মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের আরো গল্প কালাচাঁদ হাইলাকান্দির হুডিনি- ভূত জোলাকিয়া রংঝুরি রহস্য
আমাদের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সনাতন সাঁতরার বাড়িতে সন্ধেবেলা জড়ো হয়েছি আমি, রাসেল, ভুলু, পিন্টুরা। এমনিতে কোনও ক্রিকেট বা ফুটবল টুর্নামেন্ট জিতলে আমাদের সনাতনকাকুর বাড়ির ছাদে জম্পেশ করে খাওয়া দাওয়ার রেওয়াজ আছে। তবে আজকের সান্ধ্য জমায়েতের পেছনে তেমন কোনও কারণ নেই। অন্যদিনের মতো হুল্লোড় করে নয়, আজ সন্ধেবেলা সনাতনকাকুর বাড়িতে আমরা এসেছি পা টিপেটিপে। সনাতনকাকু পইপই করে বলে দিয়েছেন সৈনিক যে ওঁর বাড়িতে দু’-দিনের জন্য ঘাঁটি গেড়েছে সেটা কাকপক্ষীও যেন জানতে না পারে। মিডিয়া তো নয়ই। আমরা তাই গোটা ব্যাপারটা একেবারেই গোপন রেখেছি। বাড়ির বড়দের কাছেও কিচ্ছুটি ফাঁস করিনি।
না না, সনাতনকাকুর ছেলে সৈনিক কোনও জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদী নয়। ব্যাপারটা আসলে উল্টো। বাংলা ছবির নবাগত নায়ক সৈনিক পুরোদস্তুর সেলিব্রিটি। যেখানে যায় ভক্তের দল ঘিরে ফেলে, সেলফি তোলার জন্য বিরক্ত করে মারে। এহেন সৈনিক নেপালে গিয়েছিল একটা বাংলা ছবির কাজে। শ্যুটিং শেষে টিমের ডিরেক্টর সহ অন্যান্য কলাকুশলী আর ক্রিউ স্বস্থানে ফিরে গেছে। সৈনিকের শরীরটা সামান্য বিগড়েছে বলে সে এসেছে বাবার কাছে, ডুয়ার্সের নিরিবিলিতে একটু বিশ্রাম নেবে বলে। আমরা সনাতনকাকুকে আগেই বলে রেখেছিলাম কখনও সৈনিক এদিকে এলে আমাদের যেন ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়। সনাতনকাকু কথা রেখেছেন। সকালেই ফোন করে খবরটা দিয়েছেন আমাকে। তবে বারবার করে বলেছেন আমরা ছাড়া কেউ যেন ব্যাপারটা না জানে।
হেমন্তের আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠেছে। দূরের ঘন গাছপালা ছুঁয়ে ভেসে আসছে পাতলা কুয়াশা। বেশ শীত শীত করছে। সনাতনকাকুর ছাদে বসে আমাদের কথা হচ্ছে। সৈনিক একটা বেতের চেয়ারে বসে আছে পোলো নেক গেঞ্জি আর ট্র্যাকপ্যান্ট পরে। উল্টোদিকে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছি বেতের মোড়ায়। সনাতনকাকুর দুই জার্মান শেফার্ড নন্দী-ভৃঙ্গী বসে আছে সৈনিকের পায়ের কাছে। সৈনিক রাক্ষুসে চেহারার কুকুরদুটোর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে। নন্দী আর ভৃঙ্গী পরম আহ্লাদে ল্যাজ নাড়ছে। আমরা সৈনিককে গোলগোল চোখে দেখছি। সাতাশ-আঠাশের মতো বয়স। ছ’ফিট লম্বা জিম করা হি-ম্যান টাইপ চেহারা। কাটাকাটা চোখমুখ। হাতের বাইসেপ, ট্রাইসেপ যেন পাথর দিয়ে কোঁদা। তবে সৈনিককে কোনও কারণে চিন্তিত মনে হচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে একটু পরপর।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার শরীর এখন ঠিক আছে?”
