কথা বলার মত সম্পর্ক ছিল না, ছেলের দৌলতে তাদের সাথেও পরিচয় হয়েছে। এরকমই কেউ একজন হবেন নিশ্চয়ই এই বেলুন দাদু।

অনেক খুঁচিয়েও আড়াই বছরের ছেলের থেকে বিশেষ কিছু তথ্য পাওয়া গেল না। পূর্ণিমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আর অপরিচিত লোকের থেকে জিনিস নেওয়ার অভ্যেসটাও বন্ধ করতে হবে। কে জানে কোনদিন কী বিপদ ঘটে যাবে! সত্যি, বাচ্চাকে কাজের লোকের হাতে ছেড়ে গিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার জো নেই।

রবিবারের সকাল। সারা সপ্তাহের জামাকাপড় ডাঁই করা। ওয়াশিং মেশিন চালিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে মোহর। আজ আবার আয়া আসবে না। মিঠাইকে একটা কালারিং বুক দিয়ে বসিয়ে এসেছে। বেশিক্ষণ তাতে তার ধৈর্য থাকবে না জানা কথা।

হঠাৎ কানে এল মিঠাই কাকে বলছে, “ওই বেলুনটা ফেটে গেছে। এবার একটা রেড বেলুন দিও।”

কথাটা কানে যেতেই মোহর গ্যাস নিভিয়ে বারান্দায় ছুটল। কিন্তু ভদ্রলোক ততক্ষণে চলে গেছেন। মোহর শুধু পেছন থেকে দেখতে পেল সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরা এক বয়স্ক ভদ্রলোক, হাতে বাজারের থলি।

মোহর ছেলেকে ধমকাল, “তুমি আবার বেলুন চেয়েছ? তোমায় আর কতবার বোঝাব অন্য কারুর থেকে কিচ্ছু চাইবে না। তোমার যা ইচ্ছা হবে, আমায় বা বাবাকে বলবে।”

এতেও বেলুনের আমদানি বন্ধ হয়নি। বেলুন ছাড়াও বিস্কুট, চকোলেট, বল এ-সবও মাঝে মধ্যে আসতে থাকে। ভদ্রলোক ওপরে ওঠেন না, নীচে কেয়ারটেকারের হাতে দিয়ে চলে যান।

তারপর হঠাৎ একদিন এ-সব বন্ধ হয়ে গেল। মিঠাইয়ের মনটা খারাপ। অনেকদিন হয়ে গেল বেলুন দাদু আর আসে না। মোহরেরও মনে হল, সত্যি তো কী হল? বয়স্ক ভদ্রলোক, অসুস্থ হলেন নাকি? ভদ্রলোকের সাথে কোনোদিন পরিচয় না হলেও মিঠাইয়ের মুখে বেলুন দাদু, বেলুন দাদু শুনতে শুনতে উনি যেন ওদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছিলেন। মোহর ওদের কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করে জানল বেলুন দাদু এ-পাড়ার পেছন দিকেই কোথাও থাকেন,  তবে নাম বা ঠিকানা ও কিছু জানে না আর বিগত অনেকদিন ধরে ওঁকে রাস্তাঘাটেও আর দেখা যায় না।

*****

ছোটো একতলা বাড়ি, বেশ পুরনো দিনের। অনেকদিন রং বা মেরামত হয়নি বোঝা যাচ্ছে। সামনে ছোটো বাগান। মাধবীলতা জড়ানো লোহার গেট ঠেলে, ছেলের হাত ধরে ভিতরে ঢুকল মোহর। বেল বাজানোর বেশ অনেকক্ষণ পরে একজন বয়স্ক মহিলা এসে দরজা খুললেন। মোহর নমস্কার করে বলল, “শান্তি বাবু আছেন? ওঁর সাথে একটু দেখা করতে পারি?”

পাড়ার মুদির দোকানে ওঁর বর্ণনা দিয়ে নাম ঠিকানাটা জোগাড় করেছে মোহর। সবসময় সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা আর সাদা চটি পরা লোক এ-তল্লাটে একজনই আছেন।

মিঠাইকে দেখেই অসুস্থ ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হেসে বললেন, “আরে দাদুভাই, কী খবর?”