সৈনিক দুর্বল গলায় বলল, “আমার শরীর খারাপের কথা কে বলল ? বাবা ? শরীর একদম ঠিক আছে। গন্ডগোলটা হয়েছে এখানে। হাত দিয়ে বুকের ছাতি দেখিয়ে সৈনিক বলল, আমি এমনিতে ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে ছেলে। অজস্রবার শ্মশানে গিয়েছি বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে। পোড়োবাড়িতে রাত কাটিয়েছি। কখনও কিছু দেখিনি। কিন্তু মোক্ষম একটা অভি’তা হল নেপালে গিয়ে। এমন একটা জিনিস সেখানে দেখেছি যে, কলজের জোর খানিকটা কমে গেছে।”
“কী দেখেছেন?” ভুলু জানতে চাইল কৌতূহলী হয়ে।
সৈনিক সে কথার সরাসরি উত্তর দিল না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “নেপালের পোখরার কাছে পাহাড় দিয়ে ঘেরা চমৎকার একটা গ্রাম হল জেলেন। সেই গ্রামের নাম শুনেছ কখনও?”
আমরা সমস্বরে বললাম, “উঁহু শুনিনি।”
সৈনিক বলল, সেই ছবির মতো সুন্দর জেলেন-এ ছিল আমাদের শ্যুটিং। সেখানেই যাচ্ছিলাম শ্যুটিংয়ের কাজে। যাবার সময়ই ঘটনাটা ঘটে। এমন একটা ভয়াবহ জিনিস দেখি .. তার পর কী করে যে শ্যুটিং করেছি আমি জানি না। অজস্র শট এন-জি হয়েছে। ডিরেক্টর সেগুলো রি-শ্যুট করিয়েছেন। বিরক্ত হয়ে বলেছেন পাঁচ বছর ধরে ইনডাস্ট্রিতে থাকা নায়কের কাছ থেকে এটা উনি আশা করেন না। কী লজ্জার ব্যাপার বলো ! এখনও সন্ধের পর বাথরুমে যেতে গেলে বুক দুরদুর করছে। নাহ্ আমাকে কলকাতা গিয়ে প্রথমেই একজন ভাল সাইকোলজিস্টের সঙ্গে কনসাল্ট করতে হবে।
আমি, ভুলু, রানা, পিন্টু, বাবু, তমাল, রাসেল হাঁ করে দেখছিলাম সৈনিককে। এমন একজন তাগড়াই চেহারার হিরো কী এমন জিনিস দেখেছে যে ভয়ে দুমড়ে গেছে ?
আমাদের জন্য একটা বড় রেকাবিতে করে মতিচুরের লাড্ডু এসেছে। সনাতনকাকু হনুমানজির পুজো করেন। এটা পুজোর প্রসাদ। অন্য দিন হলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম সকলে। আজ একমাত্র রাসেল দুটো লাড্ডু তুলে নিল। আমরা বাকিরা কেউ ওদিকে ভ্রূক্ষেপ অবধি করলাম না।
তমাল নড়েচড়ে বসে বলল, ঘটনাটা একটু খুলে বলুন না।
নন্দী আর ভৃঙ্গীকে নিচতলা থেকে ডাকছেন সনাতনকাকু। তার মানে আটটা বেজে গেছে। কুকুরদুটোর রাতের আহারের সময় হয়ে গেছে। নন্দী আর ভৃঙ্গী এক ছুটে চলে গেল নিচে। সৈনিক দূরমনস্কের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকল একটুক্ষণ। কিছু ভাবল। তারপর নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল, কাঠমান্ডু থেকে সোজা রাস্তা ধরে জিপে সাত-আট ঘন্টার রাস্তা হল জেলেন। আগেও অনেকবার নেপাল গিয়েছি। তবে এবারের অভি’তা একেবারে নতুন। আমাদের গোটা টিম আগেই পৌঁছে গিয়েছিল স্পটে। আমার কয়েকদিন পর জয়েন করার কথা ওদের সঙ্গে। সেভাবেই কাঠমান্ডুগামী বিমানে চেপেছিলাম। প্লেনের সিটে বসেই পেলাম খবরটা।
– কী খবর ? রাসেল লাড্ডু চিবোতে চিবোতে বলল।
– মাওবাদীদের একটা উপদল কীসব রাজনৈতিক কারণে নাকি ক্ষেপে গেছে। সহযাত্রীদের মুখে গুজব শোনা গেল দু’জন বিদেশিকে নাকি কুকরি চালিয়ে খুনও করেছে তারা। ফলে গোটা কাঠমান্ডুতেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা আঁটসাঁট করা হয়েছে। বিমান থেকে নেমে দেখলাম সত্যিই রাস্তাঘাট শুনশান। এদিকে বিকেল তখন গড়াচ্ছে সন্ধের দিকে। এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোন বের করে দুশ্চিন্তা আরও বাড়ল। ইন্টারন্যাশনাল রোমিং কোনও কাজ করছে না। ওদিকে জেলেন গ্রামে আমার টিমের বাকিরা সবাই অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য। আমি না পৌঁছতে পারলে সব পন্ড। হতভম্ব হয়ে কী করব ভাবছি এমন সময় পেছন থেকে কেউ চাপা গলায় বলল, কোথায় যাবেন ?
বাপ্পা বলল, কে কথাটা বলল ? আপনার কোনও ফ্যান নিশ্চয়ই ?
সৈনিক কেঠো হাসি হেসে বলল, ধুস ফ্যান কোত্থেকে আসবে ? আমি বাংলা ছবি করছি মোটে কয়েক বছর। প্রসেনজিৎ বা দেব হলেও না হয় একটা কথা ছিল, কাঠমান্ডুতে আমার মতো দু’দিনের বৈরাগীকে কে চিনবে !
আমি বললাম, তাহলে ?
সৈনিক বলল, আসলে হয়েছে কী, একটা শুকনো মাছ ভর্তি ছোট ট্রাক যাবে কাঠমান্ডু পেরিয়ে। কথাটা বলল তার ড্রাইভার। দু’হাজার টাকা ভাড়া চাইল। আমি এক হাজার বললাম। শেষে দরদস্তুর করে বারোশোতে রফা হল। ট্রাকের সামনের সিটে বসল ড্রাইভার আর খালাসি। প্রথমজন অমর ভুজেল, দ্বিতীয়জন পদম প্রধান। দুজনেই নেপালের অধিবাসী। সামনে দু’জনের বেশি লোক আঁটবে না। তাই পেছনে বসলাম আমি। মাঝে একটা ছোট গোল ফুটো দিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলছিলাম।
পিন্টু তাজ্জব হয়ে গিয়ে বলল, বলেন কী ? নিজেরা সামনে বসে আপনার মতো সেলেব্রিটিকে পেছনে বসাল ?
সৈনিক মুখ ভেটকে বলল, রাখো তোমার সেলেব্রিটি ! ওই গোলযোগের মধ্যে যে ব্যবস্থা একটা হল সেটাই অনেক। মুশকিল বাধল অন্য জায়গায়। ট্রাকের পেছনে শুকনো সার্ডিন মাছ ভর্তি পেল্লায় সব টিন সাজানো। সেখান থেকে যা গন্ধ উঠছে তাতে অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়ে আসার জোগাড়। একটু বাদেই গাড়ি চলতে শুরু করল। শহর পার হয়ে চলে এলাম পাহাড়ি রাস্তায়। ট্রাকের মাথা খোলা। মাথার ওপর আকাশ। ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছিল পাহাড়ি প্রকৃতি। গন্ধটাও সয়ে গেল একটু একটু করে। অসুবিধেগুলো কাটিয়ে উঠছিলাম মনে মনে। এমন সময় ঘ্যাঁষ করে ব্রেক কষল অমর, আমাদের ড্রাইভার।
পিন্টু বলল, কেন ? হঠাৎ করে গাড়ি থামাল কেন ? ভূত-প্রেত কিছু দেখেছিল নাকি ?
সৈনিক বলল, আরে না, ভূত-টুত নয়, সামনে মাওবাদীদের সেই উপদলের ঘাঁটি। বিদেশি দেখলে কী করবে ওরা তার ঠিক নেই। কুকরিও চালিয়ে দিতে পারে তারা। কাজেই আর উপায়ন্তর নেই। পদম বলল, মাছের টিনের মধ্যেই ঢুকে পড়তে হবে আমাকে। কোনও ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। একটা সার্ডিন মাছের টিন খুলে কিছু মাছ বের করে সেই জায়গায় আমাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। অমর ড্রামের ঢাকনা আটকে দিল এমন করে যাতে আমি শ্বাসটুকু নিতে পারি কোনওরকমে। আবার চলতে শুরু করল গাড়ি।
ভুলু গলা খাকরে বলল, আচ্ছা ওই খালাসি আর ড্রাইভার এদের মধ্যে কেউ ভূত নয়তো ? এদের ছায়া কি পড়ছিল মাটিতে ?