ঘরের দেওয়াল জোড়া বিখ্যাত ফুটবলারদের ছবি। মাঝে ফুটবল পায়ে ওঁরও কতগুলো তরুণ বয়সের ছবি। ফার্স্ট ডিভিশন অবধি খেলেছেন। তারপর পারিবারিক কারণে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। একটা কাচের আলমারি ভর্তি শান্তিদেব বন্দোপাধ্যায়ের ট্রফি আর মেডেল।

আঠারো বছর বয়সের একমাত্র ছেলে হঠাৎ করে মাত্র দু’দিনের জ্বরে মারা যাওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী দুজনেই প্রায় পাগলের মত হয়ে গেছিলেন। সেই থেকে ওঁর স্ত্রী স্নায়ুরোগে আক্রান্ত। বছরে বেশিরভাগ সময় অসুস্থই থাকেন। শান্তিবাবু বাঁচার অবলম্বন হিসেবে আবার নতুন করে আঁকড়ে ধরেছিলেন ফুটবলকে। পাড়ার মাঠে আশেপাশের দুঃস্থ শিশুদের বিনামূল্যে ফুটবল শেখাতে শুরু করেন। নিজের পেনশনের টাকাতেই ওদের জার্সি, জুতো সব কিনে দিতেন। ডিম, কলা, পাউরুটি এসবও। পেট ভরে না খেলে  খেলবে কী করে  বাচ্চাগুলো?

এইভাবেই বেশ চলছিল। কয়েকমাস আগে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন শান্তিবাবু। হৃদরোগের জটিল সমস্যা ধরা পড়ে। খেলাধুলো করা বন্ধ। ব্যায়বহুল চিকিৎসা চালানোর পর আর কোচ রেখে ছেলেদের ফুটবল শেখানো সম্ভব নয়। তাই এখন সব বন্ধ। বাচ্চাগুলো এখনও মাঝে মাঝে সাহায্য নিতে আসে। এসে বিষণ্ণ মুখে ফিরে যায়।

*****

১৫ই আগস্টের সকাল। শান্তিবাবুর ছেলের নামে ‘সায়ন ফুটবল কোচিং সেন্টারের’ আজ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। মোহরের মুখে সব শুনে নড়েচড়ে বসেছিল নিলয়। ফুটবল পাগল। নিজেও ভালো খেলত। মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তো হতেই হবে। তাই বাড়ির চাপে স্কুলের পর ফুটবল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এখন অবশ্য অফিসের ফুটবল টিমের ম্যানেজার। অসুস্থতা আর অর্থাভাবে কতগুলো গরিব শিশু ফুটবল শেখা থেকে বঞ্চিত হবে? তা কি হতে দেওয়া যায়? মোহরের মুখে সব শুনে সরাসরি শান্তিবাবুর সাথে গিয়ে কথা বলেছিল নিলয়। শনি, রবিবার ও নিজেই বাচ্চাদের কোচিং করাবে। আরো দু’একজন বন্ধুরও সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছে। মোহরও মিডিয়ার বন্ধুদের সাহায্যে শান্তিবাবুর উদ্যোগের প্রচার করে কিছু আর্থিক সাহায্য জোগাড় করেছে। নিলয়ের মাথায় আরো প্ল্যান আছে। যদি কর্পোরেট সোশাল রেস্পন্সিবিলিটির আওতায় নিজের কোম্পানি থেকে কিছু সাহায্য পাওয়া যায়। বেশ ভিড় হয়েছে মাঠে। অনেকেই এগিয়ে আসছেন সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কতদিন পর বাচ্চাগুলোর মুখে আজ হাসি ফুটেছে। শান্তিবাবু চেয়ারে বসে বসে সব দেখছেন। চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ। মিঠাই এসে ওঁর হাতে বেলুনের গোছাটা ধরিয়ে দিল। বেলুন দাদু বেলুন উড়িয়ে দিলেন আকাশে। হাততালিতে গর্জে উঠল সারা মাঠ।

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s