আমি ভুলুকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুই চুপ কর তো একটু। তারপর সৈনিককে বললাম, আপনি বলুন।
সৈনিক আবার বলা শুরু করল, চারপাশে গাঢ় অন্ধকার, একটুও আলো দেখতে পাচ্ছি না, নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে শুকনো মাছের গন্ধে। তার মধ্যেও টের পাচ্ছি কখনও রাস্তা টার্ন নিচ্ছে, কোথাও এবড়ো-খেবড়ো পথ। মাঝে মাঝে চেকপোস্ট আসছে। ট্রাকের গতি কখনও কমছে। কখনও বাড়ছে। পাহাড়ি রাস্তায় পাক খেতে খেতে চলেছে আমাদের গাড়ি। দাঁড়াচ্ছে কখনও কখনও। মনে মনে ভাবছি, তবে কি কারও সন্দেহ হল ? এখন কি ড্রামের মুখ থেকে ঢাকনা সরিয়ে নেমে আসবে বন্দুকের নল ? এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ ঝলসে গেল তীব্র আলোয়।
তমাল সিঁটিয়ে উঠে বলল, কী সর্বনাশ, আপনার মাথা তাক করে বন্দুকের নল নেমে এল নাকি ?
সৈনিক শুকনো হাসল, বন্দুকের নল নয়, চাঁদের আলো। সামনে এক পাহাড়ি নদী। তার আলোতে প্রতিফলিত হচ্ছে জ্যোৎস্না। কয়েক ঘন্টা নিকষ কালো অন্ধকার থাকায় চোখ ধাঁধিয়ে গেছে সেই সামান্য আলোটুকুতেই। সেই অবস্থাতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। পাগল পাগল লাগছিল। মাথা কাজ করছিল না। জামাকাপড় পরেই ডুব দিলাম নদীতে। আপাদমস্তক ভিজিয়ে স্নান করার পর একটু ভাল লাগল। হি হি করে কাঁপতে কাঁপতেই এসে আবার উঠলাম গাড়ির ডালায়। অমর আমাকে আশ্বস্ত করে জানাল, এদিকটা জনমানবশূন্য। কাজেই আর রিস্ক নেই। তবে মানুষের ভয় না থাকলেও অন্য ভয় আছে।
রাসেল বলল, কীসের ভয় ? জীবজন্তুর, নাকি ভূতের ?
সৈনিক বলল, সেটাই জিজ্ঞেস করলাম ড্রাইভার আর খালাসিকে। ওরা নিজেদের মধ্যে একবার চোরা চাউনি বিনিময় করে নিল। অমর আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, পাহাড়ি পথে অনেক অস্বাভাবিক জিনিস দেখা যায়। ড্রাইভারদের সেসব গা-সওয়া। যা-ই দেখুন, ভয় পাবেন না কিছুতেই। ওদের কথামতো আমার ভেজা সোয়েটার, জামা-টামা সব খুলে ফেললাম। ওরাই পরিস্কার দেখে চাদর আর কম্বল দিল। সেগুলো গায়ে পেঁচিয়ে বসে রইলাম পেছনে। তবে এবার আর মাছের ড্রামের মধ্যে নয়, স্বাভাবিকভাবে। যাই হোক গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। পেছনে বসেই দেখতে পাচ্ছি মাঝেমধ্যে শুধু একেকটা চেক পয়েন্ট আসছে আর আমাকে কম্বলে মুড়ে লুকিয়ে পড়তে নির্দেশ দিচ্ছে ড্রাইভার। এভাবেই একটা একটা করে চেক পয়েন্ট ক্রস করে এগিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। একটা ছোট ধাবা দেখে আমাদের ট্রাক দাঁড় করাল অমর। সেটা হল মোমোর ধাবা। শুধুই মোমো পাওয়া যায়।
রাসেল বলল, ওখানে লোকজন চোখে পড়ল ?
সৈনিক বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ গমগম করছে লোক। বাইরে খাটিয়া পেতে বসে ছিল কয়েকজন। তাস খেলতে খেলতে সত্তর দশকের হিন্দি গান গাইছিল কোরাসে। এদের কেউ ট্রাক চালায়, কেউ খাবার বানায়, কেউ খালাসি। আমাদের শহুরে সভ্যতার অনেক মাইল দূরে এদের বসবাস। এরা পুরনো হিন্দি গান শোনে, চরম বিপদের মধ্যেও হাসতে পারে। ট্রাকই এদের ঘরসংসার। বউ, বাচ্চা, বাবা-মায়ের ছবি টাঙিয়ে রাখে ট্রাকে। এরাই চলমান ডাকবাক্স। এদের মুখেমুখেই শহরের খবর ছড়ায় দিকে দিগন্তে।
আমি বললাম, তারপর ?
সৈনিক বলল, এদের মোমোর স্বাদ খুব ভাল। চিকেন মোমো খেতে খেতে কথা হল দোকানির সঙ্গে। মঙ্গোলয়েড মুখের লোকটা আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, গন্তব্যের কাছে প্রায় চলে এসেছি আমি। জেলেন সেই ধাবা থেকে ঘন্টাখানেক দূরে। আমার মুখে স্বস্তির হাসি খেলে গেল। খাওয়া শেষে যখন জল খাচ্ছি তখন দোকানি আমার কানের কাছে এসে বলল, একটা কথা বলে রাখি। এই পাহাড়ে চুড়েলের উপদ্রব আছে। অনেকেই দেখেছে। তাদের কেউ কেউ পাগল হয়ে গেছে। আমার শুকনো মুখচোখ দেখে সেই দোকানির বোধ হয় করুণা হল। আমাকে পরামর্শ দিয়ে বলল, যদি পাহাড়ি পথে তেমন কিছু দেখেও ফেলেন তবে সেটা নিয়ে বেশি ভাববেন না। মাথা থেকে দুর করে দেবেন। কেননা ভয় যদি একবার ঘাঁটি গেঁড়ে বসে মনের মধ্যে তাহলেই বিপদ। তখন তাকে উপড়ে ফেলা যায় না কিছুতেই। যারা সেটা পারে না তাদেরই বিপদ হয়।
আমি উদগ্রীব হয়ে বললাম, তারপর কী হল ?
সৈনিক বলল, অমর বহুক্ষণ গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। সে আর পদম এবার জায়গা বদলাবদলি করে নিল। কোত্থেকে একটা বাঁশি বের করে ফুঁ দিল অমর। চমৎকার মিঠে পাহাড়ি সুর ভেসে বেড়াতে লাগল পাহাড় জুড়ে। আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে হেসে অমর বলল, শখে বাজায়। এদিকে গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। পাহাড়ি পথ এবার সরু হয়ে আসছে। একদিকে উঁচু পাহাড়, অন্যদিকে ধু ধু খাদ। অতল খাদ থেকে উঠে আসছে কুয়াশার দল। পাশাপাশি দুটো গাড়ি যাবার জায়গা নেই। হঠাৎ আমাদের গাড়ির স্বাভাবিক গতি কমে গেল। অমরও বাঁশি বাজানো বন্ধ করে দিল।
পিন্টু বলল, গাড়ির গতি কমল কেন ? কুয়াশার জন্য ?
সৈনিক বলল, না কুয়াশা নয়, সামনে তাকিয়ে কারণটা বুঝতে পারলাম। কালো চাদরমুড়ি দেওয়া কেউ, থুত্থুড়ি বুড়িই হবে হয়তো, বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েছে মাটিতে, বাঁকানো একটা লাঠির ঠকাস ঠকাস শব্দ তুলে পাহাড়ি পাকদন্ডি ধরে নামছে আমাদের গাড়ির আগে আগে। একটা হাকুচ কালো কুকুর গুটিগুটি হাঁটছে বুড়ির পেছন পেছন। কুয়াশামাখা জ্যোৎস্না উল্টোদিক থেকে বুড়ির গায়ে এসে পড়ায় দৃশ্যটা সিল্যুয়েটের মতো লাগছে।
আমার হৃদপিন্ড স্তব্ধ হল একটুক্ষণের জন্য। শ্বাস নিতেও যেন ভুলে গিয়েছিলাম। কোনও রকমে বললাম, তারপর?
সৈনিক বলল, অতল খাদ থেকে ফিনফিনে কুয়াশা এসে আড়াল করে দিচ্ছিল দৃষ্টিপথ। একটু পরে কুয়াশা সরে যাচ্ছিল। তখন দেখতে পাচ্ছিলাম পথের মধ্যিখান দিয়ে শ্লথ গতিতে হাঁটছে বুড়ি। ভাবটা এমন যেন যেতে দেবে না আমাদের ট্রাককে। ওদিকে আমাদের গাড়িটা বুড়িকে পাশ কাটিয়ে এগোচ্ছে না কিছুতেই। স্লো সাইকেল রেসের মতো যেন কোনও অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলছে। এদিকে জেলেনের এত কাছে এসে আমার আর ধৈর্য ধরছিল না। চিৎকার করে পদমকে বললাম বুড়িকে ওভারটেক করার জন্য। অমর আর পদম আমার কথা আমল দিল না। আমি রেগে গিয়ে ওদের গুষ্টির তুষ্টি করতে থাকলাম। দুজনেই দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আঙুল দেখিয়ে ইশারা করে চুপ করতে বলছে। আমি তবুও রাগারাগি করেই যাচ্ছিলাম। আমার হট্টগোল বুড়ির কানেও গিয়ে থাকবে। বুড়ি একটু যেন সরে গেল পাশের খাদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে কালো কুকুরটাও সরে গেল বুড়ির পেছন পেছন। আমাদের গাড়ি আচমকা স্পিড বাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে এগোল বুড়িকে পেছনে ফেলে। আমি গালাগালি দিতে দিতে পেছন ফিরতেই একটা জোর ধাক্কা খেলাম।
কেন ? আমরা সমস্বরে বললাম।
সৈনিক বলল, আমার চোখ বা মন কোনওটাই অমন ভয়াবহ দৃশ্যের জন্য তৈরি ছিল না। একটা ভাঙা মুহূর্ত শুধু, তারপরই চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম ভয়ে। কিন্তু ওটুকুর মধ্যেই যা দেখলাম, আমি জীবনে ভুলতে পারব না। পেটের ভেতরে পাকিয়ে উঠল, বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটতে লাগল কেউ, প্রচন্ড তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। গায়ের সমস্ত রক্ত যেন জমে গেল এক লহমায়।
রাসেল অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল, কী দেখলেন ?
সৈনিক অন্যমনস্ক হয়ে গেল একটু। যেন ফিরে গেছে সেই মুহূর্তটায়। কয়েক সেকেন্ড পর একটা ঝাঁকি খেয়ে হুঁশ ফিরে পেল যেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে গলায় সৈনিক বলল, কী দেখেছি সেদিন এই প্রশ্নটা আর করো না আমাকে। এই দ্যাখো এখনও আমার গায়ে কেমন কাঁটা দিচ্ছে। যত সেদিনের সেই মুহূর্তটার কথা ভাবছি তত পাগল পাগল লাগছে। ঘুম আসছে না। যা-ও বা আসছে, নিয়ম করে দুঃস্বপ্ন দেখছি। কিছুতেই ওই ফেজটা থেকে নিজেকে বার করে আনতে পারছি না। ওই মোমোর দোকানের লোকটার কথা মনে পড়ছে বারবার। ভয় হচ্ছে শেষে পাগল না হয়ে যাই।
সৈনিকের কথা শুনে মুখ তাকাতাকি করলাম আমরা। ডাকাবুকো চেহারার রুপালি পর্দার নায়কের গায়ের সমস্ত রোম দাঁড়িয়ে গেছে অজানা ত্রাসে। নখ থেকে মাথা অবধি মানুষটা ডুবে আছে এক বোবা আতংকে। চোখেমুখে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে অদ্ভুত এক ভয়।
ভূতের গল্প ছোটবেলা থেকে অনেকের মুখে অনেক শুনেছি। কিন্তু অলৌকিক দৃশ্যের এমন প্রত্যক্ষদর্শী আমরা জীবনে দেখিনি।
ছবিঃঅংশুমান
khub valo laglo
LikeLike